মুহাররম ১৪৩৯   ||   অক্টোবর ২০১৭

রক্ত ঝরছে, আগুন জ্বলছে আরাকানের মুসলিম জনপদে

মাওলানা আবু তাহের মেসবাহ

অনেক দিন থেকেই ওখানেঝরছিলো ফোঁটা ফোঁটা রক্ত, একটু একটু করে জ্বলছিলো আগুন! তাতে এখানেআমাদের অভ্যস্ত জীবনে তেমন কোন ছেদ পড়েনি। একটু হয়ত হা-হুতাশ, তারপর সবকিছু আবার শান্ত স্বাভাবিক। হয়ত ভেবেছি, সাময়িক দুর্যোগ, সময়ের প্রলেপেই উপশম হয়ে যাবে। তাছাড়া বিপদ বলি, দুর্যোগ বলি, তা আমাদের নয়, প্রতিবেশীর।  তার উপর মাঝখানে রয়েছে নদী! আমাদের আর চিন্তা কী!! যাদের মাথা তাদেরই না ব্যথা, আধুনিক কূটনীতির ভাষায় যার নাম অভ্যন্তরীণ সমস্যা’!!

এই ছিলো এত দিন আরাকানের মোটামুটি পরিস্থিতি এবং এমনই একটা গাছাড়া অবস্থা ছিলো আমাদের!!

***

তারপর হঠাৎ করেই যেনএলো ২৫শে আগস্টের ভয়াল রাত।  যা ঘটার ঘটতে শুরু করলো  সেই ভয়াল রাতের আঁধারে, লোকচক্ষুর আড়ালে! শাব্দিক অর্থেই যেন শুরু হয়ে গেলো রোয কেয়ামত! মৃত্যুর দানব তার ভয়াল থাবা ও লেলিহান জিহ্বা বিস্তার করে ধেয়ে এলো গোটা আরাকান উপত্যকার দিকে!!

তারপর চারদিকে শুধু মৃত্যু আর মৃত্যু! ডানে বাঁয়ে, সামনে পিছনে শুধু লাশ আর লাশ!! ক্ষতবিক্ষত, ছিন্নভিন্ন এবং অগ্নিদগ্ধ লাশ!! একসময় দেখা গেলো, স্থলভূমি উপচে নদীতেও ভেসে চলেছে অসংখ্য লাশ।

তখনো গোটা বিশ্ব ঘুমে বেঘোর!! তখনো শোনা যায় নিদ্রাকাতরজাতিসঙ্ঘের নাসিকাধ্বনি!! আমেরিকা অবশ্য জেগে আছে।  আমেরিকা জেগে থাকে; বিশ্বের একমাত্র মোড়লকে জেগে থাকতে হয়। তবে আমেরিকা তখন ব্যস্ত মধ্যপ্রাচ্যে দাবার ছক নিয়েএবং আফগানিস্তানে শতরঞ্জের নতুন চাল নিয়ে!

আর বিশ্বের নামী দামী মানবাধিকার সংস্থাগুলো, তাদের তো রয়েছে আরো কত শত চিন্তা ও ব্যস্ততা!! পৃথিবীর পরিবেশ ও জলবায়ু নিয়েও তো ভাবতে হয়! সাগরের উচ্চতা বেড়ে যাচ্ছে, যা মানবজাতির জন্য মস্ত বড় সমস্যা। ছোট্ট একটা নদীর পানি লাল হওয়া সে তুলনায় তো কোন সমস্যাই না। তাও মুসলিম রক্ত! পানির চেয়ে সস্তা, তেলের চেয়ে কমদামী!!

তাছাড়া আমরাও তো আড়মোড়া ভেঙ্গে বলতে শুরু করেছি, এটা মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ সমস্যা, আমাদের তাতে কিছু করার নেই। এমনিতেই কয়েক লাখ রিফিউজিনিয়ে আমরা বিপদে আছি। নতুন করে একজন রোহিঙ্গাকেও আর নদী পার হতে দেবো না। দেবো না তো দেবোই না।

ওপারে গুলিখাওয়া লোকগুলো প্রাণভয়ে নৌকা-বোঝাই হয়ে এপারে আসে, আমরা বন্দুক উঁচিয়ে ধরি। বোঝাই নৌকা ফেরত পাঠাই। অসহায় চোখগুলো ঘোলা দৃষ্টিতে তাকায়, একবার এদিকে, একবার ওদিকে। হয়ত বোঝার ব্যর্থ চেষ্টা করে নাফনদীর দুই তীরের পার্থক্য! ওরা বলে, বাঙ্গালী, তাড়াও, আমরা বলি, অনুপ্রবেশকারী, ঠেকাও। নাফনদীর লাল পানি অবশ্য কিছু বলে না। নৌকাডুবি হলে শুধু লাশগুলো গ্রহণকরে। একটা নদী এর চেয়ে বেশী আর কী করতে পারে!! ১

***

২৫শে আগস্টের সেই ভয়াল রাতের পর আরো বহু রাত এলো এবং পার হলো। প্রতিটি রাতের অন্ধকার যেন নতুন নতুন বিভীষিকা ও বীভৎসতা নিয়ে হাজির হয়। আরো খুন ঝরে, আরো আগুন জ্বলে, আরো কিছু অসহায় মা-বোনের ... নাহ্, আর পারি না। ভয় হয়, কাটা ঘায়ে নুনের ছিটা না হয়!!

এই রোয কেয়ামত যাদের উপর দিয়ে বয়ে গেছে তারাই শুধু বুঝতে পারে এর ভয়াবহতা ও বিভীষিকা, কিন্তু আমাদের বলে বোঝাতে পারবে না। এটা বোঝানোর জন্য মানুষের ভাষায় আসলে উপযুক্ত কোন শব্দ নেই।

যা বলা যায় তা শুধু এই যে, আরাকানের বিপর্যস্ত জনপদে রক্তের স্রোত সেই যে শুরু হয়েছে, আর থামেনি; বরং প্রবল থেকে প্রবল হয়েছে। দাউ দাউ আগুন সেই যে জ্বলে উঠেছে, আর নেভেনি, বরং নতুন নতুন জনপদে বিস্তার লাভ করেছে। জ্বলে পুড়ে সবকিছু ছারখার হয়ে গেছে।

নাফনদীর এপারে দাঁড়ালেই দেখা যায়, ওপারে দাউ দাউ আগুনের লেলিহান শিখা!! আর নদীর পানিতে ভেসে যাওয়া অসংখ্য লাশ, নারী-পুরুষ ও শিশু-বৃদ্ধের। আশ্চর্য, এত কিছু দেখার পরো আমাদের দিলে দয়া হলো না! আশ্রয়প্রার্থী অসহায় মানুষগুলোর দিকে তাক করা বন্দুকের নল নামলো না!!২

***

নাফনদীর পানি লাল হয়ে অনেক দূর গড়ানোর পর এবং বহু নারী-পুরুষ ও শিশু-বৃদ্ধের লাশ ভেসে যাওয়ার পর এখন অবশ্য অবস্থার কিছুটা পরিবর্তন হয়েছে। সরকারের নীতি, বক্তব্য ও আচরণ যথেষ্ট নমনীয় হয়েছে। অবশ্য জানহাতে পালিয়ে আসা বিপন্ন ও বিপর্যস্ত মুহাজিরীনের সর্বপ্লাবী ঢল নদী উপচে এমনভাবে ধেয়ে এসেছে যে বাধা দেয়ার কোন উপায়ও ছিলো না। তাছাড়া জাতীয় পত্রপত্রিকার মতে শুরুতে না বুঝলেও সরকার এখন বুঝতে পেরেছে, রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেয়া রাজনীতি এবং আগামী নির্বাচনের জন্য কতটা লাভজনক।

কারণ যাই হোক, সরকারের নমনীয় সিদ্ধান্তের কারণে বিপন্ন উদভ্রান্ত লাখ লাখ বনী আদমের তাতে একটু যেন দম ফেলার সুযোগ হলো। মাথা গোঁজার ঠাঁই না হলেও দাঁড়াবার জায়গা অন্তত হলো।

