জুমাদাল আখিরাহ ১৪৪৭   ||   ডিসেম্বর ২০২৫

প্রসঙ্গ গণভোট
‖ উচ্চকক্ষ ও নারী আসন আসলে কার স্বার্থে?

মুফতি আবুল হাসান মুহাম্মাদ আব্দুল্লাহ

প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস ১৩ নভেম্বর ২০২৫ তারিখে জাতির উদ্দেশে একটি ভাষণ দিয়েছেন এতে তিনি আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও গণভোট একই তারিখে হবে বলে সরকারের সিদ্ধান্ত জানিয়েছেন

বাংলাদেশের ইতিহাসে জঘন্যতম স্বৈরাচারী আওয়ামী ফ্যাসিবাদী সরকারের পতনের পর অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া ব্যক্তিরা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বসিয়েছিলেন অনেক আশা নিয়ে ইউনূস সাহেব এই সরকারে তাঁর পছন্দমতো লোকদেরকে উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগ দিয়েছেন কিন্তু সেই উপদেষ্টাদের অধিকাংশই অভ্যুত্থানে নেতৃত্বদানকারী এবং দেশের সাধারণ জনগণকে হতাশ করেছেন তাঁরা প্রথম করণীয় কাজগুলো না করে অযথা সময় নষ্ট করেছেন এমন কাজে তারা হাত দিয়েছেন, যা করার শক্তি-সামর্থ্য ও অধিকার কোনো কিছুই তাদের ছিল না এ সংস্কার কমিশন, সে সংস্কার কমিশন নামে রাষ্ট্রের সময় ও টাকা কম ব্যয় হয়নি ফলাফল হয়েছে শূন্যের কাছাকাছি এরপরে বানানো হয়েছে ঐকমত্য কমিশন সেখানেও অনেক কিছুর ওপর ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হয়নি সে কমিশনের কর্ণধার এখন যোগ দিয়েছেন ইউনূস সাহেবের বিশেষ সহকারী হিসেবে এরই মধ্যে ড. ইউনূস আগামী ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় নির্বাচনেরও ঘোষণা দিলেন দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে নির্বাচনের তারিখ এবং আগামীতে সংবিধান সংস্কার ইত্যাদি বিষয় নিয়ে মতবিরোধ যখন চরম আকার ধারণ করেছিল, তখনই এল প্রধান উপদেষ্টার এ ভাষণ

ইউনূস সাহেব তাঁর ভাষণে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বিবদমান একটি চরম বিরোধপূর্ণ বিষয়ে সরকারের ফয়সালা ব্যক্ত করেছেন দেশের একটি বড় দল আগে জাতীয় সংসদ নির্বাচন, পরে গণভোটের কথা বলে আসছিল এ দলটি ছাড়া অধিকাংশ দলই আগে সংবিধান সংস্কার বিষয়ে গণভোট এবং সে আলোকে সংসদ নির্বাচনের জোর দাবি করে আসছিল সরকারের প্রধান উপদেষ্টা একই দিনে দুটি নির্বাচনের ঘোষণা দেওয়ায় দেশের পুরোনো দলটি বেজায় খুশি

দেশে এখন মোটামুটি নির্বাচনি হাওয়া বইছে বিদ্যমান রাজনৈতিক দলগুলো বিভিন্ন কথা বলে মাঠ গরম রাখার চেষ্টা করলেও প্রায় সকলেই নিজের সম্ভাব্য নির্বাচনি এলাকা চষে বেড়াচ্ছেন আজকের এই সংক্ষিপ্ত নিবন্ধে আমরা আগামী জাতীয় নির্বাচন বা দলগুলোর অবস্থান নিয়ে কথা বলব না শুধু যেসকল সুনির্ধারিত বিষয়ে প্রধান উপদেষ্টা গণভোট আয়োজনের কথা বলেছেন, তার দুয়েকটি নিয়ে কিছু আরজ করার চেষ্টা করব

