গণঅভ্যুত্থানের এক বছর
‖ প্রাপ্তি ও অপ্রাপ্তির হিসাব
২০২৪ সনের ছাত্র-জনতার জুলাই গণঅভ্যুত্থানের এক বছর পূর্ণ হয়েছে। এ উপলক্ষ্যে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাজের কিছু মূল্যায়ন এবং জুলাই গণঅভ্যুত্থানের সফলতা-ব্যর্থতা নিয়ে কিছু বলার প্রয়োজন মনে করছি।
আমরা যারা কুরআন-সুন্নাহ, সীরাত ও ইসলামী ইতিহাসের ছাত্র, তারা তো মনেপ্রাণেই এ কথা বিশ্বাস করি– প্রচলিত পশ্চিমা শিক্ষাব্যবস্থা, অর্থব্যবস্থা এককথায় পশ্চিমা রাষ্ট্রব্যবস্থা বহাল রেখে কোনো সরকারই দেশ ও জনগণের জন্য প্রকৃত সফলতা আনতে পারবে না।
সত্যিকারের সফলতা তো তখন আসবে, যখন সর্বশক্তিমান সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ তাআলার দেওয়া বিধিবিধান অনুযায়ী দেশের সরকার, আইন-আদালত, শিক্ষা ও অন্যান্য বিভাগ প্রতিষ্ঠিত ও পরিচালিত হবে।
কথা বলছিলাম জুলাই গণঅভ্যুত্থান নিয়ে। এখানে দুটি বিষয় পাশাপাশি রয়েছে :
একটি হচ্ছে, ছাত্রজনতার সে ঐতিহাসিক ত্যাগ ও আন্দোলন। যা চূড়ান্ত পর্যায়ে গণঅভ্যুত্থানে রূপ নেয়।
দ্বিতীয়টি হচ্ছে, এ অভ্যুত্থানের ফলে আত্মপ্রকাশকারী অন্তর্বর্তীকালীন সরকার।
আমরা উভয় বিষয়েই সংক্ষেপে কিছু কথা আরজ করব। তবে এর আগে একটি কথা মনে রাখা দরকার। তা হচ্ছে, মানুষের সাধারণ স্বভাবের মধ্যে এটিও একটি যে, তারা দূর অতীতকে অনেক সময় তাড়াতাড়ি ভুলে যায়। নগদ বা সাম্প্রতিক বিষয়াদি দ্বারা বেশি প্রভাবিত হয়। জুলাই অভ্যুত্থানের ক্ষেত্রেও এমন একটি প্রবণতা দেখা যায়। দেশে বর্তমান পরিস্থিতি, অন্তর্বর্তী সরকারের কিছু বিতর্কিত সিদ্ধান্ত এবং বৈষম্যবিরোধী ছাত্র সমন্বয়ক দাবিদার কারো কারো নৈতিক স্খলনসহ বিভিন্ন কারণ দেখিয়ে অনেকে এমন ভাব প্রকাশ করতে চায়, যেন জুলাই অভ্যুত্থানই ভুল হয়েছে, হাসিনার থেকে যাওয়াই ভালো ছিল!
