হেদায়ার খুতবা : কিছু কথা
রজব ১৪৪৪ হি. (ফেব্রুয়ারি ২০২৩) সংখ্যায় ‘মিশকাতুল মাসাবীহের খুতবা : কিছু কথা’ শিরোনামে বান্দার একটি লেখা প্রকাশিত হয়েছিল, যাতে মিশকাতের খুতবা সম্পর্কে নিজের ফাহাম ও বুঝ পেশ করার প্রয়াস পেয়েছিলাম। তখনো আশা ছিল এবং এখনো আছে, উস্তায ও তালিবুল ইলমগণ আমার সে বুঝের তাসহীহ, তাসদীদ ও তাহযীব করে দেবেন।
গত কিছুদিন যাবৎ কয়েকজন তালিবুল ইলমের সঙ্গে হেদায়া মুযাকারা করার একটি সিলসিলা জারি হয়েছে। তো হেদায়া শুরু করতে গিয়ে প্রথমে খুতবা হল্ করার প্রসঙ্গ আসে। আর তা হল্ করতে গিয়ে আমাদের ইসতে‘দাদ ও ফাহমের দুর্বলতার কারণে বেশ কষ্টে পড়তে হয়। এরপরও যথাসাধ্য তো নয়, বরং মোটামুটি চেষ্টা-মেহনতের পর আমাদের বুঝ অনুসারে আমাদের সামনে খুতবার একটি হল্ আসে। সে হল্টি উলামা, আসাতিযা ও তলাবা হযারাতের খেদমতে সবিনয়ে পেশ করছি। আশা করি, তারা এ হল্টির ইসলাহ ও তাহযীব করে দেবেন ইনশাআল্লাহ।
ছাহেবে হেদায়া খুতবা শুরু করেছেন এভাবে–
الحمدُ لله الذي أَعلى مَعالِمَ العلمِ وأعلامَه، وأَظْهَرَ شعائرَ الشَّرْعِ وأحكامَه.
তিনি আল্লাহ তাআলার হামদের মাধ্যমে কিতাব শুরু করেছেন। حمد ও مدح উভয়টির অর্থ প্রশংসা করা। তবে حمد হয় দয়ার প্রেক্ষিতে। আর مدح যে কোনো কারণেই হতে পারে। যেহেতু হামদ ও মাদহ নিয়ে সাধারণভাবে আমাদের প্রায় প্রতিটি কিতাবের শুরুতে আলোচনা হয়, সেহতেু কাদীম কিছু কিতাবের বরাতে উভয়ের অর্থ ও পার্থক্য পেশ করা হল।
হামদ ও মাদহের অর্থ ও পার্থক্য
হেদায়ার একটি গুরুত্বপূর্ণ শরাহ গায়াতুল বায়ান। পূর্ণ নাম–
غاية البيان نادرة الزمان في آخر الأوان
মুসান্নিফ ইমাম কাযী কিওয়ামুদ্দীন আমীর কাতিব আতকানী রাহ. (৭৫৮ হি.)। আতকানী রাহ. গায়াতুল বায়ানে (১/১৪) হামদ সম্পর্কে লেখেন–
واختيارُ الحمدِ دونَ المدحِ لاقتضاءِ الأولِ سابقةَ الإحسانِ جزماً دونَ الثاني.
চতুর্থ শতকের ভাষাবিদ ইমাম আবু হিলাল আসকারী রাহ. বলেন–
الفرق بين الحمد والمدح : أن الحمد لا يكون إلا على إحسان، والله حامد لنفسه على إحسانه إلى خلقه، فالحمد مضمن بالفعل. والمدح يكون بالفعل والصفة، وذلك مثل أن يمدح الرجل بإحسانه إلى نفسه وإلى غيره، وأن يمدحه بحسن وجهه وطول قامته، ويمدحه بصفات التعظيم، من نحو قادر وعالم وحكيم، ولا يجوز أن يحمده على ذلك، وإنما يحمده على إحسان يقع منه فقط.