সরকারী দল এবং সরকারেরবিরোধীদল জনতার বিরোধীদলের যাবতীয় ত্রাণ তৎপরতা স্টপকরে দিলেও নিজেরা যথেষ্ট ত্রাণ বিতরণ করছেন। সবকিছু নিয়ন্ত্রণের জন্য শেষ পর্যন্ত সেনাবাহিনীকে মাঠে নামানো হয়েছে। এখন আশা করা যায়, আশ্রয়শিবিরগুলোতে - মানবেতর পরিবেশ বিরাজ করলেও - বড় কোন দুর্যোগ বা বিপর্যয় নেমে আসবে না। বাকি আল্লাহর ইচ্ছা।

***

আশ্রয়গ্রহণকারী মুহাজিরীনের মধ্যে নারী, বৃদ্ধ ও শিশুরাই সংখ্যায় বেশী। কারণ অধিকাংশ যুবকই হয়েছে নিষ্ঠুর হত্যার শিকার। কাউকে গুলি করে, কাউকে গলা কেটে, আর কাউকে বা যিন্দা আগুনে জ্বালিয়ে মারা হয়েছে।

এমন বিশাল জনপদে এমন ব্যাপক পর্যায়ে এমন নৃশংস ও পৈশাচিক কায়দার হত্যাকাণ্ডের নযির হয়ত কমই পাওয়া যাবে, পৃথিবীর দূরের ও নিকটের ইতিহাসে।

এ যেন প্রাচীন রোমের নর ও পশুর নিষ্ঠুর হত্যাক্রীড়ারই আধুনিক সংস্করণ, স্টেডিয়াম- ভর্তি মানুষ পাশবিক উল্লাসে যা উপভোগ করতো। আজকের আরাকান যেন একদল নিরস্ত্র মানুষের উপর একদল সশস্ত্র পশুর সেই হত্যাক্রীড়ারই রক্তলাল ভূমি! আর স্যাটেলাইট যুগের সভ্য মানুষ যেন তা উপভোগ করছে দূর থেকে নীরব ও নিঃশব্দ উল্লাসে। আর যাই হোক সভ্যতার আবরণটা তো রক্ষা করতেই হয়!

নরপশুদের শিকারী দৃষ্টি এড়িয়ে বনে জঙ্গলে লুকিয়ে থেকে দিনের পর দিন পায়ে হেঁটে ভুখা নাঙ্গা এই আদমের বাচ্চাগুলো কীভাবে বাংলাদেশে পৌঁচেছে, তার বিবরণ পত্রপত্রিকায় নিয়মিত আসছে। এককথায় অবিশ্বাস্য ও হৃদয়বিদারক। পথেই কাদামাটির মধ্যে জন্মগ্রহণ করেছে বহু শিশু। পথেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছে বহু মানুষ, একটুকরো কাফন, একমুঠ মাটিও জুটেনি তাদের ভাগ্যে। তবু তারা ভাগ্যবান, মৃত্যুর আগে নরকভূমিথেকে  বের হতে তো পেরেছিলো!

আর ছিন্নভিন্ন আবরুর মা-বোনদের মর্মন্তুদ বিবরণ যত কম দেয়া যায় ততই ভালো। বরং এগুলো যদি খবরনা হতো অনেক ভালো হতো। উপশমের মলম যখন আমাদের হাতে নেই তখন কী দরকার কাঁচা যখমে ...!

***

একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়; আমাদের হয়ত অনেকের জানা নেই, আরাকান হচ্ছে হাজার বছরের সমৃদ্ধ ইতিহাসের অধিকারী একটি মুসলিম জনপদ এবং আরাকানে যারা বাস করে তারা আমাদেরই মত একটি মুসলিম জনগোষ্ঠী, যারা আজ ব্যাপক গণহত্যা ও জাতিগত নিধনের শিকার। এই অজ্ঞতার কারণে আরাকান সমস্যার সঠিক গতিপ্রকৃতি সম্ভবত আমরা অনুধাবন করতে পারি না। তাই  ব্যর্থ হই সমস্যাটির গভীরে প্রবেশ করতে এবং ব্যর্থ হই আমাদের কাছে পালিয়ে আসাসন্ত্রস্ত ও বিপর্যস্ত মুসলিম ভাইদের যথাযোগ্য মর্যাদায় বরণ করতে, আল্লাহ্ ও তাঁর নবী যাকে বলেছেন ঈমানী বন্ধন এবং ইসলামী ভ্রাতৃত্বের মর্যাদা, যার শুভ্র সুন্দর প্রকাশ শুরু হয়েছে মদীনায় আনছার-মুহাজিরদের জীবন থেকে, যা এখনো অব্যাহত আছে মুসলিম উম্মাহর মধ্যে, খুব ক্ষীণ ধারায় হলেও।

আমরা অনেকে এটাকে মানবিক দিক থেকে বিবেচনা করার কথা বলি এবং তাতেই যেন বিবেকের কাছে দায়মুক্ত হয়ে যেতে চাই। আসলে তো তা নয়। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের জন্য এটা ঠিক আছে। যদি লাঞ্ছিত মানবতার ডাকে সঠিক অর্থেই তারা সাড়া দেয় এবং এগিয়ে আসে তাহলে অবশ্যই তা প্রশংসার দাবিদার। কিন্তু মুসলিম উম্মাহর জন্য তো এটা ঈমানের দাবী এবং ইসলামী ভ্রাতৃত্বের আকুতি। আমাদের তো এখন আরাম-ঘুম হারাম হওয়ার সময়! আমাদের তো এখন অস্থির, বে-কারার হওয়ার সময়! আমাদের তো এখন দেয়ালে পিঠঠেকা মানুষের মত রুখে দাঁড়ানোর সময়!

আমাদের তো আজ বুকে ধারণ করতে হবে আলকোরআনের সেই আসমানি ওয়াহি-

إِنَّمَا الْمُؤْمِنُوْنَ إخْوَةٌ

মুমিনগণ হলো পরস্পর ভাই।

আমাদের তো আজ হতে হবে আল্লাহ্র পেয়ারা নবীর সেই চিরন্তন বার্তার ধারক ও বাহক,

المسلمون كجسد واحد ...

 ‘মুসলিমগণ একদেহের মত। দেহের কোন অঙ্গ যখন পীড়িত হয়, অন্যান্য অঙ্গ সে পীড়া একই রকম অনুভব করে।

তাছাড়া আমাদের আজ এটা বুঝতে হবে যে, আরাকানের মুসলিম জনগোষ্ঠী অত্যন্ত ভয়াবহ এক আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের শিকার, যা একবার যদি বাস্তবায়িত হয়ে যায় তাহলে জাতি হিসাবে আমরা যারা বাংলাদেশে বাস করছি, আমাদেরও সামনে রয়েছে বড় কোন বিপদ, ভয়ঙ্কর কোন দুর্যোগ। তখন আল্লাহ না করুন, আমাদের অবস্থাও হয়ত ...!! নাহ, মুখে উচ্চারণ করতেও ভয়ে বুকটা কেঁপে উঠে। শুধু বলি, আল্লাহ পানাহ!!