মুখোশধারী আওয়ামী দোসর মিডিয়াগুলোও এই চিন্তায় হাওয়া দিয়ে যাচ্ছে। অথচ যারা এসব বলছে, তারা এ কথা মনে রাখছে না যে, তাদের এসব মূল্যায়ন ও কথাবার্তার সুযোগ পাওয়াও জুলাই অভ্যুত্থানের সুবাদেই হয়েছে। কথা না বাড়িয়ে এবার আমরা মূল প্রসঙ্গে যাই।
হাসিনা-মুক্ত বাংলাদেশই অভ্যুত্থানের প্রধান অর্জন
ছাত্র-জনতার এই অভ্যুত্থান ছিল হাসিনা বিদায়ের। অভ্যুত্থানে এটা বলা হয়নি যে, সামনের বাংলাদেশ ছাত্রদের হবে, সামনের বাংলাদেশ উন্নত বাংলাদেশ হবে, আগামীর বাংলাদেশ ভালো হবে অথবা অমুক দল ক্ষমতায় আসবে। বরং দফা ছিল একটাই– হাসিনা ও তার সরকারের পতন। সেটা অর্জিত হয়ে গেছে ক্ষমতা ছেড়ে হাসিনার পালানোর মাধ্যমে। যারা মনে করে, এ অর্জনটা কম ছিল, তারা বোকা অথবা স্বার্থপর। অন্তত গত বছরের জুলাই-আগস্টের পূর্বেকার বছরগুলোর পরিস্থিতির চিন্তা করলে বোঝা যাবে, হাসিনার বিদায়ের চেয়ে বড় অর্জন আর বাংলাদেশে কিছু নেই। তারা যেভাবে দেশকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে গেছে, যেভাবে তাদের চৌদ্দগোষ্ঠী– বাবা, ভাই, পরিবারের নামে সব বরাদ্দ দেওয়া, গোটা দেশকে নিজেদের পৈতৃক সম্পত্তি বানিয়ে ফেলা, দালাল-দোসর দিয়ে ভরে ফেলা থেকে নিয়ে রাষ্ট্রের সকল স্তম্ভকে তারা ধ্বংস করেছে! এখন বিএনপিসহ অন্যান্য দল বড় বড় কথা বলে, দাবি-দাওয়া উঠায়– তারাই বলুক না, তারা কি গত বছর জুলাইয়ের আগে হাসিনার এভাবে এত তাড়াতাড়ি বিদায় হওয়ার কথা চিন্তাও করেছিল! সুতরাং হাসিনার বিদায় এক বিচারে এ দেশের শ্রেষ্ঠ প্রাপ্তি। তারা এতদিন ক্ষমতায় থাকলে এদেশ ও জনগণের অবস্থা কোথায় গিয়ে ঠেকত, তা চিন্তা করাও কঠিন।
১৬ বছরের স্বৈরশাসনে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত শ্রেণি
দেশ ও জনগণের ধ্বংসের কথা তো আগেই বলা হল, কিন্তু অন্য বিচারে বিগত আমলে এদেশে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে উলামায়ে কেরাম, মসজিদ-মাদরাসা। আগে সারা দেশে খুঁজে হয়তোবা এক-দুজন আওয়ামী লীগ হুজুর পাওয়া যেত। কিন্তু বিগত আমলে শুধু ধর্মীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতেই তারা হানা দেয়নি; বরং বড় বড় দ্বীনী বোর্ডগুলোকেও পরোক্ষভাবে তাদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নিয়েছিল। মাদরাসা শিক্ষা বোর্ডগুলোর স্বকীয়তা ধ্বংস করে দিয়েছিল। বোর্ডের কে প্রধান হবে, কে সেক্রেটারি হবে– তারাই ঠিক করে দিত। যে হেফাজতে ইসলাম প্রতিষ্ঠিতই হয়েছিল শয়তানদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার জন্য; শেষ পর্যন্ত এ হেফাজতে ইসলামকেই তারা গ্রাস করে ফেলে। কার কোন্ পদ থাকবে, সভায় কী সিদ্ধান্ত হবে, এসবকিছু সরকারের গোয়েন্দারাই ঠিক করে দিত। শুধু কি তাই, কওমী ঘরানার অধিকাংশ রাজনৈতিক দলই তাদের কবজায় চলে গিয়েছিল। এক শ্রেণির কিছু আলেম তো প্রকাশ্যে খোশ দিলে দেদারসে হাসিনা ও তার বাবার প্রশংসা গেয়ে নিজেকে সম্মানিত অনুভব করত।
হেফাজতে ইসলামের কথা তো একটু আগে বললাম। বোর্ডগুলোর কথাও বলা হল। যাদের কাছে এগুলো হালকা জিনিস, তারা তো মৃতপ্রাণ। এগুলো কি হালকা মনে হয়? যারা মানুষের ঈমান রক্ষা করবে, তারা যদি অন্যের অনুগামী হয়ে যায়, তারা যদি দুষ্ট লোকদের অনুচর হয়ে যায়, তারা যদি দুষ্ট লোকদের দ্বারা পরিচালিত হয়, তারা দ্বীনের কাজ কী করবে? তখন তো দ্বীন ও ইসলামের চেয়ে নিজের স্বার্থ ও পদ-পদবি মুখ্য হয়ে দাঁড়াবে। মানুষ তাদের ওপর আস্থা রাখবে কীভাবে?