মূল যে দুটি বিষয় নিয়ে আমরা আলোকপাত করতে চাই, তা নিয়ে বলার ইচ্ছা ছিল আরও কয়েক মাস আগেই, যখন এগুলো নিয়ে কথাবার্তা শুরু হয় এবং জাতীয় ঐকমত্য কমিশন তাদের মতামত রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে তুলে ধরে কিন্তু বিভিন্ন কারণে এ নিয়ে আলকাউসারে লেখা হয়নি একটি বড় কারণ ছিল, তখন মনে হয়নি যে, সরকার শেষ পর্যন্ত এ সিদ্ধান্তে অটল থাকতে পারবে এখন যেহেতু সরকারপ্রধান এ বিষয়ে গণভোটের সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিয়েছেন, তাই দেশের নাগরিক হিসেবে আমরাও আমাদের কিছু কথা তুলে ধরছি

প্রসঙ্গ : পার্লামেন্টে উচ্চকক্ষ

প্রধান উপদেষ্টার ঘোষণা অনুযায়ী গণভোটে নাগরিকদের যে প্রশ্নগুলো জিজ্ঞেস করা হবে, তার মধ্যে একটি হচ্ছে, পার্লামেন্টের ১০০ সদস্যবিশিষ্ট একটি উচ্চকক্ষ প্রতিষ্ঠা করা ভবিষ্যতে যদি বাস্তবেই এমনটি হয়, তাহলে সেটি হবে বর্তমান সরকারের অভিপ্রায়ের একটি ফসল জন্মলগ্ন থেকেই বাংলাদেশে একটি পার্লামেন্ট চালু আছে, যা জাতীয় সংসদ নামে পরিচিত এদেশের সরকারও এককেন্দ্রিক এখানে কোনো প্রদেশ নেই উচ্চ আদালতও রয়েছে রাজধানীভিত্তিক জেনারেল এরশাদ একবার সংবিধান সংশোধন করে উচ্চ আদালতের শাখা দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করেছিলেন কিন্তু তৎকালীন প্রধান বিচারপতি শাহাবুদ্দীন আহমদ সে সংশোধনী বাতিল করে দিয়েছেন এ যুক্তি পেশ করে যে, বাংলাদেশ এককেন্দ্রিক রাষ্ট্র, এখানে কোনো প্রদেশ নেই যে, বিভিন্ন এলাকায় সুপ্রিম কোর্টের শাখা বসাতে হবে বিশ্বের যেসকল দেশে দ্বিকক্ষবিশিষ্ট পার্লামেন্ট রয়েছে, সেগুলোর প্রায় সবগুলোই বৃহদায়তনের দেশ সেসব দেশে বিভিন্ন প্রশাসনিক প্রদেশ রয়েছে

বাংলাদেশে দ্বিকক্ষবিশিষ্ট পার্লামেন্টের দাবি ধারাবাহিকভাবে করে আসছিল একটিমাত্র দল আ স ম আব্দুর রবের নেতৃত্বাধীন জাসদ নিয়মতিই এ দাবি করত এছাড়া কোনো স্বীকৃত বড় দল এমন দাবি কখনো করেনি; বরং বিরোধিতা করেছে এদেশের সাধারণ জনগণের এমন কোনো অভিপ্রায় এতদিন ছিল না অবশ্য কোনো কোনো এনজিও বিভিন্ন সময় এ ধরনের দাবি তুলেছে তাদের যুক্তি ছিল, এতে করে নির্বাচনে জয়ী হতে পারবে না এমন লোকেরা উচ্চকক্ষের সদস্য হয়ে রাষ্ট্রীয় কাজে যুক্ত হওয়ার সুযোগ পাবে

