মাওলানা সা‘দ সাহেব ও তার অনুসারীদের বিষয়ে আকাবির উলামায়ে বাংলাদেশের ফতোয়া বিস্তারিত আলোচনা
(পূর্ব প্রকাশের পর)
ইসলামে মসজিদের মর্যাদা ও গুরুত্ব
দ্বীনী কাজসমূহ মসজিদে আঞ্জাম দেওয়া নিয়ে মাওলানা সা‘দ সাহেব অনেক বাড়াবাড়িতে লিপ্ত হয়েছেন। এ প্রসঙ্গে তিনি অনেক আপত্তিকর কথাবার্তা ও মুনকার রেওয়ায়েত এবং নানা গোমরাহীপূর্ণ চিন্তাধারার অবতারণা করেছেন। ইতিপূর্বে আমরা এ ধরনের কিছু বিষয়ে পর্যালোচনা করেছি। সামনেও কিছুটা বিস্তারিত আকারে আরও কিছু বিষয়ের পর্যালোচনা করা হবে ইনশাআল্লাহ। তবে তার আগে ‘ইসলামে মসজিদের মর্যাদা ও গুরুত্ব’ সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করা মুনাসিব মনে হচ্ছে, যাতে এ বিষয়ে বাড়াবাড়ি ও ছাড়াছাড়ি থেকে মুক্ত হয়ে সঠিক ও ভারসাম্যপূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গিটি স্পষ্ট হয়ে যায়।
কুরআন মাজীদে সূরা নূরে ইরশাদ হয়েছে–
فِیْ بُیُوْتٍ اَذِنَ اللهُ اَنْ تُرْفَعَ وَ یُذْكَرَ فِیْهَا اسْمُهٗ یُسَبِّحُ لَهٗ فِیْهَا بِالْغُدُوِّ وَ الْاٰصَالِ، رِجَالٌ لَّا تُلْهِیْهِمْ تِجَارَةٌ وَّلَا بَیْعٌ عَنْ ذِكْرِ اللهِ وَ اِقَامِ الصَّلٰوةِ وَ اِیْتَآءِ الزَّكٰوةِ یَخَافُوْنَ یَوْمًا تَتَقَلَّبُ فِیْهِ الْقُلُوْبُ وَالْاَبْصَارُ.
আল্লাহ যেসব ঘরকে সমুন্নত করতে এবং যেগুলোতে তাঁর নাম উচ্চারণ করতে আদেশ দিয়েছেন, তাতে সকাল-সন্ধ্যায় তাঁর তাসবীহ পাঠ করে– এমন লোকেরা, ব্যবসা-বাণিজ্য ও ক্রয়-বিক্রয় যাদের গাফেল করে না– আল্লাহর স্মরণ, নামায কায়েম করা ও যাকাত আদায় করা থেকে। তারা সেই দিনকে ভয় করে, যেদিন (মানুষের) অন্তর ও চোখগুলো উল্টে যাবে। –সূরা নূর (২৪) : ৩৬-৩৭
মসজিদের মর্যাদা ও গুরুত্ব সম্পর্কে হাদীসের নির্ভরযোগ্য গ্রন্থসমূহে অনেক হাদীস বর্ণিত হয়েছে। তন্মধ্যে কয়েকটি হাদীস এখানে উল্লেখ করা হচ্ছে–
১. রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন–
إنما هي لذكر الله عزَّ وجل، والصلاة، وقراءة القرآن.
অর্থাৎ মসজিদসমূহ তো আল্লাহ তাআলার যিকির, নামায এবং কুরআন পাঠের জন্য। –সহীহ মুসলিম, হাদীস ২৮৫
২. আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন–
صَلَاةُ الرَّجُلِ فِي جَمَاعَةٍ تَزِيدُ عَنْ صَلَاتِهِ فِي بَيْتِهِ وَصَلَاتِهِ فِي سُوقِهِ بِضْعًا وَعِشْرِينَ دَرَجَةً، وَذূلِكَ: أَنَّ أَحَدَكُمْ إِذَا تَوَضَّأَ فَأَحْسَنَ الْوُضُوءَ، ثُمَّ أَتَى الْمَسْجِدَ، لَا يُرِيدُ إِلّا الصَّلَاةَ، ولَا يَنْهَزُه إِلّا الصَّلَاةُ، لَمْ يَخْطُ خَطْوَةً إِلّا رُفِعَ لَه بِهَا دَرَجَةٌ، وَحُطَّ بِهَا عَنْهُ خَطِيئَةٌ، حَتَّى يَدْخُلَ الْمَسْجِدَ، فَإِذَا دَخَلَ الْمَسْجِدَ كَانَ فِي صَلَاةٍ مَا كَانَتِ الصَّلَاةُ هِيَ تَحْبِسُه، وَالْمَلَائِكَةُ يُصَلُّونَ عَلূى أَحَدِهِمْ مَا دَامَ فِي مَجْلِسِهِ الَّذِي صَلّى فِيهِ، يَقُولُونَ: اللّূهُمَّ اغْفِرْ لَهُ، اللّূهُمَّ ارْحَمْهُ، اللّূهُمَّ تُبْ عَلَيْهِ، مَا لَمْ يُؤْذِ فِيهِ، مَا لَمْ يُحْدِثْ فِيهِ.
ব্যক্তির জামাতে নামায আদায় তার ঘরে বা বাজারে নামায আদায় করা অপেক্ষা বিশ গুণের চেয়ে বেশি ফযীলতপূর্ণ। আর তা এভাবে যে, কোনো ব্যক্তি যদি ঘর থেকে উত্তমরূপে ওযু করে মসজিদের উদ্দেশে রওয়ানা হয়, তাহলে প্রত্যেক কদমে তার একটি মরতবা বুলন্দ হয় এবং একটি গুনাহ মাফ হয়। মসজিদে প্রবেশ করার পর যতক্ষণ সে নামাযের অপেক্ষায় থাকে ততক্ষণ তা নামাযে গণ্য হতে থাকে। আর নামায শেষ করার পর যতক্ষণ সে ওযু অবস্থায় সেই স্থানে বসে থাকে, ফেরেশতাগণ তার জন্য দুআ করতে থাকে– হে আল্লাহ! আপনি তাকে মাফ করে দিন। হে আল্লাহ! আপনি তার ওপর রহম করুন। হে আল্লাহ! আপনি তার তওবা কবুল করুন। –মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ৩৬২৩, সহীহ বুখারী, হাদীস ৪৭৭; সহীহ মুসলিম, হাদীস ১৫০৪, ১৫১৯
৩. মুআয ইবনে জাবাল রা. কর্তৃক বর্ণিত এক দীর্ঘ হাদীসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর একটি স্বপ্নের বিবরণ দান করেন, যাতে তিনি আল্লাহ তাআলার দীদার লাভ করেছেন। (আর নবীগণের স্বপ্ন ওহী হয়ে থাকে।) নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন–
فَقَالَ: يَا مُحَمَّدُ، قُلْتُ: لَبَّيْكَ رَبِّ،قَالَ: فِيمَ يَخْتَصِمُ الْمَلَأُ الأَعْلূى؟ قُلْتُ: فِي الكَفَّارَاتِ، قَالَ: مَا هُنَّ؟ قُلْتُ: مَشْيُ الأَقْدَامِ إِلَى الجَمَاعَاتِ، وَالجُلُوسُ فِي الْمَسَاجِدِ بَعْدَ الصَّلَوَاتِ، وَإِسْبَاغُ الوُضُوءِ فِي الْمَكْرُوهَاتِ، قَالَ: ثُمَّ فِيمَ؟ قُلْتُ: إِطْعَامُ الطَّعَامِ، وَلِينُ الكَلاَمِ، وَالصَّلاَةُ بِاللَيْلِ وَالنَّاسُ نِيَامٌ. قَالَ: سَلْ. قُلْتُ: اللّূهُمَّ إِنِّي أَسْأَلُكَ فِعْلَ الخَيْرَاتِ، وَتَرْكَ الْمُنْكَرَاتِ، وَحُبَّ الْمَسَاكِينِ، وَأَنْ تَغْفِرَ لِي وَتَرْحَمَنِي، وَإِذَا أَرَدْتَ فِتْنَةً فِي قَوْمٍ فَتَوَفَّنِي غَيْرَ مَفْتُونٍ، وَأَسْأَلُكَ حُبَّكَ وَحُبَّ مَنْ يُحِبُّكَ، وَحُبَّ عَمَلٍ يُقَرِّبُ إِلَى حُبِّكَ، قَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: إِنَّهَا حَقٌّ فَادْرُسُوهَا ثُمَّ تَعَلَّمُوهَا.
আল্লাহ তাআলা বললেন, হে মুহাম্মাদ!
আমি বললাম, আমার রব! আমি উপস্থিত।
তিনি বললেন, ঊর্ধ্বমহলে কী নিয়ে পর্যালোচনা হচ্ছে?
আমি বললাম, গুনাহ মোচনকারী বিষয়াবলি নিয়ে।
তিনি বললেন, সেগুলো কী?
আমি বললাম, জামাতের উদ্দেশে পায়ে হেঁটে যাওয়া, নামাযের পর মসজিদে বসে থাকা, কষ্টের সময়ও পরিপূর্ণরূপে ওযু করা।
তিনি বললেন, এরপর কী বিষয়ে আলোচনা হচ্ছে?
আমি বললাম, খাদ্য দান, কোমল কথা এবং রাতের বেলা যখন মানুষ ঘুমন্ত থাকে তখন নামায (তাহাজ্জুদ) আদায় করা।
তিনি বললেন, প্রার্থনা কর।
আমি বললাম, হে আল্লাহ! আপনার নিকট কল্যাণকর কাজ করা, মন্দ কাজ পরিত্যাগ ও মিসকীনদের প্রতি ভালবাসা (-এর তাওফীক) প্রার্থনা করি। আমি আপনার নিকট আরও প্রার্থনা করি যে, আপনি আমাকে মাফ করে দেবেন এবং আমার প্রতি রহম করবেন। কোনো সম্প্রদায়ের ব্যাপারে যখন আপনি ফিতনার ইচ্ছা করেন, তখন আপনি আমাকে ফিতনামুক্ত মৃত্যু দান করুন। আমি চাই, আপনার প্রতি ভালবাসা এবং আপনাকে যারা ভালবাসে তাদের ভালবাসা এবং যেসব আমল আমাকে আপনার ভালবাসার নিকটবর্তী করবে সেসব আমলের ভালবাসা।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, নিশ্চয়ই এটি সত্য। সুতরাং তোমরা তা পড় এবং শিখে নাও। –জামে তিরমিযী, হাদীস ৩২৩৫
৪. আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন–
أَلَا أَدُلُّكُمْ عَلَى مَا يَمْحُو اللهُ بِهِ الْخَطَايَا، وَيَرْفَعُ بِهِ الدَّرَجَاتِ؟ قَالُوا بَلَى يَا رَسُولَ اللهِ. قَالَ: إِسْبَاغُ الْوُضُوءِ عَلَى الْمَكَارِهِ، وَكَثْرَةُ الْخُطَا إِلَى الْمَسَاجِدِ، وَانْتِظَارُ الصَّلَاةِ بَعْدَ الصَّلَاةِ، فَذلِكُمُ الرِّبَاطُ.
্আমি কি তোমাদের এমন আমলের কথা বলব, যার মাধ্যমে আল্লাহ গুনাহসমূহ মুছে দেন এবং মর্যাদাসমূহ বুলন্দ করেন?
সাহাবীগণ বললেন, অবশ্যই আল্লাহর রাসূল!
