ইমামুল কুররা
‖ ইয়াহইয়া ইবনে ওয়াসসাব আলআসাদী রাহ.
মাওলানা আতাউল্লাহ
ইয়াহইয়া ইবনে ওয়াসসাব আলআসাদী রাহ.। হিজরী প্রথম শতাব্দীর একজন বিশিষ্ট তাবেয়ী। তৎকালীন ইলমের প্রাণকেন্দ্র্র কূফা নগরীর খ্যাতনামা ইমাম ও প্রখ্যাত কারী। কুরআনের জন্য নিবেদিত ও উৎসর্গপ্রাণ এক মনীষী। কুরআনের প্রতি ছিল তার অসীম অনুরাগ। আবদুল্লাহ ইবনে উমর রা. ও আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা.-এর বিশিষ্ট শাগরেদ। তাঁদের কাছ থেকে হাদীস শিখেছেন। আবদুল্লাহ ইবনে মাসঊদ রা. ও আলী রা.-সহ বিভিন্ন সাহাবীর বড় বড় শিষ্যের কাছ থেকে কুরআন মাজীদ ও ইলমুল কিরাআত শিখেছেন।
তার পূর্বপুরুষ ছিলেন পারস্যের বাসিন্দা। হিজরী ২৩ বা ২৪ সনের দিকে আবু মূসা আশআরী রা.-এর নেতৃত্বে মুসলিমগণ পারস্যের (বর্তমান ইরানের) যে বিশাল ভূখণ্ড জয় করেন, তন্মধ্যে আসফাহান ছিল অন্যতম। অসফাহানেরই একটি বৃহত্তম শহর কাশান, বর্তমানেও যা শিল্প, বাণিজ্য ও ঐতিহাসিক স্থাপনার জন্য বিখ্যাত। হাজার হাজার বছরের নানা ঐতিহ্যের সাক্ষী এ শহর। এ অঞ্চল বিজয় করার সময় মুসলিমদের হাতে বন্দি হন শহরের সম্ভ্রান্ত পরিবারের এক যুবক। নাম ‘ইয়াযদূয়াহ ইবনে মাহূয়াহ’ (يزدويه بن ماهويه)। তিনি আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা.-এর মলিকানাধীন হওয়ায় তাঁর পুণ্যময় সান্নিধ্য অর্জনে ধন্য হন। ইবনে আব্বাস রা. তার নাম পরিবর্তন করে রাখেন ওয়াস্সাব (وثّاب)।
তারই ঘর আলোকিত করে জন্ম হয় শিশু ইয়াহইয়ার। কে জানত এ শিশুই একসময় যুগশ্রেষ্ঠ ইমাম হবে এবং কূফার মতো ইলমের প্রাণকেন্দ্রে বড় বড় ইমামগণও তার শিষ্যত্ব লাভে ধন্য হবেন।
একসময় ওয়াস্সাব রাহ. ইবনে আব্বাস রা.-এর নিকট নিজ দেশে ফিরে যাওয়ার অনুমতি চাইলে ইবনে আব্বাস রা. তাকে অনুমতি দেন। ওয়াস্সাব রাহ. পুত্র ইয়াহইয়াসহ কাশানের উদ্দেশে রওয়ানা হলেন। পথিমধ্যে কূফায় অবস্থান করতে হয়েছিল। এখানে ইলমে দ্বীনের ব্যাপক চর্চা দেখে পুত্র ইয়াহইয়া অত্যন্ত বিমোহিত হন। তিনি বাবাকে অনুরোধ করে বললেন, আমি পার্থিব সম্পদের ওপর ইলমে দ্বীনকেই প্রাধান্য দেব। আপনি আমাকে এখানে থাকার অনুমতি দিন।
একথা শুনে ওয়াস্সাব রাহ. খুশিমনে তাকে কূফায় থেকে যাওয়ার অনুমতি দেন। বালক ইয়াহইয়া ইলমের প্রতি পূর্ণ মনোনিবেশ করেন এবং বড় বড় সাহাবীর প্রসিদ্ধ শিষ্যগণের কাছ থেকে ইলমুল কিরাআত শিখতে লাগলেন।
ইমাম আবুশ্ শায়েখ ইবনে হাইয়ান আলআসবাহানী রাহ. তার ‘তবাকাতুল মুহাদ্দিসীন বিআসবাহান ওয়াল ওয়ারিদীনা আলাইহা’ নামক প্রসিদ্ধ ইতিহাসগ্রন্থে (১/৩৫৫) বলেন–
إن وثابا كان من أهل قاشان، فوقع إلى ابن عباس، فأقام معه سنتين ثم استأذنه في الرجوع إلى قاشان، فأذن له، فرحل من الحجاز، معه ابنه يحيى بن وثاب، فلما بلغ الكوفة قال لأبيه: إني مؤثر حظ العلم على حظ المال، فأعطني الإذن في المقام، فأذن له وخرج وثاب وأقام يحيى بن وثاب بالكوفة، فصار إماما في القراءة.
