দুটি আয়াত
‖ সুস্থ সমাজ গঠনে দশটি মূলনীতি
আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন–
قُلۡ تَعَالَوۡا اَتۡلُ مَا حَرَّمَ رَبُّکُمۡ عَلَیۡکُمۡ اَلَّا تُشۡرِکُوۡا بِہٖ شَیۡئًا وَّبِالۡوَالِدَیۡنِ اِحۡسَانًا، وَلَا تَقۡتُلُوۡۤا اَوۡلَادَکُمۡ مِّنۡ اِمۡلَاقٍ نَحۡنُ نَرۡزُقُکُمۡ وَاِیَّاہُمۡ، وَلَا تَقۡرَبُوا الۡفَوَاحِشَ مَا ظَہَرَ مِنۡہَا وَمَا بَطَنَ، وَلَا تَقۡتُلُوا النَّفۡسَ الَّتِیۡ حَرَّمَ اللّٰہُ اِلَّا بِالۡحَقِّ، ذٰلِکُمۡ وَصّٰکُمۡ بِہٖ لَعَلَّکُمۡ تَعۡقِلُوۡنَ، وَلَا تَقۡرَبُوۡا مَالَ الۡیَتِیۡمِ اِلَّا بِالَّتِیۡ ہِیَ اَحۡسَنُ حَتّٰی یَبۡلُغَ اَشُدَّہٗ، وَاَوۡفُوا الۡکَیۡلَ وَالۡمِیۡزَانَ بِالۡقِسۡطِ، لَا نُکَلِّفُ نَفۡسًا اِلَّا وُسۡعَہَا، وَاِذَا قُلۡتُمۡ فَاعۡدِلُوۡا وَلَوۡ کَانَ ذَا قُرۡبٰی، وَبِعَہۡدِ اللّٰہِ اَوۡفُوۡا، ذٰلِکُمۡ وَصّٰکُمۡ بِہٖ لَعَلَّکُمۡ تَذَکَّرُوۡنَ.
আপনি বলুন, এসো, আমি (তোমাদেরকে) তা পড়ে শোনাই, যা তোমাদের রব তোমাদের জন্য হারাম করেছেন; তা এই যে, তোমরা তাঁর সঙ্গে কোনো কিছু শরীক করো না, পিতা-মাতার সঙ্গে সদ্ব্যবহার করো, দারিদ্র্যের ভয়ে তোমরা নিজ সন্তানদের হত্যা করো না, আমি তোমাদের রিযিক দেই এবং তাদেরও। আর তোমরা প্রকাশ্য ও গোপন কোনো রকম অশ্লীল কাজের নিকটেও যেয়ো না আর আল্লাহ যে প্রাণকে মর্যাদা দান করেছেন, তাকে যথার্থ কারণ ছাড়া হত্যা করো না। এসব বিষয়ে আল্লাহ তোমাদেরকে আদেশ করেছেন, যাতে তোমরা উপলব্ধি কর।
এতীম পরিপক্ব বয়সে না পৌঁছা পর্যন্ত তার সম্পদের নিকটেও যেয়ো না, তবে এমন পন্থায় (যাবে, তার পক্ষে) যা উত্তম হয়। পরিমাপ ও ওজন ন্যায়ানুগভাবে পরিপূর্ণ করবে। আমি কাউকে তার সাধ্যাতীত ভার অর্পণ করি না। আর যখন (কোনো কথা) বলবে, ন্যায্য বলবে, যদিও নিকটাত্মীয়ের বিষয়ে হয়। আল্লাহর প্রতিশ্রুতি পূর্ণ করবে। আল্লাহ এসব বিষয়ে তোমাদেরকে গুরুত্বের সাথে আদেশ করেছেন, যাতে তোমরা উপদেশ গ্রহণ কর। –সূরা আনআম (০৬) : ১৫১-১৫২
কুরআন কারীমের প্রতিটি আয়াতই হেদায়েত ও আলোর দিশারি। বন্ধ হৃদয়ের কপাট খুলে দেয়। হৃদয়ের জং-মরিচা দূর করে। অন্ধকার থেকে আলোয় নিয়ে আসে। ইহকালীন শান্তি পরকালীন মুক্তির পথ বাতলে দেয়।
সূরা আনআমের উল্লিখিত আয়াতদুটি সম্পর্কে বিখ্যাত সাহাবী আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. বলেন–
مَنْ سَرَّه أَنْ يَنْظُرَ إِلَى الصَّحِيفَةِ، الَّتِي عَلَيْهَا خَاتَمُ مُحَمَّدٍ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، فَلْيَقْرَأْ هذِهِ الآيَاتِ.
