জুমাদাল উলা ১৪৪৭   ||   নভেম্বর ২০২৫

কাবুলের পথ কীভাবে বন্ধ হবে?

হামেদ মীর

পেশোয়ারে হায়াতাবাদ নামে একটি বিশাল এলাকা আছে হায়াতাবাদ আমাদেরকে খাইবার পাখতুনখা প্রদেশের গভর্নর হায়াত খান শেরপাওয়ের কথা মনে করিয়ে দেয় এছাড়াও নওশেরার হায়াত শেরপাও রেলস্টেশন এবং লাহোরের শেরপাও ব্রিজসহ বেশ কিছু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হায়াত শেরপাওয়ের নামে নামকরণ করা হয়েছে

১৯৭৫ সালের ফেব্রুয়ারি পেশোয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ে বোমা বিস্ফোরণের মাধ্যমে তাঁকে শহীদ করা হয় খাইবার পাখতুনখার প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী এবং কওমী ওয়াতন পার্টির প্রধান আফতাব আহমেদ খান শেরপাও তাঁর বড় ভাই হায়াত খান শেরপাওয়ের শাহাদাতের পর রাজনীতিতে প্রবেশ করেন হায়াত খান শেরপাওয়ের শাহাদাতের পর অর্ধ শতাব্দী পেরিয়ে গেছে এখন কারও মনে নেই তাঁকে হত্যার পরিকল্পনা কাবুলে করা হয়েছিল

শেরপাও সাহেবের হত্যার পরই ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ) নিষিদ্ধ করা হয় এই হত্যাকাণ্ডের পরিকল্পনার অভিযোগ তৎকালীন বিরোধী দলীয় নেতা খান আব্দুল ওয়ালী খানের ছেলে এসফেন্দিয়ার ওয়ালীর বিরুদ্ধে আনা হয়েছিল; কিন্তু এই ঘটনার সঙ্গে তাঁর দূরতম সম্পর্কও ছিল না এই হামলায় চারসাদ্দার দুই যুবক আনোয়ার আমজাদ জড়িত ছিল, যারা পাখতুন জালমে নামক একটি সংগঠনের সাথে জড়িত ছিল সংগঠনটি ন্যাপ নেতা আজমল খটক কাবুলে বসে পরিচালনা করছিলেন

১৯৭৩ সালের ২৩ মার্চ রাওয়ালপিন্ডির লিয়াকতবাগে ন্যাপের একটি সমাবেশে ফেডারেল সিকিউরিটি ফোর্স (এফএসএফ) গুলি চালানোর পর আজমল খটক বেশ কয়েকজন সহযোগীসহ আফগানিস্তানে চলে গিয়েছিলেন, যেখানে সরদার দাউদ জহির শাহকে উৎখাত করে ক্ষমতা দখল করেছিলেন লিয়াকতবাগে বিরোধীদের সমাবেশ করা থেকে বিরত রাখার চেষ্টা করা হয়েছিল, কিন্তু বিরোধীরা সরকারের ইচ্ছার বিরুদ্ধে সমাবেশ করেছিল, যা থামাতে সরকার নির্বিচারে বল প্রয়োগ করে যাতে অনেক ন্যাপ কর্মী নিহত হয়েছিল নিহতরা খাইবার পাখতুনখার বাসিন্দা ছিল

এই ঘটনা পাকিস্তানের রাজনীতিতে যে ঘৃণা প্রতিশোধের জন্ম দিয়েছিল, তার ফলে পাখতুন জালমের উত্থান ঘটে, যার কর্মীদেরকে কাবুলে সন্ত্রাসবাদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হত

হায়াত খান শেরপাওয়ের দুই খুনিও অভিযান শেষ করে কাবুলে ফিরে এসেছিল কাবুলে শুধু পশতুন বেলুচ নেতারাই নয়, সিন্ধু দেশের সমর্থকদেরও আশ্রয় দেওয়া হয়েছিল, যারা কাবুলের ভারতীয় দূতাবাস থেকে অর্থ পেত

