গাজা এবং মেড ইন ইন্ডিয়া
ওয়াসআতুল্লাহ খান
স্পেন যখন ইসরাইলের সঙ্গে বাণিজ্য ও প্রতিরক্ষা সম্পর্ক ছিন্ন করে নিয়েছে, যখন প্রায় দুই ট্রিলিয়ন ডলারের মালিক বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ নরওয়ের ওয়েলথ ফান্ড (Wealth Fund) ইসরাইলের ৩৪টি কোম্পানি থেকে নিজেদের বিনিয়োগ তুলে নিয়েছে এবং ইসরাইলকে বুলডোজার সরবরাহকারী বিশ্বের সর্ববৃহৎ মার্কিন কোম্পানি ক্যাটার পিলার থেকেও শুধু এই অজুহাতে নিজেদের বিনিয়োগ তুলে নিয়েছে যে, ক্যাটার পিলারের বুলডোজার ফিলিস্তিনীদের ঘরবাড়ি উচ্ছেদ ও তাদের জাতিনিধনে বড় ভূমিকা রাখছে– ঠিক এমন সময় ভারত ইসরাইলকে পূর্ণ সমর্থন দেওয়ার প্রকাশ্য ঘোষণা দিয়েছে।
তবে বড় দ্বিচারিতা এই যে, মোদি সরকার এখনো কাগজে-কলমে ‘দুই রাষ্ট্র সমাধান’-এর পক্ষে। অথচ দিল্লিতে ফিলিস্তিনের সমর্থনে কোনো বিক্ষোভ মিছিলের চেষ্টা করলে পুলিশ লাঠিচার্জ করতে প্রস্তুত। অন্যদিকে ইসরাইলের পক্ষে কোনো মিছিল করতে চাইলে পুলিশ নিরাপত্তা দিতেও রাজি।
মোদি সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকেই আন্তর্জাতিক কোনো ফোরামে ফিলিস্তিনের পক্ষে ও ইসরাইলের বিরুদ্ধে প্রস্তাব এলে ভারত নিজেকে অনুপস্থিত দেখাতেই নিরাপদ মনে করেছে।
এমনকি গত বছর জাতিসংঘের সাধারণ সভায় যখন অনতিবিলম্বে গাজায় যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতায় গৃহীত হয়েছিল, তখনো ভারত নিজেকে অনুপস্থিত দেখিয়েছে।
সাংহাই সহযোগিতা সংস্থা (SCO)-এর পররাষ্ট্র মন্ত্রীদের বৈঠকে ইরানের ওপর ইসরাইলী হামলার নিন্দা জানাতেও ভারত অস্বীকৃতি জানিয়েছিল। কিন্তু ট্রাম্প যখন ভারতীয় পণ্যের ওপর ৫০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করে, তখন চীনে এসসিওর শীর্ষ সম্মেলনের ঘোষণাপত্রের বিষয়ে ভারত কোনো আপত্তি তোলেনি। অথচ ঘোষণাপত্রে ইরানের বিরুদ্ধে ইসরাইলী আগ্রাসনের নিন্দাও জানানো হয়েছিল।
ইসরাইলে বর্তমানে যত বিদেশি শিক্ষার্থী পড়াশোনা করছে, তার সবচেয়ে বেশি সংখ্যক ভারতীয়। ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবরের পর ইসরাইলের কৃষি ও শিল্প খাতে কর্মরত দেড় লক্ষ ফিলিস্তিনী শ্রমিকের অনুমতি বাতিল করে দেওয়া হয়। তাদের পরিবর্তে ভারত থেকে প্রায় এক লক্ষ শ্রমিক নিয়োগ করা হয়েছে।
ইসরাইলের অস্ত্র কেনার সবচেয়ে বড় দেশ ভারত। পাকিস্তানের সাথে ৭ থেকে ১০ মে (২০২৫) পর্যন্ত চলা সংঘাতে ভারত ইসরাইলের তৈরি হিরন ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র প্রকাশ্যেই ব্যবহার করেছে।
গত বছর (২০২৪)-এর ৬ জুন গাজায় জাতিসংঘ পরিচালিত নাসিরিয়া শরণার্থী শিবিরে ইসরাইল যখন বোমা হামলা চালায়, তখন একটি বিস্ফোরিত ক্ষেপণাস্ত্রের টুকরোয় লেখা ছিল Made in India। ছবিটি তখন সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে এবং বেশ প্রচার পায়।
বিশ্ব তখন ঠিকই জানতে পারে যে, ভারত ইসরাইলকে কী কী সরবরাহ করেছে! গত বছরের এপ্রিল মাসে চেন্নাই বন্দর থেকে যাত্রা করা দুটি জাহাজকে ট্র্যাকিং করা হলে দেখা যায়, জাহাজদুটির গন্তব্য ছিল গাজার কাছাকাছি ইসরাইলের আশদোদ সমুদ্র বন্দর (Port of Ashdod)। অথচ বুরকাম (Borkum) ও মারিয়ানা ডেনিকা (Marianne Danica) নামের এ দুটি জাহাজকে স্পেন তাদের বন্দরগুলোতে সাময়িকভাবেও ভিড়তে দেয়নি।