যার রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সেই মোহরাঙ্কিত সহীফা ও ওসিয়তনামা দেখার আগ্রহ জাগে, সে যেন এই আয়াতগুলো পাঠ করে। –জামে তিরমিযী, হাদীস ৩০৭০; তাফসীরে ইবনে কাসীর ৩/৩৫৯
দুটো আয়াত। এর প্রতিটি অংশই একেকটি মূলনীতি। দ্বীন-ঈমান, মানবিক মূল্যবোধ, পারিবারিক বন্ধন, ন্যায়বিচার, প্রাণের নিরাপত্তা, ইনসাফের দণ্ড, প্রতিশ্রুতি রক্ষা, তাকওয়া ও খোদাভীতির পয়গাম– সবই রয়েছে এ দুই আয়াতে।
মুফাস্সিরকুলের সরদার আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. বলেছিলেন–
هذه الْآيَاتُ الْمُحْكَمَاتُ الَّتِي ذَكَرَهَا اللهُ فِي سُورَةِ آل عمران أَجْمَعَتْ عَلَيْهَا شَرَائِعُ الْخَلْقِ، وَلَمْ تُنْسَخْ قَطُّ فِي مِلَّةٍ.
এই আয়াতগুলো আয়াতে মুহকামাত (ভাষা দ্ব্যর্থহীন ও সুস্পষ্ট, বিষয় দুর্বোধ্যতামুক্ত এবং অর্থ সুবিদিত ও সুনির্দিষ্ট)-এর অন্তর্ভুক্ত। এই আয়াতে উল্লেখিত বিধানসমূহ সকল আসমানী শরীয়তেই বিদ্যমান ছিল। কোনো শরীয়তেই এগুলো রহিত ছিল না। –তাফসীরে কুরতুবী ৭/১৩২
মৌলিকভাবে আয়াতদ্বয়ে দশটি বিষয়ে নির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে। যার গুরুত্ব কুরআন কারীমের অপরাপর আয়াতেও দেওয়া হয়েছে।
এক : আল্লাহর সঙ্গে কাউকে শরীক না করা
اَلَّا تُشْرِكُوْا بِهٖ شَیْـًٔا.
(তোমরা তাঁর সঙ্গে কোনো কিছু শরীক করো না।)
এই প্রসঙ্গে কুরআন কারীমে বারবার বলা হয়েছে, বিভিন্নভাবে সতর্ক করা হয়েছে। এক আয়াতে ইরশাদ হয়েছে–
وَمَنْ یُّشْرِكْ بِاللهِ فَكَاَنَّمَا خَرَّ مِنَ السَّمَآءِ فَتَخْطَفُهُ الطَّیْرُ اَوْ تَهْوِیْ بِهِ الرِّیْحُ فِیْ مَكَانٍ سَحِیْقٍ.
যে কেউ আল্লাহর সাথে কাউকে শরীক করে, সে যেন আকাশ থেকে পতিত হল, তারপর পাখি তাকে ছোঁ মেরে নিয়ে গেল অথবা বাতাস তাকে দূরবর্তী স্থানে নিক্ষেপ করল। –সূরা হজ্ব (২২) : ৩১
ঈমানের উচ্চতা যেন আকাশতুল্য। কেউ শিরকে লিপ্ত হওয়ার অর্থ আকাশ তথা ঈমানের সমুচ্চ স্থান থেকে নিচে পড়ে যাওয়া। সেখান থেকে পাখি তাকে ছোঁ মেরে নিয়ে যায়। অর্থাৎ তার কুপ্রবৃত্তি ও খেয়ালখুশি তাকে সরল পথ থেকে বিচ্যুত করে ফেলে। এভাবে সে ঈমানের উচ্চতর স্থান থেকে স্খলিত হয়ে কুপ্রবৃত্তি ও শয়তানের দাস হয়ে যায়। (দ্র. তাফসীরে তাওযীহুল কুরআন, সংশ্লিষ্ট আয়াত)
অন্য আয়াতে ইরশাদ হয়েছে–
اِنَّ اللهَ لَا یَغْفِرُ اَنْ یُّشْرَكَ بِهٖ وَیَغْفِرُ مَا دُوْنَ ذٰلِكَ لِمَنْ یَّشَآءُ وَمَنْ یُّشْرِكْ بِاللهِ فَقَدِ افْتَرٰۤی اِثْمًا عَظِیْمًا.