তিনি বললেন, কষ্টের সময় পূর্ণরূপে ওযু করা, মসজিদের উদ্দেশে অধিক পরিমাণে কদম ফেলা এবং এক নামাযের পর আরেক নামাযের অপেক্ষা করা। এটাই রিবাত (প্রহরা)। –সহীহ মুসলিম, হাদীস ২৫১
৫. আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন–
مَنْ غَدَا إِلَى الْمَسْجِدِ، أَوْ رَاحَ، أَعَدَّ اللهُ لَه فِي الْجَنَّةِ نُزُلًا، كُلَّمَا غَدَا أَوْ رَاحَ.
যে ব্যক্তি সকালে বা সন্ধ্যায় মসজিদে গমন করে, প্রতিবারই আল্লাহ তার জন্য জান্নাতে আবাস প্রস্তুত করেন। –সহীহ বুখারী, হাদীস ৬৬২; সহীহ মুসলিম, হাদীস ৬৬৯
৬. আবু উমামা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলূল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন–
مَنْ خَرَجَ مِنْ بَيْتِه مُتَطَهِّرًا إِلَى صَلَاةٍ مَكْتُوبَةٍ فَأَجْرُه كَأَجْرِ الْحَاجِّ الْمُحْرِمِ، وَمَنْ خَرَجَ إِلَى تَسْبِيحِ الضُّحَى لَا يَنْصِبُه إِلّا إِيَّاهُ فَأَجْرُه كَأَجْرِ الْمُعْتَمِرِ، وَصَلَاةٌ عَلَى أَثَرِ صَلَاةٍ لَا لَغْوَ بَيْنَهُمَا كِتَابٌ فِي عِلِّيِّينَ.
যে ব্যক্তি ওযুর হালতে কোনো ফরয নামাযের উদ্দেশে ঘর থেকে বের হয়, তার প্রতিদান ইহরাম ধারণকারী হাজ্বীর প্রতিদানের ন্যায়। আর যে ব্যক্তি চাশতের নামাযের উদ্দেশে বের হয় এবং তার বের হওয়ার উদ্দেশ্য যদি কেবল এটাই হয়, তাহলে তার প্রতিদান উমরা আদায়কারীর প্রতিদানের ন্যায়। আর এক নামাযের পর আরেক নামায, যার মধ্যে কোনো অনর্থক কথা বা কাজ নেই, তা ইল্লিয়্যীনে লিপিবদ্ধ হয়। –সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ৫৫৮
৭. একটি প্রসিদ্ধ হাদীস, যাতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাত শ্রেণির মানুষের আলোচনা করেছেন, যাদেরকে আল্লাহ তাআলা কিয়ামতের দিন তাঁর ছায়ায় আশ্রয় দান করবেন। সেদিন তাঁর ছায়া ব্যতীত আর কোনো ছায়া থাকবে না। সেই সাত শ্রেণির মধ্যে এক শ্রেণি হল–
وَرَجُلٌ كَانَ قَلْبُه مُعَلَّقًا بِالمَسْجِدِ إِذَا خَرَجَ مِنْهُ حَتَّى يَعُودَ إِلَيْهِ.
অর্থাৎ ওই ব্যক্তি, যে মসজিদ থেকে বের হওয়ার পর মসজিদে পুনরায় ফিরে আসা পর্যন্ত তার অন্তর মসজিদের সঙ্গে লেগে থাকে। –মুআত্তা মালেক, হাদীস ২০০৫; জামে তিরমিযী, হাদীস ২৩৯১
৮. আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন–
مَا تَوَطَّنَ رَجُلٌ مُسْلِمٌ الْمَسَاجِدَ لِلصَّلَاةِ وَالذِّكْرِ، إِلّا تَبَشْبَشَ اللهُ لَه، كَمَا يَتَبَشْبَشُ أَهْلُ الْغَائِبِ بِغَائِبِهِمْ إِذَا قَدِمَ عَلَيْهِمْ.
কোনো মুসলিম ব্যক্তি যখন নামায ও যিকিরের জন্য নিয়মিত মসজিদে যাওয়া-আসা করে, আল্লাহ তার প্রতি এমনই খুশি হন, যেমন কোনো পরিবার তাদের দূর থেকে ফিরে আসা কোনো প্রিয়জনকে দেখে খুশি হয়। –সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস ৮০০; মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ৯৮৪১
৯. আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন–
إِنَّ لِلْمَسَاجِدِ أَوْتَادًا الْمَلَائِكَةُ جُلَسَاؤُهُمْ، إِنْ غَابُوا يَفْتَقِدُونَهُمْ، وَإِنْ مَرِضُوا عَادُوهُمْ،وَإِنْ كَانُوا فِي حَاجَةٍ أَعَانُوهُمْ. وَقَالَ: جَلِيسُ الْمَسْجِدِ عَلَى ثَلَاثِ خِصَالٍ: أَخٍ مُسْتَفَادٍ، أَوْ كَلِمَةٍ مُحْكَمَةٍ، أَوْ رَحْمَةٍ مُنْتَظَرَةٍ.
নিশ্চয়ই মসজিদসমূহের কিছু খুঁটি রয়েছে, যাদের সঙ্গী হলেন ফেরেশতাগণ। তারা অনুপস্থিত থাকলে ফেরেশতাগণ তাদের খোঁজখবর নেন। তারা অসুস্থ হলে ফেরেশতাগণ তাদের ইয়াদাত করেন এবং তাদের কোনো প্রয়োজন থাকলে ফেরেশতাগণ তাদের সহযোগিতা করেন।
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, মসজিদের সঙ্গীর তিনটি বৈশিষ্ট্য : উপকৃত হওয়ার মতো একজন ভাই অথবা হিকমাহপূর্ণ কথা কিংবা প্রতীক্ষিত রহমত। –মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ৯৪২৪, ৯৪২৫
১০. আবু উসমান রাহ. থেকে বর্ণিত, সালমান ফারসী রা. আবুদ দারদা রা.-কে চিঠির মাধ্যমে নসীহত করেন–
يَا أَخِي! عَلَيْكَ بِالْمَسْجِدِ فَالْزَمْهُ، فَإِنِّي سَمِعْتُ رَسُولَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَقُولُ: الْمَسْجِدُ بَيْتُ كُلِّ تَقِيٍّ.
ভাই! তুমি মসজিদকে আপন করো; সর্বদা মসজিদের সঙ্গে লেগে থাক। কারণ আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি, মসজিদ সকল মুত্তাকীর ঘর। –মুসনাদে বাযযার, হাদীস ২৫৪৬
১১. আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন–
مَا اجْتَمَعَ قَوْمٌ فِي بَيْتٍ مِنْ بُيُوتِ اللهِ، يَتْلُونَ كِتَابَ اللهِ، وَيَتَدَارَسُونَه بَيْنَهُمْ، إِلّا نَزَلَتْ عَلَيْهِمِ السَّكِينَةُ، وَغَشِيَتْهُمُ الرَّحْمَةُ وَحَفَّتْهُمُ الْمَلَائِكَةُ، وَذَكَرَهُمُ اللهُ فِيمَنْ عِنْدَه.
যখন কিছু মানুষ আল্লাহর কোনো ঘরে একত্রিত হয়ে কুরআন তিলাওয়াত করে এবং একে অপরকে শোনায়, তখন তাদের ওপর শান্তি বর্ষিত হয়, আল্লাহর রহমত তাদের ঢেকে নেয়, ফেরেশতাগণ তাদের বেষ্টন করে নেন এবং আল্লাহ তাঁর নৈকট্যশীল ফেরেশতাদের মাঝে তাদের আলোচনা করেন। –সহীহ মুসলিম, হাদীস ২৬৯৯; সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ১৪৫৫
১২. আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন–
أَحَبُّ الْبِلَادِ إِلَى اللهِ مَسَاجِدُهَا، وَأَبْغَضُ الْبِلَادِ إِلَى اللهِ أَسْوَاقُهَا.
আল্লাহর নিকট সবচেয়ে প্রিয় স্থান হল মসজিদ আর আল্লাহর নিকট সবচেয়ে অপছন্দনীয় স্থান হল বাজার। –সহীহ মুসলিম, হাদীস ৬৭১
১৩. আনাস রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন–
مَنْ صَلَّى الغَدَاةَ فِي جَمَاعَةٍ ثُمَّ قَعَدَ يَذْكُرُ اللهَ حَتّূى تَطْلُعَ الشَّمْسُ، ثُمَّ صَلَّى رَكْعَتَيْنِ كَانَتْ لَه كَأَجْرِ حَجَّةٍ وَعُمْرَةٍ. قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: تَامَّةٍ تَامَّةٍ تَامَّةٍ.
যে ব্যক্তি ফজরের নামায জামাতে আদায় করে, এরপর বসে আল্লাহর যিকির করতে থাকে যতক্ষণ না সূর্য উদিত হয়, তারপর দুই রাকাত নামায আদায় করে, সে হজ্ব ও উমরার সওয়াব লাভ করবে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, পূর্ণ পূর্ণ পূর্ণ। –জামে তিরমিযী, হাদীস ৫৮৬
সালাফের মাঝে এ আমলটির বিষয়ে অনেক গুরুত্ব ছিল। যেমন ইমাম আওযায়ী রাহ. (৮৮হি.-১৫৭ হি.)-এর জীবনীতে আছে, ওলীদ ইবনে মুসলিম বলেন–
رَأَيتُ الأَوْزَاعِيَّ يَثْبُتُ فِي مُصَلاَّهُ، يَذْكُرُ اللهَ، حَتَّى تَطلُعَ الشَّمْسُ، وَيُخْبِرُنَا عَنِ السَّلَفِ: أَنَّ ذূلِكَ كَانَ هَدْيَهُم، فَإِذَا طَلَعَتِ الشَّمْسُ، قَامَ بَعْضُهُم إِلَى بَعْضٍ، فَأَفَاضُوا فِي ذِكْرِ اللهِ، وَالتَّفَقُّهِ فِي دِيْنِه.
আমি আওযায়ী রাহ.-কে (ফজরের নামাযের পর) নামাযের জায়গায় বসে সূর্যোদয় পর্যন্ত আল্লাহর যিকির করতে দেখেছি। তিনি আমাদেরকে পূর্ববর্তী মনীষীগণ সম্পর্কে জানিয়েছেন যে, এমনই ছিল তাদের আমল। যখন সূর্য উঠে যেত তখন তারা একে অপরের কাছে গিয়ে আল্লাহর যিকির ও দ্বীনের তাফাক্কুহ হাসিলে মগ্ন হয়ে যেতেন। –সিয়ারু আ‘লামিন নুবালা, যাহাবী ৭/১১৪
১৪. আবু যামরা রাহ. বলেন, একবার আবু বকর রা. মানুষের উদ্দেশে খুতবা দিলেন। প্রথমে আল্লাহ তাআলার হাম্দ ও প্রশংসা করলেন। অতঃপর বললেন–
إِنَّه سَتُفْتَحُ لَكُمْ الشَّامُ فَتَأْتُونَ أَرْضًا رَفِيعَةً حَيْثُ تُمَتَّعُونَ فِيهَا مِنَ الْخُبْزِ وَالزَّيْتِ، وَسَتُبْنَى لَكُمْ بِهَا مَسَاجِدُ فَإِيَّاكُمْ أَنْ يَعْلَمَ اللهُ عَزَّ وَجَلَّ أَنَّكُمْ إِنَّمَا تَأْتُونَهَا تَلَهِّيًا إِنَّمَا بُنِيَتْ لِلذِّكْرِ.
