জুমাদাল উলা ১৪২৮   ||   জুন ২০০৭

তুরস্ক : বেজে উঠল শেয়ানার পুরনো সুর

আপত্তির প্রথম সুরটা শুনলে মনে হতে পারে আপত্তি উত্থাপনকারীদের মনের ভেতরে হয়ত কোনো জটিলতা নেই। গণতন্ত্র, বাকস্বাধীনতা রক্ষা কিংবা ইসলামী দলের কাণ্ডারীদের প্রতি সাধারণ অনীহার কারণে অথবা বিষয় সম্পর্কে বাস্তব জ্ঞানের কমতি কিংবা বুঝের স্বল্পতার কারণেই এ আপত্তিটা তারা উত্থাপন করেছেন। কিন্তু ধীরে ধীরে তাদের আপত্তির অনমনীয়তা এবং যুক্তিতর্ক ও অবস্থানের ডবল স্ট্যান্ডার্ডের কারণে বোঝা যায় এ আপত্তি উত্থাপনকারীরা আসলে শেয়ানা কেউ অথবা শেয়ানাদেরই পোষ্য কেউ। পৃথিবীর কোনো দেশে ইসলামী শাসনব্যবস্থা  প্রতিষ্ঠা কিংবা ইসলামপন্থী কোনো ব্যক্তিকে রাষ্ট্রপ্রধান মনোনয়নের ক্ষেত্রে আপত্তির মাত্রা দেখে উপরের ধারণাটি গড়ে ওঠেছে। স¤প্রতি তুরস্কের সংসদের বেশির ভাগ সদস্য তাদের বর্তমান পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসলামপন্থী হিসেবে খ্যাত আব্দুল্লাহ গুলকে প্রেসিডেন্ট মনোনীত করলে এ রকম একটি ঘটনা ঘটেছে।

সেখানকার সেফুলারিজমপন্থী বিরোধী দল প্রথমে এ মনোনয়নের বিরোধিতা করে। প্রধানমন্ত্রী রেসেপ তায়েপ এরদোগানের সরকার একজন ইসলামপন্থীকে প্রেসিডেন্ট মনোনীত করে সেকুলারিজমের পরিবর্তে দেশটিতে ইসলামী শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য অনুকূল পরিবেশ  তৈরি করতে চান বলে বিরোধীরা আপত্তি জানান। দেশটির ধর্ম নিরপেক্ষতাবাদী ভাবমূর্তি এতে ভেঙ্গে পড়তে পারে বলে তারা আশঙ্কা করেন। বিরোধীদলের আপত্তির পর একই সুর আরো কঠোর ভাষায় ব্যক্ত করে সে দেশের সেনাবাহিনী। রাজনৈতিকভাবে জন সমর্থন নিয়ে ক্ষমতায় বসা একটি দল নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে একজন প্রেসিডেন্ট মনোনয়ন এবং একটি আদর্শ গ্রহণের পথে অগ্রসর হলে সেখানে গণতান্ত্রিক একটি রাষ্ট্রের সেনাবাহিনীর কোনো ভূমিকা থাকার কথা ছিল না। সেনাবাহিনীর এধরনের ভূমিকাকে  পশ্চিমা মোড়ল দেশগুলোর সরকার ও মিডিয়াগুলো অত্যন্ত বিরক্তির চোখে দেখার রেওয়াজ গড়ে তুললেও তুরস্কের বেলায় এর উল্টো চিত্র দেখা যাচ্ছে। তুর্কির সেনাবাহিনী ১৯৬০ থেকে এ পর্যন্ত চারটি সরকারকে অপসারণ করেছে। ১৯৯৭ সালে সাম্প্রতিকালে প্রথম প্রকাশ্য ঘোষণাদানকারী সেখানকার ইসলামপন্থী প্রধানমন্ত্রীকে অপসারণ করে ইসলামী শাসনের পরিবর্তে সেদেশে সেক্যুলারিজম রক্ষার দায়িত্ব যেন তারা নিয়েই রেখেছে। সেক্যুলারিষ্ট বিরোধী দল ও সেনাবাহিনীর ভূমিকাকে ফোকাস করে তাই তাদের প্রতি সহানুভূতি ও সমর্থন ছড়িয়ে দিচ্ছে পশ্চিমারা। এ ঘটনার সবচেয়ে মারাত্মক দিকটি হল, ৫৫০ টি সংসদীয় আসনের ৩৫০ জনেরও অধিক সদস্য যাকে প্রেসিডেন্ট পদে মনোনয়ন দিয়েছেন, বিরোধী দল ও সেনাবাহিনীর বিরোধিতার কারণে তুরস্কের আদালতও সংসদের সেই রায়কে বাতিল ঘোষণা করে দিয়েছে। আদালতের এই রায় নিয়ে নতুন রাজনৈতিক সংকটের জন্ম হয়েছে তুরস্কে। ১৬ মে সেখানকার আগের প্রেসিডেন্টের মেয়াদ শেষ  হয়ে যাওয়ায় সংসদের মাধ্যমে নতুন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন হওয়ার কথা। কিন্তু মে মাসের প্রথম দিন থেকেই সংকট ঘনীভূত হওয়ায় বর্তমান প্রধানমন্ত্রী এরদোগান আগাম নতুন জাতীয় নির্বাচনের ঘোষণা দিয়ে দিতে পারেন বলে পর্যবেক্ষকরা মত প্রকাশ করছেন।