***

আরাকান! দুর্ভাগা আরাকানের কথা যত বলি তত যেন কথা থেকে যায়!! মুসলিমবিশ্বের সাম্প্রতিক ইতিহাসে রক্তে ভেজা এবং আগুনে পোড়া শব্দ আছে অনেক। আছে ফিলিস্তীন ও কাশ্মীর, আছে চেচেনিয়া ও বসনিয়া। এমনকি আছে কাশগর ও দাগিস্তান। ঐসকল ভূখণ্ডেও রক্ত ঝরছে, আগুন জ্বলছে, ঐসব জনপদেও উড়না-দোপাট্টা ছিন্নভিন্ন হচ্ছে মানুষরূপী হয়েনাদের হাতে, কিন্তু মর্মন্তুদ সত্য এই যে, আমাদের ঘরলাগোয়াআরাকানের মুসলিম ভূখণ্ডে যা ঘটছে তা একেবারে নযিরবিহীন। অনেক রক্ত ঝরার পরো ফিলিস্তীনের ভূখণ্ড তার পরিচয়সত্তা হারায়নি। এখনো পৃথিবীর মানচিত্রে জ্বলজ্বল করছে, রক্তলাল ফিলিস্তীনের নাম। তদ্রূপ আগুনে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছারখার করেও মানচিত্র থেকে মুছে ফেলা সম্ভব হয়নি কাশ্মীরের নাম। কিন্তু হাজার বছরের ঐতিহ্য বহনকারী এ বিরাট ভূখণ্ডের পরিচয়সত্তাই আজ মানচিত্রের পাতা থেকে মুছে ফেলা হচ্ছে, বরং মুছেই ফেলেছে মিয়ানমারের শাসকচক্র। মানচিত্রে নতুন নাম হলো রাখাইন। পুরো বিশ্ব এখন রাখাইন নামটার সঙ্গে পরিচিত হয়ে গেছে। আমরাও যেন ভুলতে বসেছি মুসলিম পরিচয়সত্তা বহনকারী আরাকান শব্দটি; যদিও আমরা বিশ্বাস করি-

এত সহজ নয় নামনিশান মুছে ফেলা আমাদের!

হাঁ, আমরা বিশ্বাস করি, খুনের দরিয়া এবং আগুনের তুফান পার হয়ে আরাকানইনশাআল্লাহ আবার ফিরে আসবে মানচিত্রের বুকে সবুজ বর্ণ ধারণ করে আপন মহিমায় ভাস্বর হয়ে।

আমরা বিশ্বাস করি, ঈমানকে ভিত্তি করে কাবাকেন্দ্রিক যাদের চিন্তাচেতনা ও জীবনপরিক্রমা, আরাকান-জনপদের আগুন শুধু ওখানেই জ্বলছে না, জ্বলছে তাদেরও  বুকে এবং জ্বলতেই থাকবে দাউ দাউ করে যতদিন না আবার ধ্বনিত হয় আরাকানের প্রতিটি মসজিদের মিনার থেকে আযানের ধ্বনি!! আবরুলুণ্ঠিতা মা-বোনের এই যে জিগরফাটা আর্তনাদ এত সহজে ভুলবো না আমরা। আমাদের কানে তা প্রতিধ্বনিত হতে থাকবে, হতেই থাকবে ওয়া মুতাছামাহরূপে যতদিন না ...!!

হয়ত আমাদের প্রতীক্ষার দৈর্ঘ্য শতাব্দী অতিক্রম করবে, কিন্তু বিশ্বাস করি, সেদিনটি অবশ্যই আসবে ইনশাআল্লাহ।

***

সভ্য পৃথিবী অনেক পাশবিকতা ও হিংস্রতা দেখেছে, কিন্তু এমন আর দেখেনি। আধুনিক বিশ্ব অনেক গণহত্যা ও জাতিনিধন-যজ্ঞ প্রত্যক্ষ করেছে, কিন্তু এমন আর কখনো প্রত্যক্ষ করেনি।

এত খুন, এত আগুন, এত অশ্রু, এত আর্তনাদ!! বিশ্বাসই হতে চায় না, আমরা সভ্য পৃথিবীতে বাস করি, যেখানে আছে জাতিসঙ্ঘ নামের কোন বিশ্বসংস্থা! আছে মানবাধিকার রক্ষার বড় বড় প্রতিষ্ঠান!!

আসলে সবই আছে, তবে তা পূর্বতিমূরের জন্য, কিংবা দক্ষিণ- সুদানের জন্য! কোন মুসলিম জনপদের জন্য কেউ নেই এবং কিছুই নেই!! তাই আমাদের প্রধানমন্ত্রীকে আজ হতাশ কণ্ঠে বলতে হচ্ছে যে, হাঁটার পথে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে তিনি একমিনিটের জন্য থামাতে পেরেছিলেন এবং রোহিঙ্গা ইস্যুটি তার সামনে উত্থাপন করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু ট্রাম্প কানেই তুলেননি তার কথা। ট্রাম্প নাকি (সম্ভবত কৌতুকের সুরে) জানতে চেয়েছেন, ‘কেমন আছে ব্যাংলাদেশ’!

তারপরো যদি আমাদের শিক্ষা হয়! তারপরো যদি আমরা বুঝতে পারি, আমাদের সমস্যা আমাদেরই সমাধান করতে হবে। যা কিছু হোক, যা কিছু ঘটুক, তারপরো মুসলিম বিশ্বই আমাদের আপন, মুসলিম উম্মাহরই আমরা একটি অঙ্গ!! ট্রাম্প, মোদি কেউ আমাদের আপন নয়। বড় জোর কয়েক টন ত্রাণছুঁড়ে ফেলবে আমাদের মুখের উপর; ‘সহানুভূতিজানাবে, শুকনো কিছু শব্দ খরচ করে, আর পাশে থাকার আশ্বাসবাণীশোনাবে; এর বেশী কিছু নয়। চলার পথে একটু থামিয়ে কথা বলতে চাইবো, কিন্তু পাবো না একঘটি জলও। আত্মসান্ত্বনা লাভের জন্য শুধু বলতে পারবো কুছ তো মিলা’!৩ 

***

আরাকানে যা ঘটে চলেছে তাকে বলা হচ্ছে নীরব গণহত্যা এবং সবার অগোচরে ঘটে যাওয়া জাতিগত উচ্ছেদ ও নিধন। ভেবে পাই না, গণহত্যা নীরবে হয় কীভাবে! জাতিগতনিধন সবার অগোচরে আবার ঘটে কীভাবে!!

যে জনপদ গণহত্যার শিকার হয় তারা কি আর্তনাদ করে না! যে জনগোষ্ঠীকে এমন নির্মমভাবে উচ্ছেদ করা হয় তারা কি আসমান ফাটিয়ে চিৎকার করে না!!

করে, তবে নির্মম সত্য এই যে, আধুনিক বিশ্বের যারা মোড়ল তারা মজলুমানের আর্তনাদ বড় একটা শুনতে পায় না, তারা শুনতে পায় - এবং সম্ভবত শুনে আনন্দ পায় - নরপশুদের হিংস্র উল্লাস।

ফিলিস্তীনে ইহুদীরা হত্যাযজ্ঞ চালায় এবং হিংস্র উল্লাসে মত্ত হয়। কাশ্মীরের জনপদেও হিন্দু হায়েনারা ঝাঁকে ঝাঁকে গুলি চালায় এবং অট্ট হাসিতে ফেটে পড়ে। তাই সভ্য পৃথিবী সামান্য হলেও বুঝতে পারে, হয়ত ওখানে কিছু একটা  প্রবলেমচলছে।

কিন্তু আরাকানের জনপদে ঘটছে অন্যকিছু। ওখানে মজলুমানের আর্তনাদ আছে, আগুনের লেলিহান শিখা আছে এবং আছে আবরুহারা মা-বোনের জিগরফাটা চিৎকার, কিন্তু নেই হিংস্র নরপশুদের নারকীয় উল্লাস।

হ্যাঁ, আরাকানের প্রতিটি জনপদে অসহায় মুসলিম জনগোষ্ঠীর উপর মানবতার কলঙ্ক মগদস্যুরা এমনই নৃশংসভাবে ঝাঁপিয়ে পড়েছে, যেন উল্লাস করারও ফুরসত নেই! খুব ঠাণ্ডা মাথায় সমগ্র মুসলিম জনগোষ্ঠীকে শাব্দিক অর্থেই নির্মূল করার কাজটা তারা চালিয়ে যাচ্ছে কোনরকম উল্লাস-শোরগোল না করে। তাই এত বড় একটা গণহত্যার খবর বিশ্বমিডিয়া যেন জানতেই পারছে না, বৃহৎ শক্তিগুলো যেন কিছুই শুনতে পাচ্ছে না। এজন্যই হয়ত বলা হচ্ছে, নীরব গণহত্যা এবং অগোচর জাতিগত নিধন।৪ 

এমনই তো মনে হয়। নইলে আমি তো বুঝতে পারি না, আর কী ব্যাখ্যা হতে পারে সারা বিশ্বের এমন অদ্ভুত নির্লিপ্ততার!