(আলফুরূকুল লুগাবিয়্যাহ, আসকারী, পৃ. ৫০, তাহকীক : মুহাম্মাদ ইবরাহীম সালীম)
ইমাম রাগেব আসফাহানী (৫০২ হি.) রাহ. বলেন–
حمد: الحمد لله تعالى: الثناء عليه بالفضيلة، وهو أخص من المدح وأعم من الشكر، فإن المدح يقال فيما يكون من الإنسان باختياره، ومما يقال منه وفيه بالتسخير، فقد يمدح الإنسان بطول قامته وصباحة وجهه، كما يمدح ببذل ماله وسخائه وعلمه، والحمد يكون في الثاني دون الأول، والشكر لا يقال إلا في مقابلة نعمة، فكل شكر حمد، وليس كل حمد شكرا، وكل حمد مدح، وليس كل مدح حمدا.
(আলমুফরাদাত ফী গারীবিল কুরআন, রাগেব আসফাহানী, পৃ. ২৫৬)
قوله: أَعلى مَعالِمَ العلمِ وأعلامَه
ছাহেবে হেদায়া দয়া ও দানের প্রসঙ্গে আল্লাহ তাআলার অসংখ্য অগণিত নিআমত ও দানের মধ্য থেকে যে বিষয়টি উল্লেখ করেছেন, তা হল–
أعلى مَعالِمَ العلمِ وأعلامَه.
معالم হল مَعلَم-এর বহুবচন। ইলমের مَعلَم কী? এর ব্যাখ্যায় একেক শারেহ একেক কথা বলেছেন। কেউ বলেছেন, শরীয়তের দলীলসমূহ। কেউ বলেছেন, কুরআন-সুন্নাহ্র নুসূস।
قال في >العناية شرح الهداية< : والمعالم جمع مَعلَم، وأراد به أصول الشرع لكونها مدارك العلم الشرعي.
وقال الأتقاني في >غاية البيان<: هو النصوص من الكتاب والسنة.
লাখনবী রাহ.-এর হাশিয়ায় আরও বিভিন্ন ইহতেমাল উল্লেখ করা হয়েছে। আমাদের খেয়ালে معالم শব্দটি ব্যাপক। এর দ্বারা ইলমের যে কোনো উৎস বা স্থান বোঝানো হয়েছে। শারেহীন যেসব বিষয় উল্লেখ করেছেন তন্মধ্যে যেগুলো সহীহ, শুধু সেগুলোর সাথে খাস নয়। আর ছাহেবে হেদায়াও শুধু সেগুলো বোঝাননি; বরং তিনি ব্যাপকার্থে কথাটি বলেছেন। কেননা তিনি এটি বলেছেন ইলমের মর্যাদা বোঝাতে। আর কথাটি যত ব্যাপক হবে, ইলমের মর্যাদা তত বেশি প্রকাশ পাবে। তাছাড়া শারেহীনের উদ্দেশ্যও এটা নয় যে, তারা যে যা বলেছেন, ইলমের মা‘লাম বলতে শুধু সেগুলোই; বরং সংক্ষেপের জন্য বা উদাহরণ হিসেবে তারা মা‘লামের কয়েকটি أفراد উল্লেখ করেছেন। এতে তো সন্দেহ নেই যে, معالم-এর উমূমের মধ্যে মাজালিসে ফিকহ, ফুকাহায়ে দ্বীন এবং সকল দ্বীনী মারকায ও মাদরাসাও অন্তর্ভুক্ত।
أعلام শব্দটি عَلَم-এর বহুবচন। এর একাধিক অর্থ। যেমন–
الْعَلامَة والأثر، وَشَيْء مَنْصُوب فِي الطَّرِيق يُهتَدى بِه، والجبل، والراية.
যেহেতু عَلَم-এর এক অর্থ আলামত সেহেতু وأعلامه-এর ব্যাখ্যায় কেউ কেউ বলেছেন–
المراد بها: الأسباب الشرعية، كدلوك الشمس للصلاة، وملك النصاب للزكاة، وشهود الشهر للصوم، والبيت للحج.
(وهذا فيما يبدو بعيد.)
আবার কেউ বলেছেন, এখানে ফুকাহা-মুজতাহিদীন ও আলেম-উলামার কথা বলা হয়েছে। আমাদের খেয়ালে এটিই বেশি গ্রহণযোগ্য। ছাহেবে কেফায়া বলেন–
وقيل: المراد بالأعلام العلماء الذين يقتدى بهم، وله وجه حيث يطلق الأعلام ويراد بها العلماء في كثير من المواضع.
