ত্রাণপ্রত্যাশী শিশু আমীরের বুকে ইসরাইলের বুলেট!
‖ অপরাধবোধে পুড়ে যাওয়া হৃদয়ের নীরব কান্না
মাওলানা শাহাদাত সাকিব
সে ছিল মাত্র আট বছরের একটি ক্ষীণদেহী শিশু। নাম আমীর। গাজা নামক উন্মুক্ত কারাগারে জন্মেছিল সে। ধুলোবালির মাঝে খেলতে খেলতেই বেড়ে উঠেছিল ক্ষুধা আর বাঁচার লড়াইয়ে। গত মাসে যখন আন্তর্জাতিক সংস্থার একটি ত্রাণ ট্রাক ঢুকেছিল খান ইউনুসের ধ্বংসপ্রায় এক প্রান্তে, তখন ছোট্ট আমীর একাই ১২ কিলোমিটার হেঁটে পৌঁছেছিল সেখানকার ত্রাণ বিতরণ কেন্দ্রে। পায়ে জুতা ছিল না, মুখে শুকনো ঠোঁটে ছিল অনাহারের রেখা।
ত্রাণ বিতরণ কেন্দ্রের সামনে যখন সে পৌঁছাল, তখন তার চোখে-মুখে ফুটে উঠেছিল এক অব্যক্ত আশা। দীর্ঘ অপেক্ষার পর তার হাতে যখন কিছু ডাল আর চাল এল, তার মলিন মুখে ফুটে উঠল এক স্বর্গীয় হাসি। সে হাসি শুধু খাবারপ্রাপ্তির আনন্দ ছিল না, ছিল বেঁচে থাকার এক দুর্নিবার আকাক্সক্ষা। ত্রাণ বিতরণকারীর হাতে চুমু দিয়ে সে শিশুসুলভ নিষ্পাপ কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছিল। ত্রাণশিবির থেকে এক মুঠো ডাল-চাল পেয়েই ভেবেছিল, আজ তার ছোট ভাই-বোনের মুখে হাসি ফোঁটাবে। এ যেন সমস্ত দুঃখের বিরুদ্ধে এক ক্ষীণ বিজয়। কিন্তু গাজায় শিশুর হাসি স্থায়ী হয় না। ইসরাইলী স্নাইপারের গুলি এসে লাগল তার কচি বুকে। হাত থেকে ছিটকে পড়ল ডালের দানা, রক্তে লাল হয়ে উঠল বালির মাটি। হয়তো আমীরের শেষ শব্দ ছিল– ‘আম্মু...’
গাজার আকাশে তখনো শোনা যাচ্ছিল তার শেষ আর্তনাদ। এই নির্মম মৃত্যু যেন শুধু একটি শিশুর জীবন কেড়ে নেয়নি, কেড়ে নিয়েছে মানবতা ও বিবেকের অবশিষ্টটুকু।
৩১ জুলাই আলজাজিরার প্রতিবেদন থেকে এ তথ্য জানা গেছে। এই ঘটনা প্রত্যক্ষ করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক এক সেনাসদস্য আগুইলার। তিনি গাজা হিউম্যানিটিরিয়ান ফাউন্ডেশন (জিএইচএফ)-এর হয়ে সেখানে ত্রাণ বিতরণ কেন্দ্রে কাজ করছিলেন।
আমীরের মতো এমন শত শত শিশুর করুণ মৃত্যু প্রতিনিয়ত ঘটছে গাজায়। ক্ষুধার্ত শিশুরা খাবারের জন্য ছুটে গিয়েও ফিরছে লাশ হয়ে। তাদের নিথর দেহগুলো যেন নীরব প্রশ্ন ছুড়ে দিচ্ছে বিশ্ব বিবেককে–
‘আমাদের অপরাধ কী ছিল? আমরা কি বেঁচে থাকার অধিকারটুকুও রাখি না?’
প্রতিটি গুলির শব্দ যেন হাজারো মায়ের হৃদয় রক্তাক্ত করছে। প্রতিটি বোমার আঘাতে ভেঙে যাচ্ছে অসংখ্য স্বপ্নের বাগান। মায়েরা এখন সিদ্ধান্ত নেয়– ‘কোন্ সন্তানকে আজ খেতে দেবে?’
মানুষ ঘাস সেদ্ধ করে খায়। কুকুর-বিড়ালের মতো আবর্জনা-স্তূপে খাবার খোঁজে। গমের আটামিশ্রিত কাঠের গুঁড়ো দিয়ে ‘রুটি’ বানায়।
গাজার প্রতিটি অলিতে-গলিতে ছড়িয়ে আছে এমন শত শত আমীরের গল্প। কেউ নিহত হয়েছে মসজিদের সীমানায় খেলতে গিয়ে, কেউ ঘুমন্ত অবস্থায় বোমার আঘাতে, কেউবা ত্রাণের লাইনে দাঁড়িয়ে।
কারো লাশ পাওয়া যায় বহুদিন পর, কেউ আবার এতটাই ছিন্নভিন্ন হয়ে যায় যে, মা-বাবা তাকে শনাক্ত করতে পারেন না।
গাজার প্রতিটি শিশু যেন একেকজন নীরব শহীদ। তাদের কবরের পাশে কেউ দাঁড়ায় না। তাদের একমাত্র সাক্ষী হল বিধ্বস্ত ভবন আর তাদের মায়েদের নিষ্ফল আর্তনাদ।
আজকের গাজা শুধু কারাগার নয়; বিশাল এক মৃত্যু-ভূমি। যেখানে বেঁচে থাকার জন্য যুদ্ধ– একটি রুটির টুকরোর জন্য, এক বোতল পানির জন্য, একমুঠো ডালের জন্য। হাজার হাজার শিশু ঘুমাতে যায় না খেয়ে এবং আর জাগে না কোনো দিন।
একটি শিশু জন্ম নেয় জগতের আলো দেখবে বলে, মায়ের কোল জুড়ে হাসবে বলে, পৃথিবীর রঙ দেখবে বলে। কিন্তু গাজায় শিশুদের জীবনের সংজ্ঞা ভিন্ন। সেখানে জন্ম মানেই মৃত্যু-প্রতীক্ষা। ওরা খেলনা চায় না, শুধু একমুঠো খাবার চায়। ওদের স্বপ্ন নেই, কেবল বেঁচে থাকার চেষ্টা আছে।
কিন্তু সভ্যতার মুখোশ পরা এই পৃথিবী তাদের বেঁচে থাকার অধিকারটুকুও দিতে পারেনি। দিয়েছে মৃত্যুর থাবা, বারবার, অবিরত এবং নৃশংসভাবে। প্রতিটি বোমার আঘাতে ভেঙে চুরমার হয়ে যাচ্ছে শৈশবের স্বপ্ন। খেলার মাঠ হয়ে উঠেছে ধ্বংসস্তূপ আর হাসিমাখা মুখগুলো ঢেকে যাচ্ছে ধুলো আর রক্তের দাগে।
এ যেন এক প্রজন্মকে ধ্বংস করে দেওয়ার নিষ্ঠুর খেলা। এই শিশুদের করুণ মৃত্যু শুধু ফিলিস্তিনের নয়, বরং মানবজাতির জন্য এক গভীর ক্ষত।