জনপদের পর জনপদ জ্বলছে, চোখের সামনে দেখা যায়! ভয়ার্ত মানুষগুলো কলজে ফাটিয়ে চিৎকার করছে পরিষ্কার শোনা যায়, অথচ গণতন্ত্রের নেত্রীঅং সান সু চি বলছেন, ‘রাখাইনে তেমন কিছুই ঘটছে না! সেনা-বাহিনী পূর্ণ সংযমের সঙ্গে শুধু নিরাপত্তা অভিযান পরিচালনা করছে এবং ইসলামী টেররিজমের মোকাবেলা করছে। রোহিঙ্গারা কেন পালিয়ে বেড়াচ্ছে তা নাকি তার বোধগম্যই হচ্ছে না! নির্লজ্জ তামাশা আর কাকে বলে!! হয়ত শান্তির নোবেল পাওয়া নেত্রীর বোধগম্য ভাষা এখনো আমরা ব্যবহার করতে পারিনি। হয়ত ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা ঠিকই বলেছেন। মানবাধিকারের স্বঘোষিত মোড়লদের অমার্জনীয় নীরবতার তীব্র নিন্দা করে মুসলিমবিশ্বের নেতৃবৃন্দকে লক্ষ্য করে তিনি বলেছেন, ‘আমাদের আশু কর্তব্য হচ্ছে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক চাপ প্রয়োগ করে এই নিষ্ঠুর নারীকে শান্তির পথে আসতে বাধ্য করা।

***

মিয়ানমারের অন্যতম প্রধান বাণিজ্যিক অংশীদার চীন মিয়ানমার সরকারের প্রতি সরাসরি ও সর্বাত্মক সমর্থন জানিয়েছে। কারণ সেনাবাহিনীর উপর হামলাহয়েছে, আর সেনাবাহিনী সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করছে।  চীন মনে করে, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়েরও কর্তব্য একে সমর্থন করা!!

ভারত, আমেরিকা ও পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদকে মোটামুটি চিনতে পারলেও চীনকে আসলে আমরা কখনো চিনতে পারিনি। উইঘোর মুসলিম জনগোষ্ঠীর উপর নিষ্ঠুর পাশবিক নির্যাতন সত্ত্বেও অবাককাণ্ড এই যে, চীনকে মনে করা হয় মুসলিমবিশ্বের প্রতি সহানুভূতিশীল। তাই বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যে সে চালিয়ে যেতে পারছে একচেটিয়া ব্যবসা। অথচ আরাকান ট্রাজেডির ক্ষেত্রে এসে কী দেখা গেলো?!

মুসলিমবিশ্বে নিজের বিশাল ব্যবসায়িক স্বার্থের কোন পরোয়া-তোয়াক্কা না করে চীন ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়েছে প্রতিদ্বন্দ্বী ভারতকে টেক্কা দিয়ে মিয়ানমারে তার বাণিজ্যিক ও সামারিক স্বার্থ রক্ষায়। রাখাইনভূমিতেও রয়েছে চীনের অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তোলার মহাপরিকল্পনা। তাই ওখানে ভূমি খালি করাতার প্রয়োজন!

একথা সত্য যে, আরাকানের গণহত্যার প্রতি নির্লজ্জ সমর্থনের মাধ্যমে চীনের ভালোমানুষি মুখোশআজ খসে পড়েছে। তারপরো অবাক হয়ে দেখি, চীনের প্রতি মুসলিম জাহানে তেমন কোন ক্ষোভ-ক্রোধ নেই, অন্তত যেমন আছে আমেরিকা ও ইসরাইলের প্রতি!

চীনা মানুষ আর চীনা জোঁক, দুটোতে বোধহয় বেশ মিল রয়েছে!!

***

ভারতের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী মোদি সাহেবের কথা আশা করি সবার মনে আছে, গুজরাটে যিনি ...!!

মোদি সাহেব ঠিক ঐ সময়টা বেছে নিয়েছেন মিয়ানমার সফরের জন্য যখন আরাকানে মানবিক বিপর্যয় চরমে উপনীত। রোহিঙ্গাদের উপর পরিচালিত ইতিহাসের নিষ্ঠুরতম গণহত্যা সম্পর্কে সম্পূর্ণ নীরবতা অবলম্বন করে মোদি সাহেব বলেছেন, ‘রাখাইনে সন্ত্রাসীদের দমন করা হচ্ছে’!!

দুদিন পরে অবশ্য মুখরক্ষার জন্য বলেছেন, ‘তবে খেয়াল রাখতে হবে, বেসামরিক লোকেরা যেন ক্ষতিগ্রস্ত না হয়!

সত্যি মোদি ও তার ভারত মহান!! আমাদের শুধু জানতে ইচ্ছা করে, নিরস্ত্র অসহায় রোহিঙ্গাদের আরাকানে বেসামরিক বসতি ছাড়া আর আছেটা কী? ভারতে তো তবু কাশ্মীরী মুজাহিদীন দশটা মার খেয়ে একটা মার দিতে চায় এবং দেয়!

গৌতম দাস সুন্দর লিখেছেন, ‘ভারত যা করছে তা হলো সাপ-ওঝার কূটনীতি। সাপ হয়ে কামড়ায়, আবার ওঝা হয়ে বিষ নামাতে আসে। নিঃসন্দেহে ভারতের সাপ-ওঝা কূটনীতির এটা হচ্ছে একটা ক্লাসিক উদাহরণ।

তারপর গৌতম প্রশ্ন করেছেন, ‘বাংলাদেশ সরকার কেন এক্ষেত্রে ভারতের তাবেদারি করবে?! সেদিন বললাম, যৌথটহলের কথা, আর এখন বলছি ষোল কোটি লোককে খাওয়াতে পারলে ওদের পারবো না কেন?’

এদিকে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার বলছে, তারা তাদের দেশ থেকে চল্লিশ হাজার রোহিঙ্গাকে বের করে দেবে। তবে অমুসলিম শরণার্থীদের নাগরিকত্ব প্রদানের বিষয়টি বিবেচনা করা হবে।

কোথায় বের করে দেয়া হবে? সাংবাদিকের এ প্রশ্নের জবাব এড়িয়ে গেছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, তবে বুঝতে বাকি থাকে না যে, দেশটা হলো বাংলাদেশ। অবশ্য চিন্তার কারণ নেই। ভারত নাকি মিয়ানমারকে বিব্রত’  না করে বাংলাদেশে পর্যাপ্ত ত্রাণ পাঠাবে বলে আশ্বাস প্রদান করেছে, আর তাতেই আমরা বগল বাজাতে শুরু করেছি যে, ভারত আমাদের পাশে রয়েছে।

সর্বশেষ খবর হলো, ইসরাইলের পর ভারতও মিয়ানমারের কাছে সামরিক সরঞ্জাম বিক্রির উদ্যোগ নিয়েছে যা ব্যবহৃত হবে রোহিঙ্গাদের জাতিগতনিধন-কাজে।

আরো খবর, আরাকানের বিভিন্ন জনপদ থেকে প্রাণ নিয়ে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের অনুপ্রবেশঠেকাতে ধর্মনিরপেক্ষ মহান’  ভারত বাংলাদেশের সীমান্তে মরিচের গুঁড়া ও স্টান গ্রেনেড ব্যবহার শুরু করেছে।৬   বিশ্ববিবেক ভারতের এ অমানবিক আচরণে প্রতিবাদমুখর হলেও আমরা এখন পর্যন্ত একটা শব্দ উচ্চারণ করতে পারিনি।

হায়, স্বাধীন সার্বভৌম একটা দেশ কতটা অসহায় এবং কতটা নতজানু হলে একটা প্রতিবাদ পর্যন্ত করার সাহস পায় না!

