শাওয়াল ১৪৩০   ||   অক্টোবর ২০০৯

একটি উজ্জ্বল নক্ষত্রের স্মরণে

মুহাম্মাদ হাসীবুর রহমান

আমরা সবাই জীবন-সফরে রয়েছি। কবে এই ক্ষণস'ায়ী সফর শেষ হবে আর চিরস'ায়ী জীবন কখন শুরু হবে আমরা কেউ জানি না। এটা একমাত্র আল্লাহ তাআলা জানেন। তিনি প্রত্যেক বান্দার জন্য একটি সময় নির্ধারণ করে রেখেছেন। তা যখন এসে যাবে তখন মৃত্যু থেকে কেউ রেহাই পাবে না। তবুও আমরা মৃত্যুর জন্য প্রস'ত থাকি না। এতে মৃত্যুর কিছু যায় আসে না। মৃত্যু নির্ধারিত সময়ে আসে এবং আসবে। এটাই চির সত্য। তবে যারা সত্যের প্রদীপ থেকে আলো গ্রহণ করে জীবনকে আলোকিত করেছে এবং কর্মের ময়দানে, চিন-ার জগতে ও চরিত্রের অঙ্গনে জ্যোতি ছড়িয়েছে তাদের জন্য মৃত্যু হল সত্যের সুসংবাদ। কারণ ক্ষণস'ায়ী জীবনে আল্লাহর সন'ষ্টি লাভের আশায় নিবেদিত থাকে তাদের দেহ-প্রাণ। মৃত্যুর মিলনে তারা অর্জন করে সেই অসীম সন'ষ্টি। এজন্যই মৃত্যু তাদের কাছে হয়ে ওঠে জীবনের চেয়ে প্রিয়। হয়ত ভূমিকাটি একটু দীর্ঘ হয়ে গেল। কারণ আমি আজ বলতে চাই একটি সুন্দর মৃত্যুর কথা এবং একটি সফল জীবনের কথা। দেশের মাটিতে জন্ম গ্রহণকারী এবং বিদেশের মাটিতে মৃত্যুবরণকারী এক তরুণ আলেমের জীবন-মৃত্যুর কথা। যিনি ইলম চর্চা ও জ্ঞান সাধনায় জীবন উৎসর্গ করেছিলেন এবং উজ্জ্বল নক্ষত্র হয়ে সবার মাঝে আলো ছড়িয়ে ছিলেন। গত ২৮ জানুয়ারি ’০৯ রোজ বুধবার তিনি ইনে-কাল করেন। তাঁর বিরল প্রতিভা ও ইলমী যোগ্যতা বিশেষ করে কায়রোতে বাংলাদেশী ছাত্রদের সামনে ছিল দীপ্তিমান। আমাকে যদি কেউ বলত বাংলাদেশী ছাত্রদের মধ্যে কে বেশি জ্ঞান ও গুণের অধিকারী? তাহলে আমি নির্দ্বিধায় তার নাম বলতাম। যারা আরো ঘনিষ্ঠ তারা তো বলতই। অন্যরাও বলত। যার বাস-ব প্রমাণ পেয়েছি মৃত্যু পরবর্তী এক আলোচনা সভায়। বিদেশের মাটিতে তিনি ছিলেন আমাদের সবার গর্ব। কাছে থেকেও জীবনের শেষ মুহূর্তে তাঁর পাশে থাকতে না পারায় খুব মর্মাহত হয়েছি এবং নিজেকে খুব অপরাধী মনে হয়েছে। হয়ত এভাবেই একদিন জীবনের সকল স্বপ্ন সাধ শেষ হয়ে যাবে পলকের মধ্যে। তাঁর মৃত্যুর দিন আমি ছিলাম মিশরের জাতীয় বইমেলায়। ভারতের এক আলেমের অনুরোধে সেদিন বই মেলায় যেতে হয়েছিল। মাগরিবের পর বই ক্রেতাদের ভীড়ে হঠাৎ দেখা হল আলজাজিরার একটি ছেলের সঙ্গে। সে কোনো ভূমিকা ছাড়াই কাঁদো কাঁদো স্বরে আমাকে সেই ভালো মানুষটির ইনে-কালের খবর শোনাল। আমি যেন আমার মৃত্যু সংবাদ শুনতে পেলাম। নিজের অজানে-ই