নরেন্দ্র মোদির ইসলাম-বিদ্বেষ এবং আরবদের মোদি তোষণ
ভারতের মুসলমানদের আবারও ‘অনুপ্রবেশকারী’ বললেন ভারতের চরম হিন্দুত্ববাদী দল বিজেপির প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। সম্প্রতি একাধিক নির্বাচনী জনসভায় মোদি এ মন্তব্য করেন। ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস ও মুসলমানদের জড়িয়ে তিনি আরো বলেন, ‘ওরা (কংগ্রেস) আপনাদের সম্পদ নিয়ে অনুপ্রবেশকারীদের দিয়ে দেবে। যারা শুধু বেশি বেশি সন্তান জন্ম দেয়।’
মোদির মুসলিম-বিদ্বেষের ইতিহাস নতুন নয়। এই ভদ্রলোক গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালেই মুসলিম-বিদ্বেষ ও মুসলিম নির্যাতনের রেকর্ড করে এসেছেন। বহু মুসলিম ব্যবসায়ী ও রাজনীতিকসহ অসংখ্য মুসলমানকে হত্যা ও নির্যাতনের জন্য তিনি বিশেষ খেতাবেও ভূষিত হয়েছিলেন। এমনকি আমেরিকাসহ বিভিন্ন দেশের ভিসাও তার জন্য নিষিদ্ধ ছিল। সে ব্যক্তিই পরবর্তীতে হিন্দুত্ববাদের জিগির তুলে ভারতের কেন্দ্রীয় ক্ষমতার আসনে অধিষ্ঠিত হন। যদিও স্বাধীনতার পর থেকে ভারতে দীর্ঘ সময় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থাকা কংগ্রেসও মুসলমানদের সাথে খুব একটা ভালো ওফাদারি বা বিশ্বস্ততার আচরণ করেনি; তবুও বিজেপির এবং আরো নির্দিষ্ট করে বললে নরেন্দ্র মোদির আমলেই সবচেয়ে বেশি নিগৃহীত হচ্ছে ভারতের মুসলিম সমাজ।
ঠুনকো বিষয় নিয়েও নির্মমভাবে হত্যা করা হচ্ছে মুসলিমদের। দখল করা হচ্ছে ঐতিহ্যবাহী মসজিদগুলো। সেখানে বানানো হচ্ছে মন্দির। মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ রাজ্য কাশ্মিরে চলছে নির্যাতনের স্টিম রোলার। রাজ্যটির বিশেষ বিধানও বাতিল করে দেওয়া হয়েছে। ইসরাইলীদের ফিলিস্তিনে অবৈধ বসতি স্থাপনের মতো কাশ্মিরেও হিন্দুদেরকে নিয়ে আবাদ করানো হচ্ছে। যেন রাজ্যটি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠতার অবস্থান হারায়। ইসলামী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, মুসলিম রাজনীতিক, ব্যবসায়ী ও সমাজপতিদের কোণঠাসা করে রাখা হচ্ছে চরমভাবে।
নরেন্দ্র মোদি ও তাঁর দল বিজেপির মুসলিম-বিদ্বেষী এ অবস্থানের ব্যাপক প্রভাব পড়ছে প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোতেও। বিশেষত বাংলাদেশে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে একশ্রেণির হিন্দুদের দৌড়াত্ম বেড়েই চলেছে। অনেকেই মনে করেন, ফরিদপুর জেলার মধুখালী এলাকায় গত ১৮ এপ্রিল বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় একদল উগ্র হিন্দুর হাতে দুজন নিরীহ সহদর মুসলিম নির্মাণ শ্রমিকের হত্যা একই সূত্রে গাঁথা। না হয় প্রকাশ্যে একটি সংখ্যালঘু সম্প্রদায় কর্তৃক এভাবে মুসলিম তরুণকে মেরে ফেলা হয় কীভাবে? দেশ ও দেশের বাইরে থেকে যদি তারা উসকানি ও আশ্রয় না পায়, তাহলে কি এমন হত্যাকাণ্ড সম্ভব? এছাড়া বিগত প্রায় দেড় দশক থেকে দেশের ব্যাংক লুটপাট, সাধারণ জনগণের শত শত কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়া, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নিজ ছাত্রীদের ওপর নির্যাতন, সর্বোচ্চ আদালতে বসে দুর্নীতি (সুরেন্দ্র কুমার সিনহা, সাবেক প্রধান বিচারপতি) -সহ বুক ফুলিয়ে অসংখ্য অপকর্ম করে যাচ্ছে এ সম্প্রদায়ের কতিপয় লোকজন। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তারা থেকে যাচ্ছে ধরা-ছোঁয়ার বাইরে।
ফিরে আসি মোদির ভাষণ প্রসঙ্গে। ভারতের অনেক বিশ্লেষক বলছেন, নরেন্দ্র মোদি ভোটে হেরে যাওয়ার আতঙ্ক থেকেই নতুন করে এমন বিস্ফোরক মন্তব্য করেছেন। যদিও মোদি ও তাঁর দলের ইসলাম-বিদ্বেষ নতুন কিছু নয়। আসামে তাঁর দলের সরকার তো তিন কোটি মুসলমানকে বাংলাদেশ থেকে অনুপ্রবেশকারী বলে আদালতে মামলাই ঠুকে দিয়েছে! ২০১৮ সালের এক জনসভায় ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহও বলেছিলেন, ‘ভারতে অবৈধভাবে আসা বাংলাদেশীরা অনুপ্রবেশকারী। তারা আমাদের দেশকে উইপোকার মতো খেয়ে ফেলছে।’
বিশ্ব হিন্দু পরিষদের সভাপতি প্রবীণ তেগোরিয়ার দাবি, ‘ভারতে প্রায় তিন কোটি বাংলাদেশী অনুপ্রবেশকারী রয়েছে।’
লক্ষ করার বিষয় হচ্ছে, এসবের মাধ্যমে বাংলাদেশের বিষয়ে ভারতের দ্বিমুখী নীতি প্রতিফলিত হচ্ছে। একদিকে তারা ২০১৪ সাল থেকে বাংলাদেশের নির্বাচন ও সরকার গঠনে অনেকটা প্রকাশ্যেই হস্তক্ষেপ করে আসছে। এদেশের সরকারের কতিপয় মন্ত্রীও এ বিষয়ে বক্তব্য দিতে দ্বিধা করছেন না, সরকারও ভারত এবং ভারতের বর্তমান সরকারকে শ্রেষ্ঠ বন্ধু মনে করছে। দিয়ে যাচ্ছে অবারিত সুযোগ-সুবিধা। অথচ সে ভারত ও তার সরকারই কি না তার দেশের মুসলমানদের নির্যাতনের সকল দ্বার খুলে দিয়েছে। এমনকি তাদেরকে অনুপ্রবেশকারী বলে নিজ মাতৃভূমি থেকে বিতাড়নে তৎপর হয়ে উঠেছে। মোদি ও বিজেপির দাবি করা শুধু আসামের তিন কোটি লোককে যদি জোর করে তারা এদিকে ঠেলে দেয় তখন এদেশের সরকার কী বলবে- তা এখনো অবশ্য জানা যায়নি।
