জুমাদাল উলা ১৪৪৭   ||   নভেম্বর ২০২৫

ফেমিনিজম : নারী সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন
‖ মুসলিম সমাজকে আইনি ও সাংবিধানিক প্রক্রিয়ায় পশ্চিমাকরণের স্থায়ী বন্দোবস্ত

মাওলানা মুহাম্মাদ সালমান

ভূমিকা

ছয় মাস আগে, এপ্রিলের ১৯ তারিখ নারী সংস্কার কমিশন সরকারের কাছে প্রতিবেদন জমা দেয় প্রতিবেদন দেখে সরকারপ্রধান তীব্র উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেন গণমাধ্যমে এসেছে, নারীর প্রতি বৈষম্য দূর করতে নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশনের যেসব সুপারিশ এখনই বাস্তবায়নযোগ্য, সেসব দ্রুত বাস্তবায়নের জন্য সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় বিভাগকে নির্দেশ দিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা তিনি বলেন, ‘এটা শুধু নারীদের বিষয় নয়, সার্বিক বিষয় এই প্রতিবেদন ছাপিয়ে বিলি করা হবে এটা পাঠ্যবইয়ের মতো বই আকারে ছাপা হবে দলিল হিসেবে অফিসে রেখে দিলে হবে না, মানুষের কাছে উন্মুক্ত করে দিতে হবে’ [আজকের পত্রিকা (অনলাইন), ১৯ এপ্রিল]

তবে সরকারের তৈরি জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের পর্যালোচনার আওতায় নারী সংস্কার কমিশনের সুপারিশমালা আসেনি নারী সংস্কার কমিশন সংসদের আসন বাড়িয়ে ৬০০ করে ৩০০টি আসন নারীর জন্য সংরক্ষিত রাখার যেঅযৌক্তিকপ্রস্তাব দিয়েছিল, তা- রাজনৈতিক-অরাজনৈতিক কোনো পক্ষ গ্রহণ করেনি [দেখুন, ‘দীর্ঘ আলোচনায়ও সংসদে নারী প্রতিনিধিত্ব উচ্চকক্ষ নিয়ে মতৈক্য হয়নি’, প্রথম আলো (অনলাইন), ১৪ জুলাই ২০২৫]

এর প্রতিবাদে নারী অধিকার সংগঠনগুলো সরকার, জাতীয় ঐকমত্য কমিশন রাজনৈতিক দলগুলোর ওপর যারপরনাই ক্ষিপ্ত হয়েছে

আগস্ট অনুষ্ঠিত একটি মতবিনিময় সভায় তাদের ক্ষিপ্ত মনোভাব পরিষ্কারভাবে জনগণের সামনে এসেছে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সভাপতি বলেন, ‘দেশে এখন নারীবিরোধী জাগরণ দেখা যাচ্ছেতিনি আরও বলেন, ‘জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের পরে নারীবিরোধী যে অবস্থানকে লালন করা হচ্ছে, সেটা বন্ধ করতে হবেকিছু দাবি তারা ঐকমত্য কমিশনের কাছে তুলে ধরারও সিদ্ধান্ত নেন [‘নারী আসন নিয়ে ঐকমত্য কমিশনের সিদ্ধান্তে ক্ষোভ’, প্রথম আলো (অনলাইন), আগস্ট ২০২৫]

নারী সংস্কার কমিশনের সদস্য এবং নারী অধিকার সংগঠনগুলোর তৎপরতা

নারী সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন প্রকাশিত হওয়ার পরপর বিভিন্ন শ্রেণি পর্যায়ে তীব্র প্রতিবাদ সমালোচনা হয়েছে তবে সময় গড়াতে থাকলে অন্য সব ইস্যুর মতো এটি নিয়েও আলোচনা কমে গেছে কিন্তু নারী সংস্কার কমিশনের সদস্য এবং নারী অধিকার কর্মীরা বসে নেই তারা নিয়মিত তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছেননিরপেক্ষ’(!) ঐকমত্য কমিশনের লোকেরাও তাদের সমর্থন জোগাচ্ছেন

গত ১০ আগস্টজাতীয় সংসদে নারী আসন নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়নশীর্ষক একটি গোলটেবিল বৈঠক আয়োজন করে প্রথম আলো সেখানে তারা কঠিন সুরে বলেন, ‘নারীর প্রতি অন্তর্বর্তী সরকার রাজনৈতিক দলের আচরণ পশ্চাৎগামী... ঐকমত্য কমিশন দলগুলোর এই রক্ষণশীল অবস্থানের জন্য ভবিষ্যতে তাদের খেসারত দিতে হবে, জবাবদিহি করতে হবেতাঁরা আক্ষেপ প্রকাশ করেনবৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার আশায় অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়েছে কিন্তু বৈষম্য বিলোপে সরকার ব্যর্থ

গণস্বাক্ষর সংগ্রহ, প্রয়োজনে ঐকমত্য কমিশনের কার্যালয় ঘেরাওয়ের মতো সিদ্ধান্ত নেওয়ারও দাবি ওঠে এই বৈঠকে

আলোচনায় অংশ নেন জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সদস্য বদিউল আলম মজুমদার, নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশনের প্রধান এবং বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সভাপতি বদিউল আলম মজুমদার বলেন, ‘আমি অকপটে স্বীকার করছি, আমরা ব্যর্থ হয়েছি পুরুষতন্ত্র জয়ী হয়েছে