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে সংসদের উচ্চকক্ষ দ্বারা আসলে কে লাভবান হবে? সাধারণ জনগণ? দেশ? নাকি রাজনৈতিক দলগুলো? স্বাধীনতার পর থেকে অনুষ্ঠিত নির্বাচনগুলোর প্রায় সবগুলোই তো দেখার সুযোগ হয়েছে জাতীয় সংসদে রাজনৈতিক দলগুলোর প্রার্থী বাছাইয়ের প্রক্রিয়া আগে যেমন ছিল, তাতেও অনেক পরিবর্তন এসেছে এখন তো বড় দলগুলোর সংসদ সদস্য হিসেবে মনোনয়ন পাওয়ার যোগ্যতাই হচ্ছে (অধিকাংশ ক্ষেত্রে) পেশিশক্তি ও বিপুল অর্থের অধিকারী হওয়া এরপর নির্বাচিত সংসদ সদস্যরা ৫ বছর পর্যন্ত রাষ্ট্রের জন্য ভালো আইন প্রণয়ন, নাগরিক সেবা ও জনগণের পাশে দাঁড়ানোর চেয়ে বেশি অগ্রাধিকার দিয়ে থাকেন দখলবাজি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও স্থানীয় প্রশাসনে কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা এবং অন্যায়-অবিচারের পক্ষপাতের মতো কাজগুলোকে সে রাজনৈতিক দলগুলোর তো মানসিকতারও কোনো পরিবর্তন হয়নি তাদের নেতৃত্বেও কোনো সংস্কার এসেছে বলে জনগণের কাছে দৃশ্যমান হয়নি তাদেরকেই কিনা উপহার দেওয়া হচ্ছে আরও ১০০ টি উচ্চকক্ষীয় সংসদ সদস্য পদ যাদের পেছনে ব্যয় হবে রাষ্ট্রের শত শত কোটি টাকা প্লট, ফ্ল্যাট, উচ্চ বেতন-ভাতা, ট্যাক্স ফ্রি গাড়িসহ কত কিছুই তো সরকারি-বিরোধী দলীয় সংসদ সদস্যরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে নিজেদের জন্য পাশ করিয়ে নিয়ে থাকেন সেসব সুবিধা দিতে দিতে এমনিতেই তো জনগণের নাভিশ্বাস ওঠে তার ওপর এখন ১০০ আসনের আরেকটি সংসদ তাদের মিটিং কক্ষ, থাকার ব্যবস্থা, তাদের জন্য প্রয়োজনীয় লোকবল নিয়োগদান অর্থাৎ বাংলাদেশের নাগরিকদের ওপর বছরে আরও কয়েক হাজার কোটি টাকার করের বোঝা চাপানোর ব্যবস্থা হচ্ছে উচ্চকক্ষ-নামীয় শ্বেতহস্তীর মাধ্যমে!

কারা লাভবান হবে?

আগেই আমরা বলেছি, এদেশের প্রেক্ষাপটে উচ্চকক্ষের সুবিধাভোগী কেবলমাত্র রাজনৈতিক দলগুলোর নেতা-নেত্রীরাই হবে কারণ সংখ্যাগরিষ্ঠ দলই তো সরকার গঠন করবে সুতরাং উচ্চকক্ষের সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন তাদের হাতেই থাকবে কম ভোট পাওয়া বিরোধীদের হাতে দু-চারটা আসন যেতে পারে কিন্তু এ সংসদ জনগণের জন্য কী করবে? ভারত, পাকিস্তান ও যুক্তরাজ্যসহ যেসকল বড় বড় রাষ্ট্রে পার্লামেন্টের দুটি কক্ষ রয়েছে, সেখানে উচ্চকক্ষের লোকেরা কী অবদান রেখে থাকেন তা কি ইউনূস সাহেবের লোকেরা যাচাই করে দেখেছেন? কেউ হয়তো যুক্তরাষ্ট্রের কথা ওঠাতে পারেন, সেখানে সিনেট তথা উচ্চকক্ষ শক্তিশালী; কিন্তু সে দেশে তো সিনেট সদস্যরা সরাসরি জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয়ে থাকেন তাদের ক্ষমতাও অনেক এখানে তো তারা মনোনীত হবেন এদের অবস্থা হবে সংরক্ষিত মহিলা আসনের সদস্যদের মতো, যারা কথা বলতে দাঁড়ালেই তারা অনির্বাচিত হওয়ার টিপ্পনী খেয়ে থাকেন

কাদের উদ্দেশ্যে এ উদ্যোগ?