নিশ্চয়ই তোমাদেরকে শামের বিজয় দান করা হবে। ফলে তোমরা সুউচ্চ ভূমিতে ছড়িয়ে পড়বে। সেখানে তোমরা রুটি ও তেল উপভোগ করবে। এবং সেখানে তোমাদের জন্য মসজিদ নির্মাণ করা হবে। সুতরাং সাবধান! আল্লাহ যেন তোমাদের বিষয়ে এমনটা না দেখেন যে, তোমরা মসজিদগুলোতে অনর্থক কার্যকলাপ ও হাসি-মজাকের জন্য যাচ্ছ। মসজিদ তো নির্মাণ করা হয়েছে আল্লাহর স্মরণের জন্য। –আযযুহ্দ, আহমাদ ইবনে হাম্বল, বর্ণনা ৫৯১
উপরোক্ত হাদীস ও বর্ণনাসমূহ নিয়ে চিন্তাভাবনা করলে এ বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে যায় যে, মসজিদ মুসলমানদের জন্য সবচেয়ে ফযীলতপূর্ণ স্থান। জামাতের সঙ্গে ফরয নামায আদায়ের একমাত্র মাসনূন (সুন্নতে মুআক্কাদা) জায়গা হল মসজিদ। এটি যিকির, তাসবীহ ও তিলাওয়াতের জায়গা। তেমনিভাবে এটি কল্যাণের কথা শেখা ও শেখানোর জায়গা। মসজিদে ইনফিরাদী ইবাদতে সময় অতিবাহিত করাও অনেক বড় ইবাদত। মসজিদকে ইলম ও আমলের মাধ্যমে আবাদ রাখা মুমিনের শান।
তবে এসবের পাশাপাশি শরীয়তে এ বিষয়টিও সুনির্ধারিত ও স্বীকৃত যে, ফরয নামাযের জামাত ও মাসনূন ইতিকাফ– কেবল এ দুটি আমলই এমন যে, এগুলো মসজিদের সঙ্গে খাস এবং এগুলো মসজিদের খাস আমল। অবশিষ্ট অন্যান্য নেক আমল ও দ্বীনী কাজ মসজিদে ও মসজিদের বাইরে সর্বত্র হওয়া বাঞ্ছনীয়। সেগুলো ঘর ও ঘরের বাইর, এমনকি বাজারেও আঞ্জাম দেওয়া প্রশংসনীয়। অতএব সেসব আমল মসজিদের বাইরে সম্পাদন করলে সেটাকে খেলাফে সুন্নত, রেওয়াজ কিংবা প্রভাবশূন্য বা সওয়াবশূন্য বলে দেওয়া অথবা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে আমলের যোগ্যতা থেকে মাহরূম আখ্যা দেওয়া সুস্পষ্ট অন্যায় এবং নিরেট গোমরাহী।
সামনে আমরা এ বিষয়েই কিছুটা বিস্তারিত আলোচনা করার প্রয়াস পাব ইনশাআল্লাহ।
ফেরেশতাদের ডানার বেষ্টনীতে থাকার ফযীলত কি মসজিদের সঙ্গে খাস?
এমনিভাবে মাওলানা সা‘দ সাহেব একাধিক বয়ানে তালীম, তরবিয়ত ও ঈমানী মজলিসের জন্য মসজিদকে খাস করার এক দলীল এটাও বলেছেন যে, ব্যক্তি যতক্ষণ মসজিদে থাকে, ফেরেশতাদের ডানার বেষ্টনীর মধ্যে থাকে। অথচ ফেরেশতাদের ডানার বেষ্টনীতে থাকা মসজিদের বৈশিষ্ট্য নয়, বরং যেখানেই ঈমান, ইলম ও যিকিরের মজলিস হবে সেখানেই ফেরেশতারা তাদের বেষ্টন করে নেন এবং তাদের ওপর শান্তি বর্ষিত হয়। আল্লাহ তাআলা তার নৈকট্যশীল ফেরেশতাদের মধ্যে তাদের আলোচনা করেন।
সহীহ হাদীসে যেমনি এই কথা ইরশাদ হয়েছে–
مَا اجْتَمَعَ قَوْمٌ فِي بَيْتٍ مِنْ بُيُوتِ اللهِ، يَتْلُونَ كِتَابَ اللهِ، وَيَتَدَارَسُونَهُ بَيْنَهُمْ، إِلّا نَزَلَتْ عَلَيْهِمِ السَّكِينَةُ، وَغَشِيَتْهُمُ الرَّحْمَةُ وَحَفَّتْهُمُ الْمَلَائِكَةُ، وَذَكَرَهُمُ اللهُ فِيمَنْ عِنْدَه.
যখন কিছু মানুষ আল্লাহর কোনো ঘরে একত্রিত হয়ে কুরআন তিলাওয়াত করে এবং একে অপরকে শোনায়, তখন তাদের ওপর শান্তি বর্ষিত হয়, আল্লাহর রহমত তাদের ঢেকে নেয়, ফেরেশতাগণ তাদের বেষ্টন করে নেন এবং আল্লাহ তাঁর নৈকট্যশীল ফেরেশতাদের মাঝে তাদের আলোচনা করেন। –সহীহ মুসলিম, হাদীস ২৬৯৯; সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ১৪৫৫
তেমনি সহীহ হাদীসে এ কথাও ইরশাদ হয়েছে–
لَا يَقْعُدُ قَوْمٌ يَذْكُرُونَ اللهَ عَزَّ وَجَلَّ إِلّا حَفَّتْهُمُ الْمَلَائِكَةُ، وَغَشِيَتْهُمُ الرَّحْمَةُ، وَنَزَلَتْ عَلَيْهِمِ السَّكِينَةُ، وَذَكَرَهُمُ اللهُ فِيمَنْ عِنْدَه.
যখন কিছু মানুষ বসে আল্লাহর যিকির করে তখন ফেরেশতারা তাদের বেষ্টন করে নেন, আল্লাহর রহমত তাদের ঢেকে নেয়, তাদের ওপর শান্তি বর্ষিত হয় এবং আল্লাহ তাঁর নৈকট্যশীল ফেরেশতাদের মাঝে তাদের আলোচনা করেন। –সহীহ মুসলিম, হাদীস ২৭০০
এখানে মসজিদের শর্ত নেই। কোথাও কিছু মানুষ ইলম ও যিকির এবং ঈমান ও কুরআনের জন্য বসলেই তাতে এই ফযীলত।
তেমনি এটাও ইরশাদ হয়েছে–
إِنَّ لِلهِ مَلاَئِكَةً يَطُوفُونَ فِي الطُّرُقِ يَلْتَمِسُونَ أَهْلَ الذِّكْرِ، فَإِذَا وَجَدُوا قَوْمًا يَذْكُرُونَ اللهَ تَنَادَوْا: هَلُمُّوا إِلَى حَاجَتِكُمْ، قَالَ: فَيَحُفُّونَهُمْ بِأَجْنِحَتِهِمْ إِلَى السَّمَاءِ الدُّنْيَا.
আল্লাহ তাআলার কিছু ফেরেশতা আছেন, যারা বিভিন্ন রাস্তায় ঘুরতে থাকেন এবং যিকিরকারীদের সন্ধান করেন। যখন তারা কিছু মানুষকে আল্লাহর যিকির করতে দেখেন তখন তারা একে অপরকে সম্বোধন করে বলেন, এখানে আসো। তোমরা যা চাইছ তা এখানে। তখন তারা তাদের ডানার সাহায্যে সেই মানুষদের বেষ্টন করে নেন; এভাবে তারা নিকটবর্তী আসমান পর্যন্ত পৌঁছে যান...। –সহীহ বুখারী, হাদীস ৬৪০৮
এটি একটি দীর্ঘ হাদীস। এ হাদীসে এটাও আছে যে, আহলুয যিকর তথা যিকিরকারীগণ কী করে! তারা তাসবীহ, তাকবীর ও হাম্দ পাঠ করে। আল্লাহর বড়ত্ব ও মাহাত্ম্য স্মরণ করে। আল্লাহর কাছে জান্নাত চায় এবং জাহান্নাম থেকে মুক্তি চায়।
সহীহ মুসলিমে হাদীসটি এভাবে বর্ণিত হয়েছে–
إن لله تبارك وتعالى ملائكة سيارة فضلا يتتبعون مجالس الذكر، فإذا وجدوا مجلسا فيه ذكر قعدوا معهم، وحف بعضهم بعضا بأجنحتهم، حتى يملئوا ما بينهم وبين السماء الدنيا..
আল্লাহ তাআলার একদল ভ্রাম্যমান অতিরিক্ত (যাদের অন্য কোনো দায়িত্ব নির্ধারিত নেই) ফেরেশতা আছেন। তারা যিকিরের মজলিসসমূহ অনুসন্ধান করে বেড়ান। যখন তারা কোনো যিকিরের মজলিস পান তখন তারা সেখানে তাদের সঙ্গে বসে পড়েন এবং একে অপরকে তাদের ডানা দিয়ে বেষ্টন করে নেন। এভাবে তারা তাদের ও নিকটবর্তী আসমানের ফাঁকা পূর্ণ করে ফেলেন।... সহীহ মুসলিম, হাদীস ২৬৮৯
এই হাদীসের আরেকটি সহীহ রেওয়ায়েতে আছে–
إن لله ملائكة سيارة، وفضلاء يلتمسون مجالس الذكر في الأرض، فإذا أتوا على مجلس ذكر حف بعضهم بعضا بأجنحتهم إلى السماء.
আল্লাহ তাআলার একদল ভ্রাম্যমান ও অতিরিক্ত ফেরেশতা রয়েছেন। তারা জমিনে যিকিরের মজলিসসমূহ অনুসন্ধান করে বেড়ান। যখন তারা যিকিরের কোনো মজলিসে আসেন, নিজেদের ডানা দিয়ে একে অপরকে বেষ্টন করে নেন আসমান পর্যন্ত। –মুসতাদরাকে হাকেম, হাদীস ১৮৪২
এসব হাদীস থেকে বোঝা গেল, ইলম ও যিকির এবং ঈমান ও কুরআনের মজলিস মসজিদের সঙ্গে খাস নয়। সেটা জমিনের যে কোনো অংশে হতে পারে। ফেরেশতাগণ ডানার মাধ্যমে সেটাকে বেষ্টন করে নেবেন। যদি যিকিরের মজলিস মসজিদের সঙ্গে খাস হত, মসজিদের বাইরে সংঘটিত মজলিস নূর ও বরকতশূন্য হত এবং ফেরেশতাদের ডানার ছায়া থেকে বঞ্চিত হত, তাহলে ফেরেশতাগণ সেসব মজলিসের সন্ধানে মসজিদগুলোতেই আসতেন; মজলিসের তালাশে তারা জমিনের রাস্তায় রাস্তায় ঘুরতেন না।
তালীম-তাআল্লুমের ফযীলত কি শুধু মসজিদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ?
বস্তুত হাদীসের মূল মর্ম কেবল তখনই স্পষ্ট হয়, যখন সংশ্লিষ্ট সকল হাদীস, সেগুলোর সমস্ত সনদ ও রেওয়ায়েত এবং সংশ্লিষ্ট সকল আছার সামনে রাখা হয়। অন্যথায় ভাসা ভাসা জ্ঞানের সর্বনিম্ন ক্ষতি এই হয় যে, যে বাক্য বা শব্দটা শুধু স্পষ্ট করার জন্য কিংবা সাধারণ অবস্থা হিসেবে অথবা ইত্তেফাকিয়া বা ঘটনাক্রমে উল্লেখ করা হয়েছে, সেটাকে ব্যক্তি ‘শর্ত’ ভেবে শর্তহীন বিষয়কে শর্তযুক্ত বানিয়ে দেবে, অতঃপর সেই ভুল ব্যাখ্যার ওপর ভিত্তি করে ভুল মাসআলা বানাতে থাকবে।
মাওলানা সা‘দ সাহেব যে তালীম-তরবিয়ত এবং দাওয়াত ও ঈমানী হালকাকে মসজিদের সঙ্গে খাস করে দিয়েছেন, তার কারণ এটাই যে, রেওয়ায়েতের ক্ষেত্রে তার দৃষ্টি অনেক সীমিত।
দৃষ্টান্তস্বরূপ এ হাদীসটি নিয়ে চিন্তা করুন; ইরশাদ হয়েছে–
من جاء مسجدي هذا، لم يأته إلا لخير يتعلمه أو يعلمه، فهو بمنزلة المجاهد في سبيل الله، ومن جاء لغير ذلك، فهو بمنزلة الرجل ينظر إلى متاع غيره.