সেপ্টেম্বর আন্তর্জাতিক সিডও দিবস উপলক্ষে ৭১টি সংগঠন নিয়ে গঠিতসামাজিক প্রতিরোধ কমিটিআরেকটি গোলটেবিল বৈঠক করে আলোচনায় বক্তারানারীর প্রতি সকল ধরনের বৈষম্য বিলোপ সংক্রান্ত জাতিসংঘ সনদবা সিডও সনদের দুটি ধারা ১৬ ()-এর ওপর বাংলাদেশ সরকারের সংরক্ষণ প্রত্যাহারের দাবি জানান এটি নিয়ে সামনে আলোচনা আসছে

১০ সেপ্টেম্বর জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে নারীররাজনৈতিক অধিকার ফোরাম’-এর পক্ষে বিভিন্ন সংগঠনের প্রতিনিধিরা বৈঠক করেন

গত সপ্তাহে, অর্থাৎ অক্টোবর বদিউল আলম মজুমদার আরেকটি সভায় বলেন, ‘নারীদের অধস্তন রাখার দৃষ্টিভঙ্গির কারণেই নারীদের যথাযথ অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়নি’ [প্রথম আলো (অনলাইন), অক্টোবর ২০২৫]

আমরা জানি না, সরকার ব্যবস্থাপনাগত কারণে, না অন্য কোনো কারণে নারী সংস্কার কমিশনের সুপারিশমালা ঐকমত্য কমিশনের আলোচনার আওতাভুক্ত করেনি

উক্ত মহলগুলো সরকারের বিরুদ্ধে বৈষম্যের অভিযোগ তুললেও, বাস্তবতা হল সরকার কমিশন এমন প্রতিবেদন উপস্থাপন করে নাগরিকদের সাথে বৈষম্য তামাশার চূড়ান্ত করেছে এবং বাংলাদেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর লালিত আচরিত সামাজিক সাংস্কৃতিক মূল্যবোধে চরম আঘাত হেনেছে

কাঠামোগত বৈষম্যের উদাহরণ

স্বৈরাচার সরকারের আমলে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো জনগণের সাথে বৈষম্যের আচরণ করে অভ্যস্ত ছিল সরকার পতনের পর দেশবাসী ভেবেছে, এবার রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে প্রকাশ্যে বৈষম্যের ধারা বন্ধ হবে কিন্তু নারী সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে গেল প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোগত বৈষম্য এখনো রয়ে গেছে

সরকার নারী বিষয়ক সংস্কারের মতো নাযুক একটি বিষয়ে প্রস্তাবনা পেশ করা নীতি নির্ধারণের কমিশন প্রধান হিসেবে স্থির করেছে ৪২ বছর পুরোনো একটি ফেমিনিস্ট বা নারীবাদী সংগঠননারীপক্ষ প্রতিষ্ঠাতা সদস্য শিরীন পারভিন হককে কমিশনের জন্য এমনসব সদস্যই নির্বাচিত হয়েছেন, যারা নারীবাদী প্রজেক্টের সাথে শতভাগ একমত এবং দেশ জাতির আবহমান কাল থেকে চলে আসা সভ্যতা-সংস্কৃতি থেকে বিচ্ছিন্ন

দেশের সুবিশাল জনগোষ্ঠীর চিন্তা-চেতনা থেকে বিচ্ছিন্ন এই সদস্যরা প্রতিবেদনে নারীবাদী প্রকল্পের সবগুলো সুপারিশ-প্রস্তাব, মত দর্শন জাতির সামনে হাজির করেছে এবং সদর্পে বিষয়টি নিজেরাই প্রকাশ করেছে

বাদবাইজমএকটি নির্দিষ্ট চিন্তাধারার অনুসারীদের বোঝায় সরকার সব মত পথের নারীর ওপর একটি চিহ্নিত গোষ্ঠীর মতাদর্শ চাপিয়ে দেওয়ার সুযোগ তৈরি করে জনগণের সাথে কাঠামোগত বৈষম্যের উদাহরণই তৈরি করল এই বৈষম্য জুলাই-পরবর্তী সরকারের কাছে জনগণ আশা করেনি

নারী-মুক্তি আন্দোলনের স্বপ্ন আকাক্সক্ষা পূরণের মাধ্যম প্রতিবেদন!

প্রতিবেদনের মলাট ওল্টালেই পাঠক দেখবেন, ‘নারী-মুক্তি আন্দোলনে যারা প্রেরণা জুগিয়েছেন এই শিরোনামে কয়েকজনের ছবি প্রকাশ করে শ্রদ্ধা নিবেদন করা হয়েছে

প্রতিবেদনের সারসংক্ষেপের ভূমিকায় বলা হয়েছে, ‘সর্বশেষ দীর্ঘমেয়াদে নারী আন্দোলনের স্বপ্ন আকাক্সক্ষা তুলে ধরা হয়েছে’ (পৃ. )

প্রেক্ষাপট আলোচনায় বলা হয়েছে, ‘নারীর প্রতি বৈষম্য-নিরসনে গঠিত সংস্কার কমিশন বাংলাদেশের নারী-মুক্তি আন্দোলন দীর্ঘদিনের সংগ্রামের প্রতি সম্মান কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করছে’ (পৃ. ২২)