এ প্রশ্নের সঠিক উত্তর তো ইউনূস সাহেবের লোকেরাই দিতে পারবেন তবে অনেকেই মনে করছেন, বিদেশীদের বিভিন্ন এজেন্ডা বাস্তবায়নের উদ্দেশ্যে দেশের বিভিন্ন পেশায় যেসকল গোষ্ঠী কাজ করে থাকে, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের মাধ্যমে তাদেরকে অথবা তাদের প্রতিনিধিদেরকে সংসদে নিয়ে যাওয়া এ উদ্যোগের একটি উদ্দেশ্য হতে পারে যারা ভোটে গিয়ে পাশ হয়ে আসার যোগ্যতা রাখে না অথবা বিভিন্ন বিতর্কিত এজেন্ডা নিয়ে কাজ করার কারণে চিহ্নিত ব্যক্তি হওয়ায় মানুষ তাদেরকে ভোট না দেওয়ার আশঙ্কা বিদ্যমান থাকে, তাদেরকে সরকারি অথবা বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর মাধ্যমে ক্ষমতায়ন উচ্চকক্ষ প্রতিষ্ঠার একটি বড় উদ্যোগ হতে পারে

প্রধান উপদেষ্টা তার বক্তব্যে উচ্চকক্ষের কী কাজ হবে তা উল্লেখ করেননি শুধু এতটুকু বলেছেন, সংবিধান সংশোধন করতে হলে উচ্চকক্ষের সংখ্যাগরিষ্ঠের সম্মতি প্রয়োজন হবে তো সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন পেয়ে যারা সরকার গঠন করবে, সাধারণ বিবেচনায় তো তারাই উচ্চকক্ষে বেশি আসনের অধিকারী হবে সেক্ষেত্রে সরকার যদি নিজের মতলবে সংবিধান সংশোধন করতে চায়, তখন কি উচ্চকক্ষ তাদের জন্য কোনো সমস্যা হবে? উচ্চকক্ষ গঠিত হবে কি না গণভোটের মাধ্যমে জনগণকে জিজ্ঞেস করার আগে এর দ্বারা জনগণ কীভাবে উপকৃত হবে এবং দেশ ও সাধারণ জনগণের এতে কী লাভ হবে স্পষ্ট করা কি ইউনূস সাহেব ও তাঁর লোকজনের দায়িত্ব নয়? এ প্রশ্ন এজন্যও উঠবে, কারণ উচ্চকক্ষের ধারণাটি তাঁরাই প্রতিষ্ঠিত করেছেন কোনো বড় দল আগে এমন দাবি করেনি; বরং অনেকেই শুরুতে এর বিরোধিতা করেছেন

প্রসঙ্গ : মহিলা আসন বৃদ্ধি

প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস যেসব বিষয়ে গণভোট আয়োজনের ঘোষণা দিয়েছেন, তার মধ্যে একটি হচ্ছে সংসদে সংরক্ষিত মহিলা আসনের পরিমাণ বৃদ্ধি করা অন্তর্বর্তীকালীন সরকার যেসকল সংস্কার কমিশন বানিয়েছে, তার মধ্যে একটি ছিল নারীবিষয়ক কথিত নারীবাদীরাই প্রধানত সে কমিশনে স্থান পেয়েছেন তারা মহিলা আসন বৃদ্ধির জন্য জোর তাগিদ দিয়েছেন গত এক বছরে তো কেউ কেউ ৩০০ সাধারণ আসনের সাথে ৩০০ সংরক্ষিত মহিলা আসনের কথা বলেছেন

বাংলাদেশে জাতীয় সংসদের ৩০০টি সাধারণ আসন রয়েছে এ আসনগুলোতে নারী-পুরুষ যে কেউই অবাধে নির্বাচন করতে পারে বিভিন্ন সময়ে খালেদা জিয়া, শেখ হাসিনা ছাড়াও আরও বহু নারী সাধারণ আসন থেকে জয়ী হয়ে সংসদে গেছেন তার পরও এখানে ঔপনিবেশিক পন্থায় সংরিক্ষত মহিলা আসনের রেওয়াজ থেকে গেছে শুধু থেকেই যায়নি; বরং তা নিয়মিত বৃদ্ধিই পাচ্ছে যতটুকু মনে পড়ে জেনারেল এরশাদ তার পাতানো  নির্বাচনে গঠিত সংসদে সংবিধানে সংশোধনী এনে দশটি সংরক্ষিত মহিলা আসন সৃষ্টি করেছিলেন এরপর তা বৃদ্ধি পেতে পেতে এখন পঞ্চাশে গিয়ে দাঁড়িয়েছে, যা সাধারণ আসনের ছয় ভাগের এক ভাগ অর্থাৎ ১৬.৬৬% এখন আবার অন্তর্বর্তীকালীন সরকার তা বৃদ্ধি করার জন্য তোড়জোড় করছে

কীভাবে নির্বাচিত হন তারা?