অর্থাৎ যে আমার এই মসজিদে কেবল এ নিয়তে আসে যে, সে কোনো কল্যাণের কথা শিখবে বা শেখাবে, তাহলে সে মুজাহিদ ফী সাবীলিল্লাহর মতো গণ্য হবে। আর যে কোনো কল্যাণের জন্য নয়, বরং এমনিতেই এসেছে সে ওই লোকের মতো, যে (বাজারে গিয়ে) আরেকজনের জিনিসের দিকে তাকিয়ে আছে। –সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস ২২৭; সহীহ ইবনে হিব্বান, হাদীস ৮৭; শুআবুল ঈমান, বাইহাকী, হাদীস ১৫৯৮
এখন হয়তো কেউ বলবে, এই ফযীলত মসজিদে নববীর সঙ্গে খাস; অন্য কোনো মসজিদে এই ফযীলত হবে না। অর্থাৎ অন্য কোনো মসজিদে কল্যাণের কথা শিখতে বা শেখাতে গেলে সে মুজাহিদের মতো গণ্য হবে না। কিন্তু যার তাফাক্কুহ আরও গভীর এবং দৃষ্টি আরও প্রশস্ত, সে বলবে– না, এই ফযীলত যে কোনো মসজিদের জন্য। কল্যাণের কথা শেখা-শেখানোর জন্য ব্যক্তি যে মসজিদেই যাবে, এর দ্বারা সে ওই ফযীলত হাসিল করবে এবং মুজাহিদ ফী সাবীলিল্লাহর কাতারে গণ্য হবে। (দেখুন হাশিয়াতুস সিন্দী আলা ইবনে মাজাহ)
এখন যে আবুদ দারদা রা.-এর এ বক্তব্য দেখবে, সে সেটার সঠিক হওয়ার বিষয়ে কোনো সন্দেহ করবে না। আবুদ দারদা রা. বলেন–
ما من أحد يغدو إلى المسجد، لخير يتعلمه أو يعلمه، إلا كتب له أجر مجاهد، لا ينقلب إلا غانما.
অর্থাৎ যে ব্যক্তি কল্যাণের কোনো কথা শেখা বা শেখানোর জন্য মসজিদে আসবে, তার জন্য এক মুজাহিদের সওয়াব লেখা হবে। আর সে তো অবশ্যই গনিমত নিয়েই ফিরবে। –জামিউ বায়ানিল ইলম, ইবনে আবদুল বার ১/৩২; মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা ১৯/১৮৯; আলমারিফাতু ওয়াত তারীখ, ইয়াকুব ফাসাবী ৩/৪০০
তেমনিভাবে বিশিষ্ট তাবেয়ী ইমাম আবু বকর ইবনে আবদুর রহমান রাহ.-ও বলেছেন–
من غدا أو راح إلى المسجد، لا يريد غيره، ليتعلم خيرا أو ليعلمه، ثم رجع إلى بيته، كان كالمجاهد في سبيل الله.
অর্থাৎ যে ব্যক্তি সকালে বা সন্ধ্যায় কেবল মসজিদের উদ্দেশে বের হয় কল্যাণের কোনো কথা শেখা বা শেখানোর জন্য, অতঃপর ঘরে ফিরে যায়, তাহলে সে আল্লাহর রাস্তায় জিহাদকারীর মতো। –মুয়াত্তা মালেক, পৃ. ১০৪-১০৫; আলইসতিযকার, ইবনে আবদুল বার ৬/২১৭
আর যার দৃষ্টি আরও প্রশস্ত এবং তাফাক্কুহ আরও গভীর হবে, সে বলবে– হাদীসের উদ্দেশ্য তালীম-তাআল্লুমের ফযীলত বর্ণনা করা। অর্থাৎ যে ব্যক্তি তালীম-তাআল্লুমের জন্য ঘর থেকে বের হবে, সে ইলম শেখা বা শেখানোর জন্য যেখানেই যাবে, কল্যাণের যে মজলিসেই বসবে, সে এই প্রতিদান লাভ করবে। কারণ যে ইল্লত ও কার্যকারণের ভিত্তিতে মুতাআল্লিম ও মুআল্লিম মুজাহিদের সওয়াব পাচ্ছে, তার সম্পর্ক কোনো খাস মসজিদ বা খাস জায়গার সঙ্গে নয়; বরং তার সম্পর্ক তালীম-তাআল্লুমের বিশুদ্ধতা এবং মুআল্লিম ও মুতাআল্লিমের ইখলাস ও তাকওয়ার সঙ্গে। সুন্নতের অনুসারী উলূমে শরীয়তে প্রাজ্ঞ ব্যক্তি মসজিদে, ঘরে কিংবা গাছের নিচে যেখানেই বসবেন, ব্যস সেটা সহীহ ইলম ও ফিকহের পরিবেশ।
সেজন্যই দেখা যায়, নবীযুগে ও খোলাফায়ে রাশেদীনের শাসনামলের অধিকাংশ সময়ে মদীনা মুনাওয়ারা ছিল ইলম ও ফিকহের কেন্দ্র। অর্থাৎ তখন সবচেয়ে বড় মুআল্লিম মসজিদে নববী বা মসজিদে নববীর চারপাশে থাকতেন। কিন্তু সাহাবায়ে কেরামের যামানায় যখন মুআল্লিমগণ বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে গেলেন তখন অন্যান্য ইসলামী শহরও ইলমের মারকায হয়ে গেল। সেসব শহরের মসজিদেও ইলম ও ফিকহের মজলিস হত এবং সেইসঙ্গে উলামা-ফুকাহা ও মুহাদ্দিসীনের ঘর এবং বাড়ির আঙিনাতেও তালীম-তাআল্লুমের মজলিস হত। সাহাবায়ে কেরামের যামানার এই হালত পরবর্তী সময়ে আরও বিস্তৃত হল। কিন্তু এই আপত্তি কেউ করেনি যে, ইলমকে কেন মসজিদে নববীর বাইরে নেওয়া হল? কেন ইলমকে মদীনার বাইরে নেওয়া হল? কেন হারামাইনের বাইরে নেওয়া হল? মসজিদ থাকা সত্ত্বেও কেন মসজিদের বাইরে তালীমের ব্যবস্থা করা হল? কারণ হাদীসের উদ্দশ্য কী– তা সবাই বুঝতেন। হাদীসের উদ্দেশ্য হল তালীম-তরবিয়ত, কুরআনের পঠন-পাঠন এবং যিকির ও ঈমানের মজলিসের প্রতি গুরুত্বারোপ করা। এগুলোকে মসজিদে নববী বা মসজিদের সঙ্গে খাস করা নয়। দৃষ্টান্তস্বরূপ মসজিদে নববী বা মসজিদের উল্লেখের দ্বারা তাখসীস তথা সীমাবদ্ধকরণ সাব্যস্ত হয় না এবং ফযীলতের বিষয়টাও তার সঙ্গে খাস হয়ে যায় না। তেমনিভাবে সহজতা কিংবা ইসলামের প্রথম শিক্ষক (রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) -এর নিকটবর্তিতা ও সোহবত থেকে ফায়েদা হাসিল করা– এসব কারণে মসজিদে নববীতে তালীম-তাআল্লুম ও তরবিয়ত-তাযকিয়ার মজলিস হওয়ার দ্বারা এটা অনিবার্য হয়ে যায় না যে, পরবর্তী সময়েও এসবের মজলিস সর্বদা মসজিদে নববী বা মসজিদেই হতে হবে। কারণ শরীয়তের দলীল-আদিল্লা, খায়রুল কুরূনের আমলে মুতাওয়ারাস ও অবিচ্ছিন্ন কর্মধারা এবং সমগ্র উম্মতের তাআমুল ও কর্মপন্থা এই তাখসীস ও সীমাবদ্ধকরণের পরিপন্থি।
এজন্যই খোদ আবুদ দারদা রা.-এর বক্তব্য হল–
من رأى الغدو والرواح إلى العلم ليس بجهاد فقد نقص عقله ورأيه.
অর্থাৎ যে ব্যক্তি সকাল-সন্ধ্যায় ইলমের জন্য বের হওয়াকে জিহাদ মনে করে না, তাহলে বোঝে নাও তার বুদ্ধি ও চিন্তায় অসম্পূর্ণতা আছে। –জামিউ বায়ানিল ইলমি ওয়া ফাযলিহি, ইবনে আবদুল বার ১/৩১; মিফতাহু দারিস সাআদাহ, ইবনুল কায়্যিম ১/৭১ (ইলমের পঞ্চাশতম ফযীলত)
আবুদ দারদা রা.-এর এই বক্তব্যে না মসজিদে নববীর কথা আছে আর না অন্য কোনো মসজিদের কথা। বরং বলেছেন, ইলম তলবের জন্য সকাল-সন্ধ্যায় যে কোনো জায়গায়ই যাবে, সেটা জিহাদের মর্যাদা রাখে। আর যে এটাকে জিহাদের মর্যাদা দেবে না, তার বুদ্ধি ও চিন্তায় অবশ্যই কোনো অসম্পূর্ণতা থেকে থাকবে।
এর সঙ্গে যদি আবু হুরায়রা রা.-সহ একাধিক সাহাবী কর্তৃক বর্ণিত এই হাদীসটি স্মরণে রাখা হয়, যাতে বলা হয়েছে–
من سلك طريقا يلتمس فيه علما سهل الله له به طريقا إلى الجنة.
অর্থাৎ যে ব্যক্তি ইলম তলবের জন্য কোনো রাস্তা অবলম্বন করে, এর মাধ্যমে আল্লাহ তাআলা তার জন্য জান্নাতের রাস্তা সহজ করে দেন। –সহীহ মুসলিম, হাদীস ২৬৯৯; সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ৩৬৪১; জামে তিরমিযী, হাদীস ২৮৭৭
তেমনিভাবে জামে তিরমিযীর এই হাদীসটি যদি স্মরণে রাখা হয়, যাতে ইরশাদ হয়েছে–
من خرج في طلب العلم فهو في سبيل الله حتى يرجع.
অর্থাৎ যে ব্যক্তি ইলম তলবের উদ্দেশ্যে বের হবে, সে ফিরে আসা পর্যন্ত আল্লাহর রাস্তায় থাকবে। –জামে তিরমিযী, হাদীস ২৮৩৮
(قال الترمذي: حديث حسن غريب، ورواه بعضهم فلم يرفعه.)
যদি এসব রেওয়ায়েত এবং حلق الذكر (যিকিরের মজলিস) সংক্রান্ত সহীহ হাদীসগুলো সামনে রাখা হয়, তাহলে এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ থাকে না যে, জিহাদের মর্যাদা লাভের ফযীলতটা তালীম-তাআল্লুমের জন্য; ইলমের সে মজলিসটা যেখানেই হোক না কেন। তবে শর্ত হল, মজলিসটা সহীহ ও উপকারী ইলমের মজলিস হতে হবে। আর এর জন্য বুনিয়াদি শর্ত হল, মুআল্লিম সহীহ ইলম ও সহীহ আকীদাসম্পন্ন হতে হবে। দ্বিতীয় শর্ত হল, ইলমের তালীম ও তাআল্লুম আল্লাহর জন্য হবে; দুনিয়াবী কোনো উদ্দেশ্যে হবে না।
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কি তালীম-তরবিয়ত ও ঈমানী মেহনতের জন্য মসজিদকে নির্ধারণ করে দিয়েছিলেন এবং একদম নামাযের মতো নির্ধারণ করে দিয়েছিলেন?