বলাবাহুল্য, অতীত বাংলাদেশে নারী-মুক্তি আন্দোলনের কথিতসংগ্রামছিল মূলত নারীবাদের আদর্শ বিশ্বাসের একনিষ্ঠ প্রচারণা দেশের আমজনতা সব সময় তাদের অযৌক্তিক মতলবি কর্মকাণ্ডের বিরোধিতা করে এসেছে

নারীপক্ষ নিজেদের ওয়েবসাইটে তাদের পথিকৃৎ অগ্রজদের তালিকায় বেগম রোকেয়া, কবি সুফিয়া কামাল জাহানারা ইমামের জীবনী উল্লেখ করেছে

নারীমুক্তি আন্দোলনকে নারীপক্ষ তাদের ওয়েবসাইটে পরিচয় করিয়ে দিয়েছে এই বলেএটি একটি বিশেষ নারীবাদী ঐতিহ্যকে ধারণ করে, যা রোকেয়া সাখাওয়াত হোসাইন-এর লেখা এবং কর্মকাণ্ডে প্রকাশিত

অথচ বেগম রোকেয়ার ইসলামবিদ্বেষী লেখা কর্মকাণ্ডের ফিরিস্তি লম্বা এই লেখায় একটিমাত্র উদ্ধৃতি উল্লেখ করছি, যানারীপক্ষ ওয়েবসাইটের অন্যতম প্রধান স্লোগানধর্মের দোহাই দিয়া পুরুষ এখন রমণীর ওপর প্রভুত্ব করিতেছেন তাই ধর্ম লইয়া টানাটানি করিতে বাধ্য হইলাম

বেগম রোকেয়া ধর্ম নিয়ে টানাটানি শুরু করে দেন ধর্ম না জেনেই ইসলামকে পড়লে তিনি বুঝতেন, ধর্মই আসলে নারীকে তার প্রাপ্য অধিকার দিয়েছে আর বাকি দুইজনের সম্পর্কে তো অনেকেই জানেন!

ফেমিনিস্ট মুভমেন্টের দাবিনামা প্রতিবেদনেরমূল অনুপ্রেরণা’!

কমিশন প্রধান ছাড়াও কমিশনের আরেকজন গুরুত্বপূর্ণ সদস্য হলেননারীপক্ষ আইনজীবী পরিচালক কামরূন নাহার

প্রতিবেদনের প্রেক্ষাপট আলোচনায় এটাও বলা হয়েছে, ‘নারী-আন্দোলনের তৎপরতা দাবিনামা বিশেষত বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ নারীপক্ষ দাবিনামা কমিশনের মূল অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করেছে

টীকায় বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের দাবিনামার শিরোনাম লেখা হয়েছে চার্টার অব ডিমান্ডস (Charter of Demands) এটি অসম্পূর্ণ শিরোনাম পূর্ণাঙ্গ শিরোনাম হল, চার্টার অব ডিমান্ডস অব দ্যা ফেমিনিস্ট মুভমেন্ট ইন বাংলাদেশ, তথা বাংলাদেশে নারীবাদী আন্দোলনের দাবিনামানারীপক্ষ ওয়েবসাইটে এর পিডিএফ আপলোড করা আছে

নারীবাদী আন্দোলনের বৈশ্বিক নেটওয়ার্ক

নারীপক্ষরাখঢাক না রেখেই নিজেদের নারীবাদী আন্দোলনের বৈশ্বিক নেটওয়ার্কের সাথে যুক্ত সংগঠন হিসেবে তুলে ধরেছে তারা বলেছে

নারীবাদী অংশগ্রহণমূলক গবেষণা

Asia Pacific Forum on Women, Law and Development (APWLD) তাদের Feminist Participatory Action Research (নারীবাদী অংশগ্রহণমূলক কর্মভিত্তিক গবেষণা)-এর জন্য মোট ১০টি দেশে প্রস্তাব পাঠায় বাংলাদেশ থেকে নারীপক্ষকে APWLD তাদের Feminist Participatory Action Research (নারীবাদী অংশগ্রহণমূলক কর্মভিত্তিক গবেষণা) পরিচালনা করার জন্য সহযোগী সংগঠন হিসেবে নির্বাচন করে সেই আহ্বানে সাড়া দিয়ে নারীপক্ষ নারীবাদী অংশগ্রহণমূলক গবেষণা প্রকল্প আগস্ট ২০১৫ থেকে বাস্তবায়ন শুরু করে

রাসূল অবমাননাকারীদের মতোমুক্তচিন্তা বিশ্বাসী!

২০২৩ থেকে ২০২৮ এই পাঁচ বছরের কৌশলপত্র প্রকাশ করেছে নারীপক্ষ এর নং পৃষ্ঠায় স্পষ্টভাবে নিজেদেরআদর্শিক নারীবাদী চিন্তা-চেতনা ধ্যান-ধারণার ধারকশব্দে ব্যক্ত করেছে

নিজেদের মুক্ত চিন্তা-চেতনায় বিশ্বাসী বলেও উপস্থাপন করেছে নং পৃষ্ঠায় রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রকাশ্য অবমাননাকারী কুখ্যাতথাবা বাবাওরফে রাজীব হায়দার এবং অভিজিৎ রায়কেমুক্তচিন্তায় বিশ্বাসী মানুষবলেমহিমান্বিতকরেছে

একই পৃষ্ঠায়নারীপক্ষ কার্যক্রমের বিবরণে লেখা হয়েছেআহমদীয়া মুসলিম জামাত তথা কাদিয়ানীদের ধর্মীয় বিশ্বাস এবং চর্চা নির্বিঘ্ন করার দাবিতে সমমনা সংগঠনের সাথে যৌথভাবে ২০০৪ সালে স্বরাষ্ট্র ধর্ম মন্ত্রণালয়ে এবং পুলিশের মহাপরিদর্শককে উকিল নোটিশ পাঠানো

এখান থেকেই পরিষ্কার হয়ে যায়, তারা কি আসলে নারী অধিকারের জন্য কাজ করে, নাকি দাবির আড়ালে ইসলামের শত্রুদের হয়ে দালালী করে! নয়তো বিশ্ব মানবতার মুক্তির দিশারি হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রকাশ্য শত্রু কাদিয়ানীদের সাথে নারীমুক্তির কী সম্পর্ক!?