প্রচলিত নিয়মে সংরক্ষিত মহিলা আসনের সদস্যদেরকে সাধারণ আসনে নির্বাচিত সংসদ সদস্যরা নির্বাচিত করে থাকেন এক্ষেত্রে সাধারণত মনোনয়নের মাধ্যমেই তারা এমপি হয়ে থাকেন প্রতিদ্বন্দ্বিতা হতে দেখা যায় না কারণ, দল যাকে মনোনয়ন দেবে, সে-ই তো নির্বাচিত হবে তাই দলীয় মনোনয়ন না পেলে কেউ নির্বাচনে প্রার্থী হন না অর্থাৎ নির্বাচন বলা হলেও এটি আসলে মনোনয়ন বা পদায়ন দলীয় প্রধান যাকে চাইবেন, তাকেই সংরক্ষিত আসনের এমপি বানাতে পারেন

কারা মনোনয়ন পেয়ে থাকেন?

সংরক্ষিত নারী আসনের বিধান চালু হওয়ার পর থেকে প্রতিষ্ঠিত সংসদগুলোর দিকে নজর দিলে দেখা যাবে, নিম্নোক্ত প্রকারের নারীরা সংরক্ষিত আসনে বেশি মনোনয়ন পেয়েছেন দু-চারটি ব্যতিক্রম ছাড়া এর ব্যত্যয় হতে দেখা যায়নি :

১. যেসকল দলীয় নেত্রী সাধারণ আসনে নির্বাচন করে পরাজিত হয়েছেন তাদের অনেককে সংরক্ষিত আসনের মাধ্যমে সংসদে নিয়ে আসা হয়েছে এই মুহূর্তে মনে পড়ছে, আওয়ামী লীগের বাঘা নেত্রী বেগম সাজেদা চৌধুরীর কথা তিনি একবার কে এম ওবাইদুর রহমানের কাছে নির্বাচনে হেরে গিয়েছিলেন তখন আওয়ামী লীগ সংরক্ষিত আসনে মনোনয়ন দিয়ে তাকে সংসদে নিয়ে আসে তবে এমন একটি ঘটনা নয়, বিভিন্ন সময়েই বিভিন্নজনকে এভাবে সংসদে আনা হয়েছে

২. প্রভাবশালী এমপি ও মন্ত্রীদের পত্নীগণ দলে বা জাতীয় ক্ষেত্রে তেমন কোনো অবদান না থাকলেও শুধু স্বামীর প্রভাবে অনেকেই সংরক্ষিত মহিলা আসনে এমপি হয়ে সংসদকে অলংকৃত(?) করেছেন ভোগ করেছেন রাষ্ট্রের তথা জনগণের কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা এমনকি বিগত আমলে অনেকটা ভাঁড় ও দালালের ভূমিকা পালন করা রাশেদ খান মেনন-হাসানুল হক ইনুদের স্ত্রীদেরও সংরক্ষিত আসনের এমপি করা হয়েছে

৩. সিনেমার নায়িকা থেকে শুরু করে পথেঘাটে গান গাওয়া ও তথাকথিত বিনোদনমূলক পেশায় থাকা দলের অনুগত চিহ্নিত মহিলারা বিগত সময়ে সংরক্ষিত নারী আসনে মনোনয়নের সময় আসলে ওসব জগতের মহিলাদের মাঝে এমপি হওয়ার জন্য ব্যাপক দৌড়ঝাঁপ, তদবির ও অস্থিরতা তৈরি হয়ে যেত

৪. এছাড়া অন্ধ দলীয় লেজুড়বৃত্তি করা শিক্ষিকা ও সাবেক আমলারাও এ পন্থায় সংসদে প্রবেশ করেছেন

কী কাজ তাদের?

