কাঁদুন আল্লাহর জন্য
‖ বেয়াদব বাউলের জন্য নয়
কথিত বাউল শিল্পীদের নেতৃস্থানীয় এক ব্যক্তির নাম আবুল হোসেন সরকার; বাউল আবুল সরকার। এই নভেম্বরের শুরুর দিকে বাউল গানের একটি অনুষ্ঠানে উচ্চারিত আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলার প্রতি চরম কটূক্তিমূলক কিছু কথা প্রকাশ্যে আসে এবং ব্যাপকভাবে সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হয়। উক্তিটি ছিল এমন যে, তাতে ধর্মপ্রাণ শুধু নন, বিচার-বিবেচনাসম্পন্ন মানুষ মাত্রেরই মনে ধাক্কা লাগার কথা এবং ক্ষুব্ধ হওয়ার কথা।
হয়েছেও তাই; বিভিন্ন মাধ্যমে দেশব্যাপী ক্ষুব্ধতার প্রকাশ ঘটেছে ও তাকে গ্রেফতার করে শাস্তি দেওয়ার দাবি জানানো হয়েছে। গত ২০ নভেম্বর ঢাকার বাইরে বাউল গানের একটি আয়োজন থেকে পুলিশ তাকে গ্রেফতার করেছে।
দুই.
আল্লাহ তাআলার বিষয়ে প্রকাশ্য কটূক্তির কারণে একজন নাগরিককে জনদাবির প্রেক্ষিতে গ্রেফতার করার ঘটনাটি ছিল স্বাভাবিক। কিন্তু ঘটনার তিন দিন পর ২৪ নভেম্বর থেকে পরিস্থিতি আরেকদিকে টেনে নেওয়ার চেষ্টা করা হয়। ওইদিন গ্রেফতার হওয়া বাউলের অনুসারীরা মানিকগঞ্জে স্থানীয় আলেম-উলামা ও তাওহীদী জনতার সমাবেশের আশেপাশে ঘুরঘুর করতে থাকায় সেখানে উত্তেজনা ও সন্দেহের উদ্রেক হয়। কিছু ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। গ্রেফতার ও মানিকগঞ্জের ঘটনাকে নিয়ে শুরু হয় নতুন মহড়া।
সেদিন মানিকগঞ্জে আবুলের বিচার দাবিকারী ও আবুলের অনুসারী উভয় পক্ষের সমাবেশ/মানববন্ধন ছিল। স্থানীয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে উভয় পক্ষকে আলাদা আলাদা স্থান ও সময় নির্ধারণ করে দেওয়া হয়। আলেম-উলামা ও তাওহীদী জনতা নির্ধারিত স্থান ও সময় অনুযায়ী মিছিল-সমাবেশ করছিলেন। কিন্তু তাদের সমাবেশের শেষ সময়ে সমাবেশ-স্থলের আশেপাশে বাউলের অনুসারী কিছু লোকজনকে ঘুরঘুর করতে দেখা যাওয়ায় উত্তেজনা তৈরি হয়।
স্থানীয় আলেম-উলামার পক্ষ থেকে পরে সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়েছে, ওইদিন বাউল আবুল সরকারের অনুসারীদের আচরণ ছিল উসকানিমূলক। তাদের সমাবেশের ভেন্যু ও সময় ভিন্ন ছিল। তারা আলেম-উলামা ও তাওহীদী জনতার সমাবেশের আশেপাশে উপস্থিত থাকায় উত্তেজনা তৈরি হয়েছে।
তিন.