মসজিদ-মাদরাসাগুলো থাকুক রাজনৈতিক প্রভাব-মুক্ত
আমি যেখানে সুযোগ হয় সেখানেই বলি, মসজিদগুলোতে রাজনীতি করতে দেবেন না। মসজিদগুলোতে হাসিনা তার লোকজন ঢুকিয়ে সাধারণ মুসলমানদের ইবাদতের জায়গাগুলোকেও কলুষিত ও দলীয়করণ করেছে।
ওইদিন দারুল ইফতায় একজন হুজুর এসেছেন। তাদের মসজিদের ওপর দিয়ে সরকার রাস্তা নেবে। এর বিরুদ্ধে তারা আন্দোলন করছে। সরকারি দফতরে লোকজন নিয়ে গেছেন। লোকটি কথায় কথায় বললেন, তাদের সাথে বিএনপির এক নেতাও ছিল।
একথা শুনে সাথে সাথে আমার মুখ দিয়ে বের হয়ে গেছে, এটা আবার করতে গেলেন কেন? বিএনপির নেতা নিয়ে যাওয়ার দরকার কী? না, এমনিতে তো বিষয়টি দোষের না। কারণ বিএনপি নেতাও একজন মুসল্লি। কিন্তু ঐ যে মসজিদে রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ! মসজিদ রাজনৈতিক-অরাজনৈতিক নেতা ও সাধারণ মানুষ সকলের ইবাদতের জায়গা। এখানের সকল মুসল্লির একটাই পরিচয় থাকবে– তারা সকলে আল্লাহর গোলাম। এখানে কেউই নেতা নন। একমাত্র ইমাম তাদের সকলের আমীর।
যাহোক আমি তাকে বোঝাতে চেয়েছিলাম, মসজিদ-মাদরাসাগুলো দলীয় রাজনীতিকদের দ্বারা পরিচালিত না হওয়া উচিত। এখন তো মানুষ এসবে অভ্যস্ত হয়ে গেছে। মসজিদ কমিটির দায়িত্বে রাজনৈতিক নেতারা বসে যায়। গত আমলে এটা হয়েছে। মসজিদের সকল কাজ ওদের মনমতো চলতে হত। তাদের অপকর্মের বিরুদ্ধে মসজিদে বলার তো সুযোগ ছিলই না, এমনকি নরেন্দ্র মোদীর মুসলিম নিধনের বিরুদ্ধে কথা বলতে গিয়েও আওয়ামী নেতাদের দাপটে অনেক ইমাম মসজিদের ইমামতি হারিয়েছেন।
এখন অনেক জায়গায় দেখা যায়, বিএনপির লোকেরাও মসজিদ কমিটিগুলো দখল করছে। ওই যে পুরোনো কালচার রয়ে গেছে। ওই যে আমাদের অনুভূতি নষ্ট হয়ে গেছে। আমরা এসবে বাধা দেই না। অথচ জনগণকে নিয়ে এসবের প্রতিরোধ করা সম্ভব।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সফলতা-ব্যর্থতা
অর্জনের কথা যদি বলা হয়, তাহলে সর্ববৃহৎ অর্জন তো হাসিনার পতনের মাধ্যমেই হয়ে গেছে। এটা হল যদি আমরা জুলাই অভ্যুত্থানের কথা বলি। কিন্তু অন্তর্বর্তীকালীন সরকার কতটুকু সফল আর কতটুকু ব্যর্থ– সে প্রশ্নে যদি আসি তবে এ মূল্যায়নের আগে একটি কথা বোঝা দরকার, তা হচ্ছে, এমন একটা অভ্যুত্থানের পর মানুষের চাওয়া কী থাকে? মানুষের চাওয়া থাকে অভ্যুত্থানের আগে দেশে যত অনিয়ম ও অনৈতিকতা ছিল, সেগুলো যেন দ্রুত সংশোধন হয়ে যায়। দেশ যেন এখন ভালোর দিকে যায়। এ চাওয়া তো স্বাভাবিক। মানুষ চাইতেই পারে। যারা খারাপ করছিল, তারা চলে গেছে। এখনো কেন খারাপ থাকবে। এই অভ্যুত্থান-পরবর্তী চাপ অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ওপর এসেছে।
