রবিউল আউয়াল ১৪৪৭   ||   সেপ্টেম্বর ২০২৫

যার বাবা এখনও জীবিত আছেন তার প্রতি

মাওলানা আবুল বাশার মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম

আমার বাড়ি বরগুনা জেলার অন্তর্গত বামনা থানাধীন কালাইয়া গ্রামে বাড়িটি গ্রামের একদম দক্ষিণ প্রান্তে পূব-পশ্চিমে লম্বা সম্মুখ পশ্চিম দিকে পূবে একটা খাল আছে, যেটা উত্তর-দক্ষিণে প্রবাহিত খালের ওপর এখন পাকা সেতু আমার শৈশব-কৈশোর ও যৌবনের প্রথম দিকে ছিল বাঁশের সাঁকো বর্তমান পাকা সেতুর চে’ ওই বাঁশের সাঁকোই স্মৃতিতে বেশি ভাসে

বাড়ি থেকে ঢাকায় আসা হয় লঞ্চে আগে লঞ্চের বডি ছিল কাঠের এখন তো বিশালাকার স্টিলবডি জাহাজেই যাতায়াত অবশ্য গ্রামের ভেতর দিয়ে বর্তমানে একসময়কার স্বপ্নাতীত বাস চলাচল করছে কাজেই বহু লোক সড়ক পথেই যাতায়াত করছে আমার স্বস্তি জাহাজেই

আমাদের লঞ্চঘাট বামনায় বাড়ি থেকে উত্তর দিকে আগে তো নৌকাযোগেই লঞ্চঘাটে আসতে হত কিন্তু পাকা সড়ক হয়ে যাওয়ার পর কেউ আর নৌকায় চড়ে না আমাদের খালে এখন নৌকা দেখা যায় না হয়তো এখনকার শিশুরা নৌকা চেনেই না

আমার বাড়ি থেকে বের হয়ে আসার পথ দুটি বাড়ির সামনে পশ্চিমগামী রাস্তার একটা শাখা উত্তর দিকে এসে বামনাগামী প্রধান সড়কের সাথে মিশেছে কখনও ওই পথ দিয়েও আসা হত আবার পূবদিকের সেতু পার হয়েও আসা যায় এখন বেশির ভাগ এ পথেই আসা হয়

এই উভয় পথেই বাড়ি থেকে যখন ঢাকায় আসা হত, তখনকার যে জ্যান্ত স্মৃতি আমাকে জ্বালায়, আমাকে গলায়, কাঁদায়, আমাকে সান্ত্বনা জোগায়, আমার হৃদয়ে পিপাসা জাগায়, হাহাকার তোলে, আমাকে অতীতে নিয়ে যায়, ব্যাকুল ও পাগল করে তোলে, যে স্মৃতি আমার সম্পদ, স্বস্তি, আমার আক্ষেপ, অস্থিরতা এবং যেই স্মৃতির ভারে আমি আক্রান্ত, আবার কখনও তা আমার পক্ষে আশ্বাসবাণী, ফলে হয়ে যাই যেন একদম ভারশূন্য, হাঁ সেই জ্যান্ত-জাগ্রত স্মৃতি এবং সেই অমর-অম্লান ছবির কথাই বলতে চাই তোমাকে, যার বাবা এখনও জীবিত সেই তোমাকে তোমার বাবার ছায়া আল্লাহ তাআলা তোমার মাথার ওপর অনেক অনেক দিন বিছিয়ে রাখুন

তোমার বাবা আছেন আমার বাবা চলে গেছেন ২০১১ ঈ.-এর ৯ নভেম্বর আমরা তাঁর স্নেহছায়া হারিয়েছি তুমি বলবে, যার বয়স নব্বই বছর পার হয়ে গেছে সে আর কতকাল বাঁচবে যুক্তির কথা এবং বাস্তবতা কিন্তু সব বাস্তবতাই কি প্রাণ মেনে নেয়, না মানা যায়? যদি বলি, মানা উচিত নয়, তা-ও কি ভুল হবে? (সাবধান! তুমি রিযা বিল কাযা-র সাথে এর দ্বন্দ্ব লাগাতে যেয়ো না)