***

রাশিয়া বলেছে আরো চমকপ্রদ কথা, ‘মনে রাখা দরকার, একটি সার্বভৌম দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করলে তা ধর্মীয় বিরোধ ও উত্তেজনা বাড়িয়ে দিতে পারে। তাই আমরা মিয়ানমার সরকারের প্রতি পূর্ণ সমর্থন জানাচ্ছি এবং ওখানকার অভ্যন্তরীন বিষয়ে হস্তক্ষেপের কঠিন পরিণাম সম্পর্কে সবাইকে সতর্ক করে দিচ্ছি।

প্রশ্ন করতে ইচ্ছে করে, তাহলে সিরিয়ায় পুতিন কী করছেন?! ইউক্রেনে কী করেছেন?! মুসলিম বিশ্বকে কি তিনি তাহলে এতটাই বোকা ভেবেছেন? পুতিন সাহেবের আর দোষ কী, আসলেই তো আমরা বোকা!

শিশুর সরলতা নিয়ে আর যাই হোক বিশ্বরাজনীতি এবং আন্তর্জাতিক কূটনীতির পক্ষহওয়া যায় না।

***

আমেরিকা, আগে কিছুটা হলেও তার লাজলজ্জার বালাই ছিলো, ট্রাম্পের আমেরিকা তাও যেন  ছুঁড়ে ফেলেছে। লিপ সার্ভিসহিসাবে শুধু বলে যাচ্ছে উদ্বেগ ও পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণের কথা। অথচ উপসহকারী পররাষ্ট্র মন্ত্রী প্যাট্রিক মার্ফি ঠিকই বার্মিজ বাহিনীর উপর কথিত সন্ত্রাসী হামলায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন, নিন্দাও করেছেন, আর বলেছেন, রাখাইন রাজ্যে একা মুসলমানরা নির্যাতিত নয়। মুসলমানদের হাতে অন্যরাও নির্যাতিত।

চমৎকার! এটাই তো চাচ্ছেন সু চি! আন্তর্জাতিক মহল এটাকে যেন বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর মধ্যে সঙ্ঘটিত জাতিগত দাঙ্গা মনে করে। এদিকে বার্মিজ বাহিনী যেন রোহিঙ্গাদের জাতিগত নির্মূলের কাজটা নির্বিঘ্নে সেরে ফেলতে পারে। হচ্ছেও তাই।

আমাদের আজ বিশ্বাস করতে বলা হচ্ছে, মার্কিন মন্ত্রী মিয়ানমার গিয়েছেন এবং আরাকানের উপদ্রুত এলাকা সফর করার অনুমতিচেয়েছেন। কিন্তু সামরিক জান্তার অনুমতি না পেয়ে ব্যর্থতার দায় মাথায় করে ফিরে গিয়েছেন।

জাতিসঙ্ঘের ভরা দরবারে উত্তর কোরিয়াকে একেবারে ধ্বংস করে ফেলার হুমকি দানকারী আমেরিকার অসাহয়ত্বকে সত্যি করুণা করতে হয়!

***

জাতিসঙ্ঘের বিষয় একটু আলাদা করে বলা দরকার। স্বীকার করতেই হবে, নইলে বড় অকৃতজ্ঞতা হয়ে যাবে যে, শুরু থেকে জাতিসঙ্ঘ তার দায়িত্ব সঠিকভাবেই পালন করে যাচ্ছে। আরাকানে গণহত্যা চলছে, জাতিসঙ্ঘ তা স্বীকার করে এবং কঠোর ভাষায়নিন্দা করে।  এমনকি জাতিসঙ্ঘ জোরদাবি জানায়, অবিলম্বে রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে হবে পূর্ণ নাগরিক মর্যাদায়। কিন্তু সমস্যা হলো, নিন্দা প্রতিবাদ যা কিছু করা হচ্ছে এবং দাবি আব্দার যা কিছু জানানো হচ্ছে, সামরিক জান্তা এবং গণতন্ত্রের নেত্রী তা কানেই তুলছেন না। কথা না শুনলে ভদ্রলোকেরকী আর করার থাকে!

তবে চিন্তার কিছু নেই, জাতিসঙ্ঘ মহাসচিব আশ্বাস দিয়েছেন, তিনি দীর্ঘ মেয়াদী একটা ব্যাপক পরিকল্পণা গ্রহণ করছেন, রোহিঙ্গাদের জন্য কার্যকর কিছু করার। ততদিন ধৈর্য ধারণ তো করতেই হবে!

আপাতত জাতিসঙ্ঘের মহাসচিব রোহিঙ্গা শরণার্থীদের জন্য কিছু বাড়তি অর্থসাহায্যের আবেদন জানিয়েছেন বিশ্বসম্প্রদায়ের কাছে, আর কতকটা যেন তোয়াজ করে অং সান সু চিকে বলেছেন, সু চির সামনে একটি শেষ সুযোগ এসেছে রাখাইনের নিপীড়িত জনগোষ্ঠীর পাশে দাঁড়াবার। নইলে পরিস্থিতি অনেক ভয়াবহ পর্যায়ে চলে যাবে৭  সদাশয় মহাসচিব আরো বলেছেন, মিয়ানমারকে অবশ্যই রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ফিরিয়ে নিতে হবে।

হাঁ, আমাদের মনে আছে, এ সেই জাতিসঙ্ঘ যে তিমুরকে দুটুকরো করতে সামান্য কালক্ষেপণও করেনি, সুদানকে দুভাগ করতে বিন্দুমাত্র দ্বিধাও করেনি, আর বিশ্বজনমতকে উপেক্ষা করে ইরাকের ভূমিতে বহুজাতিক বাহিনীকে হামলার ছাড়পত্রদিয়েছে বেশ সাজ সাজ রব করে!!

যিনি বলেছেন সত্য বলেছেন, ‘জাতিসঙ্ঘ হলো সেই বিশ্বসংস্থা যার রয়েছে দুটি চোখ। একটি দিয়ে দেখে বিশ্বকে, আরেকটি দিয়ে দেখে মুসলিমবিশ্বকে। দুর্ভাগ্য এই যে, মুসলিমবিশ্বকে দেখার চোখের দৃষ্টিটা হচ্ছে ঝাপসা।

***

আশ্চর্য, মানুষ অন্ধ হয়, বধির হয়, জানি, কিন্তু গোটা সভ্য পৃথিবী হতে পারে একযোগে এমন অন্ধ ও বধির! আরাকানে যা ঘটেছে এবং ঘটছে তা যদি ঘটতো কোন অমুসলিম জনপদে, কোন মুসলিম জনগোষ্ঠীর হাতে?! যদিও ইতিহাস সাক্ষী, মুসলিম উম্মাহর গৌরবময় অতীতে কখনো ঘটেনি এমন কোন ঘটনা; এমনকি উম্মাহর শক্তি ও প্রতাপের চরম উত্থানের যুগেও না। ইতিহাস তার বিভিন্ন অধ্যায়ে এ জাতিকে নিপীড়নের শিকার হতে দেখেছে বারবার, কিন্তু নিপীড়কের ভূমিকায় দেখেনি একবারও। বোঝার জন্য শুধু মহান সুলতান গাজী ছালাহুদ্দীনের বাইতুল মাকদিস বিজয়ের ঘটনাই যথেষ্ট হতে পারে।

বলছিলাম, আরাকানে যা ঘটেছে তা যদি ঘটতো কোন অমুসলিম জনপদে কোন মুসলিম জনগোষ্ঠীর হাতে তাহলে কী হতো জাতিসঙ্ঘের প্রতিক্রিয়া?! কতক্ষণ লাগতো নিরাপত্তা-পরিষদের জরুরি বৈঠক তলব করতে এবং কঠোর থেকে কঠোর কোন প্রস্তাবও পাশ করে চব্বিশ ঘণ্টার চরমপত্র ঘোষণা করতে?! পঞ্চপাণ্ডবের কোন একজনেরও কি তখন মনে পড়তো, তার ভেটো প্রয়োগের অধিকার রয়েছে?!