এটাও হতে পারে যে, أعلام শব্দটি এখানে معالم-এর মুরাদিফ হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে।
قوله: وأَظْهَرَ شعائرَ الشَّرْعِ وأحكامَه
এখানে أظهر -এর অর্থ সাধারণত তালিবুল ইলম ভাইগণ ‘প্রকাশ করেছেন’ বলে থাকেন। আমাদের খেয়াল হল, এটি কুরআন মাজীদের আয়াত–
هُوَ الَّذِیْۤ اَرْسَلَ رَسُوْلَهٗ بِالْهُدٰی وَ دِیْنِ الْحَقِّ لِیُظْهِرَهٗ عَلَی الدِّیْنِ كُلِّهٖ .
থেকে গৃহীত, যার অর্থ শুধু প্রকাশ করা নয়, বরং এতে إعلاء ও غلبة-ও রয়েছে। তখন এটি أعلى معالم العلم-এর أعلى-এর সাথে মিলে যাবে।
ছাহেবে হেদায়া বলেন–
وبعث رسلا وأنبياء -صلوات الله عليهم أجمعين وسلامه- إلى سبل الحق هادين، وأخلفهم علماء إلى سَنَنِ سُنَنِهم داعين، يسلكون فيما لم يؤثر عنهم مسلك الاجتهاد، مسترشدين منه في ذلك، وهو ولي الإرشاد، وخص أوائل المستنبطين بالتوفيق،حتى وضعوا مسائل من كل جلي ودقيق.
قوله: إلى سَنَنِ سُنَنِهم
এখানে প্রথম سنن হল بفتح السين المهملة। এই শব্দের যব্ত ছাহেবে হেদায়া থেকে এভাবে বর্ণিত হয়েছে। ইমাম আতকানী রাহ. লেখেন–
إلا أن الرواية بالمفتوح خاصة، لأن المضموم في معناه قليل الاستعمال.
ছাহেবে হেদায়া নবীগণের প্রসঙ্গে বলেছেন– إلى سبل الحق هادين আর আলেমদের সম্পর্কে বলেছেন–
إلى سنن سننهم داعين.
هادين হল رسلا وأنبياء-এর সিফত আর داعين হল علماء-এর সিফত। তবে কেউ কেউ এগুলো حال হওয়ার পক্ষে মত ব্যক্ত করেছেন। আল্লামা আইনী এটি শক্তভাবে খণ্ডন করেছেন। তিনি বলেছেন–
م : (هادين) ش : نصب على أنه صفة لقوله) :رسلا وأنبياء(، ويقال: نصب على الحال من )رسلا(، وليس بصحيح؛ لأن الحال من النكرة لا يصح إلا بتقديم ذي الحال على الحال. وقد علم أن حق الحال أن يكون نكرة، وحق ذي الحال أن يكون معرفة، للفرق بينهما وبين الصفة والموصوف، فقيل: لأن الحال هو الخبر في الحقيقة، والخبر حقه التنكير. قلت: هما يتفقان في هذا، ولكنهما يفترقان من وجوه، الأول:..
(আলবিনায়া, আইনী ১/১১৮)
আরও একটি কারণ, صفة হল দায়েমী গুণ। আর হাল শুধু عامل তথা ফেয়েল ঘটার সময়ের অবস্থা বোঝায়। অর্থাৎ فاعل থেকে فعل কী অবস্থায় صدور হয়েছে, অথবা মাফউলের ওপর ফেয়েল কী অবস্থায় واقعহয়েছে– শুধু সেটি বোঝায়। যেমন–
جاءني زيد راكبا.
এখানে راكبا হালটি শুধু যায়েদের আসার অবস্থা বোঝায়। সে হিসেবে এ দুটিকে حال ধরা হলে هادينশুধু بعث-এর এবং داعين শুধু أخلف-এর সময়ের অবস্থা বোঝাবে। অথচ তা সঠিক নয়।
এরপর ছাহেবে হেদায়া বলেন–
غير أن الحوادث متعاقبة الوقوع، والنوازل يضيق عنها نطاق الموضوع، واقتناص الشوارد بالاقتباس من الموارد والاعتبار بالأمثال من صنعة الرجال، وبالوقوف على المآخذ يعض عليها بالنواجذ.