বাবার চলে যাওয়ায় কি কেবল স্নেহছায়াই হারিয়েছি? বর্ণনীয়-অবর্ণনীয় কত কী যে হারিয়েছি তার তো ইয়ত্তা নেই সেই হারানোর ক্ষতিপূরণ কোনও কিছু দিয়ে কি সম্ভব? তাই তো নব্বই কেন, যদি আরও বহুকাল বেঁচে থাকতেন আর আমার মরণ তাঁর স্নেহ-করতলে হত, না জানি সে মরণ কত শান্তির ও কল্যাণের সাথে হত সন্দেহ নেই, বাবার পক্ষেও তা দুর্বিসহ কষ্টের হত বাবাকে সে কষ্ট দু-দুবার সইতেও হয়েছে আমার ছোট ভাই ও তারও আগে ছোট বোনের মৃত্যু বাবার সেই কষ্টের ছবিসহ অনেক সবকই আমাদের জন্য রেখে গেছে

তা বুকের ধন সন্তানকে কবরে রাখার বেদনা বাবার পক্ষে কেমন ছিল? কেমন যে ছিল, তা আঁচ করা তো সম্ভব নয় কিছুটা আঁচ করতে পারি তাঁর সেই কষ্ট, যা বাড়ি থেকে আমাদের কারও ঢাকায় বা অন্য কোথাও চলে আসা কালে তাঁর বুকে বাজত

বরাবরই তাঁর নিয়ম ছিল, সঙ্গে অনেক দূর এগিয়ে দেওয়া একসময় তো আনুমানিক চার কিলোমিটার দূরে বামনা লঞ্চঘাট পর্যন্ত আসতেন বার্ধক্য বৃদ্ধির সাথে সাথে তা যথাক্রমে কমতে থাকে বয়স নব্বইয়ের কাছাকাছি হলে লাঠিতে ভর করেই চলতে হত কিন্তু তখনও বাড়ি থেকে আসার সময় যথারীতি এগিয়ে দিতেন এ অবস্থায় তো আর বেশি দূর যাওয়া সম্ভব হত না সাধারণত পূব দিক থেকে আসলে খালপাড় পর্যন্ত আসতেন আর পশ্চিম দিক থেকে আসলে বাড়ির দক্ষিণ-পশ্চিম কোণের পারিবারিক কবরস্থান পর্যন্ত

কবরস্থান বা খালপাড় পর্যন্ত আসার পর শুরু হত তাকিয়ে থাকার পালা যতদূর পর্যন্ত আমাকে দেখা যেত এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতেন কখনও গাছের বা অন্য কিছুর আড়াল হলে ডানে-বামে উঁকি দিয়ে দেখতেন সম্পূর্ণরূপে দৃষ্টির আড়াল না হওয়া পর্যন্ত তাকিয়েই থাকতেন

এই তাকিয়ে থাকার কী ব্যাখ্যা? কোনও ব্যাখ্যা নেই কোনও যুক্তি নেই প্রাণের ধন কয়েক মাসের জন্য দূরে চোখের আড়ালে চলে যাচ্ছে, আবার না আসা পর্যন্ত দেখতে পাওয়া যাবে না তাই দেখে দেখে চোখের তিয়াস মেটানোর চেষ্টা যতক্ষণ পারা যায়, চোখ ভরে দেখে নিই ছুটির মাত্র কয়েকটা দিন বাড়িতে ছিল দেখে তো মন ভরেনি আবার কবে দেখতে পাওয়া যাবে মাস কয়েক? সে তো অনেক দূর তাই এই দু-চার মিনিটের দেখাটাও যেন অনন্তের অমৃত এর একটা পলও নষ্ট হতে দেওয়া যায় না তাকিয়ে আছেন তো তাকিয়েই আছেন

তাকিয়ে থেকে প্রাণের পিপাসা মেটাচ্ছেন সেইসঙ্গে প্রাণভরে দুআ মা‘বুদ গো, আমার বাছারে নিরাপদে পৌঁছিয়ো, নিরাপদে রেখো পথে যেন কোনও কষ্ট না হয় গন্তব্যে যাওয়ার পর অসুখ-বিসুখ যেন না হয় সুস্থ রেখো, শান্তিতে রেখো

ওই দুআ, ওই তাকিয়ে থাকা প্রাণের বাছার পক্ষে কি পরম আশ্বাসের বাণী ছিল না যে, ‘বাছা, একটুও চিন্তা করো না আল্লাহ তাআলা তোমাকে সহীহ-সালামতে রাখবেন কোনও ভয় করো না আমার দুআ তোমার সঙ্গে আছে তোমার আর ভাবনা কীসের?’

