সব কথা বলতে নেই
ওয়াসআতুল্লাহ খান
ইরাক-ইরান যুদ্ধ ১৯৮০ সালেই শেষ হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু সাদ্দাম হুসাইন আরব মিত্রদের কাছে নিজেকে আরও বড় জাহির করার নেশায় ১৯৯০ সালের আগস্টে কুয়েত আক্রমণ করে বসে। অথচ ইরাক-ইরান যুদ্ধ চলাকালে কুয়েতই সাদ্দাম হুসাইনকে সবচেয়ে বেশি অর্থ সহায়তা দিয়েছিল। যার ফলে উপসাগরীয় দেশগুলোর নিজেদের অভ্যন্তরীণ হুমকি ঠেকাতে যুক্তরাষ্ট্রের শরণাপন্ন হতে হয়। পরবর্তীতে আমেরিকা-উপসাগরীয় জোট কুয়েতকে মুক্ত করে নেয়। আর সাদ্দাম হুসাইনের ভাগ্য মুখ থুবড়ে পড়ে।
১৯৯৫ সালে আমেরিকা বাহরাইনে তাদের পঞ্চম নৌ সদর দপ্তর স্থাপন করে। ২০০১ সালের জানুয়ারিতে উপসাগরীয় সহযোগিতা পরিষদের (GCC) সদস্য দেশগুলো যৌথ প্রতিরক্ষা চুক্তি করে। এতে অঙ্গীকার করা হয়, কোনো সদস্য রাষ্ট্রের ওপর বহিঃআক্রমণ গোটা পরিষদের ওপর আক্রমণ হিসেবে পরিগণিত হবে এবং সম্মিলিতভাবে এর জবাব দেওয়া হবে।
২০০২ সালে আমেরিকা তার সেন্ট্রাল কমান্ডের আঞ্চলিক হেডকোয়ার্টার সৌদি আরবের প্রিন্স সুলতান বিমানঘাঁটি থেকে কাতারে সরিয়ে নেয়। আর দোহার ‘আল উদেইদ’ (Al Udeid) হয়ে ওঠে মধ্যপ্রাচ্যের সবচেয়ে বড় মার্কিন বিমানঘাঁটি। যেখানে একসাথে প্রায় দশ হাজার সেনা থাকার ব্যবস্থা ছিল।
২০২০ সালের সেপ্টেম্বরে ট্রাম্পের প্রথমবার রাষ্ট্রপতি থাকাকালে সংযুক্ত আরব আমিরাত ও বাহরাইন ইসরাইলের সঙ্গে ‘আব্রাহাম চুক্তি’ স্বাক্ষর করে। পরে মরক্কো ও সুদানও এতে যুক্ত হয়। কাতার ‘আব্রাহাম চুক্তি’তে চুক্তিবদ্ধ না হলেও একইসাথে পিএলও ও হামাসের সঙ্গে যেমন সম্পর্ক বজায় রেখেছিল, তেমনি ইসরাইলের সঙ্গেও তার আনুষ্ঠানিক যোগাযোগ ছিল। যার সুবাদে ফিলিস্তিনী কর্তৃপক্ষ, হামাস ও ইসরাইলের মধ্যে মিশরের পাশাপাশি কাতারও মধ্যস্থতার সেতু হয়ে ওঠে।
২০০৭ সালে হামাস যখন গাজায় নির্বাচনে জয়লাভ করে সরকার গঠন করে এবং পিএলও-কে গাজা থেকে উৎখাত করে, তখন ইসরাইল গাজাকে অবরুদ্ধ করে রাখে। কিন্তু ইসরাইলের মৌন সম্মতিতে কাতার হামাস প্রশাসনকে আর্থিক ও পুনর্গঠনে সহায়তা দিতে থাকে।
২০১২ সালে আমেরিকার অনুরোধে কাতার দোহায় হামাসের রাজনৈতিক কার্যালয় প্রতিষ্ঠার অনুমতি দেয়। যেন প্রয়োজনে আমেরিকা হামাসের সাথে পরোক্ষ যোগাযোগ রাখতে পারে। কাতার খালেদ মিশাল, ইসমাইল হানিয়া, খালীল আলহাইয়াসহ হামাসের শীর্ষ নেতাদের আতিথ্য দেয়। এখনো হামাসের শীর্ষ নের্তৃবৃন্দ ছাড়াও সংগঠনটির প্রায় এক হাজার সদস্য ও তাদের পরিবার কাতারে বসবাস করছেন।
