সফর ১৪৩৪   ||   জানুয়ারি ২০১৩

আমাদের রাজ্যশাসন-৪

মাওলানা আবদুস সালাম কিদওয়ায়ী

(পূর্ব প্রকাশিতের পর)

 বদর যুদ্ধ (দ্বিতীয় হিজরী)

মদীনায় হিজরতের পর কিছুটা স্বস্তি ও আরাম মিলল। কিন্তু কুরাইশ কোনোভাবেই মেনে নিতে পারল না যে, মুসলমানরা কোথাও নিশ্চিন্তে ও নিরাপদে থাকুক। এজন্য তারা কখনো ইহুদীদেরকে মুসলমানদের বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে তুলত, আবার কখনো মুনাফিকদেরকে উস্কানি দিত। মোটকথা, তারা সবসময় কোনো না কোনো বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির অপচেষ্টায় লিপ্ত ছিল।

এসবে যখন কোনো কাজ হল না তখন তারা যুদ্ধের সিদ্ধান্ত নিল এবং এক বিশাল বাহিনী নিয়ে অগ্রসর হল। মুসলমানদের সংখ্যা তখন কতইবা ছিল! নবীজী কিছু মুহাজির ও কিছু আনসার সাহাবীকে নিয়ে রওনা হলেন। তাঁরা সংখ্যায় ছিলেন ৩১৩ জন। বদর পাহাড়ের প্রান্তরে দুপক্ষের লড়াই হল। মুসলমানগণ খুবই চিন্তিত ছিলেন। এত বিশাল বাহিনীর বিরুদ্ধে ৩১৩ জন কীইবা করতে পারে?! তাছাড়া তাদের অবস্থাও ছিল খুব শোচনীয়। তাদের না ছিল  বাহন, না ছিল হাতিয়ার। এমনকি পর্যাপ্ত সরঞ্জামও তাদের ছিল না। কিন্তু তারপরও আল্লাহর এই বান্দাগণ ছিলেন পূর্ণ আশ্বস্ত। তারা নির্দ্বিধায় যুদ্ধে নেমে পড়লেন আর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সিজদায় পড়ে রইলেন। কেঁদে কেঁদে দুআ করলেন আল্লাহর দরবারে। দুআ কবুল হল। আল্লাহ তাআলা মুসলমানদের সাহায্য করলেন। একদিকে মুষ্টিমেয় ভিনদেশী মুসলমান ও কিছু সাহায্যকারী। আর অন্যদিকে পূর্ণ মনোবলে উজ্জীবিত ও অস্ত্রেশস্ত্রে সজ্জিত কুরাইশ বাহিনী। ময়দান মুসলমানদের নিয়ন্ত্রণে থাকবে-এটা তখন কেই-বা ভেবেছিল?

কিন্তু কেউ আল্লাহর হলে আল্লাহও তার হয়ে যান। কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই কুরাইশ পুরাপুরি পরাজিত হল। তাদের বড় বড় নেতা মারা গেল। আবু জাহল-রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর শত্রুতায় যার ভূমিকা ছিল সবচেয়ে বেশি-নিহত হল। তাদের ৭০জন মুসলমানদের হাতে গ্রেফতার হল। তারা সবাই ছিল রাসূলের বড় শত্রু। মক্কায় তারা নবীজীকে অনেক কষ্ট দিয়েছিল এবং মুসলমানদের প্রতি অনেক জুলুম করেছিল। অন্য কেউ হলে চরম প্রতিশোধ নিত। কিন্তু রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছিলেন অতি দয়ালু। তিনি তাদেরকে সামান্য কষ্টও দেননি। এমনকি মুসলমানদেরকে সতর্ক করে দিলেন যেন তাদের কোনো কষ্ট না হয়। যাদের কাছে পরিধানের কাপড় ছিল না তাদেরকে কাপড় দিয়েছেন। সাহাবীগণ নিজেরা খেজুর খেয়ে দিন পার করলেও বন্দিদেরকে রুটি খাওয়াতেন। এভাবে কিছুদিন আরাম ও নিরাপদে রাখার পর মুক্তিপণ নিয়ে সবাইকে মুক্ত করে দেওয়া হল।

 

উহুদ যুদ্ধ (তৃতীয় হিজরী)

বদরে পরাজিত হওয়ার সংবাদ যখন মক্কায় পৌঁছল তখন ঘরে ঘরে শুরু হল শোকের মাতম। যাদের আত্মীয়-স্বজন মারা গেছে তারা সকলে একত্র হয়ে আবু সুফিয়ানের নিকট এল। তারও নিকটজন বদরে মারা গিয়েছিল। তাছাড়া ঐ সময় তিনি ছিলেন কুরাইশের সরদার। তাই মুসলমানদের প্রতিশোধ নেওয়া ছিল তার লক্ষ্য। তার আদেশে সকল কুরাইশের নিকট থেকে চাঁদা তোলা হল এবং এক মহাযুদ্ধের প্রস্ত্ততি শুরু হল। পরের বছর ৩ হাজার সৈন্য মদীনা অভিমুখে রওনা হল। এ বাহিনী উহুদ পাহাড়ের পাদদেশে পৌঁছে তাঁবু স্থাপন করল।