পূর্বতিমুরে কিছুই তো হয়নি! দক্ষিণসুদানেও ঘটেনি তেমন কোন হত্যাকাণ্ড, গণহত্যা তো অনেক পরের কথা। অথচ ...!!

খৃস্টানঅধ্যুষিত জনপদে একটা ঘরেও তো আগুন জ্বলেনি, না পূর্বতিমুরে, না দক্ষিণসুদানে, অথচ ...!!

আর নারীনিপীড়নের অভিযোগ তো আমাদের চরম শত্রুও কখনো আরোপ করতে পারেনি, অথচ ...!!

এই অথচটাই আজ ভালোভাবে বুঝতে হবে এবং ভালোভাবে মনে রাখতে হবে মুসলিম উম্মাহকে, মুসলিমবিশ্বের নেতৃবৃন্দকে, যদি আমরা চাই আমাদের ভবিষ্যত নিরাপদ হোক, আমাদের আর কোন জনপদে না ঘটুক আরাকান ট্রাজেডির পুনরাবৃত্তি।

***

কেউ কেউ অনেকটা যেন ভয়ে ভয়ে বলছেন, সুচির শান্তিনোবেল প্রত্যাহার করা কথা। আমাদের যারা বোকা ভাবে, তাদের পক্ষ হতে এটা এক নতুন তামাশা! তা না হয় করা হলো, কিন্তু তাতে কি সব খুন মাফ হয়ে যাবে? সব আগুন নিভে যাবে? লুণ্ঠিত আবরুর যখম শুকিয়ে যাবে? নাফনদীতে ভেসে যাওয়া সব লাশ যিন্দা হয়ে যাবে?!! আমি জানতে চাই, এতগুলো খুনের, এত রক্তপাতের বিচার হবে না কেন? এমন বর্বর গণহত্যার অপরাধী যারা আসামীর কাঠগড়ায় তাদের তোলা হবে না কেন? সাদ্দামের অপরাধ কী ছিলো? তার যদি ফাঁসি হতে পারে তাহলে ...?

আমার তো নিশ্চিত ধারণা, অং সান সু চির কিছুই হবে না। তার কেশাগ্রও স্পর্শ করা হবে না, আর নোবেল পুরস্কার ঝুলতেই থাকবে তার গলায়। এমনকি সবকিছু শেষ হওয়ার পরযদি তিনি একটু বলেন, ‘আচ্ছা, ঠিক আছে - এবং সম্ভবত তিনি তা বলবেন - তখন যদি শান্তিতে নোবেল পুরস্কারের জন্য তার নামটাও সর্ট লিস্টেচলে আসে, অবাক হওয়ার কিছুই থাকবে না। ইহুদির বাচ্চা নেতানিয়াহু কি ফিলিস্তীনে গণহত্যার পুরস্কার পাননি?!

***

অমুসলিম বিশ্বকে তো কিছুটা হলেও বুঝতে পারি, কিন্তু মুসলিম বিশ্ব! ও আই সি!! খাদেমুল হারামাইন!!

কোথায় তাহলে আমাদের ঈমান! কোথায় তাহলে আমাদের ইসলামী ভ্রাতৃত্বের চেতনা!! বিশ্বের দরবারে প্রতিবাদ বলুন, ফরিয়াদ বলুন যা কিছু করছেন একা এরদোগান। নিজের দেশ তুরস্ক নিয়েই তিনি রয়েছেন মহা বিপদে। ভিতরের বাইরের  বহু রকম ষড়যন্ত্রের মোকাবেলা তাঁকে করতে হচ্ছে অহরহ।৮  তারপরো শুধু ঈমানী গায়রাতের দাবীতে  প্রতিটি আন্তর্জাতিক সভায় তিনি আওয়ায তুলছেন আরাকানে গণহত্যা বন্ধের দাবীতে, রোহিঙ্গাদের জাতিগতনিধন থেকে রক্ষার জন্য, যদিও স্বাভাবিক কারণেই তাঁর বলিষ্ঠ প্রতিবাদও তেমন কোন কাজে আসছে না, প্রায় অরণ্যেরোদনের মতই অবস্থা। তবু ... তবু  পৃথিবী অন্তত জানতে পারছে, মুসলিম বিশ্বে এখনো আছেন এমন কেউ যার অন্তর কাঁদে আপন অসহায় মজলুম মুসলিম ভাইদের জন্য।  জাতিসঙ্ঘের সাধারণ পরিষদে ভাষণ দেয়া উপলক্ষে এরদোগান এখন নিউইয়র্কে অবস্থান করছেন। সেখানে এক বিরাট সম্বর্ধনাসভায় তিনি বলেছেন, ‘মুসলিমরাই শুধু জঙ্গী হয়, সন্ত্রাসী হয়, অথচ মিয়ানমারের বৌদ্ধরা এই যে নিষ্ঠুরতম গণহত্যা চালিয়ে যাচ্ছে, তারা কিন্তু সন্ত্রাসী হচ্ছে না। এটাই আজকের পৃথিবীর বাস্তবতা।

আমার শুধু জানতে ইচ্ছে করে, মুসলিম বিশ্বে কি নেই আর কোন কণ্ঠ এবং কণ্ঠস্বর?!

এমনকি এরদোগানের পর্দানশীন স্ত্রী, তুরস্কের ফার্স্ট লেডি, আমেনা এরদোগান, তিনি একবার ছুটে গেলেন আরাকানে হত্যা-উচ্ছেদের ভয়ে ভীত সন্ত্রস্ত রোহিঙ্গা মুসলমানদের অবস্থা সরেজমিনে দেখার জন্য, আরেকবার ছুটে এলেন বাংলাদেশে আশ্রয়গ্রহণকারী রোহিঙ্গা মুহাজিরীনের প্রতি সমবেদনা জানাতে। আবরু লুণ্ঠিতা মুসলিম নারীদের আহাজারিতে তার চোখ থেকে পানি ঝরলো। তিনি তাদের বুকে জড়িয়ে ধরে কাঁদলেন।৯   প্রশ্ন হলো, পঞ্চাশটিরও বেশী মুসলিম দেশের একজন নেতারও কি সময় হলো না নিজের চোখে এই অসহায় মুসলমানদের দুঃখ দুর্দশা একটু দেখে যাওয়ার?!

***

আরাকানে কেন আজ এ নারকীয় হত্যাযজ্ঞ? কী অপরাধ রোহিঙ্গা মুসলিম জনগোষ্ঠীর? অপরাধ কি শুধু এই যে, তারা কালিমায় বিশ্বাসী, তাওহীদের পূজারী? অপরাধ কি শুধু এই যে, তারা

আজ শক্তিহীন, দুর্বল? অপরাধ কি শুধু এই যে, তারা যে উম্মাহর অনুসারী, বিশ্বের সভায় তাদের কোন কণ্ঠ নেই এবং নেই কোন কণ্ঠস্বর?

তাহলে কি সেই  যুগ এসে গেছে যে যুগ সম্পর্কে আমাদের পেয়ারা হাবীব ভবিষ্যদ্বাণী করে গেছেন! এমন এক যামানা আসবে যখন বিভিন্ন সম্প্রদায় পরস্পর ডাকাডাকি করবে আর তোমাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়বে যেমন ঝাঁপিয়ে পড়ে ক্ষুধার্ত মানুষ  খাদ্যসম্ভারের উপর?

আর তা একারণে হবে না যে, তোমরা সংখ্যায় কম। না সংখ্যায় তো তোমরা অনেক হবে, তবে  তোমরা হবে বানে ভেসে আসা খড়কুটার মত।

তাই তো শতাব্দীর সবচেয়ে বীভৎস একটা গণহত্যা এবং জাতিগত নির্মূলীকরণ ঘটে যাচ্ছে সবার চোখের সামনে, অথচ মানবাধিকারের মোড়লরা সেজে আছে অন্ধ-বধির?! কেন?