তিনি ইলমুল কিরাআত শিখেছেন আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা.-এর বিশিষ্ট ছাত্র উবাইদ ইবনে নুযাইলাহ (عبيد بن نضيلة) রাহ.-এর কাছে। [দ্র. আততাবাকাতু কুবরা, ইবনে সা‘দ ৮/২৩৭, জীবনী : ২৮২৪]
ইয়াহইয়া রাহ. উবাইদ রাহ.-এর নিকট এক এক আয়াত করে কুরআন মাজীদ শিখেছেন। একটি আয়াত শেখা হলে শায়েখকে শোনাতেন। এরপর আবার আরেক আয়াত শিখতেন। এভাবে পূর্ণ কুরআন মাজীদ খতম করেন। এ বিষয়ে তার সমসাময়িক ইমাম আসেম ইবনে আবীন নাজূদ রাহ. (প্রসিদ্ধ সাত কারীর একজন) বলেন–
تعلم يحيى بن وثاب من عبيد آية آية، وكان والله قارئا للقرآن.
উবাইদ রাহ.-এর কাছে ইয়াহইয়া ইবনে ওয়াস্সাব এক একটি করে আয়াত শিখেছেন। আল্লাহর শপথ, তিনি কুরআনের একজন (উচ্চমানের) কারী ছিলেন।
এছাড়াও তিনি মাসরূক, আলকামাহ, আসওয়াদ, যির ইবনে হুবাইশ, উবাইদ ইবনে কায়স, আবু আমর আশশাইবানী, আবু আবদুর রহমান আসসুলামী রাহিমাহুমুল্লাহ প্রমুখ তাবেয়ীর কাছেও ইলমুল কিরাআত শিখেছেন। এদের প্রত্যেকেই এক বা একাধিক বড় বড় সাহাবীর কাছে কুরআন মাজীদ শিখেছেন।
ইমাম আবু আমর আদদানী রাহ.-এর বক্তব্য অনুযায়ী ইয়াহইয়া রাহ. উক্ত তাবেয়ীগণের প্রত্যেককে পূর্ণ কুরআন মাজীদ শুনিয়েছেন। এভাবেই তিনি ইলমুল কিরাআত অর্জন করেন এবং আপন যুগের শ্রেষ্ঠ ইমাম হয়ে ওঠেন।
ইবনে খাকান রাহ. বলেন, সে সময়ে কূফা নগরীতে ইলমুল কিরাআতে শ্রেষ্ঠ ছিলেন তিনজন– ইমাম ইয়াহইয়া ইবনে ওয়াসসাব রাহ., ইমাম আছেম রাহ. ও ইমাম আ‘মাশ রাহ.। তাঁদের মধ্যে সবচেয়ে প্রবীণ ও সবার শ্রেষ্ঠ ছিলেন ইয়াহইয়া ইবনে ওয়াস্সাব রাহ.।
তাঁর কাছে বড় বড় ইমামগণও ইলমুল কিরাআত শিখেছেন। এর মধ্যে ইমাম আ‘মাশ রাহ. অন্যতম, যিনি নিজেও ইলমুল কিরাআতের বড় ইমাম ছিলেন।
ইমাম আ‘মাশ রাহ. বলতেন- (আমাদের উস্তায) ইয়াহইয়া হলেন পৃথিবীর বুকে শ্রেষ্ঠ কারী।
তিনি আরও বলেন–
كان يحيى بن وثاب من أحسن الناس قراءة، وربما اشتهيت أن أقبل رأسه من حسن قراءته، وكان إذا قرأ لا يسمع في المسجد حركة، وكأن ليس في المسجدأحد.
ইয়াহইয়া রাহ.-এর তিলাওয়াত ছিল সবচেয়ে সুন্দর ও সুমধুর। তার তিলাওয়াতের মাধুর্যে বিমোহিত হয়ে প্রায়ই আমার মনে আকাক্সক্ষা জাগত, তার কপালে চুমু দেই। যখন তিনি তিলাওয়াত করতেন মসজিদের সবকিছু নীরব নিস্তব্ধ হয়ে যেত, যেন মসজিদে কেউই নেই।
নামাযে একাগ্রতার ক্ষেত্রেও ইয়াহইয়া ইবনে ওয়াসস্সাব রাহ. ছিলেন এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। হাদীস শরীফে নামাযের একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য বর্ণিত হয়েছে–
فإنه يناجي ربه.
অর্থাৎ নামাযী ব্যক্তি নামাযে যেন তার রবের সাথে প্রার্থনা ও বিশেষ আলাপচারিতায় লিপ্ত থাকে। দ্র. সহীহ বুখারী, হাদীস ৪০৫; সহীহ মুসলিম, হাদীস ৫৫১
ইমাম ইয়াহইয়া রাহ. ছিলেন এরই উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। তাঁকে নামাযরত দেখে মনে হত, তিনি আল্লাহ তাআলার সাথে মুনাজাত ও বিশেষ আলাপচারিতায় লিপ্ত।
হিজরী ১০৩ সনে ইমাম ইয়াহইয়া ইবনে ওয়াসসাব রাহ. ইন্তেকাল করেন। আল্লাহ তাআলা তাঁকে জান্নাতে উচ্চ মাকাম দান করুন।