কিন্তু অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাজের মূল্যায়নের আগে বুঝতে হবে, দেশের শাসনব্যবস্থা তো আর পরিবর্তন হয়ে যায়নি, দেশের অর্থনৈতিক ব্যবস্থা তো পরিবর্তন হয়নি। তাই সবকিছু পরিবর্তন হয়ে যাওয়া তো কঠিন। দেশ এতদিন যে ব্যবস্থায় চলছিল, সে ব্যবস্থার ওপরই আছে। তবুও আমাদের মনে হয় অন্তর্বর্তীকালীন সরকার সম্ভবত অগ্রাধিকার নির্ণয়ে ভুল করেছে। ক্ষমতায় বসেই অনতিবিলম্বে কিছু কাজ করে ফেলা তাদের দরকার ছিল। এখন যেগুলো করতে গেলে পেছন থেকে বাধা দেওয়ার মতো অনেক শক্তি দাঁড়িয়ে গেছে। তখন ওই কাজগুলো করে ফেললে বাধা দেওয়ার মতো কেউ থাকত না। তখন জনতার স্রোত ছিল, আন্দোলনের পক্ষে আওয়াজ ছিল, ডাক দিলে আবার রাজপথ জমে উঠত। তারা সেই অগ্রাধিকার ঠিক করতে পারেনি। সংবিধানে হাত না দিয়েও অনেক কিছুই সংশোধন করে ফেলা যায়। সরকার সেসব না করে সম্ভবত সঠিক পথে হাঁটেনি।
উপদেষ্টা পরিষদ
ইউনূস সাহেব প্রধান উপদেষ্টা হওয়ার সংবাদ জানতে পেরে সম্ভবত কিছু উপদেষ্টার নাম নিজেই বলে দিয়েছেন। কিছু এনজিও সদস্য, কিছু নারীর নাম তাঁরই প্রস্তাব করা। হয়তোবা এজন্য, যেন তাঁর দল ভারি হয়। পক্ষের লোক বেশি থাকে। তিনি কোনো সিদ্ধান্ত নিতে চাইলে ভোট বেশি পাবেন। দ্বিতীয়ত তিনি নিজে অনেক বছর ধরে এনজিও চালিয়ে আসছেন। তিনি মনে করেছেন, তাদের মাধ্যমে তিনি কাজ করিয়ে নেবেন। তারা ভালো-মন্দ যতটুকুই পারুক, উল্টো কিছু করবে না। যদিও পরবর্তীতে তাদের অনেককেই অভিজ্ঞ মহলের কাছে উপযুক্ত মনে হয়নি। রাষ্ট্র চালানো এবং এনজিও চালানো তো এক কথা নয়। দুইটা দুই জিনিস।
এজেন্ডাহীন উপদেষ্টা
এরচেয়ে বড় কথা হল, অল্প কয়েকজন ছাড়া অধিকাংশ উপদেষ্টাকেই ইতিবাচক অবস্থানে দেখা যায়নি।
অভ্যুত্থান পরবর্তী সরকারের একটি কেবিনেটের মূল এজেন্ডাই তো হওয়া উচিত ছিল স্বৈরাচারের দোসরদের রাষ্ট্রের সকল স্তর থেকে সমূলে বিদায় করা। হাসিনাসহ না হয় কয়েকজন দেশ ছেড়ে পালিয়েছে; কিন্তু আরও তো শত শত লোক নিয়ে সে চলেছে। হাজারো লোক তাদের দোসর ছিল। প্রত্যেকটা দোসরকে পাকড়াও করা, বিচারের আওতায় আনার কোনো তৎপরতাই ওই উপদেষ্টাদের মধ্যে দেখা যায়নি। দক্ষতা দেখাতে না পারলেও এ কারণে কোনো উপদেষ্টা এখন পর্যন্ত পদত্যাগও করেননি।
এদেশে বিদায় করে দেওয়ার রেওয়াজ কম। বিদায় হয়ে যাওয়ারও রেওয়াজ কম। বিদেশে এমনটা হয় না। শেখ রেহানার মেয়ে টিউলিপ সিদ্দিকি, যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রীর বন্ধু। আমাদের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার যখন টিউলিপের বিরুদ্ধে দুর্নীতির তথ্য ও অভিযোগ এনেছে, তখন তাকে মন্ত্রীর পদ থেকে সরিয়ে দিয়েছে ব্রিটিশ সরকার। সেসব দেশে ব্যক্তির চেয়ে রাষ্ট্র ও সরকারের ইমেজকে বড় করে দেখা হয়। তাই তদন্তের স্বার্থে সরিয়ে দেওয়া হয়। তদন্তের পর নির্দোষ প্রমাণিত হলে ফিরিয়ে আনা হয়। টিউলিপের ইস্তফার দরুন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীও দুঃখ প্রকাশ করেছেন।