নিশ্চয়ই আল্লাহ এ বিষয়কে ক্ষমা করেন না যে, তার সঙ্গে কাউকে শরীক করা হবে। এর চেয়ে নিচের যে কোনো বিষয়ে যাকে ইচ্ছা ক্ষমা করেন। যে ব্যক্তি আল্লাহর সঙ্গে কাউকে শরীক করে, সে এক গুরুতর পাপে লিপ্ত হল। –সূরা নিসা (০৪) : ৪৮
শিরক ছাড়া অন্য সকল গুনাহ আল্লাহ চাইলে তওবা ছাড়াও নিজ অনুগ্রহে ক্ষমা করতে পারেন। কিন্তু শিরকের অপরাধ কেবল তখনই ক্ষমা হতে পারে, যখন ব্যক্তি খাঁটি মনে তা থেকে তওবা করে তাওহীদে বিশ্বাস স্থাপন করে। অন্যথায় জাহান্নামই হবে তার চিরস্থায়ী ঠিকানা।
আনাস রা. রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে একটি হাদীসে কুদসী বর্ণনা করেন। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন–
يَا ابْنَ آدَمَ إِنَّكَ مَا دَعَوْتَنِي وَرَجَوْتَنِي غَفَرْتُ لَكَ عَلَى مَا كَانَ فِيكَ وَلاَ أُبَالِي، يَا ابْنَ آدَمَ لَوْ بَلَغَتْ ذُنُوبُكَ عَنَانَ السَّمَاءِ ثُمَّ اسْتَغْفَرْتَنِي غَفَرْتُ لَكَ، وَلاَ أُبَالِي، يَا ابْنَ آدَمَ إِنَّكَ لَوْ أَتَيْتَنِي بِقُرَابِ الأَرْضِ خَطَايَا ثُمَّ لَقِيتَنِي لاَ تُشْرِكُ بِي شَيْئًا لأَتَيْتُكَ بِقُرَابِهَا مَغْفِرَةً.
হে আদম সন্তান! তুমি যতক্ষণ আমাকে ডাকবে এবং আমার কাছে আশা রাখবে, আমি তোমার সকল গুনাহ ক্ষমা করে দেব, কোনো পরোয়া করব না।
হে আদম সন্তান! যদি তোমার গুনাহ আকাশ পর্যন্ত পৌঁছে যায়, তারপর তুমি আমার কাছে ক্ষমা চাও, আমি তোমাকে ক্ষমা করে দেব, কোনো পরোয়া করব না।
হে আদম সন্তান! যদি তুমি আমার কাছে আসো পৃথিবী পরিমাণ গুনাহ নিয়ে, কিন্তু শিরক থেকে মুক্ত থাকো, আমিও তোমার জন্য পৃথিবী পরিমাণ ক্ষমা নিয়ে আসব। –জামে তিরমিযী, হাদীস ৩৫৪০; মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ২১৪৭২
দুই : পিতা-মাতার সাথে সদ্ব্যবহার করা
وَ بِالْوَالِدَیْنِ اِحْسَانًا.
(পিতা-মাতার সঙ্গে সদ্ব্যবহার করো)
এই বিষয়েও কুরআন কারীমে রয়েছে স্বতন্ত্র নির্দেশনা। এক আয়াতে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন–
وَ قَضٰی رَبُّكَ اَلَّا تَعْبُدُوْۤا اِلَّاۤ اِیَّاهُ وَ بِالْوَالِدَیْنِ اِحْسَانًا اِمَّا یَبْلُغَنَّ عِنْدَكَ الْكِبَرَ اَحَدُهُمَاۤ اَوْ كِلٰهُمَا فَلَا تَقُلْ لَّهُمَاۤ اُفٍّ وَّلَا تَنْهَرْهُمَا وَقُلْ لَّهُمَا قَوْلًا كَرِیْمًا، وَاخْفِضْ لَهُمَا جَنَاحَ الذُّلِّ مِنَ الرَّحْمَةِ وَقُلْ رَّبِّ ارْحَمْهُمَا كَمَا رَبَّیٰنِیْ صَغِیْرًا.