একদিকে হায়াত খান শেরপাওয়ের হত্যাকাণ্ড আমাদেরকে পাকিস্তানের রাজনীতিতে ঘৃণা প্রতিশোধ প্রবণতার কারণগুলো বিবেচনা করতে আহ্বান জানায়, অন্যদিকে এটিও দেখায়, আফগানিস্তান ভারত কেবল আজ নয়, কয়েক দশক ধরে পাকিস্তানে সন্ত্রাসবাদ চালিয়ে আসছে সাধারণত রাষ্ট্রের প্রতি ক্ষুব্ধ পাকিস্তানীদের এই সন্ত্রাসবাদের কাজে ব্যবহার করা হয়

পরিহাস দেখুন, যখন রাষ্ট্র লিয়াকতবাগে তার নিজের নাগরিকদের ওপর গুলি চালায় এবং হায়াত খান শেরপাও নিহত হন, তখন জুলফিকার আলী ভুট্টো পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী কয়েক বছর পরে, জেনারেল জিয়াউল হক ভুট্টোকে হটিয়ে ক্ষমতা দখল করেন এবং পাকিস্তানের প্রথম নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রীকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে দেন এই ফাঁসি যে ঘৃণা প্রতিশোধের জন্ম দেয়, তা মীর মুর্তজা ভুট্টোকে কাবুলে নিয়ে যায়

১৯৮১ সালে মীর মুর্তজা ভুট্টো যখন পিআইএ বিমান ছিনতাইয়ের দায় স্বীকার করেন, তখন আজমল খটক এবং মীর মুর্তজা ভুট্টো উভয়েই কাবুলে ছিলেন বহু বছর আগে, আমি দৈনিক জঙ্গের জন্য আজমল খটকের সাক্ষাৎকার নিয়েছিলাম তিনি সন্দেহ প্রকাশ করেছিলেন, পিআইএ বিমানটি সামরিক সরকার নিজেই হাইজ্যাক করেছে; যাতে অপহরণের দায় মীর মুর্তজা ভুট্টোর ওপর চাপানো যায় এবং পিপলস পার্টির বিরুদ্ধে ক্র্যাক ডাউন চালানো যায়, যে দলটি অন্যান্য রাজনৈতিক দলের সাথে মিলে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের আন্দোলন শুরু করতে চেয়েছিল

এই হাইজ্যাকিংয়ের মূল হোতা ছিল সালামুল্লাহ টিপু, যিনি পরবর্তীতে ১৯৮২ সালে ভারত সফরের সময় দিল্লিতে হযরত নিজামুদ্দিন আউলিয়ার মাযার যিয়ারতের সময় জেনারেল জিয়াউল হককে হত্যার পরিকল্পনা করেছিল পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য টিপুকে হাতবোমা এবং কালাশনিকভ সরবরাহ করার দায়িত্ব ছিল তার এক সহযোগী পারভেজ শিনওয়ারির ওপর পারভেজ শিনওয়ারি তা করতে পারেনি টিপু কাবুলে ফিরে এসে শিনওয়ারিকে হত্যা করে শিনওয়ারি হত্যার অভিযোগে আফগান রাষ্ট্রপতি . নাজিবুল্লাহর নির্দেশে কাবুলে সালামুল্লাহ টিপুকে গুলি করে হত্যা করা হয়

আরও দাবি করা হয়, মীর মুর্তজা ভুট্টোর সন্দেহ ছিল, টিপু পাকিস্তানী গোয়েন্দা সংস্থার হয়ে কাজ করে যে কারণে সে দিল্লিতে জেনারেল জিয়াকে হত্যা করেনি তাই মুর্তজার অনুরোধে টিপুকে গুলি করে হত্যা করা হয় তবে পাকিস্তান সরকার পিআইএ বিমান ছিনতাইয়ের জন্য টিপুকে শাস্তি দিতে পারেনি শেষ পর্যন্ত আফগান সরকার নিজেই কাবুলে তাকে গুলি করে হত্যা করে অন্য দেশের সহায়তায় নিজের দেশের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসবাদে যুক্ত বেশির ভাগ যুবকের সালামুল্লাহ টিপুর মতোই পরিণতি হয়