ভারতের ক্ষমতাসীন হিন্দুত্ববাদী দল বিজেপি ও প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির এধরনের মুসলিম-বিদ্বেষী তৎপরতার কোনো প্রভাব এদেশের সরকারে যেমন পড়েনি, তেমনি আরব মুসলিম দেশগুলোতেও পড়েনি; বরং উল্টো কতিপয় আরব রাষ্ট্র নরেন্দ্র মোদিকে তাদের দেশের ‘হিরো’ বানিয়ে বসে আছে। সে দেশগুলোর মধ্যে সংযুক্ত আরব আমিরাত সবার শীর্ষে রয়েছে। দেশটিতে বিগত কয়েক বছরে বহুবার সফর করেছেন নরেন্দ্র মোদি। ভাষণও দিয়েছেন প্রধান অতিথি হিসেবে। শুধু তা-ই নয়; বরং ইউএইর রাজধানী আবুধাবির সন্নিকটে মহাসড়কের পাশেই নির্মাণ করা হয়েছে বৃহত্তর হিন্দু মন্দির। সেটিরও উদ্বোধন করানো হয়েছে নরেন্দ্র মোদিকে দিয়ে। যে জাযিরাতুল আরব থেকে সর্ব প্রকারের মূর্তি ও পৌত্তলিকতাকে বিদায় দিয়েছিলেন নবীকূল সরদার হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তাঁর খলীফাগণ সে আরবরাই এখন তাদের দেশে পৌত্তলিকতাকে ফিরিয়ে আনছে। তাদের সরকারের এহেন কাণ্ডে কোনো বিকার নেই তাদের। তাদের বলেই বা কী লাভ?! আমরা এদেশের লোকেরা তো পৌত্তলিকতাকে নিজেদের সংস্কৃতিই বানিয়ে ফেলেছি।
যাহোক, মধ্যপ্রাচ্যের এ দেশটি ইসরাইলকে স্বীকৃতি দিয়ে প্রকাশ্যেই ইহুদীতোষণে নামার পর হিন্দু ও হিন্দুত্ববাদীদের আদর-যত্নেও অগ্রগামী ভূমিকা রাখছে। যেখানে তাদের চোখের সামনেই ভারতের মুসলমানেরা নিগৃহীত নীপিড়িত হচ্ছে, নির্যাতনের স্টিম রোলার চলছে তাদের ওপর; কিন্তু সেদিকে তাদের ভ্রুক্ষেপ নেই। তারা সেই নির্যাতনকারীদেরকে নিজ দেশে নিয়েই পদক দিচ্ছেন, সম্মানিত করছেন। বিশ্ব সমাজে মুসলমানদের বর্তমান অবস্থার জন্য দেশে দেশে মুসলিম ক্ষমতাসীনরাই যে প্রথমভাগে দায়ী- এর জন্য তো বেশি ব্যাখ্যা দেওয়ার প্রয়োজন নেই।
স্বাধীন ভারতের প্রথম শিক্ষামন্ত্রী ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম ব্যক্তিত্ব মাওলানা আবুল কালাম আযাদ একবার বলেছিলেন-
ہم کو ہمارے سوا کوئي زير نہيں کر سکتا
[আমাদের (মুসলমানদের)-কে আমরা ছাড়া কেউ ধ্বংস করতে পারবে না।]
আসলেই তো তাই, আমরা মুসলিমরা যেমন ইসলামের শিক্ষা ছেড়ে, তাহযীব-তামাদ্দুন ছেড়ে স্বাধীন জীবনযাপন করছি, তেমনি আমাদের শাসকরাও ইসলামের বিধানের ধার না ধরে সম্মান করছে বিজাতীয় বিধান, বন্ধু বানাচ্ছে ইসলাম ও মুসলমানদের চরম শত্রু কাফের, মুশরিক ও জালেমদের। তো আমাদের অধঃপতনের জন্য মোদি-নেতানিয়াহুদের দায়ী না করে নিজেদের দিকে বরং ফিরে দেখা উচিত।
