একটি সুন্দর মৃত্যু
উম্মে উসাইদ
মৃত্যু একটি চিরসত্য। প্রতিটি মানুষের জীবনেই মৃত্যু আসবে। এটা থেকে কেউ পালাতে পারবে না। কিন্তু কার মৃত্যু কেমন হবে সেটাই হল সবচেয়ে বড় কথা। আল্লাহ তাআলা সবাইকে সবার আমল অনুযায়ী মৃত্যু দেবেন। যাকে আল্লাহ তাআলা সহজ মৃত্যু দান করবেন সে তো সবচেয়ে বড় সফলকাম।
আজ এখানে একটি সুন্দর মৃত্যুর কথা লিখব। সেই সুন্দর মৃত্যু কাছ থেকে দেখার সৌভাগ্য আমার হয়নি; কিন্তু খুব কাছের মানুষদের কাছ থেকে শুনেছি, যারা সেই মৃত্যু কাছ থেকে দেখেছেন। সেই সুন্দর মৃত্যুর পথযাত্রী ছিলেন আমার নানু শাশুড়ি। যিনি ছিলেন ড. আনোয়ারুল কারীম রাহ.-এর সম্মানিতা স্ত্রী এবং ইঞ্জিনিয়ার আব্দুল মুকীত রাহ.-এর সুযোগ্য কন্যা। ১৩ই এপ্রিল ২০২৫ ঈ. রাত দেড়টার দিকে তিনি আল্লাহর কাছে চলে যান। তাঁর মৃত্যু ছিল খুবই সুন্দর।
১২ই এপ্রিল রাত দশটায় তিনি আমার শ্বশুর-শাশুড়ির সাথে আমার বড় ননাসের বাসায় যান। অর্থাৎ তার বড় নাতনির বাসায় যান। সেই বাসা ছিল তাঁর খুব পছন্দের একটি জায়গা। সেখানে তিনি নিজে হেঁটে সিঁড়ি বেয়ে ওঠেন। যাওয়ার পর থেকেই তাঁর স্বাস্থ্য খুব খারাপ হয়ে গিয়েছিল। তিনি খুব অস্থির হচ্ছিলেন। বলছিলেন, খুব খারাপ লাগছে। পরে সবাই তাঁকে শোয়ার ব্যবস্থা করে দেন। কিন্তু শোয়ার পরও তিনি স্থির হতে পারছিলেন না। কিছুক্ষণ পরপর শোয়া থেকে উঠে যাচ্ছিলেন আর আমার শাশুড়িকে না দেখলে তাকে খুঁজছিলেন। তার জন্য অস্থির হচ্ছিলেন। আমার শাশুড়িও এসে এসে তাঁকে আরাম দিচ্ছিলেন। শুইয়ে দিচ্ছিলেন।
এমন করতে করতে একসময় তিনি যমযম পানি চান। অসুস্থ হলে সব সময়ই তিনি খুব গুরুত্বের সাথে যমযম পানি পান করতেন। সাধারণত ঔষধপত্র সেবন করতেন না। তাকে যমযম পানি পান করানো হল। তারপর তিনি শাশুড়িকে বুকে পিঠে যমযম পানি দিয়ে মালিশ করে দিতে বললেন। তিনি করে দিলেন। মালিশ করে দেওয়ার পর আমার শাশুড়িকে তিনি বললেন, আমার এখন ভালো লাগছে। তুমি যেতে পারো।
শাশুড়ি তাঁকে ডান কাতে শুইয়ে দিয়ে কোনো এক কাজে চলে গেলেন। অল্প কিছুক্ষণ পর আমার শাশুড়ি তাঁকে আবার দেখতে গেলেন। গিয়ে দেখেন নানু কেমন যেন হয়ে শুয়ে আছেন। পিছে পিছে আমার ছোট ননদও গেল। তারা কাছে গিয়ে নানুকে ধরলেন। ঠিকঠাক করে দিলেন; কিন্তু তার কোনো সাড়াশব্দ নেই। ভালোমতো দেখার পর তাদের বুঝতে বাকি রইল না– তিনি আর হায়াতে নেই; আল্লাহর কাছে চলে গেছেন।