তোমার প্রতিপালক ফয়সালা দিয়েছেন যে, তাকে ছাড়া অন্য কারো ইবাদত করো না, পিতা-মাতার সাথে সদ্ব্যবহার করো, পিতা-মাতার কোনো একজন কিংবা উভয়ে যদি তোমার কাছে বার্ধক্যে উপনীত হন, তবে তাদেরকে উফ্ পর্যন্ত বলো না। আর তাদেরকে ধমক দিয়ো না; বরং তাদের সাথে সম্মানজনক কথা বলো। আর তাদের প্রতি মমতাপূর্ণ আচরণের সাথে তাদের সামনে নিজেকে বিনয়াবনত করো এবং দুআ করো, হে আমার প্রতিপালক! তারা যেভাবে আমার শৈশবে আমাকে লালনপালন করেছেন, তেমনি আপনিও তাদের প্রতি রহমতের আচরণ করুন। –সূরা বনী ইসরাঈল (১৭) : ২৩-২৪
মা-বাবার কোনো কথা বা আচরণে বিরক্ত হওয়া যাবে না। তাদেরকে ধমক দেওয়া যাবে না। এমনকি উফ্ শব্দও বলা যাবে না। তারা কখনো অন্যায় আচরণ করলেও তাদের সাথে বেয়াদবি করা যাবে না। বিনয় ও নম্রতার আচরণ করতে হবে। পরিপূর্ণ শ্রদ্ধা ও সম্মানের সাথে কথা বলতে হবে। আর তাদের জন্য আল্লাহ তাআলার কাছে বেশি বেশি দুআ করতে হবে–
رَّبِّ ارْحَمْهُمَا كَمَا رَبَّیٰنِیْ صَغِیْرًا.
অর্থাৎ হে আল্লাহ! আমাকে যেমন খুব আদর-যত্ন করে তারা লালনপালন করেছেন, আপনিও তাদের প্রতি সেরকম দয়া করুন।
তিন : দারিদ্র্যের ভয়ে সন্তানদের হত্যা না করা
وَ لَا تَقْتُلُوْۤا اَوْلَادَكُمْ مِّنْ اِمْلَاقٍ.
(দারিদ্র্যের ভয়ে তোমরা নিজ সন্তানদের হত্যা করো না।)
আরবের মুশরিকরা কখনো কখনো সামাজিক লজ্জা ও অপমানের ভয়ে কন্যা সন্তানকে মেরে ফেলত। আবার কখনো দারিদ্র্যের ভয়েও নিজ সন্তানকে মেরে ফেলত।
আল্লাহ তাআলা সতর্ক করে বলেন–
وَلَا تَقْتُلُوْۤا اَوْلَادَكُمْ خَشْيَةَ اِمْلَاقٍ نَحْنُ نَرْزُقُهُمْ وَاِيَّاكُمْ اِنَّ قَتْلَهُمْ كَانَ خِطْاً كَبِيْرًا.
দারিদ্র্যের ভয়ে নিজ সন্তানদেরকে হত্যা করো না। আমি তাদেরকেও রিযিক দেই এবং তোমাদেরকেও। নিশ্চয়ই তাদেরকে হত্যা করা গুরুতর অপরাধ। –সূরা বনী ইসরাঈল (১৭) : ৩১
চার : অশ্লীলতা থেকে দূরে থাকা
وَلَا تَقْرَبُوا الْفَوَاحِشَ مَا ظَهَرَ مِنْهَا وَمَا بَطَنَ.
