বিশেষ সম্পাদকীয়
একটি দলের মৌলবাদী, উগ্রবাদী বলে চেঁচামেচি
<br> ‖ এদের বিষয়ে জনগণকে সতর্ক থাকতে হবে
বাংলাদেশে দীর্ঘ ফ্যাসিবাদী অপশাসনের অবসান হয়েছে মাত্র বছরখানেক হল। কিন্তু এরই মধ্যে কিছু কিছু রাজনীতিবিদের মুখে ফ্যাসিবাদের ব্যবহার করা শব্দ বারবার উঠে আসছে। মনে হচ্ছে, পতিত স্বৈরাচারের কৌশল কাজে লাগিয়ে তারা ক্ষমতার মসনদে আসীন হতে চায়। না হলে এমন একটি দল, যারা এদেশে একাধিকবার ক্ষমতায় আসীন হয়েছে। তৃণমূল পর্যন্ত রয়েছে যাদের জনসমর্থন। তারা কেন মতলবি ফ্যাসিবাদীদের কৌশল অবলম্বন করবে?
মাসিক আলকাউসার কোনো দলীয় মুখপত্র নয়। কোনো বিশেষ দলের পক্ষে-বিপক্ষে কাজও করে না। দেশের একটি জনপ্রিয় সাময়িকী হিসেবে ইসলাম ও ন্যায়ের কথাগুলো বলে যাওয়া এ পত্রিকার কাজ। তাই আমরা বিশেষ কোনো দলকে টার্গেট না করেই বলতে চাই, এদেশে মৌলবাদী, ধর্মান্ধ, উগ্রবাদী শব্দগুলো কিন্তু বিশেষ মতলবি গোষ্ঠীর। তারা এ শব্দগুলো উচ্চারণ করে তাদের বিদেশি প্রভুদের খুশি করার মাধ্যমে রাষ্ট্র ক্ষমতায় যেত এবং তা আঁকড়ে রাখত। দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর সমর্থন তাদের পক্ষে না থাকা সত্ত্বেও তারা বিদেশিদের বোঝাত, যদি আমরা ক্ষমতায় না থাকি, তাহলে এদেশ ধর্মপন্থিদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হবে। এখানে তোমাদের স্বার্থ বিঘ্নিত হবে। তাই ধর্মপ্রাণ মানুষদের দমিয়ে রাখতে হলে আমাদেরকে ক্ষমতায় রাখতে হবে। এজন্য তারা মৌলবাদী, কট্টরপন্থি এবং আরও কত কী শব্দ গড়ে দিন-রাত সেগুলোর জিগির চালাত।
সে ফ্যাসিবাদ তো এই কৌশল করেও শেষ পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকতে পারেনি। কিন্তু এখন একই সুর শোনা যাচ্ছে একটি পুরোনো বড় রাজনৈতিক দলের নেতাদের মুখে। সে দলের কার্যকর প্রধান নেতা লন্ডনে বসেই দেশে মৌলবাদের উত্থান নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করে যাচ্ছেন। লন্ডনে থাকা নেতা তো দীর্ঘদিন থেকেই স্বপ্রণোদিত নির্বাসনে রয়েছেন। বিগত সময়ে দেশে থাকলে তার কী হত, তার ওপর কী ঘটে যেত– সেটা তো আর এখন বলা যাচ্ছে না। তার সম্মানিত মাতার ওপরে কী অত্যাচার-নির্যাতন চলেছে– সেটা তো সকলেরই জানা। কিন্তু তিনি তো দেশে আসেননি। এখন দেশের ছাত্র-জনতা জীবন বাজি রেখে বহু রক্তের বিনিময়ে স্বৈরাচারের পতন ঘটাবার পর তিনি দেশে ফিরে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার স্বপ্ন দেখছেন। জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয়ে তিনি সে পদে আসীন হলে কারো আপত্তি থাকার কথা নয়। কিন্তু লন্ডনে বসে তিনি কীভাবে দেশে মৌলবাদী আবিষ্কার করছেন! এদেশের কোটি কোটি মানুষ, যারা দেশে বাস করছেন, তারা তো এমন কিছু এখানে দেখছেন না। কোনো ধর্মীয় উগ্রবাদ কারো চোখের সামনেও নেই। উগ্রবাদ তো দূরের কথা, দেশের ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলো, রাজনৈতিক, অরাজনৈতিক ধর্মভিত্তিক দল ও সংস্থাগুলো এখন অনেকটাই নীরব। তো ঐ দলটির বিদেশে থাকা ও দেশে অবস্থান করা নেতাদের এ মতলবি রঙিন চশমা পরিয়ে দিল কে এবং কীসের স্বার্থে? তারা কেন অযথা বানিয়ে কথা বলছেন?