যাইহোক, নরেন্দ্র মোদি ও তার দলের মুসলিম-বিদ্বেষ নতুন কিছু নয়। চরম নির্যাতন ও প্রতিকূলতার মধ্যেও ভারতের মুসলিম সমাজ সাহসিকতার সাথেই এগুলোর মোকাবেলা করে যাচ্ছেন। তারা সহজে ছেড়ে কথা বলবেন বলে মনে হয় না। সে কারণেই এত বছর দাপটের সাথে ক্ষমতায় থেকে মুসলমানদেরকে কোণঠাসা করার চেষ্টার পরেও সম্ভবত মোদির মুসলিমভীতি কমেনি। মুসলমানদের সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়া দেখে তাদের আতঙ্ক বরং আরো বাড়ছে।
দুজন ভারতীয় মুসলিমের সাথে বছরখানেক আগে দেখা হয়েছিল। তাঁদেরকে সে দেশে হিন্দু-মুসলিম জনসংখ্যা বৃদ্ধির অনুপাত জিজ্ঞেস করার পর হেসে দিয়েছিলেন। বললেন, ‘ওদের সন্তানদেরকে তো তারা নিজেরা খাওয়ায়। এজন্য তারা বেশি সন্তান জন্ম দিতে ভয় পায়। কিন্তু আমাদের সন্তানদেরকে তো আমরা খাওয়াই না, বরং আল্লাহ খাওয়ান। তাই আমাদের এ নিয়ে ভয় নেই।’
আমরা বাংলাদেশের ভীত মুসলিমরা নিজেদের চোখের সামনে সংখ্যালঘু কর্তৃক হত্যা, নির্যাতন, লুটতরাজ চোখ বুজে সয়ে গেলেও ভারতে কম ক্ষেত্রেই এমনটি ঘটে। সেখানে প্রতিবাদ-প্রতিরোধের চেষ্টা থাকে প্রায় অনেক ক্ষেত্রেই। তাই অনুপ্রবেশকারী বলে ভারতের কোটি কোটি মুসলমানকে দেশান্তরের মোদিয় স্বপ্ন অধরাই থেকে যাবে হয়তো। বছর দুয়েক আগে ইন্তেকাল হয়ে যাওয়া ভারতের জনপ্রিয় শক্তিমান কবি রাহাত ইন্দোরির কয়েকটি পঙ্ক্তি মনে পড়ে গেল-
اگر خلاف ہيں، ہونے دو، جان تھوڑي ہے
يہ سب دھواں ہے، کوئي آسمان تھوڑي ہے
তারা তোমার বিরোধী ও শত্রু হতে চাইলে হতে দাও, তাদের মাঝে প্রাণ আছে থোড়াই
এসবই ধোঁয়া, আসমান থোড়াই।
لگے گي آگ تو آئيں گے گھر کئي زد ميں
يہاں پہ صرف ہمارا مکان تھوڑي ہے
আগুন লাগলে অনেকের ঘরই পোড়াবে
এখানে কেবল আমার ঘর থোড়াই।
ميں جانتا ہوں کہ دشمن بھي کم نہيں ليکن
ہماري طرح ہتھيلي پہ جان تھوڑي ہے
আমি জানি দুশমনও দুর্বল নয়, কিন্তু
আমাদের মতো তাদের প্রাণ হাতের মাঝে আছে থোড়াই।
ہماري منہ سے جو نکلے وہي صداقت ہے
ہماري منہ ميں تمہاري زبان تھوڑي ہے
আমাদের মুখ থেকে যা নিঃসৃত হয় সেটিই চরম সত্য।
আমাদের মুখে তোমার মতো মিথ্যাবাদী জিহ্বা তো আর নেই।
جو آج صاحبِ مسند ہيں، کل نہيں ہوں گے
کرائے دار ہيں، ذاتي مکان تھوڑي ہے
আজ যে ক্ষমতার মসনদে আসীন, কাল সে থাকবে না;
ভাড়াটিয়া সে, নিজের বাড়ি থোড়াই।
سبھي کا خون ہے شامل يہاں کي مٹي ميں
کسي کے باپ کا ہندوستان تھوڑي ہے
এই মাটিতে সব ধর্ম-গোত্রের মানুষের রক্ত মিশে আছে
হিন্দুস্তান একা কারো বাবার থোড়াই!