(আর তোমরা প্রকাশ্য ও গোপন কোনো রকম অশ্লীল কাজের নিকটেও যেয়ো না।)
আয়াতের চতুর্থ শিক্ষা, প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য সব ধরনের অশ্লীলতা থেকে দূরে থাকা। বান্দাকে বিপথগামী করতে শয়তানের এক সফল অস্ত্র অশ্লীলতা। যা ধীরে ধীরে বান্দার ঈমান দুর্বল করে দেয় এবং তার হৃদয় থেকে তাকওয়ার আলো নিভিয়ে দেয়। একপর্যায়ে সে আল্লাহ থেকে দূরে সরে যায়। তখন শয়তান তাকে বিপথগামী করে ফেলে।
অন্য আয়াতে আল্লাহ তাআলা এ বিষয়ে সতর্ক করে বলেছেন–
اِنَّمَا يَاْمُرُكُمْ بِالسُّوْٓءِ وَالْفَحْشَآءِ وَاَنْ تَقُوْلُوْا عَلَي اللهِ مَا لَا تَعْلَمُوْنَ.
সে তো তোমাদেরকে অন্যায় ও অশ্লীল কাজ করতে এবং আল্লাহ সম্পর্কে এমন কথা বলতেই আদেশ করে, যা তোমরা জান না। –সূরা বাকারা (০২) : ১৬৮
اَلشَّيْطٰنُ يَعِدُكُمُ الْفَقْرَ وَيَاْمُرُكُمْ بِالْفَحْشَآءِ وَاللهُ يَعِدُكُمْ مَّغْفِرَةً مِّنْهُ وَ فَضْلًا.
শয়তান তোমাদেরকে দারিদ্র্যের ভয় দেখায় এবং তোমাদেরকে অশ্লীলতার আদেশ করে, আর আল্লাহ তোমাদেরকে তাঁর মাগফিরাত ও অনুগ্রহের প্রতিশ্রুতি দেন। –সূরা বাকারা (০২) : ২৬৮
অন্যত্র তিনি আরও ইরশাদ করেছেন–
اِنَّ اللهَ يَاْمُرُ بِالْعَدْلِ وَالْاِحْسَانِ وَاِيْتَآئِ ذِي الْقُرْبٰي وَيَنْهٰي عَنِ الْفَحْشَآءِ وَالْمُنْكَرِ وَالْبَغْيِ يَعِظُكُمْ لَعَلَّكُمْ تَذَكَّرُوْنَ.
নিশ্চয়ই আল্লাহ ইনসাফ, দয়া এবং আত্মীয়স্বজনকে (তাদের হক) প্রদানের হুকুম দেন আর অশ্লীলতা, মন্দ কাজ ও জুলুম করতে নিষেধ করেন। তিনি তোমাদেরকে উপদেশ দেন, যাতে তোমরা উপদেশ গ্রহণ কর। –সূরা নাহল (১৬) : ৯০
আল্লাহর সঙ্গে গভীর সম্পর্ক, আত্মিক প্রশান্তি, পারিবারিক ও সামাজিক স্থিতিশীলতা রক্ষার জন্য অশ্লীলতা থেকে বেঁচে থাকার বিকল্প নেই।
পাঁচ : অন্যায়ভাবে কাউকে হত্যা না করা
وَلَا تَقْتُلُوا النَّفْسَ الَّتِيْ حَرَّمَ اللهُ اِلَّا بِالْحَقِّ.
(আল্লাহ যে প্রাণকে মর্যাদা দান করেছেন, তাকে যথার্থ কারণ ছাড়া হত্যা করো না।)
আয়াতের পঞ্চম শিক্ষা অন্যায়ভাবে কাউকে হত্যা না করা। কারণ অন্যায়ভাবে হত্যাকারী পুরো মানবতার শত্রু। যে একজন মানুষকে হত্যা করল, সে যেন সমস্ত মানুষকেই হত্যা করে ফেলল।
আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন–
مَنْ قَتَلَ نَفْسًۢا بِغَيْرِ نَفْسٍ اَوْ فَسَادٍ فِي الْاَرْضِ فَكَاَنَّمَا قَتَلَ النَّاسَ جَمِيْعًا وَمَنْ اَحْيَاهَا فَكَاَنَّمَاۤ اَحْيَا النَّاسَ جَمِيْعًا.
কেউ যদি কাউকে হত্যা করে এবং তা অন্য কাউকে হত্যা করার কারণে কিংবা পৃথিবীতে অশান্তি বিস্তারের কারণে না হয়, তবে সে যেন সমস্ত মানুষকে হত্যা করল। আর যে ব্যক্তি কারো প্রাণ রক্ষা করে, সে যেন সমস্ত মানুষের প্রাণরক্ষা করল। –সূরা মায়েদা (০৫) : ৩২
একই বিষয়ে হাদীসে এসেছে–
لَزَوَالُ الدُّنْيَا أَهْوَنُ عَلَى اللهِ مِنْ قَتْلِ رَجُلٍ مُسْلِمٍ.