মাওলানা সা‘দ সাহেব ‘তালীম-তরবিয়ত, ঈমানী হালকা ও দাওয়াত মসজিদের সঙ্গে খাস এবং এগুলো মসজিদের বাইরে করা খেলাফে সুন্নত’– কেবল এই বেদআত আবিষ্কার করেই ক্ষান্ত হননি, বরং তার দাবি হল নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঈমানী মেহনত ও তালীম-তরবিয়তের নেযামকে এমনভাবে মসজিদের সঙ্গে জুড়ে দিয়েছেন, যেভাবে নামায ও ইবাদতকে মসজিদের সঙ্গে জুড়েছেন!!
সা‘দ সাহেব বলেন–
اللہ کا امر ہے ایمان والوں کے لیے ایمان لانے کا، تو سوال یہ ہے کہ اس ایمان کے لانے کا طریقۂ عمل کیا ہوگا؟ طریقۂ محنت کیا ہوگا؟ طریقۂ محنت صحابہ سے ملےگا، طریقۂ محنت صحابہ سے ملےگا، ایمان لانے کا امر ہے، اس امر کے پورا کرنے کا تعلق اس طرح مسجد سے ہے جس طرح نماز کے ادا کرنے کا تعلق مسجد سے ہے، ہماری بات توجہ سے سننا، نماز کے فریضے کی ادائیگی کی جگہ مسجد ہے، ایک صحابی نے سارے اعذار آپ کے سامنے پیش کر دیا ۔
آپ نے ساری بات سن کر فرمایا کہ اذان سنتے ہو؟ کہا جی ہاں، فرمایا پھر تو مسجد ہی آیا کرو!
میں ایک مثال دے رہا ہوں آپ کو سمجھانے کے لیے، کہ جس طرح نماز کے فریضے کے ادا کرنے کی جگہ مسجد ہے اس طرح ایمان کے فریضے سیکھنے کی جگہ بھی مسجد ہے، اصل بات یہ ہے، اس لیے صحابہ صحابہ پر گشت کرتے تھے اور کہتے تھے کہ آؤ، اٹھو ہمارے ساتھ، چلو ہمارے ساتھ، آؤ ہمارے ساتھ، اپنے رب پر ایمان لائیں! اس میں سب سے بنیادی چیز یہ ہے کہ اللہ کی ذات پر ایمان لانے کے لیے لوگوں کو مسجد سے باہر کے پھیلے ہوئے مادی نقشوں سے نکالنا ہوگا، اس لیے کہ جتنے مسجد سے باہر مادی نقشے پھیلے ہوئے ہیں ان نقشوں میں اللہ کے غیر سے ہونا سمجھ میں آتا ہے، اللہ کی ذات سے ہونے کو سمجھنے کے لیے ان نقشوں سے نکلنا ضروری ہے، مسجد سے باہر جو کائنات کے نقشے پھیلے ہوئے ہیں ان نقشوں سے نکلنا ضروری ہے۔
‘মুমিনদের প্রতি আল্লাহ তাআলার আদেশ হল ঈমান আনা। তাহলে প্রশ্ন এই– যে ঈমানের আদেশ, সে ঈমান পুরা করার সম্পর্ক এমনভাবে মসজিদের সঙ্গে, যেভাবে নামায আদায় করার সম্পর্ক মসজিদের সঙ্গে।
আমাদের কথা মনোযোগ দিয়ে শুনতে হবে। নামাযের যিম্মাদারী আদায়ের জায়গা মসজিদ। এক সাহাবী সমস্ত ওযর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সামনে পেশ করলেন। ... তিনি সব কথা শুনে বললেন, আযান শুনতে পাও?
বললেন, জ্বী।
নবীজী বললেন, তাহলে মসজিদে আস।
আমি একটা দৃষ্টান্ত দিচ্ছি আপনাদের বোঝানোর জন্য। যেভাবে নামাযের দায়িত্ব আদায়ের জায়গা মসজিদ, সেভাবে ঈমান শেখার যিম্মাদারী আদায়ের জায়গাও মসজিদ। আসল কথা হল এটা। এজন্য সাহাবীরা সাহাবীদের ওপর গাশত করতেন এবং বলতেন, আসো! ওঠো! আমাদের সাথে চল। আমাদের সাথে আসো। আমাদের রবের প্রতি ঈমান আনি।
এক্ষেত্রে সবচেয়ে মৌলিক বিষয় এই যে, আল্লাহর যাতের প্রতি ঈমান আনার জন্য মানুষদেরকে মসজিদের বাইরে ছড়িয়ে থাকা বস্তু-কেন্দ্রিক নকশা থেকে বের করে আনতে হবে। সেটা এজন্য যে, বস্তু-কেন্দ্রিক যত নকশা বাইরে ছড়িয়ে আছে, সেসব নকশায় গায়রুল্লাহ থেকে হওয়া বুঝে আসে। আল্লাহর যাত থেকে হওয়ার বুঝ হাসিলের জন্য সেসব নকশা থেকে বের হওয়া জরুরি। মসজিদের বাইরে জগতের যেসব নকশা ছড়িয়ে আছে সেসব নকশা থেকে বের হওয়া জরুরি। ...।’ (বয়ান ০৯/০৭/২০১৯ ঈ., বাদ ফজর, ২৫ মি. ২৪ সে. থেকে)
এই বয়ানেই তিনি বলেছেন–
مسجدوں کو اعمال سے آباد کرو، تاکہ تربیت کا ماحول قائم ہو، میں یہ شروع سے عرض کر رہا کہ حضور اکرم صلی اللہ علیہ وسلم نے تربیت کے لیے مسجدیں بنوائی تھی، اللہ سے جوڑنے کے لیے مسجدیں بنائی گئی ہیں، تشکیل بھی مسجد کا ماحول چاہتی ہے۔
‘মসজিদগুলোকে আমল দ্বারা আবাদ কর। যাতে তরবিয়তের পরিবেশ কায়েম হয়। আমি এটা শুরু থেকে বলে আসছি যে, হুযুরে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তরবিয়তের জন্য মসজিদসমূহ বানিয়েছিলেন। আল্লাহর সঙ্গে জুড়ে দেওয়ার জন্য মসজিদগুলো বানানো হয়েছে। তাশকীলও মসজিদের পরিবেশ দাবি করে...।’ (বয়ান ০৯/০৭/২০১৯ ঈ., বাদ ফজর, ১ ঘ. ৫০ মি. থেকে)
পর্যালোচনা
যেসব আমলের আঞ্জাম দেওয়ার জায়গা আল্লাহ ও তাঁর রাসূল ব্যাপক রেখেছেন এবং মসজিদের সাথে খাস করে দেননি, সেসব আমলকে মসজিদের মধ্যে সীমাবদ্ধ করে দেওয়া এবং মসজিদের বাইরে সেগুলো আঞ্জাম দেওয়াকে সুন্নত পরিপন্থি ও প্রভাবশূন্য আখ্যা দেওয়াটাই ইহদাস ফিদদ্বীন ও গোমরাহী। তথাপি এর চেয়ে আগে বেড়ে যদি এই দাবি করে যে, যেভাবে ফরয নামায আদায় করার জায়গা মসজিদ, সেভাবে ঈমান শেখার জায়গা মসজিদ, তাহলে এটা একদম স্পষ্টই শরীয়ত বানানো হল। আখের কোন্ দলীলের ভিত্তিতে মাওলানা সা‘দ সাহেব এ কথা বলছেন?
তিনি বোঝানোর জন্য মেছাল (দৃষ্টান্ত) তো দিয়েছেন, কিন্তু মেছাল তো দলীল নয়! তাহলে কোন্ দলীলে এটা সাব্যস্ত হল যে, ঈমান শেখার জায়গা শুধুই মসজিদ, যেভাবে ফরয নামায আদায় করার জায়গা মসজিদ?
ফরয নামায মসজিদে জামাতের সঙ্গে আদায় করা সুন্নতে মুআক্কাদা। কোনো ওযর ছাড়া এ বিষয়ে অবহেলা করা গুনাহ। তাহলে কোন্ শরয়ী দলীল দ্বারা এ কথা সাব্যস্ত হল যে, ঈমান শেখার জন্যও মসজিদে আসা সুন্নতে মুআক্কাদা? এবং ওযর ছাড়া এই আমল মসজিদের বাইরে আঞ্জাম দেওয়া গুনাহ?
ওযর ব্যতীত মসজিদে ফরয নামাযের জামাতে উপস্থিত না থাকা– এটা তো এত বড় অপরাধ যে, এ বিষয়ে হাদীস শরীফে ইরশাদ হয়েছে–
وَالَّذِي نَفْسِي بِيَدِه لَقَدْ هَمَمْتُ أَنْ آمُرَ بِحَطَبٍ، فَيُحْطَبَ، ثُمَّ آمُرَ بِالصَّلاَةِ، فَيُؤَذَّنَ لَهَا، ثُمَّ آمُرَ رَجُلًا فَيَؤُمَّ النَّاسَ، ثُمَّ أُخَالِفَ إِلَى رِجَالٍ لَا يَشْهَدُونَ الصَّلَاةَ، فَأُحَرِّقَ عَلَيْهِمْ بُيُوتَهُمْ.
সেই সত্তার কসম, যার হাতে আমার প্রাণ! আমার ইচ্ছা হয় যে, কাউকে লাকড়ি আনার আদেশ করি। লাকড়ি আনার পর নামাযের আদেশ করি। তখন নামাযের জন্য আযান দেওয়ার পর একজনকে বলি মানুষের ইমামতি করতে। অতঃপর যে পুরুষরা নামাযে আসেনি, তাদের কাছে গিয়ে তাদের ওপরেই তাদের বাড়ি-ঘর পুড়িয়ে দিই। –সহীহ বুখারী, হাদীস ৬৪৪; সহীহ মুসলিম, হাদীস ৬৫১
আর এটা তো জানা কথাই যে, ফরয নামাযের জামাতে উপস্থিত না হওয়াকে নববী যুগে নেফাকের আলামত মনে করা হত।
প্রশ্ন হল, এর চেয়ে নিচু পর্যায়ের কোনো ধমকি বা সতর্কবাণীও কি উচ্চারিত হয়েছে– মসজিদের ঈমানী মজলিসে উপস্থিত না হওয়ার বিষয়ে? কিংবা মসজিদের বাইরে ঈমানী হালকা কায়েম না করার বিষয়ে?
কিংবা কোনো দলীল দ্বারা কি এটা প্রমাণিত যে, মসজিদের ঈমানী মুযাকারার হালকায় কিংবা মসজিদের ইলম ও যিকিরের মজলিসে শরীক না হলে সেটাকে নেফাকের আলামত আখ্যা দেওয়া হবে?
তারগীব বা উৎসাহ যেটা এসেছে সেটা তালীম ও তাআল্লুম, ইলম ও যিকির এবং ঈমান ও কুরআনের মজলিস কায়েম করার বিষয়ে; সেটা যেখানেই হোক না কেন। দুয়েকটি হাদীসে ইলম ও যিকিরের উদ্দেশ্যে মসজিদে আসার যে তারগীব বর্ণিত হয়েছে, সে বিষয়ে ইতিপূর্বে আলোচনা হয়েছে যে, এগুলোর দ্বারা মূলত ইলম ও যিকিরের প্রতি তারগীব দেওয়াই উদ্দেশ্য ছিল। যেহেতু ইসলামের শুরু থেকেই মসজিদের বাইরে এসব আমল জারি ছিল, তাই ইলম ও যিকিরের জন্য মসজিদে আসার তারগীব দেওয়াতে এগুলো মসজিদে সম্পাদন করা সুন্নতে মাকসূদা বা সুন্নতে মুআক্কাদা প্রমাণিত হবে না কোনোভাবেই।
এটা নিঃসন্দেহে সঠিক– নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও সাহাবায়ে কেরামের যুগে মসজিদগুলোতে এ ধরনের মজলিস অনেক পরিমাণে হতেই থাকত এবং সাহাবায়ে কেরাম এসব মজলিসে আগ্রহের সঙ্গে উপস্থিত হতেন। তবে এটাও একটা বাস্তবতা যে, নবী ও সাহাবাযুগেই তালীম-তাআল্লুম, ইলম ও যিকির এবং ঈমান ও কুরআনের মজলিস মসজিদের বাইরে ঘরে ও অসংখ্য জায়গাতে হতে থাকত। কিন্তু কোনো একটা হাদীস বা আসারেও এ বিষয়ে কোনো আপত্তি ও নিষেধাজ্ঞা আসেনি। আর না এই তাম্বীহ কোনো হাদীসে এসেছে যে, হে ঈমানদারেরা! তোমরা ঈমান শেখার জন্য মসজিদে কেন আস না? মসজিদের বাইরে ঈমান শেখার যত চেষ্টাই কর, এর দ্বারা আমলের যোগ্যতা হবে না; এর দ্বারা আছর হবে না; কিংবা এটা আমার সুন্নতের খেলাফ!