মুখ থেকে বের হল, ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। এমন শোকাঘাত আমার জীবনে খুবই কম এসেছে। চোখের পানি ধরে রাখতে পারলাম না। নির্বাক হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। সংবাদদাতার হাতের স্পর্শে সম্বিত ফিরে পেলাম। চলে যাওয়ার সময় তার চেহারায় ছিল গভীর বিষন্নতার ছাপ। সেদিন বুঝতে পেরেছিলাম, মৃত্যু যেমন ভাষা ও ভূখণ্ড বিচার করে না, তেমনি প্রিয়জনের বিরহ বেদনাও স্বদেশী বিদেশী সকলকেই ভারাক্রান- করে। সাথের সেই ভারতীয় আলেম আমাকে অনেক সান-্বনা দিলেন এবং নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর এই অমর বাণী শোনালেন- যে ব্যক্তি ইলম অর্জনের উদ্দেশ্যে বের হবে সে ফিরে না আসা পর্যন- আল্লাহর রাস-ায় থাকবে। আমাদের পাশে বয়স্ক এক মিশরী দাড়িয়েছিলেন তিনিও পূর্ণ সমর্থন জানালেন এবং তা’যিয়া প্রকাশ করে বললেন, আল্লাহই একমাত্র চিরঞ্জীব। হয়তো জগতের ভালো মানুষদের মৃত্যু হলে অদৃশ্য থেকে সবার অন-রে বার্তা পৌঁছে যায়। তাই ভাষা ও ভূখণ্ডের বিভিন্নতা এবং অপরিচয়ের দূরত্ব থাকা সত্ত্বেও সবাই একই সাক্ষ্য বহন করে। গায়েব থেকে আমাকে যেন সতর্ক করা হল, এখনও কি তুমি অবহেলা করবে তার শিয়রে দাঁড়াতে? সবাইকে ছেড়ে আমি ছুটে চললাম প্রধান গেটের দিকে। একবার মনে হল আমার পা চলছে না। আবার মনে হল আমি যেন দৌড়ে অগ্রসর হচ্ছি। জীবনের শেষ নিঃশ্বাস যেখানে তিনি ত্যাগ করেছেন বই মেলা থেকে তা খুব নিকটে। সামান্য কয়েক মিনিটের পথ। এই সামান্য পথটুকু আমার কাছে মনে হল অনেক দীর্ঘ। রাতের আলো-অন্ধকারে গোটা প্রকৃতিকে আজ মনে হল বড় বিষন্ন। কারণ জগতের গাছপালা, পশুপাখি যে জানতে পারে ভালো মানুষের চলে যাওয়া। যখন পৌঁছলাম, তালিবুল ইলমের এক জামাত সেখানে দেখতে পেলাম। তাদের হৃদয়ের ঝড় চেহারায় স্পষ্ট ফুটে উঠেছে। আমরা কেউ কাউকে সান-্বনা দিতে পারলাম না। কারণ তিনি ছিলেন আমাদের সবার মধ্যমণি। আজ সকালে তিনি বলেছিলেন, ‘এটা তো মসজিদ। অনেক তালিবুল ইলম আজ এখানে জমা হবে তাই না!’ যারা পাশে ছিলেন তারা বুঝতে পারেননি। কীভাবে পারবেন, গায়েবের খবর তো কারো জানা থাকে না। সত্যিই আজ তালিবুল ইলমের নূরানী এক জামাত উপসি'ত হয়েছিলেন! তাঁর চোখের সামনে নয়, তার শিয়রে। যাদের চলে যাওয়ার সময় ঘনিয়ে আসে তারা হয়তো বুঝতে পারেন কিন' বুঝাতে পারেন না। কাছের একজন আমাকে জানালেন, সকাল বেলায় পাশের জানালার দিকে মুখ করে