এদেশে এটার রেওয়াজ নেই। উচিত ছিল কিছু উপদেষ্টাকে সরিয়ে দেওয়া। ইউনূস সাহেব সে সাহস দেখাননি। এরা বসে শুধু রুটিন কাজ চালিয়েছে। ভবিষ্যতে টিকতে হলে যে ময়দান পরিষ্কার করতে হবে, সে কাজ তারা করেনি। পুলিশের মধ্যে এ পরিচ্ছন্নতার কাজ কিছুটা হয়েছে। পুলিশের কিছু পদস্থ অফিসার তো আগেই পালিয়েছে। যার দরুন গত বছর আগস্টে দেশে কিছুদিন পুলিশ প্রশাসনই ছিল না। কিন্তু জনপ্রশাসন– সরকারি অফিসার, গোয়েন্দা বিভাগ, অন্যান্য সেক্টরের যারা আছেন, এমনকি আর্মির প্রথম সারির কিছু লোক ছাড়া বাকিদের মধ্যে সরকার চাইলেই বেছে বেছে ফ্যাসিবাদের দালাল/দোসরদের সরিয়ে দিতে পারত। বেসামরিক কর্মচারীদের ২৫ বছর হলেই তো অবসরে পাঠানো যায়। আর সামরিকদের তো আরও অনেক কম বছরেই তা সম্ভব।
এতদিন পরে সরকারের টনক নড়েছে। তারা যখন দেখতে পেয়েছে সচিবালয়, এনবিআরসহ বিভিন্ন স্তরের কর্মকর্তারা আন্দোলন করতে গিয়ে বিদ্রোহের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে গেছে, তখন সরকার একটু কড়া হয়ে উঠেছে। এখন তারা ফ্যাসিবাদের কিছু দোসরকে চাকরিচ্যুত করেছে।
সরকার যা করতে পারত
শুরুতেই আগের সরকারের আমলের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের সচিবসহ অন্যান্য বড় জায়গাগুলোতে দায়িত্বে থাকা ফ্যাসিবাদের দোসরদের বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠাতে পারত। ঠিক যে নিয়মের ভিত্তিতে এখন কারো কারো ক্ষেত্রে এমনটি করা হয়েছে।
অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পরেই বিভিন্ন সময় দেখা গেছে, প্রধান উপদেষ্টার দপ্তর যমুনা ঘেরাও করে রেখেছে বিভিন্ন স্তরের সরকারি চাকরিজীবীসহ অন্যান্য বিভিন্ন গোষ্ঠী। সরকার এটা করতে দেবে কেন? সরকার অকারণেই এসব বিষয়ে নমনীয়তা দেখিয়েছে। সময় মতো কঠোর হয়নি। যা অনেকের চোখে তাদেরকে দুর্বল চিহ্নিত করেছে।
এ সরকার বসেই দুটি দলের উপর থেকে নিচের নেতাকর্মীদের বিনা বাক্যে ছেড়ে দিল, তাদের মামলা শেষ করে দেওয়ার সব আয়োজন করল। আমরা বলছি না, কারো নামে হওয়া অন্যায় মামলা সচল রাখতে হবে। কিন্তু এ কাজটি যথানিয়মে হতে পারত। এরপরে কী দেখা গেল? পুরোনো বড় দলটির কিছু নেতা সরকারের বিরুদ্ধে সরব হয়ে উঠেছে। তাদের সাথে যোগ হয়েছে বিগত আমলের সুবিধাভোগী মিডিয়া গোষ্ঠী। অনেকেই বলছেন, তাদের পেছনে কাজ করছে মুখোশধারী পতিত আওয়ামী গোষ্ঠীও।