২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর দক্ষিণ ইসরাইলে হামাস ও ইসলামিক জিহাদের যৌথ হামলার পর ইসরাইলের জিম্মি মুক্তি ও দুটি অস্থায়ী যুদ্ধবিরতিতে কাতার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে এবং একেবারে সাম্প্রতিক সময় পর্যন্ত সকল পক্ষের মাঝে মধ্যস্থতার ভূমিকা পালন করে।
১৯৯৭ সালে ইসরাইল জর্ডানের রাজধানী আম্মানে খালেদ মিশালকে হত্যার ব্যর্থ চেষ্টা চালিয়েছিল। আর গত বছর তেহরানে হামলা চালিয়ে ইসমাইল হানিয়াকে হত্যা করে। তবে কেউ ভাবেনি যে, আমেরিকার ঘনিষ্ঠ মিত্র কাতারকে ইসরাইল সরাসরি লক্ষ্যবস্তু বানাবে। তাও আবার এমন সময়ে, যখন হামাসের নের্তৃবৃন্দ আমেরিকার প্রস্তাবিত শান্তিচুক্তি নিয়েই আলোচনায় বসেছিল।
ইসরাইলের যদি যুদ্ধ কিংবা মানবিক নীতি-আদর্শ বলে কিছু থাকে, তবে তা বাকি বিশ্বের মানদণ্ডের সঙ্গে মেলে না। কাতারে চালানো ৯ সেপ্টেম্বরের হামলা আকস্মিক ছিল না। ইসরাইলের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা সংস্থা শিন বেতের একজন কর্মকর্তা জানায়, ইরানের সাথে যুদ্ধবিরতির পর থেকেই এ হামলার পরিকল্পনা চলছিল।
এটিও অবিশ্বাস্য যে, এ হামলার বিষয়ে আমেরিকার পূর্ব সম্মতি নেওয়া হয়নি। যদি ধরে নেওয়া হয় যে, সত্যিই জানানো হয়নি। তবুও অবাক লাগে, কাতারে স্থাপিত মার্কিন বিমান বাহিনীর রাডার সিস্টেম ইরানের উৎক্ষেপিত ক্ষেপণাস্ত্র ওড়ার আগেই শনাক্ত করতে সক্ষম হলেও ১৫টি ইসরাইলী জঙ্গি বিমান দেখতে পারল না! যেগুলো দুই হাজার কিলোমিটার উড়ে জর্ডান, উত্তর সিরিয়া ও ইরাক অথবা জর্ডান ও সৌদি আরব পাড়ি দিয়ে কাতারের আকাশসীমায় প্রবেশ করে এবং নিজেদের মিশন সফল করে নিরাপদে ফিরে যেতে সমর্থ হয়!
অবশ্য আমেরিকার দাবি, ইসরাইলের স্বেচ্ছাচারিতায় হামলাটি হয়েছে। আর বিমানগুলো আকাশে ওড়ার পরই তাঁকে জানানো হয়েছে। ট্রাম্প যদি শেষ মুহূর্তেই খবর পেয়ে থাকেন, তবুও তাঁর হাতে দেড় ঘণ্টা সময় ছিল। এ সময়ের মধ্যে সে নেতানিয়াহুর সাথে যোগাযোগ করে এমন এক রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে অহেতুক আক্রমণ করা থেকে বিরত রাখতে পারত, যে রাষ্ট্র মাত্র সাড়ে তিন মাস আগেই প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে উষ্ণ সংবর্ধনা জানিয়েছে এবং একটি বিমানও উপহার দিয়েছে। কিন্তু ট্রাম্প সম্পর্কের দাবি উপেক্ষা করে কাতারের আমিরকে অগ্রিম সতর্ক করেছে, যখন ইসরাইলের বিমানগুলো হামাসের দপ্তরে ক্ষেপণাস্ত্র বর্ষণ করছিল।
মিশন সম্পন্ন হওয়ার কয়েক ঘণ্টা পর হোয়াইট হাউস ইসরাইলের এ হামলার প্রতি ‘অসন্তুষ্টি’ প্রকাশ করেছে। আর চক্ষুলজ্জায় প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ফোনে কাতারের আমিরকে আশ্বস্ত করেন যে, ভবিষ্যতে এমনটি হবে না।