অনেক শরাহ ও হাশিয়ায় এটিকে একটি সুওয়ালে মুকাদ্দারের জবাব ধরা হয়েছে। সুওয়ালটি হল, যদি মুতাকাদ্দিমীন ছোট-বড় মাসআলা প্রণয়ন করেই ফেলেন, তাহলে আপনার কিতাব লেখার প্রয়োজন কী? ছাহেবে হেদায়া এর জবাব দেন, নিত্যনতুন ঘটনা ও সমস্যা তো একের পর এক আসছেই।...
এই তাওজীহে একটি বড় প্রশ্ন তৈরি হয় যে, তাহলে হেদায়া কি حوادث ও نوازل-এর কিতাব? তা তো নয়। কারণ এটি আগাগোড়া মানসূস আলাইহি মাসায়েলের কিতাব। এতে মুতাকাদ্দিমীন থেকে বর্ণিত মাসায়েল ও সেগুলোর দালায়েল সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। আমাদের দৃষ্টিতে এ প্রশ্নটি এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই। তাই আমাদের খেয়ালে এই তাওজীহ এখানে মিলবে না।
আমাদের দৃষ্টিতে এর তাওজীহ হল, ছাহেবে হেদায়া খুতবায় প্রথমে আল্লাহ তাআলার প্রশংসা করেন। এরপর নবীগণের বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করেন। তারপর ফুকাহা-মুজতাহিদীন ও আহলে ইলমের বৈশিষ্ট্য ও কীর্তি সম্পর্কে আলোচনা করেন। আহলে ইলমের আবার দুই ভাগ–
ক. মুতাকাদ্দিমীন। তাদের বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে বলেন–
وخص أوائل المستنبطين بالتوفيق،حتى وضعوا مسائل من كل جلي ودقيق.
খ. মুতাআখখিরীন। তাদের প্রসঙ্গে বলেন–
غير أن الحوادث متعاقبة الوقوع، والنوازل يضيق عنها نطاق الموضوع.
অর্থাৎ মুতাকাদ্দিমীন যদিও ইজতিহাদ ও ইসতেম্বাতের ক্ষেত্রে বিশেষভাবে তাওফীক প্রাপ্ত হয়েছেন এবং তাঁরা সমকালীন সব মাসায়েল প্রণয়ন করেছেন, তবে সমস্যা ও মাসআলার ধারার তো শেষ নেই। নিত্যনতুন ঘটনা ও সমস্যা একের পর এক ঘটেই চলেছে, যেগুলোর শরয়ী সমাধান বের করা জরুরি। মুতাআখখিরীন ফুকাহায়ে কেরাম সেগুলোর সমাধান বের করেন।
أوائل المستنبطين-এর প্রথম জামাত খায়রুল কুরূনের ফুকাহায়ে কেরাম। তাদের ইসতেম্বাতসমূহ হাদীস ও আসারের কিতাবসমূহেও সংকলিত হয়েছে, ফিকহ-ফতোয়ার মাবসূত কিতাবসমূহেও সংকলিত হয়েছে। ইমাম আবু হানীফা রাহ. খোদ তাবেয়ী ছিলেন এবং ফিকহ সংকলন করেছেন। তাঁর মাযহাবের সংকলিত রূপ ইমাম মুহাম্মাদ রাহ.-এর কিতাবসমূহে এবং সেসব কিতাবের অনুসরণে লেখা ফুকাহায়ে হানাফিয়ার মাবসূত ও জামে কিতাবসমূহে রয়েছে। মুতাআখখিরীন ফুকাহায়ে কেরামের ইসতেম্বাতসমূহ ফিকহুন নাওয়াযিলের কিতাবসমূহে সংকলিত হয়েছে। ইমাম মারগিনানী রাহ. আইম্মায়ে হানাফিয়ার সংকলিত ফিকহের একটি খুলাসা বিদায়াতুল মুবতাদীতে পেশ করেছেন। আর ফিকহুন নাওয়াযিলের মাসআলাসমূহ ‘মুখতারাতুন নাওয়াযিল’ ও ‘আততাজনীস ওয়াল মাযীদ’-এ পেশ করেছেন।
غير أن الحوادث متعاقبة الوقوع، والنوازل يضيق عنها نطاق الموضوع
–এর পরে একটি জুমলা মালহূয আছে, যদিও তা ইবারতে আসেনি। তা এই–
ووفق أواخر المستنبطين باستنباط أحكام تلك الحوادث والنوازل، فقاموا بذلك أحسن قيام.