এরপর মানিকগঞ্জ শহরের ২৪ নভেম্বরের ঘটনার ছুতো ধরে পরদিন ঢাকায় ‘বাউলদের ওপর হামলা’-বিরোধী সমাবেশ করা হয়। সেখানে নেতৃত্ব দিতে দেখা যায়, বাউলবেশী এক পরিচিত শহুরে বুদ্ধিজীবীকে। আড়াই শ’জনের মতো নাগরিক বিবৃতি দেয় বাউলদের পক্ষে। দেশে শিক্ষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি সবকিছু শেষ করে দেওয়া হল বলে মাতম শুরু করে দেওয়া হয়। আর প্রভাবশালী মিডিয়াগুলো আবুলের কটূক্তির অপরাধের চেয়ে প্রতিবাদী মানুষকে ‘বড় অপরাধী’ হিসেবে উপস্থাপনে সচেষ্ট হয়ে ওঠে।
বাউলবেশী রাজনৈতিক বুদ্ধিজীবী, বিবৃতিদাতা আড়াই শ এবং সুযোগসন্ধানী একশ্রেণির মিডিয়া একযোগে ইসলাম অবমাননাকারী ও আল্লাহ তাআলার প্রতি কটূক্তিকারী বাউলকে মুক্তি দেওয়ার দাবি জানায়। তারা কটূক্তির অপরাধে অপরাধীকে মুক্তি দেওয়ার কথা বললেও প্রতিবাদী ধর্মপ্রাণ মানুষের কঠোর শাস্তি দাবি করে। তারা দাবি করে, প্রতিবাদীদের কেউ কেউ ঘটনাস্থলে ঘটনাক্রমে বাউলদের তৈরি করা উত্তেজনায় ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার ঘটনায় জড়িয়ে পড়েছিলেন।
চার.
এ দেশে দলের নেতার বিরুদ্ধে কটূক্তি করলে বিনা প্রশ্নে মামলা হয়, গ্রেফতার হয়। আদালত, ইতিহাস কিংবা স্বীকৃত শ্রেণির বিরুদ্ধে কথা বললে আইনি ব্যবস্থা অবধারিত হয়। সেখানে আল্লাহ তাআলার সঙ্গে চরম বেয়াদবি প্রকাশ হলেও তার শাস্তি ও বিচার নিয়ে টালবাহানা করাটা যে কত বড় ধৃষ্টতা ও অযৌক্তিক প্রবণতা তা বলাই বাহুল্য। দেখা যাচ্ছে, একশ্রেণির বুদ্ধিজীবী, রাজনীতিক ও মিডিয়াবাজদের কাছে আল্লাহ তাআলার সঙ্গে বেয়াদবি-কটূক্তি ও ইসলাম অবমাননার ইস্যুর চেয়ে কটূক্তিকারী বাউলদের মর্যাদা ও নিরাপত্তার ইস্যু অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
এখন তো ময়দানে সেক্যুলার আওয়ামী লীগ নেই, বাম ইনু-মেনন নেই। কিন্তু কথিত জাতীয়তাবাদের বড় দলের মহাসচিব থেকে নিয়ে অভ্যুত্থানের ছাত্রদের দলের বিবৃতিতেও ভ্রষ্টবাদী বাউলদের জন্য কান্নার ধ্বনি উচ্চারিত হয়, বেয়াদব বাউলের মুক্তি দাবি করা হয়; কিন্তু মহান সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ তাআলার প্রতি চরম কটূক্তির শাস্তি দাবি করা হয় না!
আরে, নিজেদের মধ্যে যদি এইসব লোক ও দলের ন্যূনতম ইনসাফবোধ থাকত, তাহলে অন্তত অন্যসব দাবির সঙ্গে ইসলাম-অবমাননা ও কটূক্তির শাস্তির দাবিটাও তারা করতেন!
পাঁচ.
বাউলদের সম্পর্কে যারা খোঁজখবর রাখেন এবং এদের বিশ্বাস, ধর্মাচার, জীবনধারা ও যৌনাচার সম্পর্কে লিখিত বইপত্র উল্টে-পাল্টে দেখেছেন, তাদের বেশিরভাগেরই মত, এদের বিশ্বাস ও জীবনধারা ভ্রষ্টতায় ভরা। বিশেষত ইসলামের মৌলিক বহু বিশ্বাস ও বিধান নিয়ে এদের বিপথগামী চর্চার মাত্রা-সংখ্যা অনেক। আল্লাহ তাআলা, কুরআন, নবীজী, নবীজীর পরিবার, হাদীস-সুন্নাহ, নমায, রোযা, হজ্ব, কা‘বা নিয়ে তাদের বহুরকম পতিত ভ্রান্ত বিশ্বাস ও কটূক্তি পাওয়া যায়। গ্রেফতার আবুল সরকার সেই ভ্রান্ত বাউল সম্প্রদায়ের একজন নেতা ‘মহারাজ’ পর্যায়ের সাধু। দ্বীনের সম্মানিত বিষয়ে তার মুখের ভাষার দুর্গন্ধ, নীচতা ও অশ্লীলতা থেকে বোঝা যায়– এই গোষ্ঠীটির বাকিদের অবস্থা কী!