আসল কথা হলো, এরদোগান যা বলেছেন সেটাই সত্য; ‘আমাদের জন্য কাঁদবার কোন চোখ নেই, আমাদের নিজেদের চোখ ছাড়া। তাই আমাদের কান্না আমাদেরই কাঁদতে হবে। আর ঐক্যবদ্ধ হতে পারলে কারো করুণার পাত্র হওয়া ছাড়া আমরা নিজেরাই পারবো নিজেদের হিসাব বুঝে নিতে।

***

হায় মুসলিমবিশ্ব এবং তার নেতৃবৃন্দ! অন্তত এই একটি বিষয়ে কি তারা এক হতে পারে না, নিজেদের সব ভেদাভেদ কিছু সময়ের জন্য ভুলে গিয়ে?! একবার, অন্তত একবার একটা মাত্র হুঙ্কারও তারা দিতে পারে না?! অস্তিত্বের সঙ্কট বোঝার বুদ্ধিটুকুও কি লোপ পেয়েছে সবার?!

ইয়া সালমান! ইয়া খাদেমাল হারামাইন!! আমার দুর্বল কণ্ঠস্বর যদি আপনার শাহী বালাখানা পর্যন্ত পৌঁছতে পারে তাহলে জানতে চাই?

আমাদের এ দুর্যোগে আপনার কি কিছুই করার নেই? আসলেই কি আপনার কোন শক্তি নেই? আসলেই কি আপনি এত দুর্বল ও শক্তিহীন যে ...?

তাহলে উত্তর কোরিয়া যাকে বলে পাগলা কুকুরতাকে নিয়ে তলোয়ার হাতে কিসের  এ নর্তন-কুর্দন? কী জন্য বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের অস্ত্র ক্রয়? কাতারকে শায়েস্তা করা কি আরাকানের অসহায় মজলুম মুসলিম ভাইদের রক্ষা করার চেয়ে জরুরি হলো?! আল্লাহর ওয়াস্তে কিছু একটা জবাব দিন। মুসলিমবিশ্ব আপনার মুখ থেকে কিছু একটা জবাব শুনতে চায়।

মৌখিকভাবে হলেও জাতিসঙ্ঘের মহাসচিব বার্মার নেত্রীকে বলেছেন শেষ সুযোগটি গ্রহণ করার কথা।

আপনার কাছে আজ বিশ্বের সোয়াশ কোটি মুসলিম উম্মাহর একটাই মাত্র আকুতি, অন্তত নিজের ভাবমর্যাদা রক্ষার এই শেষ সুযোগটুকু গ্রহণ করুন। ইতিহাস আজ রুদ্ধশ্বাসে চেয়ে আছে আপনার বার্ধক্যপীড়িতমুখের দিকে।

জানি, দুশমনের পাতা ফাঁদে পা দিয়ে আপনি আজ কতটা নাজেহাল। তারপরো বলছি, বার্মার নরপশুদের বিরুদ্ধে দুর্বল কণ্ঠে হলেও একটা হুঙ্কার দিয়ে দেখুন, কীভাবে মুসলিম উম্মাহর শত কোটি কণ্ঠে তা প্রতিধ্বনিত হয়! কীভাবে চমকে ওঠে জাতিসঙ্ঘ!! কীভাবে হৃৎকম্প শুরু হয়ে যায় বৃহৎ শক্তিবর্গের!! তারপর দেখবো, ‘বার্মারসামরিক জান্তার কত বুকের পাটা! দেখবো, কীভাবে আমার আর কোন ভাইয়ের গলায় ছুরি চলে!! আরাকানের আর কোন ঘরে কীভাবে আগুন জ্বলে!! আমার মা-বোনের উড়না-দোপাট্টার দিকে আর কোন না-পাক হাত কীভাবে আগে বাড়ে!!

সময়ের সুযোগ দ্রুত ফুরিয়ে যাচ্ছে, এখনো যদি না জাগি তাহলে আর কবে জাগবো আমরা?! আর কবে হবো আমরা এক জাসাদের মত’?!

আর কত রক্ত ঝরলে, আর কত আগুন জ্বললে ফিরে আসবে আমাদের ঈমানি জোশজাযবা! আমাদের ইসলামী ভ্রাতৃত্বের চেতনা!!১০

***

অন্তত আমরা! বাংলাদেশের মুসলিম জনতা!! নাফনদীর এপার থেকে যারা দেখতে পাই, ওপারে জনপদের পর জনপদে জ্বলছে দাউ দাউ আগুন!! পানিতে ভাসছে লাশের পর লাশ, নারী-পুরুষ ও শিশু-বৃদ্ধের!! যারা শুনতে পাচ্ছি আবরুহারা মুসলিম মা-বোনের জিগরফাটা চিৎকার!! যারা দেখতে পাচ্ছি ভুখা-নাঙ্গা জীবন্মৃত লাখো মুহাজিরীনের মিছিল!! কবে হবে আমাদের হুঁশ! কবে জাগবে আমাদের ঈমানি জোশ!! ষোলকোটি কণ্ঠ কি একসঙ্গে গর্জন করে উঠতে পারে না! চালের ক্ষুধাকি আমাদের এতই সর্বগ্রাসী!!

বলো আমার ভাই, বুকে হাত রেখে বলো, এ লজ্জা কোথায় রাখি, আমার দেশে আশ্রয়গ্রহণ-কারী বিপন্ন বিপর্যস্ত মুহাজিরীনকে একটুখানি সান্ত্বনা দেয়ার জন্য সবার আগে ছুটে এলেন ভিনদেশেরএক নারী!! তারপর খুললো আমাদের চোখ, ভাঙ্গলো আমাদের ঘুম?

তবু ভালো, চোখ খুলেছে, ঘুম ভেঙ্গেছে!! আমরা কৃতজ্ঞ  যে, যেভাবেই হোক, সরকার অন্তত একটা মানবিক সিদ্ধান্ত নিতে পেরেছে। এ সিদ্ধান্তে মৃত্যুভয়ে ভীত সন্ত্রস্ত ও দিশেহারা রোহিঙ্গাদের অন্তত জান বাঁচানোর একটা সুযোগ  তো তৈরী হয়েছে!১১

আমরা আরো কৃতজ্ঞ, আমাদের মাননীয়প্রধানমন্ত্রী জাতিসঙ্ঘের সাধারণ পরিষদে দেয়া তার ভাষণে রোহিঙ্গাদের দুঃখ-দুর্দশার বিষয় মোটামুটি তুলে ধরেছেন এবং স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন যে, রোহিঙ্গারা জাতিগতনিধন-এর শিকার হয়েছে, অথচ তারা হাজার বছরেরও বেশী সময় ধরে আরাকানে বসবাস করে আসছে।

***

আমরা যারা মনে করি, এখনো আছে আমাদের কিছু ঈমান; এখনো বেঁচে আছে কিছু ভ্রাতৃত্ববোধ, আমাদের আজ ঈমানি দায়িত্ব হলো জানমাল সর্বস্ব নিয়ে আরাকানের মজলুম ভাইদের পাশে দাঁড়ানো, তাদের বুকের জখমে একটু সান্ত¦নার প্রলেপ বুলানো এবং জীবনকে ধরে রাখার জন্য একটু সাহস যোগানো; তাদের দুঃখ-কষ্ট যতটা সম্ভব লাঘবের চেষ্টা করা। আমাদের আরো কর্তব্য হলো শেষ রাতে দুফোটা চোখের পানি ফেলে দরদে দিলের সঙ্গে’  সর্বশক্তিমান আল্লাহ তালার দরবারে ফরিয়াদ করা, যেন তিনি মজলূমকে সাহায্য করেন, জালিমকে শায়েস্তা করেন। সীমিত সাধ্য নিয়েও যারা মজলুমানের দুঃখ-কষ্ট লাঘবের চেষ্টা করে যাচ্ছে আল্লাহ যেন তাদের আরো তাওফীক দান করেন, আল্লাহ যেন তাদের পুরস্কৃত করেন।

আর যারা এমন কঠিন দুর্যোগের মধ্যেও অসহায় মুহাজিরীনের দুর্ভোগবৃদ্ধির কারণ হচ্ছে; এখনো যারা রাজনীতিখেলে চলেছে আল্লাহ যেন তাদের ...।