শরীয়ত খোলাফায়ে রাশেদীন ও সাহাবায়ে কেরামকে উম্মতের জন্য হেদায়েতের মানদণ্ড ও অনুসরণীয় বানিয়েছে। কিন্তু এ বিষয়ে তাদের কারো থেকে এ ধরনের কিছু একেবারেই প্রমাণিত নেই। বরং এর বিপরীতে তাদের কর্মপন্থা এই যে, তারা ইলম ও যিকির এবং ঈমান ও কুরআনের মজলিসগুলো সর্বদা ‘আম’ ও ব্যাপক রেখেছেন।
মাওলানা সা‘দ সাহেব এ বিষয়ে যতগুলো আছার উল্লেখ করেছেন, কোনোটাতেই এ কথা নেই যে, সাহাবায়ে কেরাম রা. মানুষকে ঈমান শেখার শিরোনামে মসজিদে সমবেত করতেন। সমস্ত রেওয়ায়েতে মসজিদের বিষয়টি সা‘দ সাহেবের বানানো। যেমনটা ইতিপূর্বে আলোচনা হয়েছে।
যেসব বিষয়কে শরীয়ত আম ও শর্তমুক্ত রেখেছে এবং মসজিদের সাথে খাস করেনি, সেসব বিষয়কে সা‘দ সাহেব নিজের চিন্তা অনুযায়ী সাহাবায়ে কেরামের নামে মসজিদের সাথে খাস করে দেন। কিন্তু যখন দলীল বলার প্রসঙ্গ আসে তখন ‘কথা বানানো’ ছাড়া তার কাছে আর কিছুই থাকে না।
এক বয়ানে (০৩/০৯/২০১৯ ঈ., বাদ ফজর, ২৬ মিনিট ৫৬ সেকেন্ড থেকে) তিনি নিজের দাবি প্রমাণের জন্য নীলনদের পানি প্রবাহিত না হওয়া প্রসঙ্গে আমর ইবনুল আস রা.-এর পত্র এবং আমীরুল মু’মিনীন উমর রা.-এর পক্ষ থেকে নীলনদের নামে প্রেরিত পত্রের কথাও উল্লেখ করেন। সেখানে সা‘দ সাহেব পরিষ্কার বলেন, পত্রবাহক সে চিঠি উমর রা.-কে মসজিদে প্রদান করেছিল। এভাবে তিনি এই বার্তা দেন যে, উমর রা.-কে সে পত্র মসজিদে দেওয়া হয়েছিল এবং তিনি মসজিদ থেকে সেটার জবাব দিয়েছিলেন আর সে জন্য আছর হয়েছিল। আর এটাই সাহাবায়ে কেরামের তরিকা যে, তারা তাদের সব সমস্যা মসজিদে নিয়ে আসতেন।
অথচ বাস্তবতা হল, কোনো রেওয়ায়েতে এ কথা নেই যে, পত্রবাহক মিশরের গভর্নরের সে পত্র মসজিদে এসে দিয়েছিলেন এবং আমীরুল মু’মিনীন মসজিদে সেটার জবাব লিখে মসজিদ থেকে পাঠিয়েছিলেন। ঘটনাটি হায়াতুস সাহাবাতেও দুই জায়গায় (৩/৮৪০-৮৪১, ৪/২০) আছে। সেখানেও মসজিদের কথা নেই। তাছাড়া যদি মসজিদ থেকেই সমস্ত সমস্যার সমাধান করার বিধান বা নিয়ম থাকত, তাহলে মিশরে কি কোনো মসজিদ ছিল না? এর জন্য আমর ইবনুল আস রা. আমীরুল মুমিনীনকে কেন চিঠি লিখলেন?
অতএব রেওয়ায়েত বানানো, নসের তাহরীফ করা, কিংবা قيد اتفاقي-কে শর্তের মর্যাদা দেওয়া ছাড়া তার কাছে আর কোনো দলীল নেই।
এই বয়ানে (০৩/০৯/২০১৯ ঈ., বাদ ফজর, ১ ঘণ্টা ৬ মিনিট ২৪ সেকেন্ড) সা‘দ সাহেব এটাও বলেন, কত হাদীস আবু হুরায়রা রা.-এর! কিন্তু এসব হাদীস তিনি বাজারে শোনাননি। বাজারের মানুষদেরকে মসজিদের পরিবেশে পাঠিয়েছেন!
সা‘দ সাহেব যে বললেন, আবু হুরায়রা রা. বাজারে হাদীস শোনাননি– সেটাও অবাস্তব কথা; বরং তিনি যে বাজারেও হাদীস শুনিয়েছেন, সেটা সহীহ সনদে প্রমাণিত। (মুসনাদে আহমাদ ১৩/২৫৭, হাদীস ৭৮৭২) খোদ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামও তো একাধিক হাদীস বাজারে ইরশাদ করেছেন। বলেননি যে, তোমরা হাদীসগুলো শোনার জন্য মসজিদে চলে আসো।
আবু হুরায়রা রা. কর্তৃক বাজারের লোকদেরকে মসজিদে পাঠানোর যে কথা মাওলানা সা‘দ সাহেব বললেন, সেটা তো সবার জানা। সেখানে তো এটাও আছে যে, আবু হুরায়রা রা.-এর কথা শুনে যখন বাজারের লোকেরা মসজিদের দিকে ছুটল তখন তিনি তাদের অপেক্ষায় মসজিদের বাইরে দাঁড়িয়ে ছিলেন। অতঃপর যখন তারা মসজিদে না প্রবেশ করে ফিরে আসল তখন তিনি তাদেরকে তার কথার হাকীকত বললেন। কিন্তু রেওয়ায়েতে এ কথা নেই যে, তিনি বাজারের লোকদেরকে পুনরায় মসজিদে পাঠানোর জন্য তাশকীল বা তারগীব দিয়েছেন।
কোনো গলত দাবিকে যদি কেউ শরয়ী দলীল দিয়ে প্রমাণ করতে চায়, তার জন্য রেওয়ায়েতের আগ-পর কাটা কিংবা তার অর্থের মধ্যে বিকৃতি ও পরিবর্তন ঘটানো ছাড়া কোনো উপায় নেই।
বিকৃতির চূড়ান্ত হয়েছে, যখন সা‘দ সাহেব নিজের আবিষ্কৃত বেদআতী চিন্তাকে একদম হাদীস বানিয়ে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দিকে সম্বন্ধ করে দিলেন।
এক বয়ানে তিনি বলেন–
حضور اکرم صلی اللہ علیہ وسلم نے سب سے پہلے یہی مشق کرائی اپنی امت کو کہ تم باہر کے ماحول سے اپنے مسائل کے حل کے لیے مسجد کی طر ف آؤ۔
‘হুজুরে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আপন উম্মতকে সর্বপ্রথম এই অনুশীলন করিয়েছেন যে, তোমরা নিজেদের সমস্যা সমাধানের জন্য বাইরের পরিবেশ থেকে মসজিদে আসো।’ (বয়ান ০২/০৭/২০১৯ ঈ., বাদ ফজর, মহারাষ্ট্রের জোড়, ৩৪ মি. ৩১ সেকেন্ড থেকে)
অথচ নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পক্ষ থেকে এভাবে অনুশীলনের কথা না কুরআনে আছে, না হাদীস ও সীরাতে আছে। কুরআন ও হাদীসের শিক্ষা তো এই যে, বান্দার কাজ হল, আল্লাহ ও আল্লাহর রাসূলের আনুগত্য করা, শরীয়ত-সুন্নাতের অনুসরণ করা, সমস্যা শরীয়তের বিধান মোতাবেক সমাধান করা, বালা-মসিবতে আল্লাহর দিকে রুজু করা, সবর ও সালাত এবং যিকির ও দুআর মাধ্যমে আল্লাহর প্রতি অভিনিবিষ্ট হওয়া, আল্লাহর কাছে সাহায্য চাওয়া এবং আল্লাহর ফয়সালায় সন্তুষ্ট থাকা।
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তো ফরয নামায আদায়ের জন্য মসজিদে আসার তাকীদ করেছেন। খায়ের ও কল্যাণের শিখন-শিক্ষাদানের প্রতি উৎসাহিত করার ক্ষেত্রেও মসজিদের কথা উল্লেখ করেছেন। তাদারুসে কুরআন-কুরআনের পঠন-পাঠনের ক্ষেত্রেও মসজিদের কথা উল্লেখ করেছেন। কিন্তু এগুলো মসজিদে করাই সুন্নত অথবা মসজিদের বাইরে করা খেলাফে সুন্নত, এবং বেআছর ও ফায়দাহীন– এমন কোনো কথা তিনি বলেননি।
সমস্যা সমাধানের জন্য নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উম্মতকে বাইরের পরিবেশ থেকে মসজিদের দিকে আসার অনুশীলন করিয়েছেন– এ কথার স্বপক্ষে না কোনো কওলী হাদীস (বাণী) আছে না ফে‘লী হাদীস। ইত্তিবায়ে সুন্নত (যা সা‘দ সাহেবের বক্তব্য অনুযায়ী গায়েবী মদদ নাযিল হওয়ার অনেক বড় মাধ্যম) তো সারা জীবনের মুআমালা, ইত্তিবায়ে সুন্নতের সম্পর্ক ঘর-বাড়ি এবং মসজিদ সব জায়গার সাথেই। আর দুআ ও সালাতুল হাজতের জন্য মসজিদে আসার তাকীদ তো দূরের কথা, তারগীবও নেই।
এ কথা কোনো রেওয়ায়েতে নেই যে, দুআ ও সালাতুল হাজত (যা সমস্যা সমাধানের গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম) মসজিদে না হলে কবুল হবে না এবং এর মাধ্যমে গায়েবী সাহায্য পাওয়া যাবে না। অথচ এর বিপরীতে হাদীস শরীফে ইরশাদ হয়েছে–
لَا تَجْعَلُوا بُيُوتَكُمْ مَقَابِرَ.