যেহেতু বাংলাদেশী সাধারণ মানুষের কাছে এ অপকৌশল নতুন কিছু নয়, তাই এটি বুঝতে তাদের তেমন বেগ পেতে হয় না। যে দলের নেতারা এখন এসব বকছেন, আমাদের প্রতিবেশী রাষ্ট্রটির বিষয়েও সচেতন মানুষ এখন তাদেরকে সন্দেহের দৃষ্টিতে দেখছেন। যেখানে ফ্যাসিবাদই সুদীর্ঘ কাল টিকে ছিল একটি দেশের জোর সমর্থনে এবং তারা সে দেশে বসে ষঢ়যন্ত্রে লিপ্ত রয়েছে, সে দেশটি সম্পর্কে কিন্তু ক্ষমতা প্রত্যাশী এ দলের নেতাদের আচার-আচরণে মানুষ বুঝতে পারছে যে, তারা ওদেরকে হাত করেই ক্ষমতায় যেতে চায়। প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সাথে সুসম্পর্ক থাকবে– সেটি তো ভালো কথা। কিন্তু বিগত ফ্যাসিবাদীদের মতো সর্বক্ষেত্রে দেশের স্বার্থকে বিকিয়ে দিয়ে একতরফাভাবে তাদেরকে সব দিয়ে দেওয়ার নীতিও কি বর্তমান ক্ষমতা প্রত্যাশী দলটি নিয়ে নিয়েছে? তা না হলে তাদের মুখে সে দেশ সম্পর্কে কোনো কথা নেই কেন?
বিগত ফ্যাসিবাদের প্রধান তার ভাগুড়া নেতাদের নিয়ে যে সে দেশে অফিস খুলে বসেছে– এ নিয়ে তারা কেন নিশ্চুপ। এর সাথে যোগ হয়েছে, দলটির উচ্চপর্যায়ের নেতাদের ধর্মবিদ্বেষী মনোভাব। তারা ভাবছে, শুধু প্রতিবেশী রাষ্ট্রকে খুশি করে ক্ষমতায় যাওয়া কঠিনও হতে পারে; সাথে পশ্চিমা স্বার্থবাদীদের এবং এদেশের ইসলাম বিদ্বেষীদের হাত করার জন্য মৌলবাদ ও উগ্রপন্থারও আবিষ্কার করতে হবে। এবং বোঝাতে হবে, আগের সরকার যেভাবে তোমাদের স্বার্থ রক্ষা করেছে, আমরাও তা দক্ষতার সাথে করব। যদি এমনটি না হবে, তাহলে ওই নেতাদের মুখে এমন অবাস্তব উচ্চারণ কেন? এটা অবশ্য ঠিক, ইসলামের নামে রাজনীতি করা একটি দলের সমর্থন নিয়ে তারা ১৯৯১-এ ক্ষমতায় বসেছিল। ২০০১ সনে তাদের সরকারে ওই দলের দুজন মন্ত্রীও ছিলেন, সে দলটি এবার তাদের সাথে নেই। এবার হয়তো তারা ওই দলের সাথে জোট করবে না। কিন্তু এর মানে তো এই নয় যে, এজন্য উগ্রপন্থা ও মৌলবাদের জিগির তুলতে হবে!
লন্ডনে বাস করা নেতাকে মনে রাখতে হবে, মৌলবাদ একটি গালি, যা কায়েমি স্বার্থবাদীরা তাদের অসৎ উদ্দেশ্যে ব্যবহার করে থাকে। যদি সাধারণ ধর্মপ্রাণ লোকেরা ইসলামের কথা বলার কারণে মৌলবাদী হয়ে যায়, তাহলে তো তার মরহুম পিতাও মৌলবাদী ছিলেন। তিনি দেশের আপামর জনসাধারণের মন-মানস বুঝতে পেরে সংবিধানে ‘বিসমিল্লাহির রহমানির রাহিম’ যুক্ত করেছেন। ধর্মনিরপেক্ষতার স্থলে ‘মহান আল্লাহর ওপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস’ বসিয়েছেন। নিষিদ্ধ থাকা ধর্মভিত্তিক রাজনীতির পুনঃঅনুমতি দিয়েছেন। সে কারণেই দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের তার প্রতি একটা দুর্বলতা বরাবরই কাজ করে। তার প্রতিষ্ঠিত দলকে মানুষ বারবার ক্ষমতায় বসিয়েছে। বসানোর পেছনে এটিও একটি বড় কারণ।
লন্ডন প্রবাসী নেতাকে মনে রাখতে হবে, ২০০৫, ৬ সনের দিকে শায়খ আব্দুর রহমান ও বাংলা ভাইয়ের বেআইনী কর্মকাণ্ডকে কেন্দ্র করে তারা যে অযথা বিভিন্ন মাদরাসা ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের ওপর নজরদারি, দোষ চাপানো ও বাড়াবাড়ি রকমের আচরণ করেছেন এবং তার মালিকানাধীন বলে প্রসিদ্ধ চ্যানেল ওয়ান সে সময় যে বিভিন্ন জায়গায় গিয়ে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ও ধর্মীয় লোকদের হেনস্তা করে সংবাদ প্রচার করেছে, পরবর্তী নির্বাচনে তাদের ভরাডুবির পেছনে এটিও একটি কারণ ছিল।
আমরা বিনয়ের সাথে বলতে চাই এবং আগেও অনেকবার বলেছি, এদেশে রাজনীতি করতে হলে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের চিন্তা-চেতনা, মন-মানস ও বিশ্বাসকে সম্মান দেখাতে হবে। বিপরীত পথে হেঁটে ক্ষমতায় যাওয়ার চিন্তা করা উচিত নয়। কারণ তারা সে পথে কতটুকুই যেতে পারবে? ফ্যাসিবাদীরা যে স্তরে নেমে গিয়েছিল, তত নিচে কি নামতে পারবে?