এখানে ইস্যুটা গানবাদ্যের বৈধতা-অবৈধতার না, শ্লীলতা-অশ্লীলতার, গুনাহ ও পাপেরও না। এগুলো তো গুনাহ হিসেবে আছেই। বাউল আবুল সরকারের ধৃষ্টতা ও শাস্তি-অপরিহার্যতা এজন্য না যে, সে বাউল বা সে গানের আসর করে। এদেশে গানবাদ্যের, হারাম বিনোদনের গুনাহ অনেক ব্যক্তি ও গোষ্ঠীই করে। তাদের কাজটা কবীরা গুনাহ– মানুষ জানে, অপছন্দ করে। কিন্তু বেদনা ও ক্ষোভে ফেটে পড়ে না এবং শাস্তি দাবি করে না। আবুল সরকারের শাস্তি ও বিচার দাবি করা হয়েছে এজন্য যে, সে আল্লাহ তাআলার সঙ্গে চরম বেয়াদবি করেছে। এটা শিল্প-সংস্কৃতির কোনো ইস্যু না, একশ্রেণির লোক যেমন দাবি করে থাকে; বরং এটা দ্বীনদ্রোহিতার ইস্যু। আল্লাহ তাআলার সঙ্গে বেয়াদবির ইস্যু, মুসলিমদের হৃদয় রক্তাক্ত করার ইস্যু।
ছয়.
কিছু বুদ্ধিজীবী, রাজনৈতিক দল ও নেতা এবং কিছু মিডিয়া ও সুশীল নাগরিক বিষয়টাকে যথাযথভাবে এড্রেস করছেন না কিংবা করতে চাচ্ছেন না। জাতির সাথে এবং ইনসাফের সাথে এটা তাদের লুকোচুরি। কই তারা আল্লাহর জন্য কাঁদবেন! তারা কাঁদছেন বেয়াদব ভ্রষ্টাচারী বাউলের জন্য!! এটা অত্যন্ত মন্দ পরিস্থিতি। তওবা ও প্রত্যাবর্তন ছাড়া এই বেদনাবহ পরিস্থিতি থেকে মুক্ত হওয়া কঠিন। আল্লাহ তাআলা সবাইকে তাওফীক দিন।
আমরা আইন, বিচার ও শৃঙ্খলার পক্ষে, আইন হাতে তুলে নেওয়ার বিপক্ষে। কিন্তু বারবার বিচারপ্রাপ্তি থেকে বঞ্চনা ও অনাস্থা মানুষকে উছৃঙ্খলার দিকে ঠেলে দেয়। আবুলের বেয়াদবি ও ধৃষ্টতার স্পষ্ট বিচার হওয়া জরুরি। আইনের শৃঙ্খলা বজায় রাখার প্রয়োজনে এবং আইন হাতে তুলে নেওয়ার চোরা পথ বন্ধের প্রয়োজনেও। যারা আইনের শাসন চান, তারা আবুলের মুক্তি চাইতে পারেন না, তারা আবুলের বিচার চাইতে পারেন। অপরাধী জেনেও যারা আবুল সরকারের বিচার চাইছেন না, বুঝতে হবে, প্রকারান্তরে তারাই আইন হাতে তুলে নিতে চাইছেন। আইনের গতি রুদ্ধ করতে চাইছেন। এটা ঠিক না, এটা সমীচীন না।