ইজতেহাদ, ইসতেম্বাত ও ইসতিখরাজুল মাসায়েল অনেক دقيق ও عميق কাজ। আইম্মায়ে মুজতাহিদীন ও পরবর্তী ফকীহগণ এই কাজটি কীভাবে করেছেন– ছাহেবে হেদায়া সেদিকে অতি সংক্ষেপে ইঙ্গিত করেছেন–
واقتناص الشوارد بالاقتباس من الموارد،والاعتبار بالأمثال،من صنعة الرجال.
-এর মাধ্যমে।
অর্থাৎ ছাহেবে হেদায়া খুতবায় প্রথমে আল্লাহ তাআলার প্রশংসা করেন। এরপর নবীগণের বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করেন। তারপর ফুকাহা-মুজতাহিদীন ও আহলে ইলমের বৈশিষ্ট্য ও কীর্তি সম্পর্কে আলোচনা করেন। আহলে ইলমের আবার দুই শ্রেণি– মুতাকাদ্দিমীন ও মুতাআখখিরীন। ছাহেবে হেদায়া উভয় শ্রেণির কীর্তি ও বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করেন। এভাবে তিনি তাঁর খুতবার প্রারম্ভ সাজান। এরপর–
وقد جرى عليّ الموعد..
বলে তিনি হেদায়া গ্রন্থ রচনার কারণ ও প্রেক্ষাপট বর্ণনা করেন। এবার চিন্তা করি, ছাহেবে হেদায়ার খুতবার প্রারম্ভ কত সুন্দর ও পরিপূর্ণ।
দেখুন, যদি غير أن الحوادث...-কে হেদায়া রচনা প্রেক্ষাপট বর্ণনার সূচনা ধরা হয়, তাহলে এটি হবে সম্পূর্ণ নতুন কথা, যা আগের কথা থেকে আলাদা। তখন তো প্রশ্ন দাঁড়াবে, আপনি শুধু উলামায়ে মুতাকাদ্দিমীন সম্পর্কে বলেছেন এবং মুতাআখখিরীনের প্রসঙ্গ ছেড়ে দিয়েছেন। ফলে ছাহেবে হেদায়ার খুতবা বড় অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। বরং وخص أوائل المستنبطين দ্বারা সহজে বোঝা যায় যে–
غير أن الحوادث متعاقبة الوقوع، والنوازل يضيق عنها نطاق الموضوع
ইবারতটি মুতাআখখিরীনের বৈশিষ্ট্য বলার জন্য; কিতাব রচনার প্রেক্ষাপট বর্ণনার জন্য নয়।
قوله : نطاق الموضوع
এখানে الموضوع মানে ‘বিষয়বস্তু’ বা ‘আলোচ্য বিষয়’ নয়। বরং একটু আগে মুতাকাদ্দিমীন সম্পর্কে যে বলা হল–
حتى وضعوا مسائل من كل جلي ودقيق.
সেখান থেকে موضوع শব্দটি নেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ মুতাকাদ্দিমীনের প্রণয়নকৃত মাসআলাসমূহ। অনেক ছাত্র এর অর্থ করে ‘বিষয়বস্তু’ বা ‘আলোচ্য বিষয়’, যা স্পষ্ট ভুল।
قوله: واقتناص الشوارد...
সাধারণত اقتناص الشوارد-কে মুবতাদা আর بالاقتباس من الموارد-কে খবর ধরে এক জুমলা বলা হয়। তেমনিভাবে والاعتبار بالأمثال-কে মুবতাদা আর من صنعة الرجال-কে খবর বলে আরেক জুমলা ধরা হয়। তখন অর্থ করা হয় এভাবে– شوارد শিকার করা হয় موارد থেকে (অর্থাৎ আধুনিক কঠিন মাসআলাসমূহ আহরণ করা হয় দালায়েল থেকে আলো গ্রহণ করে ) এবং أمثال-এর মাধ্যমে اعتبار করা (অর্থাৎ সাদৃশ্যপূর্ণ মাসায়েলের ওপর কিয়াস করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা) অতি কামিল লোকদের কর্ম।
কিন্তু তখন প্রশ্ন হয়, ‘শাওয়ারেদ শিকার করা হয় মাওয়ারেদ থেকে’– এই কথার সাথে ‘আমছালের মাধ্যমে اعتبار করা অতি কামিল লোকদের কর্ম’– এই কথার কী সামঞ্জস্য?