তোমরা তোমাদের ঘরগুলোকে কবরস্থান বানিয়ে ফেলো না। –সহীহ মুসলিম, হাদীস ৭৮০
হাদীস ও আছারসমূহে দুআ ও সালাতুল হাজতকে কখনো মসজিদের সঙ্গে খাস করা হয়নি। কুরআন কারীমে তো রিযিকের সমস্যা সমাধানের জন্য فانتشروا في الأرض ও فامشوا في مناكبها-এর হুকুম দেওয়া হয়েছে। তেমনিভাবে অন্যান্য সমস্যার সমাধানের জন্য আল্লাহ ও তাঁর রাসূল আল্লাহপ্রদত্ত মুবাহ আসবাব ও উপায়-উপকরণ গ্রহণ করার বিধান দিয়েছেন। তাহলে কোন্ হাদীস অথবা কীসের ওপর ভিত্তি করে এ কথা বলা হচ্ছে যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উম্মতকে সর্বপ্রথম এই অনুশীলন করিয়েছেন যে, সমস্যা সমাধানের জন্য তোমরা বাইরের পরিবেশ থেকে মসজিদের দিকে আসো?! এটি মূলত সা‘দ সাহেবের নিজস্ব আবিষ্কৃত মতবাদ। যা তিনি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দিকে যুক্ত করে দিয়েছেন। এসম্পর্কে তার কাছে না আছে কোনো হওয়ালা, না আছে কোনো সনদ। হাদীস জাল করা কত বড় গোমরাহী, তা একেবারে স্পষ্ট।
কোনো সন্দেহ নেই, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উম্মতকে মসজিদমুখী করেছেন এবং মসজিদমুখী হওয়া, মসজিদের সঙ্গে দিলের সম্পর্ক কায়েম রাখা মুমিনের ঈমানী দায়িত্বও বটে। তবে তা মূলত নামায, যিকির, তাসবীহ, তাকবীর, তিলাওয়াতে কুরআন ও ইতিকাফের জন্য। দ্বিতীয়ত মসজিদে ইলম ও যিকিরের সহীহ কোনো হালকা বিদ্যমান থাকলে তা থেকে উপকৃত হওয়ার জন্য। এজন্য নয় যে, দুনিয়াবী প্রয়োজন পূরণ ও সমস্যা সমাধানের জন্য আসবাব তথা উপায়-উপকরণের পরিবর্তে মসজিদে এসে বসে থাকবে কিংবা আসবাব গ্রহণের হালতে দুআ ও সালাতুল হাজতের জন্য এ চিন্তা করে মসজিদে আসবে যে, এটা মসজিদের খাস আমল।
খোলাসা কথা হল, তালীম-তাআল্লুম, ইলম ও যিকিরের মজলিস, ঈমান ও কুরআনের ফযীলত ও ইফাদিয়্যাতকে মসজিদের সাথে এভাবে খাস করা (নির্দিষ্ট ও সীমাবদ্ধ করা) যে, এই আমলগুলো মসজিদে করাই সুন্নত এবং মসজিদের বাইরে এগুলো করা সুন্নত বহির্ভূত, এই আমলসমূহ মসজিদের বাইরে করা হলে মানুষের দিল প্রভাবিত হয় না, আমলের মানসিকতা তৈরি হয় না– এমন কথা ও চিন্তা সম্পূর্ণ ভুল ও ভ্রান্ত ধারণা এবং দ্বীনের মাঝে নতুন বিষয় আবিষ্কারের নামান্তর।
আর এর চেয়ে আগে বেড়ে এই দাবি করা যে, ঈমান শেখার জন্য মসজিদের পরিবেশ এমন, যেমন ফরয নামায আদায়ের জন্য মসজিদ– কোনো সন্দেহ নেই, এ কথা আরও খতরনাক ‘ইহদাস ফিদদ্বীনের’ শামিল।
কোনো হাদীসে কি মসজিদের বাইরের ঈমানী ও দাওয়াতী আমল উপকারী হওয়ার জন্য মসজিদের শর্ত করা হয়েছে?
হাদীস ও সীরাতের ওপর যার প্রশস্ত দৃষ্টি আছে এবং হাদীস ও সীরাতের বিভিন্ন ঘটনাবলি থেকে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আসল উদ্দেশ্য বোঝার জন্য ইলম ও ফিকহের যে গভীরতা ও রুসূখ আবশ্যক, তা যাদের মাঝে যথাযথ পরিমাণে আছে, তাদের বয়ান ও বিবৃতি তো পরিষ্কার যে, কোনো হাদীসে উক্ত আমলগুলো উপকারী ও সুন্নতসম্মত হওয়ার জন্য মসজিদকে শর্ত করা হয়নি। পূর্বে এ সম্পর্কে একাধিক হাদীসের আলোকে আলোচনা করা হয়েছে। এখানে একটি হাদীসকে দ্বিতীয়বার উল্লেখ করে তার ব্যাখ্যা সম্পর্কে উম্মতের আলেমদের কিছু বক্তব্য উদ্ধৃত করা হচ্ছে। এক হাদীসে ইরশাদ হয়েছে–
مَا اجْتَمَعَ قَوْمٌ فِي بَيْتٍ مِنْ بُيُوتِ اللهِ، يَتْلُونَ كِتَابَ اللهِ، وَيَتَدَارَسُونَه فِيمَا بَيْنَهُمْ، إِلّا نَزَلَتْ عَلَيْهِمِ السَّكِينَةُ، وَغَشِيَتْهُمُ الرَّحْمَةُ وَحَفَّتْهُمُ الْمَلَائِكَةُ، وَذَكَرَهُمُ اللهُ فِيمَنْ عِنْدَهُ.
যখন কিছু লোক আল্লাহর ঘরে একত্র হয়ে কিতাবুল্লাহ তিলাওয়াত করে, কিতাবুল্লাহ পড়ে ও পড়ায়, তখন ফেরেশতারা তাদের ঘিরে রাখে, আল্লাহর রহমত তাদের আচ্ছাদিত করে রাখে, তাদের ওপরে ‘সাকীনা’ নাযিল হয় এবং আল্লাহ তাঁর কাছে যারা আছে, (অর্থাৎ তাঁর নৈকট্যশীল ফেরেশতাগণ) তাদের সামনে তাদের কথা আলোচনা করেন। –সহীহ মুসলিম, হাদীস ২৬৯৯
এই হাদীস পড়ে কারো মনে এ কথা আসতে পারে, পরস্পর কুরআন তিলাওয়াত ও দরসে কুরআনের ফযীলত হাসিল হওয়ার জন্য আল্লাহর কোনো ঘর অর্থাৎ মসজিদে একত্রিত হওয়া শর্ত। কিন্তু এ হাদীসের সঙ্গে সঙ্গে এ বিষয়ের অন্যান্য হাদীসের ওপরও যার দৃষ্টি আছে এবং مناط الحكم ও منشأ الحديث -এর গভীরে যাদের ফাহাম পৌঁছেছে তাদের বক্তব্য হল, এ ফযীলত মসজিদের সাথে খাস নয়। যে কোনো জায়গায় আল্লাহর কিছু বান্দা একত্রিত হয়ে এ আমল করলে তারা এই ফযীলতের অধিকারী হবে।
কারণ, এখানে ‘আল্লাহর ঘরের’ উল্লেখ শর্ত হিসেবে করা হয়নি; বরং উদাহরণ হিসেবে করা হয়েছে। তাই এর অর্থ এই নয় যে, মসজিদের বাইরে এই আমল করা হলে হাদীসে উল্লেখিত ফযীলত পাওয়া যাবে না। ‘আল্লাহর ঘরের’ উল্লেখ এখানে শর্ত হিসেবে করা হয়নি– এ কথা বলতে গিয়ে ইমাম নববী রাহ. (৬৭৬ হি.) বলেছেন, ইনশাআল্লাহ এ ফযীলত মাদরাসা, খানকা প্রভৃতিতে কুরআন তিলাওয়াত ও দরসের মজলিস কায়েম করার দ্বারাও হাসিল হবে। তিনি বলেছেন যে, এর একটি দলীল হল, সহীহ মুসলিমে এ হাদীসের পরে উল্লেখকৃত হাদীস (২৭০০), যাতে মসজিদের উল্লেখ নেই; বরং যেখানেই যিকিরের মজলিস হোক এ ফযীলত অর্জিত হওয়ার কথা আছে।
ইমাম নববী রাহ.-এর বক্তব্যের শব্দমালা এই–
ويلحق بالمسجد في تحصيل هذه الفضيلة الاجتماع فى مدرسة ورباط ونحوهما إن شاء الله تعالى، ويدل عليه الحديث الذي بعده؛ فإنه مطلق يتناول جميع المواضع، ويكون التقييد في الحديث الأول خرج على الغالب، لا سيما في ذلك الزمان، فلا يكون له مفهوم يعمل به.
(দ্র. শরহু সহীহ মুসলিম, ইমাম নববী, ২৬৯৯ নং হাদীসের আলোচনা)
বরং আল্লামা তীবী রাহ. তো এ-ও লিখেছেন যে, এই হাদীসে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মসজিদের বদলে আল্লাহর ঘরের কথা এজন্য বলেছেন যে, এখানে ঘর দ্বারা বিশেষভাবে মসজিদ উদ্দেশ্য নয়; বরং যে কোনো ঘর আল্লাহর নৈকট্য লাভের উদ্দেশ্যে দ্বীনী কাজের জন্য বানানো হবে– এর মাঝে শামিল। যেমন, মসজিদ, মাদরাসা, রিবাত-খানকা। তিনি শরহে মিশকাতে লিখেছেন–
وإنما عدل صلى الله عليه وسلم من المساجد، إلى هذه الصيغة أعني ((من بيوت الله)) ليشمل جميع ما يبني لله تقرباً إليه من المساجد والمدارس، والربط. (الكاشف عن حقائق السنن شرح المشكاة للطيبي ২/٦٦٥)
সহীহ মুসলিম, মিশকাতুল মাসাবীহ, আলআরবায়ীন, আলআযকারুন নববিয়্যাহ, আলহিসনুল হাসীন প্রভৃতির অনেক মুহাক্কিক ব্যাখ্যাকার ইমাম নববী ও আল্লামা তীবীর উপরোক্ত ব্যাখার সঙ্গে একমত পোষণ করেছেন। মিশকাতের শরাহ ‘মাযাহেরে হক’ গ্রন্থে উল্লেখ আছে–
اور نہیں جمع ہوتی کوئی قوم بیچ کسی گھر کے گھروں میں سے اللہ کے، یعنی مسجد مدرسہ وغیرہ میں، پڑہیں کتاب اللہ اور معنی بیان کرے اس کے۔ (مظاھر حق ج ১ ص ৯১ کتاب العلم)
মোটকথা, মসজিদ ও মাদরাসা তো অবশ্যই, জমিনের ওপর যে কোনো জায়গায় আল্লাহর কিছু বান্দা একত্রিত হয়ে দরসে কুরআনের আমল করে অথবা ইলম, ঈমান, যিকির ও দুআর মজলিস করে, যদি সেগুলো শরয়ী তরিকায় হয়, তাহলে হাদীসে উল্লেখিত ফযীলত অর্জিত হবে।
মসজিদের খাস ফযীলত এবং খাস বরকত হাসিল করার জন্য আসল করণীয় কাজ কী?