একদৃষ্টে অনেক্ষণ তাকিয়ে ছিলেন বাইরের সবুজ গাছটির দিকে। এরপর বললেন, সাদা পোশাক পরিহিত এখানে কারা আসা যাওয়া করছে? কাছে যারা ছিলেন তাদের ধারণা ছিল, রোগের প্রকোপে হয়তো তিনি এগুলো বলছেন। কিন' এ যে ছিল মৃত্যুর অতি নিকট পূর্বাভাস। মৃত্যুর মাত্র কয়েকদিন আগের ঘটনা। এক ভাই রাত দুইটার দিকে ঘুম থেকে উঠে দেখলেন, তিনি অসুস' অবস'ায়ও কাঁথা মুড়ি দিয়ে বসে উচ্চ স্বরে যিকর করছেন। আরেক ভাই একদিন অসুস'তার খবর নিতে গিয়ে দেখলেন, তাঁর ঘরের দরজা ভিড়ানো। ভিতর থেকে দুআ-দুরূদ পাঠ করার আওয়াজ ভেসে আসছে। বিশেষ করে আরবী === কুরআন মজীদের এই দুআ পাঠ করার আওয়াজ বেশি শোনা যাচ্ছিল। আর দুআর শেষাংশ বার বার তিনি উচ্চারণ করছেন। তাঁকে এ অবস'ায় পেয়ে তিনি আর ভেতরে ঢুকেননি। আল্লাহর প্রিয় বান্দা যারা তারা এভাবেই পবিত্র হয়ে দুনিয়া থেকে বিদায় নেন। তালিবুল ইলমের জামাতের সাথে ধীরে ধীরে সামনে অগ্রসর হলাম। সেই অতি পরিচিত ভালো মানুষটির শিয়রে এসে দাঁড়ালাম। তার মুখে ছিল মধুর হাসি। যিনি আজীবন মানুষের ভালবাসা পেয়েছিলেন আজ মৃত্যুকেও যেন তিনি জয় করে নিলেন। হাসপাতালের সবুজ শয্যায় তিনি ইনে-কাল করেছিলেন। বয়সে ছিলেন উদ্দীপ্ত তরুণ। ইলম চর্চা ছিল তার সাধনা। আর পরোপকারে ব্যস- ছিল তার জীবন। একদিন হঠাৎ জ্বরে আক্রান- হলেন। কমে বাড়ে এ অবস'ায় কয়েকদিন কেটে গেল। তার অসুস'তার খবর শুনে চারদিক থেকে সবাই ছুটে আসতে লাগলেন খোঁজখবর নেওয়ার জন্য। এতদিন যিনি অন্যের বিপদে পাশে দাড়িয়েছেন আজ অন্যরাও তার পাশে এসে দাড়াল মায়া-মমতা ও ভালবাসার বন্ধন নিয়ে। অনেকে তার শুশ্রূষা করলেন। একপর্যায়ে সেবা-যত্নের সুবিধার্থে তাকে নিজের বাসা থেকে আরেকটি বাসায় নিয়ে যাওয়া হল। চিকিৎসাও চলছিল। আর বাসার সবাই তার খেদমতে ছিল একনিষ্ঠ। কিন' অবস'ার কোনো উন্নতি না দেখে হাসপাতালে ভর্তি করা হল। হাসপাতালে একটি মাত্র দিন কাটালেন। এরপর রবের ডাকে সাড়া দিয়ে পরপারে চলে গেলেন। মনে হয়, জীবন দিয়েও কাউকে কষ্টে ফেলে যেতে চাননি। সবার ঋণ শোধ করে বিদায় নিলেন। এই সামান্য অসুস'তা থেকে এত অল্প সময়ের মধ্যে তিনি আমাদের ছেড়ে চলে যাবেন আমরা কল্পনাও করতে পারিনি। সবার চোখের সামনে দ্বীনের একটি প্রদীপ চিরদিনের জন্য নিভে গেল। অসুস'তা তো বাহ্যিক একটি কারণমাত্র। মানুষ নিজের মনকে সান-্বনা দেওয়ার জন্য তা স্মরণ করে। প্রকৃত বিষয় হল আল্লাহর ফয়সালা, যা তিনি নির্ধারণ করে