আমাদের খেয়ালে, بالاقتباس من الموارد এটি আলাদা شبه الفعل-এর সাথে متعلقহয়ে اقتناص-এর খবর নয়; বরং এটি সরাসরি اقتناص-এর সাথে متعلق। তখন এটি খবর হবে না। বরং এটি اقتناص-এর সাথে মিলে পুরোটা মুবতাদা হয়ে معطوف عليه। আর والاعتبار بالأمثال মাতূফ হয়ে দ্বিতীয় মুবতাদা। আর من صنعة الرجال উভয় মুবতাদার খবর। মূল ইবারতটি হবে এইরূপ–
واقتناصُ الشوارد بالاقتباس من الموارد والاعتبارُ بالأمثال: من صنعةِ الرجال.
অবশ্য الاعتبار এটি الاقتباس-এর ওপর আত্ফ হয়ে মাজরূরও হতে পারে। তখন ইবারত হবে এমন–
واقتناص الشوارد بالاقتباسِ من الموارد والاعتبارِ بالأمثال : من صنعة الرجال.
মোটকথা যদি পুরোটাকে এক জুমলা না ধরে বরং واقتناص الشوارد بالاقتباس من الموارد -কে এক জুমলা আর والاعتبار بالأمثال من صنعة الرجال-কে আলাদা জুমলা ধরা হয়, তাহলে দুই জুমলার মাঝে তেমন মিল পাওয়া যায় না।
قوله: وبالوقوف على المآخذ يعض عليها بالنواجذ
এই বাক্যে المآخذ দ্বারা আহকামের মানাত ও ইল্লত বোঝানো হয়েছে। বলতে চাইছেন, ইসতেম্বাতের ক্ষেত্রে تنقيح المناط ও استخراج المسائل অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। সেটা পেয়ে গেলে (تحقيقا أو تقليدا) তার খুব গুরুত্ব দেওয়া দরকার। এই বাক্যটি ফুকাহায়ে কেরামের ফিকহ থেকে ইসতেফাদাকারী মুতাফাক্কিহীনের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য বলা হয়েছে। والله تعالى أعلم.
কোনো কোনো শারেহের দাবি, ছাহেবে হেদায়া এই কথাগুলোর মাধ্যমে হেদায়া রচনার বিষয়ে নিজের সালাহিয়্যাত ও উপযুক্ততা সাব্যস্ত করেছেন। তিনি বলতে চাইছেন, মুতাকাদ্দিমীনও রিজাল, আমরাও রিজাল।
أي : الحكم بالقياس من شأن الرجال، وما كان المتقدمون إلا رجالا من بني آدم، فهم رجال ونحن رجال، فيسوغ لنا التصنيف والاجتهاد كما ساغ لهم، وهذا كله عذر من الشيخ رحمه الله عن شروعه في التصنيف.
(গায়াতুল বায়ান, আতকানী ১/২৬)
আমাদের দৃষ্টিতে এটিও সহীহ নয়। কেননা ছাহেবে হেদায়ার تواضع সুপ্রসিদ্ধ। এই ব্যাখ্যা তার তাওয়াযুর সাথে খাপ খায় না। আর এতে তাঁর খুতবা অসম্পূর্ণ থেকে যায়।
আবার কেউ বলেছেন, এটি মুসান্নিফ নিজের অযোগ্যতা প্রকাশের জন্য বলেছেন। অর্থাৎ এ কাজগুলো তো রিজালের, আর আমার মধ্যে তো এসব যোগ্যতা নেই। তারপরও আমি এ রচনা শুরু করেছি এজন্য যে, বিদায়াতুল মুবতাদীর শুরুতে ওয়াদা করেছিলাম, আমি কিফায়াতুল মুনতাহী নামে বিদায়াতুল মুবতাদীর একটি শরাহ লেখব। আর যেহেতু ওয়াদা করেছি, সেহেতু অযোগ্যতা সত্ত্বেও ওয়াদার কারণে আমার জন্য এই শরাহটি লেখার কিছু বৈধতা তৈরি হয়েছে।
আমাদের দৃষ্টিতে এটি نكتة بعد الوقوع-এর পর্যায়েরই একটি কথা। কেননা মুসান্নিফ উক্ত কথাটি কিতাব রচনার প্রেক্ষাপট হিসেবে বলেননি; বরং এর দ্বারা তিনি ফুকাহায়ে কেরামের বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করেছেন।
যাহোক আমাদের দৃষ্টিতে তিনি الحمد لله থেকে নিয়ে يعض عليها بالنواجذ পর্যন্ত প্রথমে আল্লাহ তাআলার প্রশংসা করেন, এরপর নবী-রাসূলগণের বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করেন, তারপর উলামায়ে মুতাকাদ্দিমীন ও উলামায়ে মুতাআখখিরীনের কীর্তি ও বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে আলোচনা করেন। এরপর وقد جرى علي الموعد থেকে হেদায়া রচনার প্রেক্ষাপট বর্ণনা শুরু করেন।
ছাহেবে হেদায়া বলেন–
وقد جَرى عليَّ الموعدُ في مبدأ >بداية المبتدي< أن أشرَحَها بتوفيق الله شرحاً أرسُمُه بـ>كفاية المنتهي<، فشَرَعتُ فيه، والوعد يُسَوِّغُ بعضَ المساغِ.