বাংলাদেশের সংবিধানে তো জাতীয় নির্বাচনে মহিলা-পুরুষ উভয় লিঙ্গের প্রার্থী হওয়ার সমান সুযোগ রয়েছে নির্বাচিত সংসদ সদস্যরা সংসদে শুধু পুরুষদের স্বার্থে কথা বলবেন এমন কোনো বিধিও নেই; বরং নারী-পুরুষ নির্বিশেষে বাংলাদেশের সকল নাগরিকের স্বার্থ দেখা এবং কার্যকর আইন প্রণয়ন করা সংসদের দায়িত্ব তাহলে আবার সংরক্ষিত নারী আসন কেন? এর পেছনে যুক্তি দেওয়া হয়, বর্তমান পুরুষ শাসিত সমাজে নারীরা অবহেলিত হয়ে আছেন, তাই বিভিন্ন পন্থায় তাদেরকে এগিয়ে নিতে হবে তাদের প্রতিনিধিরা জাতীয় সংসদ এবং অন্যান্য স্থানীয় পরিষদে মনোনীত হয়ে নারীদের স্বার্থে অবদান রাখবে বাংলায় একটি প্রবাদ আছে, ‘দাদায় কইছে ভানতে ধান, ভানতে আছে ওদা ধান’ ওদা ধান অর্থ হচ্ছে যে ধান এখনো পরিপক্ব হয়নি

এযুগের মহাজ্ঞানী ও বুদ্ধিজীবীরা বাংলার মানুষের জন্য ‘ওদা ধান’ই ভেনে যাচ্ছেন, যা থেকে কখনো ‘চাল’ আশা করা যায় না বিগত কয়েক দশকের ইতিহাসে সংরক্ষিত নারী আসনের কয়জন এমপি এ অঞ্চলের নারী সমাজের জন্য বিশেষ অবদান রেখেছেন? রেখে থাকলে সেটি কী? নারীকে সংরক্ষিত আসনে এমপি বানানোর দ্বারা দেশের সাধারণ নারী সমাজের ভাগ্য পাল্টে গেছে? দেশের জনগণ তো বরং উল্টোটাই লক্ষ করেছে সংরক্ষিত আসনের নারীরা বরাবরই সংসদে কথা বলার সুযোগ পাওয়ার ক্ষেত্রে পিছিয়ে থেকেছে দলীয় প্রধানের বিশেষ ব্যক্তি হওয়ার তকমা থাকলে দুয়েকজনের ক্ষেত্রে হয়তো ব্যতিক্রমও ঘটেছে কিন্তু সাধারণ অবস্থায় কতবার যে সংরক্ষিত মহিলা আসনের সদস্যদের কথা বলতে গিয়ে মনোনীত হওয়ার তির্যক মন্তব্য শুনতে হয়েছে, তা হিসেব করাও কঠিন হবে শুধু তাই নয়, মহিলা সদস্যগণ ফ্লোর নিতে গিয়েও হীনম্মন্যতায় ভুগেছেন দেখা গেছে, তিনি দাঁড়িয়ে আছেন, ফ্লোর পাচ্ছেন না এরপর স্পিকারের উদ্দেশে বলছেন, ‘মাননীয় স্পিকার! আমাদের নারীদের সাথে আপনি বৈষম্যের আচরণ করছেন আমরা ফ্লোর চেয়েও পাই না’ স্পিকার হয়তো জবাব দিচ্ছেন, ‘আপনি এমন অপবাদ দিবেন না আমি আপনাদের যথেষ্ট সুযোগ দিয়ে থাকি