রেখেছেন মানুষ পৃথিবীতে আগমন করার আগেই। হায়! আল্লাহর ফয়সালার কাছে মানুষ কত অসহায়! মৃত্যু এত সনর্-পণে আসে যে, কেউ বুঝতে পারে না। তার মৃত্যু ঠিক এভাবেই এসেছিল। তার পাশের কেউ জানতে পারেনি। বুঝতেও পারেনি। স্বাভাবিকভাবে চোখ বুজলেন আর মেললেন না। শান- বদনে চির শান- হয়ে ঘুমিয়ে রইলেন। ডাক্তার যখন এলেন ততক্ষণে জিসিমের সাথে রূহের বন্ধন শেষ হয়ে গেছে এবং আশা করি আখেরাতের শাহী মেহমান বনে গেছেন। কায়রো থেকে দাফনের ব্যাপারে তার পরিবারের মতামত চাওয়া হল। তারা যে মতামত পেশ করলেন তা যেন স্বর্ণ যুগের ইতিহাসকে স্মরণ করিয়ে দেয়। তার পিতার বক্তব্য ছিল এ রকম, সে ইলম অর্জনের জন্য সফর করেছে এবং এ পথে জীবন উৎসর্গ করেছে। তাই দিলের তামান্না আল্লাহর মুসাফিরের দাফন আল্লাহর রাস-ায় হোক এবং ইলমের সফর আখেরাতের সফরের সাথে মিলিত হোক। সত্যিই যেমন বাবা তেমনি তার যোগ্য ছেলে। মিশরের মাটিও যেন তার ‘মাটি’ বরণ করার জন্য প্রস'ত ছিল। একটি বেসরকারী সংস'া তার মৃত্যু খবর পাওয়া মাত্রই দাফনের যাবতীয় দায়িত্ব গ্রহণ করার আগ্রহ প্রকাশ করল। আসলে মাটির মানুষ যখন ভালো মানুষে পরিণত হয় তখন তারা মাটির অনেক বেশি আপন হয়ে যায়। কে না জানে, মিশর হল নবী-অলিদের ভূমি। পুন্যভূমিতে আজ তিনি এক পুন্যবান হয়ে শুয়ে রইলেন। পরদিন যোহরের পর আলআযহার-এর বিদেশী ছাত্রাবাসের পাশের একটি মসজিদে জানাযার নামায হল। বিভিন্ন দেশের অনেক মানুষ তার জানাযায় শরীক হয়েছিলেন। আর ভালো মানুষ যারা তাদের জানাযায় আসমানের নূরানী ফেরেশতারাও শামিল হন। আমি যেন চোখের সামনে আমার জানাযার দৃশ্য দেখতে পেলাম। জানাযার নামায শেষে যখন খাটিয়া গাড়িতে উঠানো হল তখন আমারও উঠতে ইচ্ছা হল। কিন' ব্যর্থ হলাম। তাকে যে কবরস'ানে রাখা হবে সেটা কায়রো শহর থেকে অনেক দূরে। ফলে অতিরিক্ত যে কয়টা মাইক্রোবাসের ব্যবস'া করা হয়েছিল তাতেও যাত্রী আগে থেকেই পূর্ণ ছিল। সবাই তাতে ঠাঁই পেলেন না। সেদিন হয়ত আমার জিসিমের উপর কারো দখল ছিল কিন' আমার মনের উপর কারো কর্তৃত্ব ছিল না। তাই শবদেহ যখন উঠানো হল আমিও তার সাথে উঠে চললাম, অন্যরাও চলতে লাগল। একসময় জানাযা কবরস'ানে পৌঁছে গেল। আগ থেকে কবর তৈরি ছিল। ধীরে ধীরে তাকে মাটির ঘরে নামানো হল। আমিও যেন তার সাথে নামলাম। পরিচিত দুআ পড়ে মাটিতে শোয়ানো হল। কবরের দরজা বন্ধ করা হল। সবাই এক মুঠো করে মাটি দিল। আমিও যেন তাদের সাথে এক মুঠো মাটি দিলাম। দাফন যখন