কিন্তু ট্রাম্পের এই আশ্বস্তির প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে নেতানিয়াহু সাফ জানিয়ে দিয়েছে, কাতার যদি হামাসকে বের করে না দেয়, তাহলে প্রয়োজনে আবারও অভিযান চালানো হবে।
আমেরিকার ওপর ইসরাইলের প্রভাব এত বেশি যে, জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ কাতারে হামলার বিরুদ্ধে নিন্দা প্রস্তাব আনলেও আমেরিকা এই শর্তে সম্মতি জানিয়েছে যে, এতে ইসরাইলের নাম উল্লেখ করা যাবে না।
ইসরাইল সাধারণত বিরোধীদের দমনের জন্য মোসাদকে ব্যবহার করে এবং নিজেদের জড়ানোকে পছন্দ করে না। কিন্তু এখন তাদের দুঃসাহস এতই বেড়েছে যে, মোসাদের পরিবর্তে প্রকাশ্যে দিবালোকে ইসরাইলের বিমান বাহিনী দিয়ে হামাসের নের্তৃবৃন্দকে হত্যার চেষ্টা চালায় এবং হামলার কয়েক মিনিটের মধ্যেই প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু এর দায়ও স্বীকার করে।
জাতিসংঘে ট্রাম্পের অসন্তুষ্টির বিষয়ে মন্তব্য করতে গিয়ে ইসরাইলের রাষ্ট্রদূত ড্যানি ড্যানন বলেন, আমরা সব সময় আমেরিকার স্বার্থ অনুযায়ী কাজ করি না। আর আমেরিকাকে সবকিছু আগে থেকে জানাতেও বাধ্য নই।
ওয়াশিংটনে ইসরাইলের রাষ্ট্রদূত ইয়েখিয়েল লাইতার (Yechiel Leiter) বলেন, হামাসকে সমূলে ধ্বংস করতে ইসরাইল যখন ও যেখানে খুশি অভিযান চালাবে। এবার তারা বেঁচে গেলেও পরেরবার আর বাঁচতে পারবে না।
ইউরোপও এ অভিযানের বিষয়ে দ্বিচারিতার পরিচয় দিয়েছে। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী কেয়ার স্টারমার (Keir Starmer) একদিকে সংসদ অধিবেশনে ইসরাইলের হামলার তীব্র নিন্দা জানিয়েছেন এবং কাতারের আমিরের সাথে ফোনে কথা বলেছেন। অন্যদিকে নিজ বাসভবনে ইসরাইলের প্রেসিডেন্ট আইজ্যাক হারজোগকে (ওংধধপ ঐবৎুড়ম) উষ্ণ অভ্যর্থনাও জানান। হামলার প্রতি জার্মানি দুঃখ প্রকাশ করলেও ইসরাইলের সাথে দীর্ঘদিনের সম্পর্ক অটুট রাখার প্রতিশ্রুতিও ব্যক্ত করেছে। ভারতের নরেন্দ্র মোদি একদিন পর কাতারের ভাইদের প্রতি সহানুভূতি জানিয়েছে। অথচ হামলার দুদিন আগে ইসরাইলের অর্থমন্ত্রী বেজালাল স্মোত্রিখ (Bezalel Smotrich) নয়াদিল্লিতে পারস্পরিক সহযোগিতা চুক্তি স্বাক্ষর করেছে।
উপসাগরীয় সহযোগিতা পরিষদের সদস্যরা সংহতি প্রকাশের জন্য পৃথক পৃথকভাবে দোহা সফর করেছেন। কিন্তু পরিষদের কেউই ২০০১ সালের যৌথ প্রতিরক্ষা চুক্তির কথা উল্লেখ করেনি।
মনে পড়ে, ২০১০ সালে মোসাদের ৮/১০ জন এজেন্ট ইউরোপের ভুয়া পাসপোর্ট নিয়ে দুবাই যায় এবং সেখানকার একটি হোটেলে হামাস নেতা মাহমুদ আলমাবহুহকে হত্যা করে নির্বিঘ্নে ফিরে গিয়েছিল। আক্রান্ত দেশ কি তখন কোনো আইনি ব্যবস্থা নিয়েছিল? হয়তো নিয়েছিল। সব কথা বলতে নেই।
[একটি বিদেশি দৈনিক থেকে
অনুবাদ : মুহাম্মাদ আবদুল্লাহ ফাহাদ।]