প্রতিবেদনে নারীবাদী সমাজবিধ্বংসী স্লোগানের সমাহার!

প্রতিবেদনের প্রতি অধ্যায়ের শুরুতে এমনসব স্লোগান উল্লেখ করা হয়েছে, যা নারীবাদীরা নিজেদের প্রচারণায় ব্যবহার করে থাকে যেমন

তৃতীয় অধ্যায়ের শুরুতে আছে, ‘রাষ্ট্র এবং পরিবারে, সমান হবো অধিকারে (পৃ. ৩১)

অর্থাৎ পরিবারকর্তা হিসেবে পুরুষের ভূমিকা অস্বীকার করা হয়েছে বিদ্যমান সমাজে উভয় পক্ষই প্রান্তিকতা, বাড়াবাড়ি অবহেলার শিকার হচ্ছে স্বভাবজাত সমাধান ছিল, নারী পুরুষের প্রাকৃতিক ভূমিকা স্বীকার এবং উভয়কে নিজ দায়িত্ব পালনে সচেষ্ট থাকার কথা বলা তাই ইসলাম নারী পুরুষ উভয়ের অধিকার দায়িত্ব নির্ধারণ করেছে

চতুর্থ অধ্যায়ের শুরুতে আছে, ‘পুরুষের ক্ষমতা, ভেঙ্গে গড়ো সমতা (পৃ. ৪৭)

নারীর কথিত স্বাধীনতা অধিকার আদায় করতে গিয়ে পুরুষকে প্রতিপক্ষ বিবেচনা করা হচ্ছে অথচ নারীর অধিকার গ্রহণ দায়িত্ব পালনে পুরুষ পরিপূরক অংশ কিন্তু ভারসাম্যপূর্ণ সম্পর্কের কাঠামো ভেঙে দেওয়ার আহ্বান জানানো হচ্ছে

পঞ্চম অধ্যায়ের শুরুতে আছে, ‘আমার কথা আমি বলব, স্বাধীনভাবে পথ চলবো’ (পৃ. ৬০)

তার মানে, নারী অন্যায় সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলেও, সীমা অতিক্রম করলেও, পিতা, ভাই, স্বামী কিংবা কোনো পর্যায়ের অভিভাবক তাকে কিছু বলতে পারবে না

ষষ্ঠ অধ্যায়ের শুরুতে আছে, ‘নারী নির্যাতন রুখবো সবে, হাত আছে হাতিয়ার হবে’ (পৃ. ৬৭)

নারীবাদীরা বিয়ের মতো পবিত্র সম্পর্কের ক্ষেত্রেওবৈবাহিক ধর্ষণ’-এর মতো অন্যায় পরিভাষা চালু করেছে এবং সেটাকে নারী নির্যাতন আখ্যা দিয়েছে!

অষ্টম অধ্যায়ের শুরুতে আছে, ‘সকল বাঁধা ভাঙবো, সমঅধিকার আনবো (পৃ. ৮৭)

তথাকথিত মুক্তমনা ব্লগারদেরবাঁধভাঙা আওয়াজনারীবাদীরা রাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ মদদে কমিশনের প্রতিবেদনে লিখিত রূপ দিয়েছে

দশম অধ্যায়ের শুরুতে আছে, ‘শরীর আমার, সিদ্ধান্ত আমার (পৃ. ১০৫)

লিবারেলিজমবা স্বেচ্ছাচারবাদের চরম ঔদ্ধত্যপূর্ণ লজ্জাহীনতার প্রকাশ হল এই স্লোগান অবাধ যৌন স্বাধীনতা এবং নারীর জন্য নিষিদ্ধ বহুগামিতারঅধিকারপেতে এই স্লোগান ব্যবহার হয় যে মানবতাবিরোধী অধিকার ফলানোর চরম মাশুল গুণতে হচ্ছে এখন পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলোকে এবং সে সভ্যতায় গড়ে ওঠা অন্যান্য সমাজকে

একাদশ অধ্যায়ের শুরুতে আছে, ‘সমান হিস্যা, সমান অধিকার (পৃ. ১১৭)

উত্তরাধিকারে মুসলিম নারীর অংশ অকাট্য দলীল দ্বারা সুনির্ধারিত, যার অস্বীকার স্পষ্টত কুফরী একটি স্বাধীন মুসলিম দেশে কী অবলীলায় কুফরী মতবাদ রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে বাস্তবায়নের সুপারিশ করা হচ্ছে?