আমাদের অবশ্যই ভাবতে হবে, সালামুল্লাহ টিপু করাচি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কাবুলে কীভাবে পৌঁছেছে? জুলফিকার আলী ভুট্টোকে যদি ফাঁসি না দেওয়া হত, তাহলে তার ছেলে মীর মুর্তজা ভুট্টো কাবুলে বসে আজমল খটক যা করছিলেন, তা করতেন না ভুট্টো সরকার যদি লিয়াকতবাগ রাওয়ালপিন্ডিতে বিরোধী সমাবেশে গুলিবর্ষণ না করত, তাহলে আজমল খটক কাবুলে গিয়ে পশতুন জালমে গঠন করতেন না এটা খুবই দুঃখের বিষয় যে, আমরা আমাদের অতীতের ভুল থেকে শিক্ষা নিই না পাকিস্তানের রাজনীতি থেকে গালি গুলি নির্মূল করার জন্য আমরা সচেতনভাবে প্রচেষ্টা করিনি

মনে রাখবেন, রাজনীতিতে যে গালিগালাজ করে সেও গালিগালাজে পরিণত হয় রাজনীতিতে যে বুলেট ব্যবহার করে, সেও বুলেটের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয় লিয়াকতবাগে গুলি চলেছিল বেলুচিস্তানে সামরিক অভিযান চালানো হয়েছিল এর ফলে আফগানিস্তানের পথ হয়ে পাকিস্তানে সন্ত্রাসবাদ দেখা দেয় ভারত আফগানিস্তান হয়ে পাকিস্তানে বোমা বিস্ফোরণ ঘটায় এবং হায়াত খান শেরপাওকে হত্যা করে এই হত্যার পর একটি রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করা হয়েছিল, কিন্তু সেই দলটি আজও এএনপি নামে বিদ্যমান জুলফিকার আলী ভুট্টোকে ফাঁসি দেওয়া হয়েছিল এই মৃত্যুদণ্ডের ফলে যে ঘৃণা প্রতিশোধের সৃষ্টি হয়েছিল, তা মীর মুর্তজা ভুট্টোকে কাবুলে নিয়ে যায় শেষ পর্যন্ত তার নিজের বোনের শাসনামলে পুলিশের গুলির শিকার হন যার গুলি চালাতে হয়, সে হয় বিপ্লবের স্লোগান তোলে, নয়তো রাষ্ট্রকে বাঁচানোর দাবি করে

ইতিহাস বলে, গুলি রাজনৈতিক সমস্যার সমাধান করে না গত বছর নভেম্বরে ইসলামাবাদে গুলি চালানো হয়েছিল রাষ্ট্র বলেছিল, আমরা আমাদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেছি এখন মুরিদকেতে তেহরিকে লাব্বাইকের ওপর গুলি চালানো হয়েছে ১৯৭৩ সালে লিয়াকতবাগে গুলিবর্ষণের সময় গুলি চালানোর যে কারণ বলা হয়েছিল, সেই একই কারণ বলা হয়েছে

১৯৭৩ থেকে ২০২৫ সাল এসে গেছে আমরা আজও বুঝতে পারিনি, গুলি ঘৃণা প্রতিশোধের জন্ম দেয় ঘৃণা প্রতিশোধ আপনার যুবকদের কাবুলের পথ দেখায় যেখানে ভারত তাদের পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ব্যবহার করার সুযোগ পায়

এখন একজন যুবক খাইবার পাখতুনখার মুখ্যমন্ত্রী হয়েছেন এই মুখ্যমন্ত্রীর কথা সুরের সাথে কেউ দ্বিমত পোষণ করতে পারে, কিন্তু তাকে কাবুলের প্রক্সি বলা অনেক যুবককে কাবুলের দিকে ঠেলে দেওয়ার সমতুল্য আপনি যদি আপনার জনগণের সাথে গালি গুলির ভাষায় কথা বলা বন্ধ করেন, তাহলে তারা কেন কাবুল যাবে? কাবুলের পথ বন্ধ করার জন্য, আপনাকে আপনার জনগণের সাথে বোঝাপড়ার পথ অবলম্বন করতে হবে

 

[ দৈনিক জঙ্গ (১৬ অক্টোবর ২০২৫) থেকে অনুবাদ করেছেন, ওয়ালিউল্লাহ আব্দুল জলীল]

 

 

advertisement