এমন নীরবে নির্জনে কাউকে কষ্ট না দিয়ে তিনি তাঁর রবের কাছে চলে গেলেন। খবরটি শুনে আমি যেন বিশ্বাসই করতে পারছিলাম না। একজন সুস্থ মানুষ কীভাবে হঠাৎ করে চলে গেলেন! তাঁর চলে যাওয়ার কোনো আলামতও ছিল না। বিশ্বাস করতে খুবই কষ্ট হচ্ছিল। আসলে এটা তো তাঁর প্রতি আল্লাহ তাআলার কত বড় রহমত যে, কাউকে কোনো কষ্ট দেওয়া ছাড়া তাঁকে তিনি নিজের কাছে নিয়ে গেলেন। পুরোপুরি সুস্থ একজন মানুষ ছিলেন তিনি। নিজের কাজ নিজেই করতেন। মৃত্যুর কিছুক্ষণ আগেও তিনি একাই হাম্মামে গিয়েছিলেন এবং ওযু করে হাম্মাম থেকে বের হয়েছিলেন। মৃত্যুর আগ মুহূর্তেও তিনি নিজের জন্য কাউকে কষ্ট করতে দেননি। এমন একজন মানুষ ছিলেন তিনি। নিজের কোনো কাজের জন্য কাউকে বাধ্য করা তো দূরের কথা, বলতেনও না। যদি কেউ সামান্য কিছু করে দিত, খুশি হতেন! খুব খুশি হতেন। কতবার যে শুকরিয়া আদায় করতেন! সকালে ও বিকেলে তিনি রং চা খেতে পছন্দ করতেন। কাছে থাকলে তাঁকে অনেকবারই চা দেওয়ার সৌভাগ্য আমার হয়েছে। চা নিয়ে তাঁর কাছে যাওয়ার পর এত খুশি প্রকাশ করতেন, এতবার জাযাকিল্লাহ বলতেন যে, মনটা খুশিতে ভরে যেত এবং সব কষ্ট দূর হয়ে যেত। সেই স্মৃতিগুলো মনে পড়লে মনটা এখনো কেমন যেন করে, চোখ দুটো ভিজে আসে।
খুব বুযুর্গ একজন মানুষ ছিলেন তিনি। অনেক পরহেযগার ছিলেন। খাবার-দাবারে খুব ইহতিয়াত করতেন। কখনোই বাইরের কেনা খাবার খেতেন না। বাজারের জবাই করা মুরগির গোশত, গরুর গোশত খেতেন না। কুরবানীর গোশত খুব পছন্দ করতেন, আগ্রহ নিয়ে খেতেন। ঘরে জবাই হওয়া মুরগি খেতেন। এ ব্যাপারে কখনো আমি তাঁকে এর ব্যতিক্রম দেখিনি।
আমার মাঝে মাঝে খুব অবাক লাগত, একটা মানুষ কীভাবে এতটা পরহেয করতে পারেন। মাঝে মাঝে তাঁর সামনে আমাদের বাজারের কেনা কত মজার মজার জিনিস খাওয়া হত, বাজারের জবাই করা মুরগি, গরুর গোশত খাওয়া হত। অথচ তিনি কখনো মুখেও দিতেন না। সামান্য আগ্রহও প্রকাশ করতেন না। এমন একজন মানুষ ছিলেন তিনি। কতটা তাকওয়াবান ছিলেন!
সব সময় যিকির অবস্থায় থাকতেন তিনি। বিরামহীনভাবে যিকির করতেন। তাঁর পাশে থাকলে প্রতিটি মুহূর্তে এমনভাবে ‘সুবহানাল্লাহ, আলহামদু লিল্লাহ’ শোনা যেত, মনে হত তার প্রতিটি শ্বাস-প্রশ্বাসের সাথে যিকির বের হচ্ছে। আমার কাছে মনে হত, এটাই কি তাহলে সেই হাদীসের ব্যাখ্যা, যে হাদীসে আছে, জান্নাতীরা শ্বাস-প্রশ্বাসের মতো আল্লাহর যিকির করতে থাকবে! কখনো তাঁকে আমি যিকির ছাড়া দেখিনি!