মসজিদের যে খাস ফযীলত এবং খাস বরকত আছে, তা অর্জন করার পদ্ধতি এই নয় যে, সকল দ্বীনী কাজ কেবল তাতেই করা হবে। বরং তার আসল তরিকা হল তা-ই, যা কুরআন ও হাদীসে ইরশাদ করা হয়েছে। অর্থাৎ ফরয নামায মসজিদে আদায় করবে, ঘরে ওযু করে মসজিদে আগে আগে যাবে, নামাযের অপেক্ষায় থাকবে এবং নামায শেষ হওয়ার পরেও মসজিদে আরও সময় থাকার চেষ্টা করবে। নামাযের মুসল্লায় যতক্ষণ বসা থাকবে, ততক্ষণ ফেরেশতাদের দুআ পেতে থাকবে এবং নামাযে থাকার সওয়াবও পেতে থাকবে। মসজিদে যত সময় থাকবে, তা কাজে লাগাবে। তিলাওয়াত, যিকির, তাসবীহ, নফল নামায এবং দুআয় মাশগুল থাকবে। মসজিদে ঈমানী মুযাকারা, দরসে কুরআন ও তাসহীহে তিলাওয়াতে কুরআনের সহীহ নিয়ম অনুযায়ী কোনো মজলিস থাকলে, তাতে শরীক হবে। যদি সময় সুযোগ থাকে তাহলে এক নামাযের পরে দ্বিতীয় নামাযের জন্য মসজিদে অপেক্ষা করতে থাকাও অনেক বড় ইবাদত। আর যখনই মসজিদ থেকে বের হবে দ্বিতীয়বার মসজিদে আসা পর্যন্ত দিল যেন মসজিদের সাথে লেগে থাকে। এটাও অনেক বড় নেক আমল এবং এর সওয়াব অনেক বড়।
তবে মনে রাখতে হবে, ইলম ও যিকিরের মজলিস, ঈমানী হালকা, তাসহীহে তিলাওয়াতে কুরআন এবং দরসে কুরআনের হালকা এবং হালাল-হারামসহ ফরয ইলম এবং ফরযে কিফায়ার ইলম এগুলো সব জায়গায়ই হতে পারে। এগুলো যেখানেই হোক তার উপকারিতা ও প্রভাব সর্বাবস্থায়ই হয়ে থাকে। এগুলোকে নববী যুগ এবং খায়রুল কুরূনের সময়ের মতো ব্যাপক রাখাই কাম্য। অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে যেখানেই এগুলোর ব্যবস্থা করা সম্ভব হয়, তা সুন্নতসম্মত বলেই বিবেচিত হবে। এবং আল্লাহ চাইলে উপকারী ও নেক প্রভাব বিস্তারকারীও হবে। কেবল মসজিদের বাইরে হওয়ার কারণে তা খেলাফে সুন্নত, গায়রে মাসনূন বা প্রভাবহীন হবে না। তাই এগুলো যেখানেই হোক তার কদর করা উচিত।
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যামানায় এই কাজগুলো মসজিদে বেশি হওয়ার কিছু বড় কারণ ছিল–
এক. নতুন নতুন ওহী নাযিল হচ্ছিল। সেগুলোর ইলম হাসিল করার জন্য নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে যাওয়াই স্বাভাবিক বিষয় ছিল, আর তাঁর যিয়ারত লাভের সবচেয়ে সহজ মুনাসিব জায়গা ছিল মসজিদে নববী। যদিও সে সময় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ঘরে তালীম এবং মুযাকারার সিলসিলা জারি ছিল।
দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল, খোদ নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সোহবত হাসিল করা।
তৃতীয় একটি বিষয় ছিল, এই সময় দ্বীনী কাজের জন্য আলাদা আলাদা মারকায বানানোর প্রেক্ষাপট তৈরি হয়নি। আর তার তাৎক্ষণিক কোনো প্রয়োজনও ছিল না। তাই নবীযুগে দ্বীনী কার্যাবলি মসজিদে নববীতে বেশি হওয়া একটি স্বাভাবিক ঘটনা ছিল। এ থেকে এ কথা ইস্তেমবাত করা যে, শরয়ী দৃষ্টিকোণ থেকেও এসকল কাজের আসল ও একমাত্র জায়গা এবং মাসনূন জায়গা মসজিদ– এটি ঠিক নয়। সালাফে সালেহীন এমনটি বোঝেননি।
উমর ইবনে আবদুল আযীয রাহ. ইসলামী বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে নিজের গভর্নরদের উদ্দেশে এই ফরমান জারি করেছিলেন–
مروا أهل الصلاح يتذاكروا السنن في مجالسهم، ومساجدهم، وأسواقهم.
অর্থাৎ তোমরা নেককার উপযুক্ত ব্যক্তিদের বল, তারা যেন তাদের মজলিসে, মসজিদে এবং বাজারে হাদীস ও সুন্নতের মুযাকারা করে। –আনসাবুল আশরাফ, বালাযুরী ৮/১৬০
দ্বিতীয় রেওয়ায়েতে এসেছে–
ومر أهل العلم والفقه من جندك، فلينشروا ما علمهم الله من ذلك، وليتحدثوا به في مجالسهم.
তুমি তোমার সৈনিকদের মাঝে যারা ইলম ও ফিকহের অধিকারী তাদেরকে বল, তারা যেন তাদের মজলিসে ইলমের প্রচার প্রসার করে এবং ইলমের মুযাকারা করে। –সীরাতে উমর ইবনে আবদুল আযীয, ইমাম ইবনে আবদুল হাকাম, পৃ. ২৩
এই রেওয়ায়েত তারীখে ইবনে আবি খায়সামা এবং ইবনে আবদুল বার রচিত জামিউ বায়ানিল ইলমি ওয়া ফাযলিহীতেও এসেছে।
সেখানে মজলিসের সাথে মসজিদের কথাও আছে। যাই হোক, শরীয়তের উদ্দেশ্য হল, ইলমের এশাআত ব্যাপক থেকে ব্যাপকতর হোক। বিশেষত ফরয ইলমের চর্চা সবচেয়ে বেশি ব্যাপক হওয়া উচিত। কি ঘর-বাড়ি, কি মসজিদ মাদরাসা, কি বাজার-ঘাট, সর্বত্র ফরয ইলমের চর্চা হওয়া কর্তব্য।
ইলম প্রচার-প্রসারের এই ব্যাপকতাই ছিল নবীযুগ ও খায়রুল কুরূনের বৈশিষ্ট্য। ইমাম শাতেবী রাহ.-এর ভাষায়–
بل العلم كان في الزمان الأول يبث بكل مكان من مسجد أو منزل أو سفر أو حضر أو غير ذلك، حتى في الأسواق.
ইলম তো প্রথম যমানায় সর্বত্র ছড়িয়ে দেওয়া হত। মসজিদে, বাড়িতে, সফরে, নিবাসে– সব জায়গায় এমনকি বাজারেও। (আলইতিসাম, তৃতীয় অধ্যায়)
সা‘দ সাহেব যদি মসজিদে ঈমানী মুজাকারা এবং ইলম ও যিকিরের হালকা কায়েম করার প্রতি তারগীব প্রদান করেই ক্ষ্যান্ত থাকতেন, তাহলে তা একটি ভালো কাজ ছিল। এর ওপর কারো কোনো আপত্তি হত না। কিন্তু তিনি কেবল তারগীব করেই ক্ষ্যান্ত থাকেননি; বরং তিনি দ্বীনের মধ্যে নতুন নতুন বিধান বানাচ্ছেন–
১. এই আমলগুলো মসজিদে হওয়া সুন্নত; মসজিদের বাইরে হওয়া সুন্নত নয়।
২. এই আমলগুলো যদি মসজিদে হয়, তাহলে এগুলোর মধ্যে আছর ও প্রভাব থাকবে। এগুলোর মাধ্যমে আমলের যোগ্যতা তৈরি হবে এবং ফেরেশতাদের ডানার বেষ্টনী নসিব হবে। আর যদি এ আমলগুলো মসজিদের বাইরে হয় তাহলে উক্ত ফায়দাসমূহের কোনো ফায়দা হবে না।
৩. ঈমান শেখার জায়গা হল মসজিদ যেমনিভাবে নামাযের জায়গা হল মসজিদ।
নিজের পক্ষ থেকে আবিষ্কৃত উক্ত বিধানগুলোকে প্রমাণ করার জন্য বিভিন্ন হাদীস ও আসারে নিজের পক্ষ থেকে সংযোজনও করেছেন। আবার সেগুলোর মর্মে বিভিন্ন আঙ্গিকে বিকৃতিও সাধন করেছেন। এই হল ‘ইহদাস ফিদদ্বীন’ এবং গোমরাহী। একে মসজিদ আবাদ করার নাম দেওয়ার দ্বারা এই ভ্রান্তিগুলো হেদায়েতে পরিণত হবে না।
তাই আল্লাহ তাআলা এবং তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যে বিধান ও ফযীলতকে আম ও শর্তমুক্ত রেখেছেন সেটাকে কোনো শরয়ী দলীল ছাড়া শর্তযুক্ত ও সংকুচিত করার অধিকার করো নেই। কেউ যদি এমনটা করে, তবে সে শরীয়তে হস্তক্ষেপ করা এবং শরয়ী দলীলে সংযোজন-বিয়োজন করার অপরাধ করল। এর আরেক নাম তাহরীফ– অপব্যাখ্যা, যা স্পষ্ট গোমরাহী।
ঈমানের মুযাকারা, দরসে কুরআন, তাসহীহে কুরআন, তিলাওয়াতে কুরআন এবং ইলম ও যিকিরের মজলিসসমূহ নূরানী ও আছরওয়ালা হওয়ার ক্ষেত্রে মূল হল পরিবেশ। যদি ঈমানী পরিবেশ হয়, তাহলে এসব আমল মসজিদে হোক কিংবা মসজিদের বাইরে, সব জায়গায়ই এর দ্বারা হেদায়েত হাসিল হয়। যদি এসব আমল মসজিদে হয়, কিন্তু তাতে সুন্নতের খেলাফ কাজও হয়– যেমন, মসজিদে ঈমানী মুযাকারা বা দ্বীনী কথা হচ্ছে, কিন্তু তাতে হাদীসসমূহের তাহরীফ করা হচ্ছে, আয়াত ও সীরাতের ঘটনাবলির তাহরীফ করা হচ্ছে কিংবা গোমরাহীপূর্ণ চিন্তাধারা মানুষের মস্তিষ্কে ঢোকানো হচ্ছে– তাহলে কেবল মসজিদে হওয়ার কারণে এর দ্বারা নূর পয়দা হবে না। এর দ্বারা হেদায়েত হাসিল হবে না। পক্ষান্তরে যদি কওলে সাদীদ তথা সত্য ও সঠিক কথার ভিত্তিতে, সুন্নাহ মোতাবেক মজলিস হয়, তাহলে ঘরে হোক কিংবা মসজিদের বাইরে, যেখানেই হোক, এর দ্বারা হেদায়েত হাসিল হবে।
মাওলানা সা‘দ সাহেব নিজেই তার বয়ানে বলেছেন–
جو ماحول مسجد ميں قائم کيا ہے وہي ماحول گھر ميں بھي قائم کرو، يوں نہيں کہ تعليم تو ہو گئي، وہ تو اجتماعي اعمال کا ماحول قائم کرنا ہے، اجتماعي اعمال کا ماحول قائم کرنا، گھر کے اندر بھي وہي ماحول قائم کرو، کيونکہ جب مسجد کے ماحول سے گھر کے ماحول ميں آجاؤ گے اور گھر ميں وہ ماحول نہيں ہوگا تو مسجد کے عمل کا اثر ختم ہو جائے گا۔۔۔اس ليے يہ بات سب کے ذہن ميں رہے کہ گھر کے اندر کيے جانے والے اعمال، گھر کے اندر اجتماعي طور پر کيے جانے والے اعمال يہ تربيت کا، ہدايت کا، تزکيہ کا، طہارت کا سبب ہيں۔
‘যে পরিবেশ মসজিদে কায়েম করেছ, সে পরিবেশ ঘরেও কায়েম কর। এই নয় যে, তালীম তো হয়ে গেল। সেটা তো ইজতেমায়ী আমলের পরিবেশ কায়েম করার জন্য। ইজতেমায়ী আমলের পরিবেশ তৈরি করা। ঘরের ভেতরেও সেই পরিবেশ তৈরি কর। কারণ যখন মসজিদের পরিবেশ থেকে ঘরের পরিবেশে চলে আসবে আর ঘরে সে পরিবেশ থাকবে না, তখন মসজিদের প্রভাব শেষ হয়ে যাবে। ... সেজন্য এ কথা সবার যেহেনে থাকবে যে, ঘরের আমলসমূহ, ঘরে ইজতিমায়ীভাবে করা আমলসমূহ– এগুলো তরবিয়তের, হেদায়েতের, তাযকিয়ার ও পবিত্রতার কারণ ...।’ (বয়ান ৩/৯/২০১৯ ঈ., বাদ ফজর, ১ ঘ. ৬ মি. ২৪ সেকেন্ড থেকে)
বিষয় যখন এটাই এবং স্বয়ং সা‘দ সাহেবও এ কথা স্বীকার করলেন, তখন তিনি কেন তালীম-তরবিয়ত, তাযকিয়া, ঈমানী মুযাকারা ও দাওয়াতকে মসজিদের সঙ্গে খাস করছেন?!
(চলবে ইনশআল্লাহ)