বিগত সংসদগুলোর কার্যবিবরণের দিকে যাদের মোটামুটি নজর ছিল, তাদের এ বিষয়গুলো ভালোভাবে জানা রয়েছে তারা জানেন, সংরক্ষিত মহিলা আসনের মাধ্যমে আসলে সাধারণ নারী সমাজের কোনোই উপকার হয়নি এর দ্বারা দেশের নারী সমাজ সম্মানবোধ করেছেন এমন কথাও কেউ জোর দিয়ে বলতে পারবে না বরং প্রভাবশালী মন্ত্রী এমপিদের স্ত্রী এবং দলীয় অন্ধ আনুগত্যকারী বিভিন্ন পেশার মহিলারাই সংসদে গিয়েছেন, যারা নির্বাচিত এমপিদের সমান সুযোগ সুবিধা নিয়ে নিজেদের ভাগ্য উন্নয়ন করেছেন নিজেদের ভাগ্য উন্নয়ন করেছেন বটে; কিন্তু নারী সমাজের বিশেষ কোনো উন্নয়ন বা উপকার সাধন করতে পারেননি

সংরক্ষিত আসন দ্বারা নারীর সম্মান বাড়ে, না কমে?

হাল আমলের নারীবাদী পুরুষ ও মহিলাগণ এবং নিজ নিজ স্বার্থে তাদের গানের তালে সুর দেওয়া লেখক, বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিক ও রাজনীতিকগণ মূলত যার যার স্বার্থে তথাকথিত নারীবাদীর জিগির তুলে থাকেন অনেক ক্ষেত্রেই সাধারণ নারী সমাজের জীবনমান উন্নয়ন এবং তাদের প্রাপ্য যথাযথ অধিকার নিয়ে মাথা না ঘামিয়ে, বস্তাপচা জিনিসকে নারী উন্নয়ন বলে চালিয়ে দিয়ে থাকেন তাই যে পন্থায় নারীর অসম্মান হয়, নারীকে নীচু দেখানো হয়, নারীর হীনম্মন্যতার কারণ হয় এ ধরনের পন্থাকেও নারী সমাজের উন্নয়ন এবং সাধারণ নারীদের জন্য ভালো কিছু হিসেবে দাঁড় করিয়ে থাকে একদিকে বলা হচ্ছে, নারী সমাজ এখন আর পিছিয়ে নেই, তারা সকল ক্ষেত্রে পুরুষের সমান, অনেক ক্ষেত্রে পুরুষ থেকেও এগিয়ে গেছে, রাষ্ট্র পরিচালনা, আন্তর্জাতিক সংস্থা পরিচালনা সব ক্ষেত্রেই নারীরা পুরুষের সাথে পাল্লা দিয়ে এগিয়ে চলেছে; আবার মতলবের সময় বলা হচ্ছে, নারীরা তো অনেক পিছিয়ে; তাদেরকে বিশেষ ব্যবস্থায় এগিয়ে নেওয়া দরকার! এ ধরনের স্ববিরোধী কথা বলতে ওইসকল জ্ঞানী লোকদের সাধারণত কোনো লজ্জাবোধ হয় না বাস্তবিক অর্থে যুগ যুগ থেকে চলে আসা সংরক্ষিত মহিলা আসন অব্যাহত রাখা এবং উত্তরোত্তর বৃদ্ধি করার মাধ্যমে সাধারণ নারী সমাজকে বরং হেয় প্রতিপন্ন করা হয় এমন একটা ভাব প্রকাশ করা হয়, তোমরা তো নির্বাচিত হয়ে আসার যোগ্যতা রাখো না, তাই তোমাদেরকে মনোনয়নের মাধ্যমেই সংসদে নিয়ে যাচ্ছি এসব কথার পেছনে আসল মতলব থাকে, নিজেদের লোকজনকে এমপি বানিয়ে রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধা হাতিয়ে নেওয়া

অতএব সত্যিকার অর্থে নারীজাতির সম্মান চাইলে সংরক্ষিত মহিলা আসন বৃদ্ধি নয়, মনোনয়নের মাধ্যমে কাউকে এমপি বানানো নয়; বরং সংবিধান সংশোধন করে তা সমূলে বিলুপ্ত করা দরকার যোগ্য নারীগণ সাধারণ আসনে নির্বাচিত হয়ে এমনিতেই সংসদে যাবেন করুণার পাত্র বানিয়ে কাউকে সম্মানিত করা যায় না মুষ্টিমেয় নারীদের রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে সুবিধা দিয়ে এমপি নাম দিয়ে কিয়ামত পর্যন্তও নারীজাতির উন্নয়ন করা যাবে না বিশেষত যাদেরকে সংসদে নেওয়া হয়, তারা তো আগে থেকেই প্রভাবশালী অথবা প্রভাবশালীদের পত্নী এবং অর্থবিত্তের মালিক থাকেন রাষ্ট্রের কাঁড়ি কাঁড়ি অর্থ এদের পেছনে ব্যয় করা মানে তেলা মাথায় তেল দেওয়া

প্রস্তাবিত গণভোট কতটুকু বাস্তবসম্মত ও যৌক্তিক?