পঞ্চদশ অধ্যায়ের শুরুতে আছে, ‘গণমাধ্যম হোক নারীপুরুষের সমঅধিকার প্রতিষ্ঠার হাতিয়ার (পৃ. ১৫৬)

ষোড়শ অধ্যায়ের শুরুতে আছে, ‘সমান মর্যাদায় হোক ক্রীড়া সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে নারীর অংশগ্রহণ’ (পৃ. ১৬৬)

ক্রীড়া সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলের উদ্দেশ্য হচ্ছে লঘু বিনোদন ক্রীড়া সংস্কৃতি নারীকে বিনোদন-পণ্য হিসেবে ব্যবহার করে নারীজাতিকে হেয় খাটো করার বৃহৎ দুটি পরিমণ্ডল

নারী মুক্তি অধিকারের নামে এসব করা হলেও এসবের বেনিফিশিয়ারি আসলে লোভী মতলবি পুরুষেরাই

কমিশনের নারীবাদী এজেন্ডা

কমিশনের আরেক সদস্য ফেরদৌসি সুলতানা বেগমের পরিচয় লেখা হয়েছে, জেন্ডার সামাজিক উন্নয়ন বিশেষজ্ঞ অর্থাৎ তার দক্ষতার জায়গাই হচ্ছে জেন্ডার বা নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সব লিঙ্গের জন্য সর্বস্তরে সমান অধিকার প্রতিষ্ঠা সমান সুযোগ তৈরির কাজ করা

এটি ছিল এই কমিশনের প্রধানতম এজেন্ডা প্রতিবেদনের প্রচ্ছদপাতার সাবটাইটেলে আছে, ‘নারী-পুরুষের সমতা অর্জনের লক্ষ্যে পদক্ষেপ চিহ্নিতকরণ এজেন্ডা বাস্তবায়নে এই বিষয়ের বিশেষজ্ঞ নিয়োগ করেছে এবং যত ক্ষেত্রে তাদের দৃষ্টিতে অসমতা আছে, তা চিহ্নিত করে সমতা প্রতিষ্ঠার সুপারিশ করেছে একটি উদাহরণ দেখুন

বাংলাদেশ সরকার সিডও Convention on the Elimination of All Forms of Discrimination Against Women (CDEW) তথানারীর প্রতি সকল প্রকার বৈষম্য বিলোপ সংক্রান্ত জাতিসংঘ সনদ’- স্বাক্ষর করেছে ১৯৮৪ সালে, তবে দুটি ধারায় সংরক্ষণ (reservation) এখনো বহাল রেখেছে সেই দুটি ধারা হল :

. ধারা (Article 2) : রাষ্ট্রগুলো নারী-পুরুষের সমঅধিকার নিশ্চিত করতে সব ধরনের বৈষম্যমূলক আইন, রীতি প্রথা বিলুপ্ত করবে এবং সমতার নীতি সংবিধান জাতীয় আইনে অন্তর্ভুক্ত করবে

. ধারা ১৬ ((Article 16, subsection 1(c) : বিবাহ পারিবারিক জীবনে নারী পুরুষের সমান অধিকার থাকবে, যেমন, বিবাহ, বিবাহবিচ্ছেদ, অভিভাবকত্ব, উত্তরাধিকার ইত্যাদি বিষয়ে

বাংলাদেশের দেওয়া সংরক্ষণ জাতিসংঘের অফিসিয়াল ওয়েবসাইটে এভাবে উল্লেখিত আছে

The Government of the People’s Republic of Bangladesh does not consider as binding upon itself the provisions of article 2, 16 (1) (c) as they conflict with Sharia law based on Holy Quran and Sunna.

গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার ধারা , এবং ১৬()()-এর বিধানাবলি নিজের জন্য বাধ্যতামূলক বলে গণ্য করে না, কারণ সেগুলো পবিত্র কুরআন সুন্নাহভিত্তিক শরিয়া আইনের সাথে সাংঘর্ষিক

কিন্তু প্রতিবেদনের ৩৯ নং পৃষ্ঠায়, অন্তবর্তী সরকারের সময় আশু বাস্তবায়নযোগ্য সুপারিশের তালিকায় আছে, ‘নারীর প্রতি সকল প্রকার বৈষম্য বিলোপ সংক্রান্ত জাতিসংঘ সনদ (CDEW)-এর ওপর করা সংরক্ষণসমূহ প্রত্যাহার করা’!! (অনুচ্ছেদ ...)

যদিও এই সংরক্ষণগুলো ছিল মুসলিম রাষ্ট্র হিসেবে দেশের ভৌগোলিক ধর্মীয় স্বাতন্ত্র্য বৈশিষ্ট্যের ন্যূনতম সংরক্ষণ কিন্তু নারীবাদী কমিশন এতটুকুও বরদাশত করেনি!

ব্র্যাক ইনস্টিটিউট

নারী কমিশনের আরেকজন সদস্য  মাহীন সুলতানা হলেনব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্নেন্স এন্ড ডেভলপমেন্ট’-এর সিনিয়র ফেলো সচেতন নাগরিক জানেন, ব্র্যাক দেশীয় ধর্মীয় মূল্যবোধে আঘাত হানতে সদাব্যস্ত একটি নাম উদাহরণ হিসেবেনারীর পোশাক কেমন হওয়া উচিতশীর্ষক প্রথম আলোতে প্রকাশিত লেখাটি দেখুন, যাব্র্যাক ইনস্টিটিউট’-এর সদস্যরা প্রস্তুত করেছে এবং তাদের ওয়েবসাইটে এই লেখার সাইটেশন আছে লেখাটিতে স্পষ্ট বলা হয়েছে, ধর্ম সমাজের দোহাই দিয়ে নারীকে ইচ্ছেমতো পোশাক অশালীন হলেও পরতে বাধা দেওয়া অন্যায় এবং নারীর সমঅধিকার ক্ষুণ্ন করার শামিল!

