সংগীতের শিক্ষক নয়
‖ প্রাথমিক বিদ্যালয়ে দরকার ধর্মীয় শিক্ষক
প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সংগীত শেখানোর জন্য স্বতন্ত্র শিক্ষক নিয়োগের প্রজ্ঞাপন জারি হয়েছে গত ২৮ আগস্ট। জানা গেছে, প্রথম পর্যায়ে সারা দেশে দুই হাজার ৫৮৩ জন সংগীত শিক্ষক নিয়োগের সিদ্ধান্ত হয়েছে। পরবর্তী ধাপে নিয়োগের সংখ্যা বাড়ানো হবে। বিষয়টি প্রাথমিক ও গণশিক্ষা বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের হলেও অর্থ বরাদ্দ ও অন্যান্য প্রশাসনিক আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করার প্রয়োজনে প্রজ্ঞাপনটি জারির আগে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের অনুমোদনও নেওয়া হয়েছে। এর মানে হল, দেশব্যাপী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে, শহরে গ্রামের সব জায়গায় কোমলমতি শিশুদের নাচ-গান শেখানোর আয়োজনটি পাকাপাকি করেই নেমেছে এ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বশীলরা।
প্রজ্ঞাপন জারি করা ও খবরটি সামনে আনার ক্ষেত্রেও একটি সূক্ষ্ম চাতুর্যের আশ্রয় নেওয়া হয়েছে। সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগে নারী কোটা সংশোধন, শিক্ষকের পদোন্নতি, বয়স ইত্যাদি বেশ কয়েকটি ইস্যুর সঙ্গে যুক্ত করে সংগীত শিক্ষক নিয়োগের প্রজ্ঞাপনটি জারি করা হয়েছে এবং খবরটি সামনে আনা হয়েছে।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উদ্যোগে এজাতীয় একটি পদক্ষেপের খবর ছড়িয়ে পড়ার পরপরই ধর্মপ্রাণ দল, মহল ও সাধারণ মানুষ প্রতিবাদী প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন। তারা বলেছেন, প্রায় ৯০ ভাগ মুসলিমের এই দেশে ইসলাম ধর্মীয় বিষয়ে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পাঠদানের জন্য স্বতন্ত্র ও যোগ্য শিক্ষক নেই। স্বতন্ত্র ও যোগ্য ধর্মীয় শিক্ষক নিয়োগের কোনো উদ্যোগও নেই। সেখানে ধর্মীয় শিক্ষক নিয়োগের প্রয়োজনীয়তা ও প্রসঙ্গ পাশ কাটিয়ে গিয়ে সংগীতের শিক্ষক নিয়োগের এই সিদ্ধান্ত ও পদক্ষেপ অত্যন্ত আপত্তিকর। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে জনগণ ও রাষ্ট্রের অর্থে গানের শিক্ষক নিয়োগের পরিবর্তে যোগ্য ধর্মীয় শিক্ষক নিয়োগের দাবি ব্যাপকভাবে সামনে এনেছেন তারা।
। দুই।
সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাঠ্যক্রমে অসম্পূর্ণ ও পরিমার্জনযোগ্য হলেও ধর্মীয় বিষয়ে পাঠ্যবই রয়েছে; মুসলিম শিশুদের জন্য ইসলাম বিষয়ক এবং অন্যান্য ধর্মের শিশুদের জন্য অন্য ধর্ম বিষয়ক। কিন্তু ইসলাম বিষয়ক স্বতন্ত্র ও যোগ্য শিক্ষকের অভাবে প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে এসব পাঠ্যবই ঠিকমতো