শাওয়াল ১৪২৯   ||   অক্টোবর ২০০৮

তারুণ্যের অবক্ষয় : ডিশ এন্টিনা ও ভিসিআর সমাচার

ইসহাক ওবায়দী

তারুণ্যের প্রারম্ভে রাত জেগে উপন্যাস পড়ার বাতিক আমাকে যেন পেয়ে বসেছিল। আম্মাজান আমার এই সমস্যা নিয়ে খুব পেরেশান থাকতেন। একদিন ভাবীকে ডেকে বলে দিলেন আমাকে যেন কোনো উপন্যাস সরবরাহ না করা হয়। আমি ভাবীর সঙ্গে রাগারাগি করায় তিনি আমার কাছে ছোট্ট একখানা চিরকুট লিখে পাঠিয়েছিলেন আমার  স্বান্ত্বনার জন্য। সে যে কী নেশা! ঘুম নেই, খাওয়া-দাওয়ার খবর পর্যন্ত থাকত না।

উপন্যাসে পড়া নায়কের অবস্থা নিজের জীবনে বাস্তবায়ন করার একটা নকশাও অন্তরের মধ্যে নিজের অজান্তেই অঙ্কিত হয়ে যেত। কদিন পর আববাজান রাহ. শেখ ফরীদ উদ্দীন আত্তার রাহ-এর লেখা তাযকিরাতুল আওলিয়া পড়তে দিলেন আমাকে। আমি দেখলাম, যত পড়ি ততই ভালো লাগে। আওলিয়াদের বাস্তব ঘটনানির্ভর এ সমস্ত কাহিনীও আমাকে রীতিমতো নেশায় ফেলেছিল।

তাদের দুনিয়াত্যাগী ঘটনাগুলো আমাকেও দুনিয়াত্যাগী হবার এক মহা প্রেরণায় উদ্বুদ্ধ করেছিল। আগে যেমন উপন্যাসের নায়কের মতো হবার স্বপ্ন দেখতাম এখন আল্লাহর ওলীদের মতো হয়ে যাবার এক মহা স্বপ্ন আমাকে বিভোর করে রাখছিল। আমিও তাদের মতো দুনিয়াত্যাগী ফকীর-দরবেশের জীবন ধারণ করব-এ প্রতিজ্ঞাই তখন আমার মনে দানা বাঁধত। ছোট মানুষ, তখন তো আর এতকিছু পার্থক্য করতে শিখিনি, কিন্তু এখন বুঝতে পারছি, প্রত্যেক লেখার মধ্যেই থাকে ঐ লেখার ভাব-দর্শন ও প্রকৃতি-চরিত্রের এক মহা আকর্ষণ, যা মানুষকে লেখার অনুকরণ-অনুসরণে আকৃষ্ট করে। লেখকের মন-মানসিকতা ও চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যও নাকি পাঠককে উদ্বুদ্ধ করে।

টিভি, ভিসিআর, ডিশ এন্টিনার মাধ্যমে যে সমস্ত ছবি ও কল্পকাহিনী প্রচারিত হয়, তার আকর্ষণও প্রতিটি দর্শকের মন-মস্তিষ্ককে আকর্ষিত করে। কিশোর-তরুণ তো বটেই, আবাল-বৃদ্ধ-বনিতাকেও ঐ ছবির দর্শন ও নোংরামির এক মহা প্লাবনে ভাসিয়ে নিয়ে যায়। দর্শকের মন ঐ ধরনের ঘটনা ঘটাতে উদ্বুদ্ধ হয় যা সে ছবিতে দেখেছে।

টিভি, ভিসিআর সম্পর্কে কিছু বলার আগে ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গির একটি ব্যাখ্যা দেওয়া প্রয়োজন মনে করছি। কেয়ামত পর্যন্ত আগত সকল মানবজাতির জন্য যে কোনো সমস্যার সমাধান একমাত্র ইসলামেই রয়েছে। তাই নতুন কোনো প্রযুক্তির উদ্ভব হলেও তার ব্যবহার সম্পর্কীয় যাবতীয় সমাধান একজন মুসলিম হিসাবে আমাকে ইসলামের ভেতরই খুঁজতে হবে। তদ্রূপ যুগের নতুন নতুন বিনোদনকেও ইসলামের কষ্টিপাথরে যাচাই করে নিতে হবে প্রথমেই।একজন মুসলমান সর্বাগ্রে দেখবে তার ধর্ম ইসলামকে, তারপর তার দেশকে, এরপর তার সমাজকে, এরপর আসবে তার ব্যক্তি।