সম্পন্ন হল এক মিশরী আসমানের দিকে হাত উঠালেন। অন্যরাও তার সাথে হাত উঠালেন। আমিও তাদের সাথে হাত উঠালাম। তিনি অনেক দুআ করলেন। সবাই আমীন বলল। আমিও বললাম। চোখের অশ্রুতে নিজে ভিজলেন, অন্যদের ভেজালেন। আমিও ভিজলাম। মনের পর্দায় আমার কবরের দৃশ্য ভেসে উঠল। আমাকেও তো একদিন এভাবে নিঃসঙ্গ কবরে রাখা হবে সেদিন কী হবে? সবাই ফিরে এলেন, শুধু একজন চিরদিনের জন্য রয়ে গেলেন। আমি বাস-ব জগতে ফিরে এলাম। মিশরের একটি বেসরকারী সংস'া ‘জামইয়্যাহ শারইয়্যা’-এর নিজস্ব কবরস'ান ‘সিত্তা অক্টোবার’ এলাকায় তাকে দাফন করা হল। ভেবেছিলাম, এখানেই লেখাটা শেষ করে দিব। কিন' কিছু স্মৃতি আমাকে বার বার নাড়া দিচ্ছিল। তাই কলমকে আবার সচল করতে হল। কিছুটা দায়িত্বের কারণে আর কিছুটা ...। সময়ের সে স্মৃতিচারণ করতে আমাকে যেতে হল বর্তমান ছেড়ে অতীতের দিকে। আমি দশ-এগারো বছর অতীতে চলে গেলাম। না, তাও হল না। আমাকে যেতে হল আরো বিশ-বাইশ বছর আগের অতীতে। যখন তিনি ছিলেন নিঃষ্পাপ শিশু এবং মায়ের কোল আলো করা ছোট্ট প্রদীপ। ১৯৭৬ সনের ফেব্রুয়ারি মাসে তার জন্ম। মা-বাবা আদর করে নাম রেখেছিলেন হেদায়াতুল্লাহ। (কায়রোতে তিনি হেদায়েত ভাই নামে সবার কাছে পরিচিত ছিলেন।) তার পিতার নাম ইজহারুল হক। তিনি স্কুল ও মাদরাসা দুটোতেই পড়াশোনা করেছেন। বর্তমানে দাওয়াত ও তাবলীগের কাজের সাথে জড়িত। ভাই বোনদের মধ্যে হেদায়েত ভাই ছিলেন পঞ্চম। দেশের বাড়ি কক্সবাজার জেলার মহেশখালী থানার মুন্সীর ডেল গ্রামে। অত্যন- ধার্মিক পরিবারে লালিত পালিত হয়েছেন। তাই শৈশব থেকেই দ্বীন ও ইলমের প্রতি তার বিশেষ আকর্ষণ ছিল। বাড়ির পাশের ‘হুসাইনিয়া আজীজুল উলূম’ মাদরাসায় তার পড়াশোনা শুরু হয়। জামাতে হেদায়াতুন্নাহু পর্যন- সেখানে পড়েছেন। এরপর পোকখালী ‘মাদরাসা ইমদাদিয়া আজীজুল উলূম’-এ শরহে বেকায়া জামাত পর্যন- পড়ালেখা করেন। তারপর জামেয়া ইসলামিয়া পটিয়ায় হেদায়া জামাতে ভর্তি হন এবং অত্যন- সুনামের সাথে দাওরায়ে হাদীস সমাপ্ত করেন। বেফাক বোর্ডে দাওরায়ে হাদীসে তিনি মেধা তালিকায় তৃতীয় স'ান অধিকার করেন। এরপরে পটিয়াতেই ভাষা ও সাহিত্য বিভাগে এক বছর অধ্যয়ন করেন এবং কৃতিত্বের সাথে পাশ করেন। ইতিমধ্যে তিনি মেধাবী ও যোগ্য ছাত্র হিসাবে প্রসিদ্ধি লাভ করেন এবং ইলম ও আমলের মাধ্যমে উস-াদদের মন জয় করে ফেলেন। তখন পটিয়া মাদরাসার মুহতামিম ছিলেন আল্লামা হারুন ইসলামাবাদী রাহ.। তিনি তাকে মাদরাসার মুদাররিস পদে নিয়োগ দেন। এখান থেকে তার সামনের দিকে পথ চলা শুরু হয়। পটিয়া মাদরাসায় দুই বছর শিক্ষকতা করেছেন। এরই মধ্যে অবাক করা ভাগ্য যেন তাকে হাতছানি দিল! আজ থেকে এগার বছর আগের কথা। হঠাৎ একদিন আল্লামা হারুন ইসলামাবাদী রাহ.