একজন মুসলিম ব্যক্তিকে (অন্যায়ভাবে) হত্যা করা আল্লাহ তাআলার নিকট সমগ্র পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাওয়ার চেয়েও গুরুতর। –জামে তিরমিযী, হাদীস ১৩৯৫; আদদিয়াত, ইবনে আবী আসেম, হাদীস ২
মূলত অন্যায়ভাবে নরহত্যায় কেবল তখনই কেউ লিপ্ত হতে পারে, যখন তার অন্তর থেকে মানুষের মর্যাদা লোপ পেয়ে যায়। এমন লোক যখন তখন কারণে-অকারণে, নিজ স্বার্থে যে কাউকে হত্যা করতে দ্বিধাবোধ করবে না। তাই অন্যায়ভাবে একজন ব্যক্তিকে হত্যা করাও অনেক বড় গুনাহ ও অপরাধ।
ছয় : এতীমের সম্পদের ব্যাপারে সতর্ক থাকা
وَ لَا تَقْرَبُوْا مَالَ الْيَتِيْمِ اِلَّا بِالَّتِيْ هِيَ اَحْسَنُ حَتّٰي يَبْلُغَ اَشُدَّهٗ.
[এতীম পরিপক্ব বয়সে না পৌঁছা পর্যন্ত তার সম্পদের নিকটেও যেয়ো না, তবে এমন পন্থায় (যাবে, তার পক্ষে) যা উত্তম হয়।]
এতীমের সম্পদ গ্রাস করা অত্যন্ত ভয়াবহ পাপ! অন্য আয়াতে একে ‘অগ্নি ভক্ষণ’ বলা হয়েছে। ইরশাদ হয়েছে–
اِنَّ الَّذِيْنَ يَاْكُلُوْنَ اَمْوَالَ الْيَتٰمٰي ظُلْمًا اِنَّمَا يَاْكُلُوْنَ فِيْ بُطُوْنِهِمْ نَارًا وَسَيَصْلَوْنَ سَعِيْرًا.
নিশ্চয়ই যারা এতীমদের সম্পদ অন্যায়ভাবে ভোগ করে, তারা নিজেদের পেটে কেবল আগুন ভরতি করে। তারা অচিরেই এক জ্বলন্ত আগুনে প্রবেশ করবে। –সূরা নিসা (০৪) : ১০
সাত ও আট : পরিমাপ ও ওজন ন্যায়ানুগভাবে পরিপূর্ণ করা
وَاَوْفُوا الْكَيْلَ وَالْمِيْزَانَ بِالْقِسْطِ.
(এবং পরিমাপ ও ওজন ন্যায়ানুগভাবে পরিপূর্ণ করবে।)
লেনদেন, বেচাকেনার সময় ওজন ও পরিমাপে সততা রক্ষা করা আয়াতের গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা। এটি কেবল বাণিজ্যিক শুদ্ধতা বা শিষ্টাচারই নয়, এতে অন্যের হকও রক্ষা করা হয় এবং এটি সমাজে বরকত ও কল্যাণও বয়ে আনে।
আল্লাহ তাআলা এ ব্যাপারে আরও ইরশাদ করেন–
وَاَوْفُوا الْكَيْلَ اِذَا كِلْتُمْ وَزِنُوْا بِالْقِسْطَاسِ الْمُسْتَقِيْمِ ذٰلِكَ خَيْرٌ وَّ اَحْسَنُ تَاْوِيْلًا.