আমাদের জাতীয় নেতা শেরে বাংলা এ.কে.ফজলুল হক সাহেব তাই বলেছিলেন, আমি প্রথমে মুসলমান এরপর বাঙ্গালী। একজন মুসলিমের যাবতীয় কাজ ইসলামের কষ্টিপাথরে উত্তীর্ণ হতে হবে। তবেই সে প্রকৃত মুসলমান হওয়ার দাবি করতে পারে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ইসলামের দৃষ্টিতে খারাপ কিছু নয়; বরং এসবও মহান আল্লাহ পাকেরই দান। মানুষের জ্ঞান ও জ্ঞানচর্চা আল্লাহরই রহমত স্বরূপ। তবে বিজ্ঞানের ব্যবহার হতে হবে ইসলামের মাপকাঠিতে। ইসলাম যেভাবে তা ব্যবহার করতে বলে ঠিক সেভাবেই তার ব্যবহার বৈধ। নতুবা অবৈধ। এই  আলোচনার পর বলা যায় যে, ইসলামে বিনোদনের স্থান একেবারেই নেই এমন নয়; বরং সীমিতভাবে ফলদায়ক বিনোদনের অনুমতি ইসলামে রয়েছে। টিভি, ভিসিআর ও ডিশ এন্টিনার প্রচলিত ব্যবহার সেই শুদ্ধ বিনোদনের অংশ কখনই নয়। কাজেই ইসলামের দৃষ্টিতে তা সম্পূর্ণ অবৈধ। ইসলাম শালীন ছবিকেও অবৈধ ঘোষণা করেছে। এমনকি পুরুষের ছবিকেও। অর্থাৎ যে কোনো প্রাণীর ছবি তোলা বা অাঁকা এবং তার প্রদর্শনের ব্যবস্থা করা ইসলামে না জায়েয। সেক্ষেত্রে একজন নারীর অশ্লীল ছবি তো দূরের কথা, শালীনভাবে তার ছবি প্রদর্শনও ইসলামে কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। এমতাবস্থায় টিভি, ভিসিআর-এর বর্তমান প্রেক্ষাপট সম্পর্কে ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি কী হতে পারে-এটা আর ব্যাখ্যার অপেক্ষা রাখে না।

ক) বর্তমানের নৈতিক অবক্ষয়, সামাজিক অবক্ষয়, অর্থনৈতিক অবক্ষয়ের যে সয়লাব দেশে চলছে এই প্রেক্ষাপটে বিনোদনের মাধ্যম হিসাবে টিভি, ভিসিআর এবং ডিশ এন্টিনাকে জাতীয় অবক্ষয়ের জন্য যথেষ্ট দায়ী বলে মনে করি।

খ) যে কোনো প্রাণীর ছবি ব্যতীত চাষাবাদ, উন্নয়নমূলক প্রতিবেদন, কল-কারখানার কাজ, প্রকৃতির সৌন্দর্যসহ জাতিগঠনমূলক ছবি ধারণ করে বাণিজ্যিকভাবে তার ব্যবহার সুফল বয়ে আনতে পারে।

গ) আগেই বলেছি, দেশ বা জাতীয় সংস্কৃতি আমার কাছে এক নাম্বার ফ্যাক্টর নয়। আমার কাছে এক নাম্বার ফ্যাক্টর হচ্ছে ইসলাম। দেশ হচ্ছে দ্বিতীয় নাম্বারে। তাই দেশীয় সংস্কৃতির যেটুকু ইসলাম কর্তৃক অনুমোদিত হবে তার বিকাশ ও প্রচার ভিসিআরসহ যে কোনো মাধ্যমেই হতে পারে।

ঘ) ভি.সি.আর, ডিশ এন্টিনার ক্রয়-বিক্রয় শুধু কঠোর আইন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হলেই চলবে না; বরং আইনের যথাযথ বাস্তবায়নও দরকার হবে।

ঙ) তরুণ-যুব সমাজকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দেওয়ার মতো অনেক ব্যবস্থাই আমদের দেশে রয়েছে। তার মধ্যে টিভি, ভিসিআর এবং ডিশ এন্টিনা অন্যতম। আমার মতে, এ ব্যাপারে সবচেয়ে বেশি দায়ী হচ্ছে আমাদের সরকারগুলো ও সরকারী আইনের শিথিলতা। কারণ স্বাধীনতার আগে বা পরে আজ পর্যন্ত আমাদের শিক্ষা কারিকুলামে নৈতিক অবক্ষয় দূর করার মতো কোনো পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা হয়নি। ফলে যুব সমাজকে নৈতিকতার দিকে আকৃষ্ট করার মতো কোনো ব্যবস্থাই আমাদের সরকারগুলোর পক্ষ থেকে কখনো গ্রহণ করা হয়নি। সরকারের দায়-দায়িত্বের পরে আমি মাননীয় অভিভাবকদেরকেই দায়ী করব। তাদের অবহেলা বা ভোগবাদী মানসিকতার কারণে তারা নিজেরা যেমন টিভি, ভিসিআর এবং ডিশে অশ্লীল কর্ম-কান্ড দেখাকে পরিত্যাগ করতে পারছেন না তেমনি নিজেদের তরুণ-তরুণী সন্তানদের জীবনকেও পঙ্কিল করে তুলছেন। উপরন্ত একে অবলিলায় সংস্কৃতি  বা  প্রকৃতিগত চাহিদার  বাস্তবায়নের নামে চালিয়ে দিচ্ছেন। তাই আমি মনে করি, এসবের জন্য সবচেয়ে বেশি দায়ী হচ্ছে সরকার ও অভিভাবকরাই। যুবসমাজের তারূণ্যকে সঠিক কাজে ব্যবহার করতে হলে সৎ সরকার ও সৎ অভিভাবকের প্রয়োজন সর্বাগ্রে। #

 

 

advertisement