প্রায় ১৪ বছর হতে চলল, আব্বা চলে গেছেন এখনও বাড়িতে যাওয়া হয় কিন্তু আসার সময় ওই ছবি আর দেখি না লাঠিতে ভর করে ঈষৎ নুয়ে দাঁড়িয়ে আছেন চোখের তৃষ্ণা মেটাচ্ছেন প্রাণভরে দুআ করছেন আর অস্তিত্বের ভাষায় আশ্বাস যোগাচ্ছেন ওই দৃশ্য আর কখনও চোখে দেখা যাবে না চোখ মুদে তো সর্বদাই দেখি কিন্তু দুআ ও আশ্বাসের যে অস্তিত্ব হারিয়েছি তার কি কোনও বিকল্প আছে? আহা! তিনি জীবিত থাকতে ওই দৃশ্যের মূল্য বুঝিনি, কিন্তু চলে যাওয়ার পর যে নিজের গোটা অস্তিত্ব দিয়েই উপলব্ধি করি বাড়ি থেকে আসার সময় হৃদয় দুমড়ে-মুচড়ে যায় এখন যে পেছন ফিরে আশ্বাসের ওই দৃশ্য দেখার কোনও সুযোগ নেই আহা! সান্ত্বনার কী শান্ত-সমাহিত দৃশ্য! ভেতরে বাৎসল্যের আলোড়ন, বাইরে স্থির দুআ-মূর্তি আজ প্রাণ ভরে তোলার কত আয়োজন, কত উপকরণ, কিন্তু প্রাণে শক্তি জোগানোর সেই উৎস কই? বার্ধক্যে ক্ষয়ে যাওয়া ওই দুর্বল অস্তিত্বে ফরযন্দের প্রাণে শক্তি জোগানোর কী উপচানো ক্ষমতাই না ছিল হৃদয়ে বড় হাহাকার ওঠে যখন ওই যষ্ঠীআশ্রয়ী অশীতিপর বাবার দাঁড়িয়ে থাকা কল্পনা করি বড় অস্থির হয়ে উঠি যখন ভাবি ওই দাঁড়িয়ে থাকাকালে তাঁর মনের ভেতর কেমন করত!

ইতিমধ্যে আমার সন্তানরাও বড় হয়ে উঠেছে যদিও ওদের আমার চোখের অতটা আড়াল হওয়ার অবকাশ এখনও হয়নি, কিন্তু সামান্য যে অভিজ্ঞতা হয়েছে, তাতেই আঁচ করতে পারি, তখন আব্বার অন্তরের মোচড় কতখানি দুর্দান্ত ছিল

আমার এক পুত্র যখন মাসখানেকের জন্য একটা তাদরীবে (প্রশিক্ষণে) অংশ নেওয়ার জন্য বাসা থেকে যাচ্ছিল, সর্বপ্রথম তখনই অত্যন্ত জোরালোভাবে ওই অপেক্ষার মর্ম আমি অনুভব করতে পারি ও যখন হেঁটে হেঁটে বাস স্টপেজের দিকে যাচ্ছিল আমি ওর অগোচরে পেছনে পেছনে হাঁটতে থাকি এই প্রথম এতদিনের জন্য প্রাণের বাছা চোখের আড়াল হচ্ছে তখন ওর চে’ বরং আমাদেরই অনেক অনেক বেশি কষ্টের অভিজ্ঞতা লাভ হয়েছে

আহা! আমি যখন বিদায় নিয়ে আসতাম তখন আমার বৃদ্ধ আব্বার অন্তরে কেমন ঝড়ই না জানি বইত! কিন্তু আমি এই অপদার্থ তার কতটুকু মূল্য বুঝেছি মূল্যদান তো সুদূরপরাহত

 

 

advertisement