একই দিনে জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও গণভোট আয়োজনের পর থেকে এ নিয়ে ইতিমধ্যে বিভিন্ন প্রশ্ন উঠেছে যে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটার এখনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা-দীক্ষার বাইরে রয়েছে, সে দেশে এ ধরনের জটিল প্রশ্ন দিয়ে রেফারেনডম করা কতটুকু বাস্তবসম্মত? সাধারণ মানুষ কি উচ্চকক্ষ বোঝে বা চেনে? তাদেরকে প্রশ্ন জিজ্ঞেস করলে ক’জনই বুঝে শুনে ‘হাঁ’ বা ‘না’ বলবে? বৃহৎ দলের এক বড় নেতা তো জনগণকে না ভোট দিতে এখন থেকেই উৎসাহিত করতে শুরু করেছেন যদি নির্বাচনের আগে চারদিকে না ভোট দেওয়ার জিগির উঠে যায়, তাহলে তো জুলাই সনদ, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা, নির্বাচন ব্যবস্থা ইত্যাদি সংক্রান্ত সংবিধানের প্রয়োজনীয় সংস্কার ধুলোয় মিশে যাবে এছাড়া আরেকটি যৌক্তিক প্রশ্ন উত্থাপিত হচ্ছে, তা হল, কোনো ভোটার যদি একটি বিষয়ে ‘হাঁ’ এবং আরেকটি বিষয়ে ‘না’ ভোট দিতে চায়, তাহলে সে কীভাবে করবে?

মৌলিক কাজগুলো না করেই কি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বিদায় নেবে?

আলকাউসারের পাতায় আমরাও বহুবার আরজ করেছি, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের মূল কাজটি হওয়া দরকার বিগত ফ্যাসিবাদী সরকারের লোকদের এবং সরকারি-বেসরকারি আমলা, প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার সাংবাদিক, সম্পাদক-নামি দালাল গং, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর কলঙ্ক হিসেবে পরিচিতি পাওয়া দলবাজ ভিসি ও একশ্রেণির শিক্ষক, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীগুলোর অতি উৎসাহী মতলববাজ সদস্যবৃন্দ, যাদের সহযোগিতায় স্বৈরাচার ক্ষমতাকে দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর করেছে, দেশবাসীর ওপর গুম-খুন নির্যাতনসহ জুলুমের স্টিমরোলার চালিয়েছে তাদেরকে কঠোর শাস্তির আওতায় আনা কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে পালাতে না পারা কয়েকজন আওয়ামী নেতাকে গ্রেফতার করা ছাড়া তেমন কিছুই সরকার করেনি এর ফল বর্তমান সরকার এখন নিজেই দেখতে পাচ্ছে কিছুদিন সুকৌশলে নীরব থাকা সে মতলবি গোষ্ঠীরা এখন চারদিক থেকে সংঘবদ্ধভাবে সক্রিয় হয়ে উঠছে কীভাবে আবার তাদের পুরোনো প্রভুদের ফেরানো যায়, সে চেষ্টা করে যাচ্ছে শুধু সরকারের সিদ্ধান্তের ওপরই আঙুল তুলছে না, আইন আদালত কোনো কিছুকেই তাদের আক্রমণের বাইরে রাখছে না এদেরকে জিইয়ে রাখার পেছনে কি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কিছু উপদেষ্টা সরাসরি জড়িত নন?

তবে কি বহু মায়ের বুকের ধনের রক্তের বিনিময়ে সফল হওয়া একটি গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী গঠিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এ ব্যর্থতাগুলো নিয়েই বাড়ি ফিরে যাবে?

 

 

advertisement