এলেখা তৈরির সময় পরিস্থিতির পরবর্তী পর্যায়গুলো সামনে আসেনি। এশিয়া ইউরোপের সংযোগভূমি তুরস্ক থেকে গত শতাব্দীর শুরুর দিকে পশ্চিমাদের সহায়তায় ইসলামী খেলাফতের বিবর্ণ হয়ে যাওয়া শেষ আলোকশিখাটি জোর করে নিভিয়ে দেওয়া হয়েছিল। পশ্চিমা আশির্বাদ ও আদর্শ নিয়ে ক্ষমতায় বসেছিল আতাতুর্ক খ্যাত বিতর্কিত কামাল। এরপর থেকেই ৯৯% সুন্নী মুসলিমের দেশটির শাসনকেন্দ্রে ইসলাম যেন উঁকি দেওয়ারও সুযোগ না পায়-পশ্চিমা দেশ ও মিডিয়ার তীক্ষ্ণ নজর সেদিকে নিবদ্ধ আছে। বর্তমান পটভূমির পেছনেও সেই তীক্ষ্ণ  নজরের ভূমিকা দৃশ্যমান হয়ে উঠেছে। পশ্চিমের দেশগুলো দেশে দেশে রাজনীতিতে সামরিক বাহিনীর আগ্রহী নজর সম্পর্কে ক্ষুব্ধ মন্তব্য ও ব্যবস্থা গ্রহণের কথা যখন বলে তখন তারা গণতন্ত্র চর্চার মাহাত্মের কথাই তুলে ধরে। কিন্তু ইসলামকে ঠেকানোর জন্য তাদের কাছে গণতন্ত্রের নামে লাঠিয়ালবাজি জায়েজ। আজ যদি তুরস্কের সেনাবাহিনীর ভূমিকা  প্রকাশ্যে ইসলামী শাসনের পক্ষে ব্যক্ত  তো তাহলে দেখা যেত গণতন্ত্রের প্রতি মোড়ল পশ্চিমাদের কত দরদ! পৃথিবীর আরো আরো দেশে ইসলামী সরকার, ইসলামী আইন কিংবা ইসলামপন্থী মানুষের সরকার গঠন ঠেকাতে সামরিক শক্তিকে এভাবেই তারা বাহবা দিয়ে যাচ্ছে। আলজিরিয়ার নির্বাচিত ইসলামী দলটিকে ক্ষমতা না  দিয়ে সে দেশের সামরিক বাহিনী ক্ষমতা কেড়ে নিয়েছে প্রায় দেড় যুগ আগে। চলছে সেভাবেই।   জনগনের ভেতরের ক্ষোভ ও ফোঁসফোঁসানি সেখানেও টের পাওয়া যাচ্ছে। কিন্তু নিবার্চন দিয়ে গণরায় নিলে পরিস্থিতি আবারো বদলে যেতে পারে। অতএব গণতন্ত্র সেখানে ঔষধ হিসেবে ফিট মনে করেন না পশ্চিমা মোড়লরা।

মে মাসের মধ্যে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন নিয়ে কৃত্রিম সাংবিধানিক জটিলতা, সামনে সাধারণ নির্বাচনের সম্ভাবনা, ক্ষমতায় সেনাবাহিনীর চলে আসার সুযোগ-এ রকম পরিস্থিতির মধ্যে তুরস্কে যে গভীর সংকট ও শংকার জন্ম হয়েছে, তা দেখে ইসলাম সম্পর্কে পশ্চিমাদের শেয়ানা সুলভ ভূমিকা সম্পর্কে মুসলিম দেশগুলোর সরকার ও নাগরিকরা নতুন সতর্ক উপলব্ধিই হয়তো গ্রহণ করবেন। প্রথমে গণতন্ত্র, বাকস্বাধীনতা, প্রগতির জন্য মায়া কান্নার সুর, পরবতীর্তে ধূর্ত শেয়ালের মতো যেকোনো মূল্যে ইসলামঠেকাও পলিসি গ্রহণ মুসলিম দেশগুলোতে পশ্চিমা সরকার ও মিডিয়াকে দিন দিন আরো কতোটা আস্থাহীন করে তুলতে পারে- ভবিষ্যতই তা বলে দেবে। 

গ্রন্থনা : ওয়ারিস রব্বানী   

 

 

advertisement