মানবাধিকার কমিশন

কমিশনের আরেকজন সদস্য    নিরূপা  দেওয়ান ফ্যাসিবাদী সরকারের আমলে দীর্ঘসময় জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সদস্য ছিলেন অথচ ফ্যাসিবাদের আমলে বারংবার লার্জ স্কেলে মানবাধিকার লঙ্ঘন হলেও মানবাধিকার কমিশন নীরব ছিল ২০১৯ সালে এই সদস্য আইপিডিসি-প্রথম আলোর সেরা শিক্ষক সম্মাননা পুরস্কারও পেয়েছেন (উইকিপিডিয়া)

সরকার পতনের পর এই সদস্য নারী সংস্কার কমিশনের অধীনে নির্দ্বিধায় জনস্বার্থ বিরোধী সুপারিশমালা প্রণয়নে যুক্ত হয়েনারী অধিকারনিয়ে উচ্চকিত এটা প্রহসন ছাড়া আর কী?!

অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় প্রতিবেদনে উপেক্ষিত

সম্প্রতি গুম কমিশনের প্রকাশিত লোমহর্ষক ডকুমেন্টারিতে এসেছে, কমিশন গঠনের চারদিনের মাথায় ৪০০ অভিযোগ জমা হয়! মোট ১৮০০ অভিযোগের মধ্যে ছয় বছরের শিশু গর্ভবতী নারীরও গুম হওয়ার অভিযোগ এসেছে! ভয়ে কিংবা অনাহুত ঝামেলা এড়াতে আরও বহু কেস সামনে আসেনি

নারীবাদী কমিশন জনগণের বিশ্বাসবিরুদ্ধ বিষয়গুলোতে সবিস্তার সুপারিশের তালিকা দিয়েছে কিন্তু স্বৈরাচার আমলে যে নারীরা গুমের শিকার হয়েছেন, সরকারি নিরাপত্তা বাহিনী কিংবা পেটোয়া বাহিনী কর্তৃক চরম নির্যাতন সয়েছেন, অন্যায়ভাবে জেল খেটেছেন তাদের দৈহিক আর্থিক ক্ষতিপূরণের কোনো সুপারিশ করেনি

শত শত নারীর স্বামী, ভাই কিংবা পিতা গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যা কিংবা বিচারিক হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন তাদের পরিবার, সন্তান, অর্থ-সম্পদ সব লন্ডভন্ড হয়ে গেছে পুরুষের অনুপস্থিতিতে তারা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগেছেন সেই নারীদের ঘা এখনো দগদগে, তাদের ক্ষত এখনো শুকোয়নি নারীর এইসব দুর্দশা সম্পর্কে কোনো সুপারিশ আসেনি এই প্রতিবেদনে অথচ জুলাইয়ের স্পিরিট ধারণ করলে এই নারীদের ভাবনা এড়িয়ে যাওয়ার কথা না

কমিশনের আলোচনার আওতাভুক্ত হওয়ার দরকার ছিল এমন অনেক মৌলিক বিষয়ই অবহেলিত উপেক্ষিত থেকে গেছে এবিষয়ে জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমের সম্মানিত খতীব হযরত মাওলানা মুহাম্মাদ আবদুল মালেক ছাহেব ২৫ এপ্রিল ২০২৫ জুমাপূর্ব আলোচনায় বলেন

এই কমিশনের আসল যে কাজ ছিল, তা কিন্তু বাকিই রয়ে গেল তারা যা করেছেন তা হল, আগাগোড়া অনধিকার চর্চা, আল্লাহদ্রোহিতা এবং আল্লাহর দেওয়া কুরআন-সুন্নাহ শরীয়তদ্রোহিতা যেটা দরকার ছিল তা হল, নারী বিষয়ে ইসলামী শিক্ষা বাস্তবায়নের অভাবে বিভিন্ন ক্ষেত্রে নারীরা যে অধিকার বঞ্চিত হয়, সেটার জন্য বাস্তবমুখী একটি প্রস্তাবনা পেশ করা, যাতে নারীরা আল্লাহর দেওয়া বিধি-বিধান মেনে আল্লাহর নেক বান্দি হিসেবে গড়ে উঠতে পারে এবং আল্লাহর দেওয়া বিধি-বিধান অনুযায়ী নিজেদের সমস্ত অধিকার লাভ করতে পারে

কমিশনের সংস্কার করার মতো আরেকটি কাজ ছিল ১৯৬১ সালের মুসলিম পারিবারিক আইনে শরীয়তের স্পষ্ট বিরোধী অনেকগুলো ধারা রয়েছে উলামায়ে কেরামের সহায়তা নিয়ে এই ধারাগুলোকে শরীয়তসম্মত করে দেওয়া তা তো করেইনি, উল্টো আরও কুফরী মতবাদ এবং জাহেলী রীতি-নীতি অবলম্বনের প্রস্তাব করেছে সরকার যদি আসলেই দেশ জনগণের কল্যাণ চায়, তাহলে এই প্রতিবেদনকে সম্পূর্ণভাবে প্রত্যাখ্যান করে ইসলামী শরীয়ত নবীজীর সীরাত থেকে নারী বিষয়ে নীতিমালা তৈরি করে তা বাস্তবায়ন করা কর্তব্য” (মাসিক আলকাউসার, মে ২০২৫ সংখ্যা, পৃ. ১৭)