একটি উদাহরণ দেওয়া যায়, অনেকে অবাক বিস্ময়ে পুরোনো দলটির একজন বড় নেতার কার্মকাণ্ড অবলোকন করেছেন। যিনি কিনা বিগত ফ্যাসিবাদী সরকারের সময় ভারতের একটি অঞ্চলে বিতাড়িত হয়েছিলেন। সেখানে তার নামে মামলা হয়। একসময় তিনি সে দেশের জেল থেকে মুক্তিও পান; কিন্তু এর পরও কয়েক বছর তিনি ভারতেই থেকে যান। কেন তিনি সেখানে থেকে গেলেন? সে দেশের কাদের সাথে তার সময় কেটেছে– এসব কিছু জনগণের কাছে স্পষ্ট নয়। যাহোক অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সময় তিনি দেশে ফিরে আসেন। এরপর থেকে তিনি মহা বিপ্লবী নেতা। তার দলের যারা দেশে থেকে জেল-জুলুম খেটেছেন, তাদের চেয়েও এ ব্যক্তির গলার স্বর বেশ উঁচু এবং তিনি অনেক বেশি আক্রমণাত্মক! এসবের পেছনের কারণ আম জনতার অজানা।
বর্তমান আমলে দুর্নীতি
ছাত্র উপদেষ্টাদের তো অভিজ্ঞতা ছিল না। ছাত্র থেকে একেবারে মন্ত্রণালয়ে চলে এসেছে। অন্য যেসকল বয়স্ক উপদেষ্টা আছেন, তাদের অগ্রাধিকারেও দোসরদের দমনের বিষয়টি ছিল না। তাদের অগ্রাধিকারে ছিল মন্ত্রণালয়গুলো ঠিকমতো চালানো, দুর্নীতিমুক্ত রাখার বিষয়গুলো হয়তো ছিল। সরকারের অর্জনের মধ্যে এগুলোও কম অর্জন নয়। একটি সরকার এতদিন পর্যন্ত আছে, তাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির তেমন কোনো বড় অভিযোগ শোনা যাচ্ছে না, সেটাও কম কথা নয়। দুয়েকজন উপদেষ্টার পিএ-পিএস দুর্নীতিতে জড়িয়েছিল, তাদের উপদেষ্টারাই গ্রেফতারের সুযোগ করে দিয়েছেন। কিন্তু উপদেষ্টা বা তাদের আত্মীয়স্বজনের মাধ্যমে দুর্নীতি না হওয়াই কি যথেষ্ট? প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরের দুর্নীতি কি বন্ধ হয়েছে বা হ্রাস পেয়েছে? সেগুলো তো আপন গতিতেই চলছে। দায়িত্বশীলদের নিজেদের দুর্নীতিমুক্ত থাকার সাথে সাথে তাদের অধীনস্ত কর্মীদেরও দুর্নীতিমুক্ত রাখতে হবে।
স্বৈরাচারের বিচারে বিলম্ব
আমরা আগেও আলকাউসারের পাতায় বলেছি, সরকার তার মনোযোগ এমন খাতে ব্যয় করছে, যা রাজনৈতিক দলগুলোর ঐকমত্য ছাড়া বাস্তবায়ন করা অসম্ভব। এই যে তারা সংস্কারের পেছনে একটি বছর শেষ করে দিল, সে সংস্কারের কয়টি বিষয়ে ঐকমত্য হয়েছে এবং আরও নির্দিষ্ট করে বলতে গেলে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন কর্তৃক প্রস্তাবিত সংস্কারসমূহের কয়টিইবা দেশ ও জনগণের জন্য বাস্তবে কল্যাণকর? তো সংস্কারের এ দীর্ঘসূত্রিতা তার জায়গায় রেখে সরকার যদি হাসিনা ও তার বড় বড় কিছু দোসরের বিচারকাজ সম্পন্ন করতে পারত– অন্তত বিভিন্ন সেক্টর থেকে বড় বড় কিছু দুষ্কৃতিকারী রাঘববোয়ালের কঠোর শাস্তি শোনানো যেত এবং দেশে যারা ভাগ্যের পরিহাসে বন্দি হয়ে গেছে, তারাও যদি শাস্তি পাওয়া শুরু হয়ে যেত, তাহলে সেটি হত একটি দৃষ্টান্তমূলক কাজ। সরকার প্রথম দিন থেকে বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠন করে এ কাজগুলোকে এগিয়ে নিলে জনমনে একটি আশার সঞ্চার হত।