অবশেষে আমরা ধর্মপ্রাণ শান্তিকামী দেশবাসীকেও এসকল উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ও অপবাক্যের ব্যাপারে সতর্ক থাকার আহ্বান জানাচ্ছি।
পাকিস্তানে ভয়াবহ বন্যায় ব্যাপক প্রাণহানি ও ক্ষয়ক্ষতি
<br> ‖ আল্লাহ তাআলা এই কঠিন বিপদ কাটিয়ে ওঠার তাওফীক দান করুন
এই আগস্টের তৃতীয় সপ্তাহে পাকিস্তানে আকস্মিক ভয়াবহ বন্যা ও ভূমিধসে ব্যাপক প্রাণহানি ও ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। ইতিমধ্যে ৭৩৯ জনের মৃত্যুর সংবাদ পাওয়া গেছে। আহত হয়েছে কমপক্ষে ৯৭৮ জন। ২৪০০ -এর বেশি ঘর-বাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এক হাজারেরও বেশি গবাদি পশু বন্যার করুণ শিকারে পরিণত হয়েছে। (উর্দু পয়েন্ট, ২২ আগস্ট ২০২৫)
দেশব্যাপী এ আকস্মিক বন্যায় ভ্রাতৃপ্রতিম মুসলিম দেশটির জনগণ অনেক কষ্টে রয়েছে। আল্লাহ তাআলা তাদেরকে এ বিপদ থেকে রক্ষা করুন। যাদের মৃত্যু হয়েছে, তাদেরকে জান্নাতুল ফিরদাউস নসীব করুন। তাদের শোকসন্তপ্ত পরিবারকে ধৈর্য ধরার তাওফীক দান করুন। বিপদ কাটিয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যাওয়ার শক্তি দিন।
এটা ঠিক যে, দেশে দেশে এসকল আকস্মিক দুর্যোগের পেছনে মানবসৃষ্ট সমস্যাগুলোকে অনেকাংশে দায়ী করা হয়ে থাকে। ব্যাপকভাবে গাছ কেটে ফেলা, যত গাছ কাটা হয় সেগুলোর জায়গায় নতুন করে সমপরিমাণ বা তারচে বেশি গাছ না লাগানো, অপরিকল্পিত কল-কারখানা স্থাপন ইত্যাদি যেসব কারণে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব বিশ্বব্যাপী দেখা যাচ্ছে, সেগুলোকেও এ ধরনের দুর্যোগের পেছনে বড় কারণ বলা হয়ে থাকে।
তার সাথে সাথে এ ধরনের বিপর্যয় আল্লাহর পক্ষ থেকে বড় পরীক্ষা– তা তো বলার অপেক্ষা রাখে না। এধরনের বিপদে যেমনিভাবে বিপদগ্রস্তদের প্রতি সহমর্মিতা দেখানো মুসলমানের দায়িত্ব, তেমনিভাবে আল্লাহমুখী হওয়া, নিজেদের ইসলাহ ও সংশোধনে মনোযোগী হওয়াও কাম্য। সাথে সাথে যেসব বাহ্যিক কারণে এসব বিপদের কথা বলা হয়, সে ব্যাপারে সচেতন ও সংশোধিত হওয়া। যেসব কারণে জলবায়ু পরিবর্তন হচ্ছে, সেসব বিষয়ে নজর দেওয়া সরকার ও সচেতন নাগরিকদের জন্য জরুরি।