 

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিষয়টি জানতে পেরে সাহাবীদের সাথে পরামর্শ করলেন এবং এক হাজার সাথী নিয়ে মোকাবেলার জন্য বের হলেন। পথে মুনাফিকদের এক বিরাট অংশ দলত্যাগ করল। নবীজীর সাথে তখন মাত্র ৭০০জন রয়ে গেলেন। লড়াইয়ের সময় ঘনিয়ে এল। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পিছন দিকে-যেদিক দিয়ে কাফেরদের আক্রমণের প্রবল আশঙ্কা ছিল-পাহারার জন্য আবদুল্লাহ ইবনে যুবাইর রা.-এর নেতৃত্বে একটি দলকে নিয়োজিত করলেন। তাদেরকে বললেন, তোমরা এখানেই অবস্থান করবে। আমরা পরাজিত হই কিংবা জয়লাভ করি কোনো অবস্থাতেই তোমরা নিজেদের স্থান ত্যাগ করবে না।

 

এরপর তুমুল যুদ্ধ শুরু হল। মুসলমানগণ অত্যন্ত বীরত্বের সাথে যুদ্ধ করলেন।  কাফেররা পিছু হটল। এ অবস্থা দেখে পাহাড়ের পিছনের দিককার নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত তীরন্দাজ দলটি গনীমতের মাল সংগ্রহে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। তাদের স্থান ফাঁকা দেখে খালিদ বিন ওলিদ, যিনি তখনও ইসলাম গ্রহণ করেননি, সেদিক থেকে মুসলমানদের উপর আক্রমণ করে বসল। মুসলমানগণ গনীমত সংগ্রহে ব্যস্ত ছিলেন। তাই তাদের প্রতিহত করতে পারলেন না। ফলে অনেক মুসলমান শাহাদাত বরণ করলেন। এদিকে এই সংবাদও ছড়িয়ে পড়ল যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শহীদ হয়েছেন। এ সংবাদ শুনে মুসলমানদের মাঝে হতাশা ছড়িয়ে পড়ল এবং তাদের মনোবল ভেঙ্গে গেল। তবে অনেকের বীরত্ব ও সাহস আরো বেড়ে গেল। তারা সমানভাবেই যুদ্ধ চালিয়ে গেলেন। ইত্যবসরে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর প্রতি এক সাহাবীর দৃষ্টি পড়ল। তিনি মুসলমানদের ডেকে বললেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এখানে আছেন। এই ঘোষণা শুনে মুসলমানগণ প্রাণ ফিরে পেলেন। তারা সকলেই রাসূলের চারপাশে সমবেত হলেন। কাফেররা এ অবস্থা দেখে চতুর্দিক থেকে নবীজীকে ঘিরে ফেলল। কিন্তু মুসলমানগণ নিজেদের জীবন বাজি রেখে কাফিরদের প্রতিহত করলেন। হযরত আবু দুজানা আনসারী রা. কাফিরদের তীরবৃষ্টির সামনে নিজের শরীর পেতে দিলেন। তাঁর শরীর ঝাঁঝরা হয়ে গেল। হযরত তালহা রা. শত্রুর তলোয়ারের আঘাত নিজ হাত দিয়ে প্রতিহত করতে লাগলেন। এতে তাঁর হাত সম্পূর্ণ অকেজো হয়ে গেল। এভাবে সাহাবীগণ নিজেদের জীবন দিয়ে নবীজীকে রক্ষা করতে লাগলেন। এরপরও নবীজী আঘাতপ্রাপ্ত হন এবং জীবন উৎসর্গী সাহাবীদের সাথে পাহাড়ের চূড়ায় আরোহন করেন। আবু সুফিয়ান মনে করেছিল নবীজী নিহত হয়েছেন। সে একটি টিলায় চড়ে আবু বকর ও ওমর রা.কে ডাকতে লাগল। যখন সে জানতে পারল রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বেঁচে আছেন তখন বলল, এটি বদরের প্রতিশোধ। আগামী বছর বদর প্রান্তরে আবারো তোমাদের সাথে যুদ্ধ হবে। নবীজী সাহাবীগণকে বললেন, তাকে জানিয়ে দাও আমরাও এ প্রস্তাব গ্রহণ করছি।

এ যুদ্ধে ৭০ জন মুসলমান শহীদ হন। বদরের বন্দীদের সাথে মুসলিমগণ কত ভালো আচরণ করেছিলেন। কিন্তু কাফেরদের ব্যবহার ছিল খুবই মন্দ। জীবিতদের কথা বাদই থাক, মৃতদের সাথেও তারা হিংস্র আচরণ করল। মৃতদেহগুলো টুকরা টুকরা করল। নাক, কান কেটে ফেলল। পেট চিড়ে কলিজা বের করে চিবুতে লাগল। মোটকথা যত ধরনের মন্দ ও খারাপ আচরণ সম্ভব সবই তারা করল।

 (চলবে ইনশাআল্লাহ)

অনুবাদ : আবদুল্লাহ ফাহাদ

 

 

advertisement