পাঠদান করা হয় না। বাধ্যতামূলক বিষয় না হওয়ায় এ বিষয়টি শেখা ও শেখানোর প্রাতিষ্ঠানিক গরজও কাজ করে না। অপরদিকে দায়ে-ঠেকায় পড়ে কোনো কোনো প্রাথমিক বিদ্যালয় বিরাজমান ধর্ম বিষয়ক পাঠ্যবই অন্য বিষয়ের শিক্ষক-শিক্ষিকারা পড়িয়ে দেন। অনেক সময় ইসলাম সম্পর্কে জানেন না, কুরআন কারীম ও হাদীস শরীফের মূল পাঠ উচ্চারণ করতে পারেন না– এমন শিক্ষকেরাও কোমলমতি শিক্ষার্থীদের ভুলভাল পড়িয়ে থাকেন। খবরে তো এমনও এসেছে যে, ধর্ম শিক্ষকের অভাবে কোনো কোনো বিদ্যালয়ে হিন্দু কিংবা অন্য ধর্মের অনুসারী শিক্ষক পর্যন্ত ইসলাম ধর্ম বিষয়ক বই পাঠদান করেছেন।
পাঠ্যক্রমে থাকার পরও, পাঠ্যবই থাকা সত্ত্বেও ইসলাম ধর্মীয় বই ও বিষয় পাঠদানের জন্য স্বতন্ত্র ও যোগ্য শিক্ষকের ব্যবস্থা না থাকাটা কিছুতেই গ্রহণযোগ্য কোনো ঘটনা হতে পারে না। এ পরিস্থিতির পরিবর্তন করে দ্রুত প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে যোগ্য ধর্মীয় শিক্ষক নিয়োগের ব্যবস্থা করা দরকার।
ফ্যাসিবাদ বিরোধী জনবিপ্লব ও গণঅভ্যুত্থানের এই অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এক বছরের বেশি মেয়াদ পার করেছে। ধর্মীয় ও নৈতিক কোনো প্রয়োজন ও দাবি সামনে এলে এ সরকারের লোকেরা বলেন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার তো, মৌলিক কাজ, দরকারি কাজই করতে পারছে না। কিন্তু দরকারি কাজ না করে অ-দরকারি অনভিপ্রেত কাজের ব্যাপারে তাদের অতি উৎসাহী পদক্ষেপে কোনো কার্পণ্য দেখা যায় না। এজন্যই ধর্মীয় শিক্ষক নিয়োগের পরিবর্তে গানের শিক্ষক নিয়োগে চটজলদি পদক্ষেপ নিতে দেখা যায়। এটা দুঃখজনক ও লজ্জাজনক।
। তিন।
মুসলিম সন্তানদের দ্বীনের মৌলিক ও জরুরি জ্ঞানচর্চা শেখানো সব মুসলিম অভিভাবকের দায়িত্ব। কুরআন কারীমের সহীহ তিলাওয়াত, জরুরি আকীদা, মাসআলা এবং ইসলামী জীবনধারা না জানা থাকলে সাধারণ শিক্ষাধারায় শিক্ষা গ্রহণ করার পর অনেক মুসলিমই পরিণত জীবনে ধর্মীয় বিষয়ে অত্যন্ত অজ্ঞ অবস্থায় থাকেন। এটা কোনোভাবেই ঠিক না; সন্তানদের জন্যও না, অভিভাবকের জন্যও না, একটি মুসলিম সমাজের জন্যও না। অথচ আমাদের সমাজে এ বাস্তবতার লজ্জাজনক বহু চিত্র বিদ্যমান। এটা দূর করতে সরকারি-বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে সঠিক উপায়ে দ্বীন শেখানোর ব্যবস্থা থাকা উচিত। এটাই নিয়মতান্ত্রিক ও স্বভাবজাত উদ্যোগ। কিন্তু এ খাতে রাষ্ট্রীয় অবহেলার কারণে স্কুলগামী শিশুদেরকে কুরআন কারীম শেখানোর জন্য, দ্বীনের জীবন ও বিধান, দ্বীনের আকাইদ-মাসায়েল শেখানোর জন্য নানারকম বিকল্প উদ্যোগ নিতে হয়। যত্নশীল অভিভাবকরা দ্বীন শেখানোর এসব বিকল্প উদ্যোগে শিশুদের যুক্ত করার পদক্ষেপ নিয়ে থাকেন। এতে বাড়তি