জাহাজগুলোতে ছিল রকেটের বিস্ফোরক চার্জার ও ইঞ্জিন ছাড়াও বারুদ এবং ভারি কামানের যন্ত্রাংশ। ইয়েমেনী হুথিদের নৌ-অবরোধ এড়াতে জাহাজদুটি সুয়েজ খাল দিয়ে ছোট রাস্তায় না গিয়ে আফ্র্রিকার চারপাশ ঘুরে ভূমধ্যসাগর হয়ে ইসরাইলের দিকে যায়।
স্টকহোম পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউট (SIPRI)-এর তথ্যমতে, ইসরাইলের বারাক ক্ষেপণাস্ত্রের মোটর উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান হল ভারতীয় কোম্পানি ‘প্রিমিয়ার এক্সপ্লোসিভস লিমিটেড’। কোম্পানিটি সামরিক কাজে ব্যবহারযোগ্য আরডিএক্স ও এইচএমএক্স বিস্ফোরকও রফতানি করে। হায়দরাবাদে আদানি ডিফেন্স অ্যান্ড অ্যারোস্পেস এবং ইসরাইলী কোম্পানি এলবিটের যৌথ কারখানায় অস্ত্রসজ্জিত হার্মিস ড্রোন তৈরি হয়।
ভারত-ইসরাইল প্রতিরক্ষা বাণিজ্য ও অংশীদারি শুরু হয় ১৯৯৯ সালের কারগিল যুদ্ধের সময়। যখন ইসরাইল জরুরি ভিত্তিতে ভারতকে গোলা-বারুদ ও যন্ত্রাংশ সরবরাহ করে। লাইন অব কন্ট্রোল ও ভারত-চীন সীমান্তে ইলেকট্রনিক সেন্সর বসাতেও ইসরাইল বড় ভূমিকা পালন করে।
ইসরাইলী প্রধানমন্ত্রী ইৎজাক রবিন, এরিয়েল শ্যারন ও নেতানিয়াহু একাধিকবার দিল্লি সফর করেছেন। আর নরেন্দ্র মোদি ২০১৭ সালে প্রথমবার ইসরাইল সফর করেন (মোদি ও নেতানিয়াহু পরস্পরের দেশে দুবার করে সফর করেছেন)।
বিশ্বাস হয় না যে, এটাই সেই ভারত, যেখানে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে ইয়াসির আরাফাত ‘ধর্ম বোন’ বলেছিলেন। ভারত ছিল নিরপেক্ষ আন্দোলনের প্রথম দেশ, যারা ১৯৭৪ সালে পিএলও-কে ফিলিস্তিনীদের প্রতিনিধি সংগঠন হিসেবে এবং ১৯৮৮ সালে ফিলিস্তিনকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছিল। কংগ্রেস দল এখনো ফিলিস্তিনপন্থি ইসরাইলবিরোধী নীতিতেই অটল আছে, তবে রাষ্ট্রীয় অবস্থান এই ইস্যুতে একেবারে উল্টো দিকে ঘুরে গেছে। আর তা এমন সময়ে যখন গাজার বিপর্যয়ের কারণে বহু ইউরোপীয় ও গ্লোবাল সাউথ দেশ ইসরাইলের সঙ্গে বাণিজ্য থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। ভারত-ইসরাইল দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যের পরিমাণ বছরে প্রায় ৪ বিলিয়ন ডলার, আর যৌথ বিনিয়োগ প্রায় ৮০০ মিলিয়ন ডলার।
নিজের কর্মকাণ্ডের কারণে ইসরাইল যখন কূটনৈতিক ও রাজনৈতিকভাবে দ্রুত একঘরে হয়ে পড়ছে, তখন বর্ণবাদী ইসরাইলী অর্থমন্ত্রী বেজালেল স্মোট্রিচ তিন সপ্তাহ আগে (৮ সেপ্টেম্বর ২০২৫) দিল্লিতে ভারতের অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারমনের সঙ্গে প্রতিরক্ষা, সাইবার সিকিউরিটি ও উচ্চপ্রযুক্তি খাতে একাধিক নতুন চুক্তি সই করেছেন। ভারতীয় অর্থমন্ত্রী এই সফর ও নতুন চুক্তিগুলোকে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের নতুন ইতিহাস তৈরির সমান বলে ঘোষণা করেছেন।
এর পরপরই পাকিস্তান-সৌদি প্রতিরক্ষা অংশীদারির খবর যেন দিল্লিতে বাজের মতো আছড়ে পড়েছে।
[একটি বিদেশি দৈনিক থেকে
অনুবাদ : মুহাম্মাদ আবদুল্লাহ ফাহাদ]