অনেক রোযা রাখতেন তিনি। আইয়ামে বীযের রোযার খুব ইহতিমাম করতেন। প্রতি সোম, বৃহস্পতি এমনকি জুমাবারও রোযা রাখতেন। বাকি ফযীলতপূর্ণ যেসব রোযা আছে, সেগুলো তো রাখতেনই। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত রোযা ছিলেন তিনি। মৃত্যুর দিন আইয়ামের বীযের রোযা ছিলেন।
তিনি দান-খয়রাতও করতেন অনেক। নিজের জন্য কখনোই কিছু জমাতেন না। সব দুহাতে বিলিয়ে দিতেন। টাকাপয়সা, ঘরের আসবাবপত্র, এমনকি নিজের পরিধানের পোশাকও দিয়ে দিতেন। আমার দেখা মতে ২-৩ সেটের বেশি পোশাক কখনোই তাঁর ছিল না। যতক্ষণ পর্যন্ত কাপড় পুরোনো না হত নতুন কাপড় পরতেন না। নতুন কাপড় পেলে দান করে দিতেন।
গরিব, অসহায়, বিধবাদের খুব খোঁজখবর রাখতেন। শক্তি সক্ষমতা যখন ছিল, নিজেই খাবার-দাবার রান্না করে তাদের বাসায় হাজির হয়ে যেতেন। তাদের জন্য প্রায়ই কিছু না কিছু হাদিয়া পাঠাতেন।
উলামায়ে কেরাম, ইমাম-মুআযযিন এবং আসাতেযায়ে কেরামের খুব সম্মান করতেন। বছরে তাঁদের জন্য সামান্য কিছু হলেও হাদিয়া পাঠাতেন। তাঁদের বাসায় গিয়ে গিয়ে সাক্ষাৎ করতেন। খোঁজখবর নিতেন। এগুলো করতে পারাকে নিজের সৌভাগ্যের কারণ মনে করতেন।
নিজের আদর্শের ওপর অটল অবিচল এক অনন্য মানুষ ছিলেন তিনি। এমন খোদাভীরু বুযুর্গ একজন সৎ মানুষ ছিলেন তিনি। তাঁর মতো মানুষ খুব কমই দেখেছি আমি। তাঁর মৃত্যুর পর খালি মনে হয়, আমরা আমাদের মাঝ থেকে একজন বুযুর্গকে হারিয়ে ফেলেছি। যাঁকে আমরা পেয়েছিলাম কত সহজে! কোনো পরিশ্রম, কোনো কষ্ট ছাড়াই। তাঁর মতো একজন সৎ মানুষকে কত কাছে পেয়েছিলাম আমরা। অথচ তাঁর থেকে কিছুই নিতে পারলাম না! কত কিছু শেখার ছিল তাঁর কাছ থেকে। অথচ কিছুই শিখতে পারলাম না। তিনি তো চলে গেলেন তাঁর রবের কাছে। আশা করি, তিনি তাঁর রবের কাছে খুব শান্তিতেই আছেন।
মারকাযুদ দাওয়াহ আলইসলামিয়া ঢাকা’র প্রধান প্রাঙ্গণ হযরতপুর কেরানীগঞ্জে নিজ স্বামী ড. আনোয়ারুল কারীম রাহ.-এর কবরের নিকটেই তাঁর কবর হয়েছে।
আল্লাহ তাআলা তাঁর কবরকে নূর দ্বারা ভরে দেন, আমাদেরকে তাঁর যোগ্য উত্তরসূরি হওয়ার তাওফীক দেন এবং আখেরাতে আমাদের সবাইকে নাজাত দান করেন, জান্নাতুল ফিরদাউসে একসাথে রাখেন– আমীন।