قوله : والوعد يُسَوِّغُ بعضَ المساغِ
এর অর্থ হল, আমার যোগ্যতার দৈন্যতা তো জানা কথা। এর পরও যেহেতু বিদায়াতুল মুবতাদীর শুরুতে ওয়াদা করেছি, তাই এর শরাহ রচনার কাজ আরম্ভ করেছি।
এরপর ছাহেবে হেদায়া বলেন–
وحين أكاد أتكئ عنه اتكاء الفراغ: تبينت فيه نبذا من الإطناب، وخشيت أن يهجر لأجله الكتاب، فصرفت العنان والعناية إلى شرح آخر موسوم بـ>الهداية<، أجمع فيه بتوفيق الله تعالى بين عيون الرواية، ومتون الدراية، تاركا للزوائد في كل باب، معرضا عن هذا النوع من الإسهاب، مع ما أنه يشتمل على أصول تنسحب عليها فصول، وأسأل الله تعالى أن يوفقني لإتمامها، ويختم لي بالسعادة بعد اختتامها.
قوله : عيون الرواية ومتون الدراية
এখানে রেওয়ায়াত বলতে ফিকহী রেওয়ায়াত। অর্থাৎ যেসব মাসায়েল মজবুত সূত্রে ইমামগণ থেকে বর্ণিত; শায বা অগ্রহণযোগ্য বর্ণনা নয়। আর দেরায়াত বলতে তার দলীল। আকলী হোক বা নকলী। অর্থাৎ তিনি প্রথমে ইমামগণ থেকে মজবুত সূত্রে বর্ণিত মাসায়েল উল্লেখ করবেন। এরপর সেগুলোর শক্তিশালী নকলী বা আকলী দলীল উল্লেখ করবেন।
সাধারণত তালিবুল ইলম ভাইগণ عيون الرواية বলতে নকলী দলীল মনে করেন। আর متون الدراية বলতে মনে করেন আকলী দলীল। এটা ভুল। রেওয়ায়াত ও দেরায়াত শব্দদুটি নকলী দলীল ও আকলী দলীল অর্থেও ব্যবহৃত হয়। তবে এখানে শব্দদুটি প্রথম অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। তাই কোথায় কোন্ অর্থে শব্দদুটি ব্যবহৃত হয়েছে তা সিয়াক-সিবাক ও প্রেক্ষাপট দেখে বুঝতে হবে।
قال في >العناية< : >وعيون الرواية هي التي اختارها العلماء رحمهم الله، فإن عين الشيء خياره، ومتون الدراية المعاني المؤثرة والنكات المتينة<.
وقال في >غاية البيان<: >قوله: (عيون الرواية)، أراد بها صور المسائل، من قولهم: عين الشيء لنفسه. (ومتون الدراية)، أراد بها الدلائل، من قولهم: رجل مَتْنٌ، أي صَلْبٌ، لأن قوة الدليل لا تحصل إلا بها<.
قوله: وأسأل الله تعالى..