যখন পরিমাপ পাত্র দ্বারা কাউকে কোনো জিনিস মেপে দাও, তখন পরিপূর্ণ মাপে দিয়ো আর ওজন করার জন্য সঠিক দাঁড়িপাল্লা ব্যবহার করো। এ পন্থাই সঠিক এবং এরই পরিণাম উৎকৃষ্ট। –সূরা বনী ইসরাঈল (১৭) : ৩৫
বেচাকেনার সময় পরিমাপ ও ওজনে কমবেশি না করা যেমন আয়াতের বিধান, তেমনি যে কোনো ক্ষেত্রে নিজের হক বুঝে নেওয়ার সময় কঠোরতা এবং অন্যের হক আদায়ে টালবাহানা না করাও আয়াতের শিক্ষা। সত্য কথা হল, এটুকু কম দিয়ে কাউকে ঠকানো হয় না; ঠকানো হয় নিজেকে এবং নিজের আখেরাতকে। কাজেই আমার প্রতিটি লেনদেনে থাকুক আল্লাহভীতি ও সততার দীপ্তি।
নয় : স্বজনপ্রীতি নয়, সর্বদা হক কথা বলা, হক পথে থাকা
وَاِذَا قُلْتُمْ فَاعْدِلُوْا وَلَوْ كَانَ ذَا قُرْبٰي.
[আর যখন (কোনো কথা) বলবে, ন্যায্য বলবে, যদিও নিকটাত্মীয়ের বিষয়ে হয়।]
যূথবদ্ধ জীবনে ন্যায় ও ইনসাফের গুরুত্ব অপরিসীম। যে কোনো সম্মিলিত কাজ, প্রতিষ্ঠান, সমাজ ও দেশে যদি ইনসাফ না থাকে, তাহলেই অশান্তির আগুন জ্বলে ওঠে। বে-ইনসাফির এক বড় কারণ স্বজনপ্রীতি। বলা হয়, স্বজনপ্রীতি নষ্ট করে সম্প্রীতি। সামাজিক সৌহার্দ, পরস্পর শ্রদ্ধা ও ভালবাসা, সবকিছুকেই স্বজনপ্রীতি নষ্ট করে দেয়।
নিজের নিকটতম বা ঘনিষ্ঠজন বলে ছাড় দেওয়া বা অগ্রাধিকার দেওয়া কোনোটাই ইসলামসম্মত নয়; সবাইকে সমানভাবে দেখাই ইসলামের শিক্ষা।
আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন–
يٰۤاَيُّهَا الَّذِيْنَ اٰمَنُوْا كُوْنُوْا قَوّٰمِيْنَ بِالْقِسْطِ شُهَدَآءَ لِلهِ وَلَوْ عَلٰۤي اَنْفُسِكُمْ اَوِ الْوَالِدَيْنِ وَالْاَقْرَبِيْنَ اِنْ يَّـكُنْ غَنِيًّا اَوْ فَقِيْرًا فَاللهُ اَوْلٰي بِهِمَا فَلَا تَتَّبِعُوا الْهَوٰۤي اَنْ تَعْدِلُوْا وَ اِنْ تَلْوٗۤا اَوْ تُعْرِضُوْا فَاِنَّ اللهَ كَانَ بِمَا تَعْمَلُوْنَ خَبِيْرًا.
হে মুমিনগণ! তোমরা ইনসাফ প্রতিষ্ঠাকারী হয়ে যাও আল্লাহর জন্য সাক্ষ্যদাতারূপে, যদিও তা তোমাদের নিজেদের বিরুদ্ধে কিংবা পিতা-মাতা ও আত্মীয়স্বজনের বিরুদ্ধে হয়। সে ব্যক্তি (যার বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেওয়ার আদেশ করা হচ্ছে) যদি ধনী বা গরিব হয়, তবে আল্লাহ উভয় প্রকার লোকের ব্যাপারে (তোমাদের চেয়ে) বেশি কল্যাণকামী। সুতরাং তোমরা ইনসাফ করার ব্যাপারে ইচ্ছা-অভিরুচির অনুসরণ করো না। যদি তোমরা প্যাঁচাও (অর্থাৎ মিথ্যা সাক্ষ্য দাও) অথবা (সঠিক সাক্ষ্য দেওয়া থেকে) পাশ কাটিয়ে যাও, তবে (জেনে রেখ) আল্লাহ তোমাদের যাবতীয় কাজ সম্পর্কে সম্পূর্ণ অবগত। –সূরা নিসা (০৪) : ১৩৫
দশ : ওয়াদা রক্ষা করা
وَبِعَهْدِ اللهِ اَوْفُوْا.