দুষ্কৃতিকারীদের শাস্তি পাওয়ার দ্বারা ভবিষ্যতে ক্ষমতাবানরা সতর্ক হতে বাধ্য হত। কিন্তু পরিতাপের বিষয় হচ্ছে, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এ কাজটি করেনি। যদি তারা ক্ষমতায় থাকতে এ কাজ শেষ করতে না পারে, তবে এটি কেবল তাদের বড় ব্যর্থতার প্রমাণই হবে না; বরং ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের জন্য ভুল বার্তাও বহন করবে। যে যত বড় অন্যায় করুক, ক্ষমতার দাপট থাকলে সে ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যায়, এমনকি ক্ষমতাচ্যুত হয়ে গেলেও।
প্রসঙ্গ মিডিয়া হাউস
গণমাধ্যমের ব্যাপারে বিশ্বব্যাপী ফ্যাসিবাদী ও একনায়কদের দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টে গেছে বেশ কিছু বছর আগেই। একসময় তো তারা নিজেদের কুকীর্তি ঢেকে রাখার জন্য গণমাধ্যমকে নিয়ন্ত্রণ করত, সেন্সরশিপ আরোপ করত। কিন্তু পরবর্তীতে তারা ভিন্ন পথ অবলম্বন করে। তাদের নিজেদের লোকদেরকে দিয়ে দেয় পত্রিকা-রেডিও ও টেলিভিশন চ্যানেলের মালিকানা। সেগুলোতে তাদের পা চাটা সুবিধাভোগী একশ্রেণির সম্পাদক, সাংবাদিক, কলামিস্ট, টকশো বক্তা এবং বহু মতলববাজ শিক্ষাবিদ ও পেশাজীবীও রাত-দিন সরকারের কুকর্মগুলোকে ভালো কাজ হিসেবে প্রচার করতে থাকে এবং মিথ্যা বানিয়ে বানিয়ে সরকারের কীর্তি প্রচার করতে থাকে। পতিত হাসিনা সরকারও এ কাজটি করেছিল। তার পতনের পর সে ভুঁইফোঁড় দালাল মিডিয়া হাউসগুলো বহাল তবিয়তেই থেকে গেছে। সময়ের প্রয়োজনে কিছু দিন তাদের কেউ কেউ হয়তো মুখোশ পরেছে। কিন্তু এখন আবার তাদের আপন মিশনে ফিরে এসেছে।
অনেকে মনে করেন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বিগত সময়ে মিডিয়া সংশ্লিষ্ট দালাল-দোসরদের অগ্রাধিকার ভিত্তিতে শাস্তির ব্যবস্থা না নিয়ে ভুল করেছে, যার খেসারত এখন তাদেরকেও দিতে হচ্ছে।
প্রসঙ্গ সংস্কার
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রতিষ্ঠিত জাতীয় ঐকমত্য কমিশন নিয়ে কাজ করে যাচ্ছেন অধ্যাপক আলী রীয়াজ। সেখানে যেসব বিষয় নিয়ে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠার জন্য তোড়জোড় চলছে, সেগুলো নিয়েও অভিজ্ঞ মহলে ব্যাপক বিতর্ক রয়েছে। যেমন, দ্বিকক্ষবিশিষ্ট পার্লামেন্ট, নারীদের জন্য ১০০ আসন সংরক্ষণ ইত্যাদি।
একথা মনে রাখা দরকার, সংস্কারের নামে এ সরকারের দ্বারা দেশ ও জনগণের চূড়ান্ত বিচারে ক্ষতি হয়, এমন কিছু যেন প্রতিষ্ঠিত না হয়ে যায়। প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সেদিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখা উচিত।
জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশনের দপ্তরসহ বিদেশি বিভিন্ন বিষয়ে বিতর্কে জড়ানো
বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার যে প্রকৃতির, তাদের থেকে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন প্রভাবশালী গোষ্ঠী এমন কিছু বাড়তি সুবিধা আদায় করতে চায়, যা অনেক সময় সত্যিকার অর্থে নির্বাচিত সরকার থেকে আদায় করা সহজ হয় না।
সত্যিকারের গণতান্ত্রিক সরকার এমন সিদ্ধান্ত নিতে ভয় পায়, যা তাদেরকে অজনপ্রিয় করে তুলবে। ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার জনসাধারণের ব্যাপক বিরোধিতার মুখেও এমন কিছু বিতর্কিত সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, যা ব্যাপকভাবে তাদেরকে জনগণের কাছে বিরাগভাজন করেছে। তার মধ্যে একটি হল জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশনকে এদেশে দপ্তর খুলতে দেওয়া। এ সংস্থাটির নামের সাথে ‘মানবাধিকার’ শব্দ থাকলেও তারা যে প্রকৃত অর্থে বিশ্বের দেশে দেশে মজলুম মানুষের অধিকার রক্ষায় চরমভাবে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়ে যাচ্ছে, তা কার অজানা। যারা এত বছরেও গাজা-ফিলিস্তিন ও কাশ্মীরসহ পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষ, বিশেষত নারী-শিশুর জান-মাল ও ইজ্জত রক্ষা করতে পারেনি, যাদের চোখের সামনে ত্রাণের মালামাল ঢুকতে না দিয়ে অনাহারে মারা হচ্ছে হাজার হাজার শিশুকে, তাদের মুখে মানবাধিকার শব্দ বড়ই বেমানান। এছাড়া ভালো তেমন কিছু না করতে পারলেও মুসলিম সভ্যতা-সংস্কৃতি বিরোধী অনেক কিছুই তাদের কাছে মানবাধিকার; যা তারা দেশে দেশে প্রতিষ্ঠা করতে উদ্যোগী হয়ে থাকে। তাদের কাছে তো এলজিবিটিকিউ-এর মতো অসভ্যতা ও মানবতাবিরোধী কাজও একটি অধিকার এবং এদেশেও তারা ও তাদের অনুসারীরা ওসব বকওয়াস করে থাকে। সঙ্গত কারণেই এদেশের সাধারণ মানুষ বাংলাদেশে এ সংস্থার দপ্তর খুলতে বারণ করে আসছে। কিন্তু সরকার ব্যাপক গণ দাবির তোয়াক্কা করেনি। এহেন কর্মকাণ্ড এমন অসংখ্য লোককেও সরকারের বিরোধী করে তুলেছে, যারা সময়ের প্রয়োজনে এ সরকারকে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছিল। মনে রাখতে হবে, দেশের ধর্মপ্রাণ মানুষ ফুঁসে উঠলে সরকারের জন্য ক্ষমতা ধরে রাখা সহজ হবে না।
সারকথা
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের বিভিন্ন ব্যর্থতা সত্ত্বেও সফলতা ও ভালো কাজও রয়েছে। কিন্তু তাদের অগ্রাধিকার নির্ণয়ে ভিন্ন চিন্তা এবং কিছু কিছু জনবিরোধী সিদ্ধান্ত যত দিন যাচ্ছে তাদেরকে জনসমর্থনে তলানির দিকে নিয়ে যাচ্ছে। ভুলে গেলে চলবে না, ভালো মানুষদের নিরঙ্কুশ সমর্থন কখনো নিঃশর্ত ও বিনা বাক্যে স্থায়ী থাকবে না।
তাই সময় থাকতে এ সরকারের সতর্ক হওয়া দরকার। আল্লাহ্ই তাওফীক দানকারী।