-এর পক্ষ থেকে একটি সুসংবাদ এল। তিনি পাঁচজন মেধাবী তরুণ আলেমকে নির্বাচন করেছেন যাদেরকে উচ্চ শিক্ষার জন্য মিশরে পাঠাবেন। তারা আলআযহার বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আল্লাহর দ্বীনের জন্য ইলম অর্জন করবে। এদের মধ্যে আমাদের প্রিয় হেদায়েত ভাই-এর নাম ছিল। তিনি তো খুশিতে আত্মহারা। কেনই বা খুশি হবেন না! এ যে ইলমের জন্য আল্লাহর পথে সফর। সন'ষ্টচিত্তে তিনি এই সুযোগ গ্রহণ করলেন এবং পরিবার পরিজনের মায়া ত্যাগ করে সুদূর মিশরে চলে এলেন ইলমের জন্য। যিনি পাঠিয়েছিলেন তিনি আজ নেই, যাকে পাঠিয়েছিলেন সেও বিদায় নিয়ে গেছে। এভাবেই পৃথিবীর সবাই নেই হয়ে যাবে এখন কিংবা তখন। তবে যিনি অদৃশ্য থেকে সব কিছু অবলোকন করলেন তিনি সব সময় ছিলেন, আছেন এবং থাকবেন। সবাইকে তাদের কর্মের প্রতিদান দিবেন। হেদায়েত ভাই কায়রোতে আসেন ১৯৯৭ সনের ২৬ অক্টোবর। দীর্ঘ এগারো বছর আগের কথা আজ যখন আমি লিখতে বসেছি তখনও মনে হয়েছে তিনি শুধু ইলমের জন্যই মিশরে এসেছিলেন। তার কর্ম ও ব্যস-তা সামনে আনলে যেন আরো স্পষ্ট হয়ে যায়। তিনি প্রথমে আলআযহার বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘আদদিরাসা আলইসলামিয়া ওয়াল আরাবিয়া’ (ঋধপঁষঃু ড়ভ ওংষধসরপ ঝঃঁফরবং ধহফ অৎধনরপ) বিভাগে ভর্তি হন। এ বিভাগের নির্ধারিত চার বছরের কোর্স সমাপ্ত করেন এবং কৃতিত্বের সাথে পাশ করেন। এরপরে কায়রো ইউনিভার্সিটিতে মাস্টার্সে ভর্তি হন। যথাসময়ের মধ্যেই কোর্স পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। তার এম.ফিল থিসিসের শিরোনাম ছিল ‘উসলূবুল হিওয়ার ফী আহাদীসি সহীহিল বুখারী’ এটি একটি অভিনব বিষয়, যা তার সৃজনশীলতার সাক্ষ্য বহন করে। এরই মধ্যে কায়রোতে তার খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে। তিনি হয়ে ওঠেন দেশী-বিদেশী সবার প্রিয়পাত্র। বিভিন্ন দেশের ছাত্ররা তার নিকট থেকে ইলমী ফায়দা গ্রহণ করার জন্য উপসি'ত হতে থাকে। কেউ কেউ গবেষণাধর্মী লেখা, প্রবন্ধ অথবা থিসিস বিষয়ে তার সাথে পরামর্শ করতে আসত। তিনি তাদেরকে দিক-নির্দেশনা দিতেন। প্রয়োজনে কিতাবাদি নামসহ উল্লেখ করে দিতেন। নিজের