(আল্লাহর প্রতিশ্রুতি পূর্ণ করবে।)
কুরআন কারীমে এ সম্পর্কে আরো অনেক আয়াত বর্ণিত হয়েছে। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন–
وَأَوْفُوا بِعَهْدِ اللهِ إِذَا عَاهَدْتُمْ وَلَا تَنْقُضُوا الْأَيْمَانَ بَعْدَ تَوْكِيدِهَا وَقَدْ جَعَلْتُمُ اللهَ عَلَيْكُمْ كَفِيلًا إِنَّ اللهَ يَعْلَمُ مَا تَفْعَلُونَ.
তোমরা যখন কোনো অঙ্গীকার কর, তখন আল্লাহর সঙ্গে কৃত অঙ্গীকার পূর্ণ কর। শপথ দৃঢ় করার পর তা ভঙ্গ করো না। –সূরা নাহল (১৬) : ৯১
وَ اَوْفُوْا بِالْعَهْدِ اِنَّ الْعَهْدَ كَانَ مَسْـُٔوْلًا.
আর অঙ্গীকার পূরণ করো। নিশ্চয়ই অঙ্গীকার সম্পর্কে (তোমাদের) জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। –সূরা বনী ইসরাঈল (১৭) : ৩৪
আল্লাহ তাআলার সাথে কৃত প্রতিশ্রুতিও রক্ষা করতে হবে। বান্দার সাথে কৃত অঙ্গীকারও পূরণ করতে হবে। উভয় ওয়াদা সম্পর্কেই আখেরাতে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।
আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের সন্তুষ্টি এবং পরকালীন কল্যাণের পাশাপাশি ওয়াদা রক্ষায় ইহজাগতিক বহু ফায়েদাও রয়েছে। পারস্পরিক আন্তরিকতা বৃদ্ধি পায় ওয়াদা রক্ষার মাধ্যমে। যেখানে প্রতিশ্রুতি রক্ষা করা হয়, সেখানে শান্তি ও নিরাপত্তা গড়ে ওঠে।
আর ওয়াদা ভঙ্গ করাকে নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন মুনাফিকের নিদর্শন। ইরশাদ হয়েছে–
آيَةُ المُنَافِقِ ثَلاَثٌ: إِذَا حَدَّثَ كَذَبَ، وَإِذَا وَعَدَ أَخْلَفَ، وَإِذَا اؤْتُمِنَ خَانَ.
মুনাফিকের নিদর্শন তিনটি। যখন কথা বলে, মিথ্যা বলে। যখন প্রতিশ্রুতি দেয়, ভঙ্গ করে। যখন তার কাছে আমানত রাখা হয়, সে খেয়ানত করে। –সহীহ বুখারী, হাদীস ৩৩; সহীহ মুসলিম, হাদীস ৫৯
ওয়াদা রক্ষা মানে কেবল দায়িত্ব পালন নয়, এটি যেমন পারস্পরিক আন্তরিকতা, বিশ্বাস ও গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধির উপায়, তেমনি ঈমানী জীবনের অনুশীলন ও মুত্তাকী হওয়ার উপকরণ।
আল্লাহ তাআলা বলেন–
بَلٰي مَنْ اَوْفٰي بِعَهْدِه وَاتَّقٰي فَاِنَّ اللهَ يُحِبُّ الْمُتَّقِيْنَ.
...(নিয়ম হল) যে কেউ নিজ অঙ্গীকার পূর্ণ করে ও (গুনাহ থেকে) বেঁচে থাকে, আল্লাহ এরূপ মুত্তাকী ও পরহেযগারদের ভালবাসেন। –সূরা আলে ইমরান (০৩) : ৭৬
শেষকথা, উক্ত আয়াতদুটি কেবল ধর্মীয় বিধিবিধান ও অনুশাসন নয়, বরং মানবিক মূল্যবোধ, সামাজিক ন্যায়বিচার, পারিবারিক বন্ধন ও আত্মিক উন্নতির এক পরিপূর্ণ ঘোষণাপত্র। বিজ্ঞ উলামায়ে কেরাম বলেন, মূলত একটি সুস্থ-সুশৃঙ্খল সমাজের জন্য যা প্রয়োজন, মৌলিক অনেক কিছুই উপরিউক্ত আয়াতদুটিতে বিদ্যমান।
আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে আমল করার তাওফীক দান করুন– আমীন।