তেমনি পশ্চিমা ধাঁচের জীবনধারা গ্রহণ করার ফলে নারীরা যে সংকটগুলোতে ভুগছেন তা নিয়ে কোনো সুপারিশ বা প্রস্তাব নেই নারী-পুরুষের কথিতপ্রেমকখনবিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে ধর্ষণ’- পরিণত হয় এবং এর জেরে নারী ব্যক্তি সামাজিক জীবনে যে ক্ষতি হেনস্তার শিকার হন এমন অতি জরুরি বিষয় নিয়েও কমিশনের কোনো উদ্বেগ দেখা যায়নি

ডিজিটাল দুনিয়ায় একই দৃশ্য মানুষ চাইলে যে কোনো সময় যে কোনো স্থানে বসে দেখতে পারে ফলে প্রতিমুহূর্তেব্রেইন-সেক্সে শিকার হচ্ছে নারী বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে তৈরি অনলাইন কনটেন্টে নারীর অশালীন পোশাক অবাধ যৌন আচরণের খোলামেলা দৃশ্যায়নের বলি হতে হচ্ছে নিম্ন মধ্যবিত্ত মধ্যবিত্ত পরিবারের নারীদের রাস্তায়, বাসে, উন্মুক্ত স্থানে নারীকে চরম ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে, চড়া মূল্য দিতে হচ্ছে কিন্তু নিয়েও কোনো উৎকণ্ঠা তৈরি হয়নি কমিশনের

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কর্মস্থলে হিজাব পর্দার কারণে কত নারী কতভাবে হেনস্তার শিকার হয়েছেন এবং হচ্ছেন; কিন্তু তারাহিজাবফোবিয়াসমাধানে কোনো সুপারিশ পেশ করেননি হিজাব বা পর্দানশীন নারীর প্রতি কোনো অন্যায় হলে রাষ্ট্র, মানবাধিকার এবং বিশেষ করে নারী অধিকার সংগঠনগুলো মুখে কুলুপ এঁটে যে বৈষম্যমূলক আচরণ করে অভ্যস্ত সে বৈষম্য দূরিকরণে তাদের কোনো বিকার নেই

উল্টো নারীবাদী এই কমিশন ফ্যাসিবাদী আমলের মতো সমাজে মতাদর্শিক লড়াই উসকে দিয়েছে তাদের ভাষায়, এই প্রতিবেদনতর্ক-বিতর্ক সৃষ্টি করার মাধ্যমে নারীর সমতা অর্জনে সহায়ক করবে’ (পৃ. ) একই পৃষ্ঠায় বলা হয়েছে, তারাআলোচনা-সমালোচনাচেয়েছেন

দেশের বিদ্যমান পরিস্থিতিতে জাতীয়, সামাজিক ধর্মীয় সংস্কৃতি এবং মূল্যবোধে চরম আঘাত হেনে এইতর্ক-বিতর্কএবংআলোচনা-সমালোচনাউসকে দিয়ে চলমান জাতীয় সংকটগুলো থেকে দৃষ্টি ফেরানোর নামই কি নারীকে অধিকার প্রদান?

সংস্কারের নামে নারীবাদী প্রজেক্ট!

নারী সংষ্কার কমিশনের সদস্যরা আসলে সুযোগের সদ্ব্যবহার করে নিজেদের পূর্ব স্থিরীকৃত ধ্যান-ধারণা অনুযায়ী নারীবাদী প্রজেক্টের একটি প্রতিবেদন উপস্থাপন করেছেন নারীবাদী ধর্ম-মুক্ত চিন্তা লালনকারী গোষ্ঠীর পরিধিতেই সীমাবদ্ধ থেকেছেন এমনকি প্রতিবেদনের শেষে উল্লেখ করা মানবাধিকার নারী অধিকার সংগঠনের বিশাল তালিকাতেও এই গোষ্ঠীর বাইরে তারা উঁকি দেননি এই চেরি-পিকিংয়ের ফলে নিরপেক্ষ গবেষণা নিরীক্ষণের বদলে চিহ্নিত একটি মতবাদের প্রতিনিধি হয়ে উঠেছে প্রতিবেদনটি

তাদের দাবি, ‘প্রচলিত আইন বিধিমালা বিশ্লেষণ, বিভিন্ন গবেষণা থেকে পাওয়া তথ্য বিশ্লেষণ, মাঠ পর্যায় থেকে তথ্য সংগ্রহ এবং বিভিন্ন বিষয়ে অভিজ্ঞজনদের সাথে পরামর্শ সভা আয়োজনের মাধ্যমে সুপারিশ প্রণয়নের পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়’ (পৃ. )

কিন্তু প্রচলিত আইন বিশ্লেষণের যে ধারা ইসলামী আইনশাস্ত্রের বিশেষজ্ঞরা অনুসরণ করেন, সে ধারার বিশ্লেষণ সামনে আনার উপযুক্ত কোনো ব্যবস্থা কি তারা গ্রহণ করেছেন? দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম জনগণের প্রতিনিধিদের মতো গুরুত্বপূর্ণ স্টেকহোল্ডারদের এড়িয়ে, তারা পছন্দের অভিজ্ঞজনদের সাথে বহু পরামর্শ সভা আয়োজন করেছেন এবং সুপারিশ তৈরি করে ফেলেছেন!