সময়, ব্যবস্থাপনা ও অর্থ খরচ হয়। কিন্তু দুনিয়া ও আখেরাতের মহা প্রয়োজন বিবেচনায় অল্পসংখ্যক সচেতন অভিভাবকরা সেটা মেনে নেন। বিপরীত দিকে বহু অভিভাবক স্কুল বা বিদ্যালয়ের রুটিনের বাইরে গিয়ে সেরকম ব্যবস্থাপনায় সন্তানদের যুক্ত করতে পারেন না। অনেক জায়গায় বিকল্প ব্যবস্থাপনাটা থাকেও না। এতে মুসলিম নতুন প্রজন্মের জীবনটা দ্বীনের পরিচর্যা থেকে, দ্বীনী শিক্ষার ভিত থেকে বঞ্চিত হয়। অথচ প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যথাযথ উপায়ে দ্বীন শেখানোর ব্যবস্থা থাকলে এমন বেদনাদায়ক ঘটনা ঘটত না।
গোটা জাতির মধ্যেই দুর্নীতি, অসততা ও নৈতিকতার অভাব নিয়ে অনেক রকম যন্ত্রণা ভুগতে এবং হা-হুতাশ করতে দেখা যায়। অথচ নতুন প্রজন্মের জীবনের গোড়ায় ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষা ছড়িয়ে দেওয়ার নিয়মতান্ত্রিক পদক্ষেপটা নিতে দেখা যায় না। সাধারণভাবে এর উপযোগী স্তর হল, প্রাথমিক বিদ্যালয় বা প্রাইমারি স্কুল। জেনারেল ধারায় পড়তে যাওয়া কোমলমতি শিশুদের অন্তরে ও মস্তিষ্কে সঠিক দ্বীন শিক্ষার ভিত্তি রচিত হলে, হালাল-হারামের জ্ঞান ও আল্লাহ তাআলার ভয়-মহব্বত রোপিত হলে এদেশের সততা ও নৈতিকতার চেহারাটা আরও উজ্জ্বল হতে পারত। এবং এখনো গান-বাদ্য হারাম বিনোদনের পরিবর্তে ধর্ম ও নৈতিক শিক্ষার আয়োজনে মনোযোগ দিলে সামনের দিনে এ চেহারাটি উজ্জ্বল হবে, ইনশাআল্লাহ।
। চার।
আধুনিক ও সেক্যুলার মনস্তত্ত্বের বিবেচনায় পদ্ধতিতে, সংগীত মানে হচ্ছে– ‘সংগীত’; গান, বাদ্য, নাচ এবং এসবের প্রাচীন ও আধুনিক নানা আয়োজন। সংগীতের নামে ইসলামী নাশিদ, বাদ্যমুক্ত আবৃত্তি কিংবা দেশাত্মবোধক কিংবা জাগরণমূলক বাদ্যমুক্ত গীত-কবিতা তাদের সিলেবাস না, উদ্দেশ্যও না। ইসলামের দৃষ্টিতে এজাতীয় সংগীত নিষিদ্ধ বিনোদনের অন্তর্ভুক্ত। চৌদ্দ শ বছরের ইতিহাসে মুসলিম শাসক ও প্রজন্মের মধ্যে যখনই গান-বাদ্যের আয়েশি শিল্প-সংস্কৃতির বিস্তার ঘটেছে, তখনই অশ্রুর কালিতে তাদের পতনের ইতিহাস লেখা হয়েছে। আন্দালুসের শেষ যুগ, বাগদাদে হালাকু খাঁর আক্রমণ-যুগ এবং ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির দিল্লি দখলের মতো যুগ ও পর্বগুলো বিশ্লেষণ করলে এ কষ্ট-সত্য সামনে আসে।
মুসলমানদের শুভ্রতা ও বিজয়পর্বের জীবনের সঙ্গে সংগীত-মিউজিক আর মাতোয়ারা বিনোদন সংস্কৃতির ভালো কোনো সংযোগ নেই। সংগীত মুসলিম নতুন প্রজন্ম ও পরিণত প্রজন্ম উভয়ের জন্যই ক্ষতিকর। ধর্মীয়ভাবেও ক্ষতিকর, সভ্যতার সুরক্ষাগতভাবেও ক্ষতিকর। এ জিনিস জনগণ ও রাষ্ট্রের পয়সা খরচ করে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শেখানোর দরকার নেই। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারেরও কাজ এটা নয়।