কিফায়াতুল মুনতাহীর পরিসমাপ্তির কাছাকাছি পৌঁছার পর মুসান্নিফ রাহ. উল্লেখিত মানহাজ মোতাবেক হেদায়া নামে মুতাওয়াসসিত পর্যায়ের যে শরাহ লেখার ইচ্ছা করেছিলেন, সে শরাহ্র ইতমামের জন্যই এই প্রার্থনা।
এক মতনের জন্য দুই ধরনের দুইটি শরাহ লেখার হেকমত বর্ণনা করতে গিয়ে মুসান্নিফ রাহ. বলেন–
حتى إن من سمت همته إلى مزيد الوقوف: يرغب في الأطول والأكبر، ومن أعجله الوقت عنه: يقتصر على الأقصر والأصغر، وللناس فيما يعشقون مذاهب، والفن : خير كله.
অর্থাৎ যার বিশদভাবে জানার হিম্মত আছে সে যেন দীর্ঘ ও বৃহৎ শরাহ্র প্রতি আগ্রহী হয়। আর যে অল্প সময়ে পড়তে চায়, সে যেন তুলনামূলক সংক্ষিপ্ত ও ছোট শরাহটি অধ্যয়ন করে।
এরপর ছাহেবে হেদায়া বলেন–
ثم سألني بعض إخواني أن أملي عليهم المجموع الثاني، فافتتحته مستعينا بالله تعالى في تحرير ما أقاوله، متضرعا إليه في التيسير لما أحاوله، إنه الميسر لكل عسير، وهو على ما يشاء قدير، وبالإجابة جدير، وإليه المرجع والمصير، وهو حسبنا ونعم الوكيل، وما توفيقي إلا بالله.
এই حتىহল ابتدائية। অর্থাৎ এটা বলে আরও কথা শুরু হচ্ছে, যার ভিত্তি পূর্বের কথার ওপর। এ حتى-কে পূর্বোল্লেখিত فصرفت العنان -এর সাথে متعلق ব বলা যেতে পারে।
قوله : أن أملي عليهم
মুসান্নিফ إملا-এর যে কথা বলেছেন, ইমলা শব্দের কারণে কারও মনে হতে পারে, তিনি হয়তো হেদায়া আগেই লিখে ফেলেছেন। এখন শুধু ইমলা করছেন তথা তাদের লেখাচ্ছেন। কিন্তু এটা ঠিক নয়। কেননা এ ইবারতেই আছে–
فافتتحته مستعينا بالله في تحرير ما أقاوله، متضرعا إليه في التيسير لما أحاوله.
(ফলে আমি তা আরম্ভ করলাম, তাঁর দরবারে সকাতর প্রার্থনা সহকারে, যেন তিনি আমাকে তাওফীক দান করেন, আমি যেন আমার বক্তব্য সঠিক ও সুন্দরভাবে উপস্থাপন করতে পারি এবং তিনি যেন আমার প্রয়াস সহজ করে দেন।)
এখান থেকে বোঝা যায়, তিনি হেদায়ার সংকলন এইমাত্র শুরু করছেন। হাঁ, এটুকু হতে পারে, তিনি যে বলেছেন–
فصرفت العنان والعناية..
এর অর্থ হল, তিনি তখন থেকে হেদায়া সংকলনের প্রস্তুতি গ্রহণ করছেন। এরপর এখন তা সাজিয়ে লিখছেন ও লেখাচ্ছেন।
قال العيني: >قوله: (أن أملي عليهم)، من الإملاء، يقال أمليت الكتاب وأملي وأمليت، لغتان جيدتان جاء بهما القرآن، وكلمة ্রأنগ্ধ مصدرية، تقديره: سألني بعض إخواني إملاء المجموع الثاني عليهم، والمراد >الهداية<، فكأنه بعد صرف العناية إليه لم يشرع فيه حتى سأله بعض إخوانه الإملاء عليهم<.
যাহোক এই হল হেদায়ার খুতবা হলের ক্ষেত্রে আমাদের বুঝ। একজন উস্তায মানেই তার কাছে ছাত্ররা আসা-যাওয়া করে। সে হিসেবে হেদায়ার অনেক ছাত্র অধমকে কিতাব শোনাতে আসে। যখন খুতবা শুনি, দেখি একেকজন একেক কথা বলে, যা শুনে কষ্ট লাগে।
আমরা আমাদের বুঝটি উলামা, আসাতিযা ও তলাবা হযারাতের সামনে পেশ করলাম। আল্লাহ সেই ব্যক্তিদের প্রতি নিজ শান মোতাবেক দয়া করুন, যারা আমাদের ভুল-ত্রুটি সংশোধন করে দেবেন।
إن الله يجزي المتصدقين، ويرعى الصالحين.