মাঠ পর্যায় থেকে যথাযথ তথ্য সংগ্রহ করলে তারা দেখতে পেতেন, অতীতে নারী উন্নয়ন সমঅধিকার শিরোনামের অনেক নীতিমালা প্রস্তাবনা দেশের নারীরাসমাজ সংস্কৃতি বিরোধী বলে প্রতিবাদ করেছেন, ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত পাওয়া এবং গভীর উদ্বেগের কথা জানিয়েছেন

প্রতিবেদন পড়লে দেখা যায়, মূল সুপারিশমালা বিভিন্ন নারীবাদী সংগঠনের লিটারেচারে পূর্ব থেকেই বিদ্যমান ছিল, বক্ষ্যমাণ প্রতিবেদনে তারা কেবল তা বিস্তারিতরূপে প্রকাশ করেছেন দুটি নারীবাদী সংগঠনের দাবিনামা যে তাদের মূল অনুপ্রেরণা (বরং মূল ভিত্তি) ছিল, সেটি তারা স্বীকারও করেছেন, যেমনটি আমরা আগে উল্লেখ করেছি তাহলে আলাদা করে গবেষণা তথ্য বিশ্লেষণের দাবিটি দ্বারা সম্ভবত তারা বিভিন্ন জরিপ বিশ্লেষণের কথা বুঝিয়েছেন?!

তাছাড়া এটি স্পষ্ট যে, বিষয়সংশ্লিষ্ট গবেষণা অনুসন্ধানের কাজটি তারা করেননি করলেও নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে বিচার করেননি পশ্চিমা সমাজবিজ্ঞানী চিন্তকদের বহু বছর আগের নারী বিষয়ক গবেষণা পড়লেও তারা দেখতেন কমিশনেরপ্রথাবিরোধীসুপারিশমালা বাস্তবায়নের ফলে পশ্চিমা সমাজে যে অস্থিরতা, দুশ্চিন্তা বিশৃঙ্খলা তৈরি হয়েছে, তা থেকে বের হয়ে আসার তারা উপায় খুঁজেছেন

পশ্চিমের ভুলগুলো অনুকরণ না করাই সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ

প্রসিদ্ধ পশ্চিমা বুদ্ধিজীবী চিন্তক বারট্রান্ড রাসেলের একটি বক্তব্য উদ্ধৃত করে লেখার কিস্তি শেষ করছি রাসেল বলেন

I think asia should seek to preserve what has been of value in its own traditional civilization, and should not allow itself to be swamped by some of the worst features of western thinking under the impression that this is the only way to preserve independence.

আমি মনে করি, এশিয়ার উচিত নিজস্ব ঐতিহ্যবাহী সভ্যতার মূল্যবান উপাদানগুলো সংরক্ষণ করা এবং স্বাধীনতা রক্ষার একমাত্র উপায় ভেবে পশ্চিমা চিন্তাধারার নিকৃষ্ট বৈশিষ্ট্যগুলোকে অন্ধভাবে গ্রহণ না করা

রাসেল আরও বলেন

I should say to the re-awakening nations of asia: ̒... what will perhaps be more difficult will be to refrain from copying the mistakes of the west.̓

আমি প্রাচ্যের পুনর্জাগরিত জাতিগুলোকে বলব, পশ্চিমের ভুলগুলো অনুকরণ না করাই হয়তো সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হবে (দ্র. Russell, Bertrand. Part I: ˝Implications of the Hydrogen Bomb,ˮ 8th Paper: ˝Reflections on the Re-Awakening Eastˮ [1954], In The Collected Papers of Bertrand Russell, Volume 28: Man̓s Peril, 1954-55, edited by Andrew G. Bone, London and New York: Routledge, 2003. р. 47.)

পাঠক মহল দেখেছেন, প্রতিবেদনটি কীভাবে বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী সভ্যতার মূল্যবান উপাদানগুলোকে সমূলে ধ্বংস করার পরিকল্পনা করেছে, ‘নারী স্বাধীনতা দাবির আড়ালে মূলত পশ্চিমা চিন্তাধারার নিকৃষ্ট বৈশিষ্ট্যগুলো অন্ধভাবে গ্রহণ করেছে!

গবেষণার একাডেমিক পদ্ধতি গ্রহণ না করা, মাঠপর্যায়ে তথ্য সংগ্রহে বিশাল খামতি গ্যাপ, দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ স্টেকহোল্ডারদের প্রতিনিধিদের উপেক্ষা করা এইসব দিক প্রতিবেদন উপস্থাপনকারীদের সংকীর্ণ সংকুচিত চিন্তা প্রকাশ করে বিশ্বজুড়ে জাতীয় পর্যায়ের প্রতিবেদন তৈরির জন্য সংশ্লিষ্ট সকল স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে যে বৈঠক-নীতি অবলম্বন করা হয়, নারী কমিশন সে নীতিও অগ্রাহ্য করেছে সেইসাথেগণতান্ত্রিকরাষ্ট্রে সবার মতামত গ্রহণের যে ধারা, সেটা উপেক্ষা করে কমিশনটিঅগণতান্ত্রিকআচরণের অভূতপূর্ব নজির স্থাপন করেছে

 

(চলবে ইনশাআল্লাহ)

 

 

advertisement