আমাদের আরো কর্তব্য হলো, এখনো যারা ঘুমের ঘোরে বেখবর, এখনো যারা মশগুল খেলাধুলায়, চিত্তবিনোদনে, এখনো যারা বিভোর নাচের আসরে, গানের জলসায় তাদের অন্তরে সেই ঈমানি চেতনা, সেই ভ্রাতৃত্ববোধ জাগিয়ে তোলার চেষ্টা করা, যা আল্লাহর পেয়ারা নবী তাঁর ছাহাবা কেরামের সিনায় রেখে গিয়েছেন।

আজ আমাদের আরো কর্তব্য হলো সম্ভাব্য সকল উপায়ে আন্তর্জাতিক জনমতকে সোচ্চার হতে উদ্বুদ্ধ করা, যাতে শান্তির নোবেলকে শান্তির পক্ষে অন্তত দুকদম আগে বাড়তে বাধ্য করা যায়।

আর কিছু না হোক, বিশ্বের জাতিবর্গকে আমরা এই হুঁশিয়ারিটুকু জানিয়ে দিতে পারি, ‘যে আগুন আজ নিজের হাতে তোমরা জ্বালছো আমাদের জনপদে তা শুধু আমাদেরই ছারখার করবে না, তোমাদের শান্তির জনপদকেও ভস্ম করে দিতে পারে, যদিও আমরা তা চাই না, কিছুতেই না।

কিন্তু সময়ের গতি তো কারো চাওয়ার উপর থেমে থাকে না। রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস তারুণ্যের সন্ত্রাসকে জন্ম দিয়েই থাকে। হয়ত তখন সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে আবার যুদ্ধ ঘোষণা করা হবে, আত্মঘাতী হামলা রোধ করার চেষ্টায় কোমর বেঁধে নামা হবে, কিন্তু ভয়-ভীতি ও ত্রাস থেকে আর মুক্তি পাওয়া যাবে না। সুতরাং এখনো সময় আছে জাতিসঙ্ঘের হে সদাশয় মহাসচিব, গণতন্ত্রের নেত্রী গ্রহণ করেননি, আপনি অন্তত শেষ সুযোগটুকুগ্রহণ করুন।

ফিলিস্তীন, কাশ্মীর, ইরাক, আফগানিস্তান ও  সিরিয়াকে কেন্দ্র করে যা কিছু সন্ত্রাস’-এর জন্ম তা কিন্তু আর কিছু নয়, মুসলিমনিধনেরই অনিবার্য প্রতিক্রিয়া।

আরেকটা কথা, ইতিহাসের  ব্যতিক্রমহীন ফায়ছালা কিন্তু এটাই যে, জালিমের পতন অবশ্যম্ভাবী, বিলম্বে কিংবা অবিলম্বে। জালিমকে যারা সাহায্য করে এবং সমর্থন যোগায় সরবে, কিংবা নীরবে তাদের জন্যও রয়েছে প্রকৃতিরঅভিশাপ! সেই অভিশাপ থেকে কেউ রক্ষা পেয়েছে, ইতিহাস তা বলে না।

***

আমার হৃদয়ে এখন যে রক্তক্ষরণ ঘটছে তা থেকে আরো একদুটি ফোঁটা, প্রিয় পাঠক, তোমার সামনে রেখে যেতে চাই।

বার্মার সামরিক জান্তা আজ বলতে চায়, আরাকানের রোহিঙ্গা মুসলিম জনগোষ্ঠী বার্মার নাগরিক নয়, তারা বহিরাগত। তারা বাংলাদেশ থেকে উড়ে এসে জুড়ে বসা বাঙ্গালী। বার্মার ভূমি থেকে তাদের উচ্ছেদ ও বিতাড়নই একমাত্র সমাধান!

হায় বার্মা! হায় বুদ্ধ!! হায় বুদ্ধু!! হাজার বছর ধরে যারা তোমাদের শেখালো জ্ঞান, সভ্যতা ও চরিত্র; তোমাদের সমাজসভ্যতায় যাদের রয়েছে অবিস্মরণীয় অবদান এই কি তার উপযুক্ত প্রতিদান!! বোধহয় এরই নাম কৃতঘ্নতা, যা বনের পশুদের মধ্যেও এতটা থাকে না।

প্রশ্ন তো করা হয় এমন মানুষকে, যার এখনো কিঞ্চিৎ বিবেক আছে! ভিতরের পশুত্ব বাইরের মনুষ্যত্বকে গ্রাস করে ফেলেছে এমন দ্বিপদ জন্তুকে তো প্রশ্ন করার কোন অর্থ হয় না। তাই আমি বার্মার জান্তাকে আজ কোন প্রশ্ন করবো না। আমি জানতে চাইবো না, এত বছর তাহলে কীভাবে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী নাগরিক সুযোগ সুবিধা ভোগ করলো? কেন তাহলে তাদের ভোটাধিকার দেয়া হয়েছিলো? পার্লামেন্টে এত দীর্ঘকাল তাদের যে সরব উপস্থিতি, কী তার যুক্তি? কিসের ভিত্তিতে তাহলে অং সান সু চি রোহিঙ্গাদের ভোট প্রার্থনা করেছিলেন এবং তাদের উপর নেমে আসা নির্যাতনের ইতি ঘটানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন? রোহিঙ্গা মুসলিমদের কাছ থেকে বিপুল হারে তিনি পেলেন ব্যালট উপহার’, কিন্তু আজ তাদেরই বুক লক্ষ্য করে দিতে চাচ্ছেন বুলেট উপহার’!!

না, আমি কোন প্রশ্ন করবো না। শুধু একটা কথাই বলবো, তোমাদের সর্বমান্য ব্যক্তিটি রাষ্ট্রীয় পদে সমাসীন অবস্থায় বলেছিলেন, ‘রোহিঙ্গারা যদি বহিরাগত হয় তাহলে আমিও তাই। তাদের যদি বিতাড়ন করতে হয় তাহলে আমাকেও বিতাড়ন করতে হবে। আর আমি এত সহজে ছাড়তে চাইবো না আমার পূর্বপুরুষের ভিটেমাটি। কারণ এ মাটির অনেক গভীরে আমার শেকড়!!

হে সভ্যপৃথিবী, কত কারণে, কত অকারণে কত অবরোধই তো আরোপ করা হলো বিভিন্ন মুসলিম দেশের বিরুদ্ধে! মুখের হম্বিতম্বি তো যথেষ্ট হলো। এবার দয়া করে শক্ত একটা অবরোধ আরোপ করো মিয়ানমারের রক্তপিপাসু জান্তার বিরুদ্ধে।

এই যে রাষ্ট্রহীন শিশুগুলো আজ কাদামাটির মধ্যে জন্মগ্রহণ করলো তাদের জন্য অন্তত কিছু একটা করো। ফিরিয়ে দাও তাদেরকে তাদের ভূমির অধিকার এবং রাষ্ট্রীয় পরিচয়! আল্লাহ তোমাদের ভালো করুন। আমি চাই না ঐ শিশুগুলো এ অনুভূতি নিয়ে বড় হোক, ‘পৃথিবীতে আমাদের চোখ খোলার সময় পৃথিবী অন্ধ ছিলো, বধির ছিলো। আত্মঘাতী হয়েই আমাদের এর প্রতিশোধ নিতে হবে।

আমি চাই না আজকের রোহিঙ্গা শিশু-কিশোর তাদের মা-বোনদের ধর্ষণের বীভৎস স্মৃতি নিয়ে বড় হোক, আর তাদের বুকের ভিতরে দাউ দাউ করে জ্বলতে থাকুক প্রতিশোধের লেলিহান শিখা। আল্লাহর ওয়াস্তে হে সভ্য পৃথিবী, তাদের বুকের আগুন নেভানোর  জন্য কিছু একটা করো। আবারো বলছি, আল্লাহ তোমাদের ভালো করুন।

 

 

advertisement