কাছে থাকলে সেগুলো দিয়ে সাহায্য করতেন। এভাবে অনেকেই তার দিক নির্দেশনা কাজে লাগিয়ে সফল হয়েছে। অনেকের ক্ষেত্রে তিনি নিজেই সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন। বিশেষ করে যখন দেখতেন, কেউ হতাশায় ভুগছে, এত কষ্ট করে বিদেশে এসে পাশ করতে পারছে না, তিনি হাতে ধরে তাদেরকে পড়াতেন এবং পরীক্ষা শেষে দেখা যেত তারা ঠিকমতো পাশ করে গেছে। তার সাধ্যের মধ্যে যে কোনো ধরনের সহযোগিতা করতে তিনি কখনো পিছপা হতেন না। আরবী ভাষায় তার দক্ষতা এমন ছিল যে, মিশরে বিদেশীদের জন্য তাবলীগের যে মারকায রয়েছে তার দায়িত্বশীলরা তাকে অনুরোধ করলেন, গ্রীষ্মকালীন ছুটিতে আরবী ভাষার উপর দরস চালু করার জন্য। যাতে ইলম ও দাওয়াতের ময়দানে ছাত্ররা অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে পারে। তিনি এই অনুরোধের সম্মান রেখেছিলেন। মারকাযের পক্ষ থেকে সব ব্যবস'া করা হল। তিনি দরস দেওয়া শুরু করলেন। তার এই দরসে বিভিন্ন দেশের ছাত্ররা অংশগ্রহণ করত এবং অনেক উপকৃত হত। আমি যা দেখেছি এবং শুনেছি তাবলীগের সাথে সম্পর্ক হওয়ার পর তার শত ব্যস-তা থাকা সত্ত্বেও মারকাযের মশওয়ারাতে শরীক হতেন এবং বয়ানের সপ্তাহে হাজির হয়ে বয়ান শুনতেন। মারকাযের মুরব্বীদের কাছে তিনি ছিলেন শ্রদ্ধার পাত্র। বার বার তিনি বলতেন, তাবলীগে গিয়ে আমি অনেক কিছু শিখেছি, কিন' সবচেয়ে বেশি যা হাসিল করেছি তা হল ‘তাওয়াক্কুল আলাল্লাহ’। সুতরাং ‘তাওয়াক্কুল’ অর্জন করতে হলে বেশি বেশি তাবলীগে বের হও। কিছু তালিবুল ইলমের আবদারে একবার তিনি ‘তাফসীরে জালালাইন’-এর দরস দেওয়া শুরু করলেন। বিভিন্ন দেশের অসংখ্য তালিবুল ইলম এই দরসে শরীক হত। তার উপস'াপনার সহজতা এবং ভাষার প্রাঞ্জলতা ছাত্রদের আকৃষ্ট করত। ছাত্ররা তৃপ্ত মনে দরস থেকে বিদায় নিত। এই দরসের উপর ভিত্তি করে পরবর্তীতে একটি পুসি-কা রচনা করেছিলেন। তার লিখনী শক্তি ছিল খুব মজবুত। বেশ কয়েকটি কিতাব রচনা করে গেছেন। তার মধ্যে কয়েকটি হল, ‘আসারুল লুগাতিল আরাবিয়্যাহ ফিল লুগাতিল বাংগালিয়া’, ‘আল ইসলাম ফী শে’রি নজরিল ইসলাম’, ‘বাংলাদেশ মিন আকবারিল আওতানিল ইসলামিয়া ওয়া মা’সাতুল ইসলাম ফী দিয়ারিহা’। তার মঝে কাব্য প্রতিভাও ছিল। তিনি কয়েকটি অনবদ্য কবিতা রচনা করে গেছেন। কিছু কিতাবের তাহকীকের কাজে হাত দিয়েছিলেন, কিন' জীবন তাকে সঙ্গ দিল না। তাই সেগুলো অসম্পূর্ণই রয়ে গেল। কয়েকটার কাজ প্রায় শেষের দিকে ছিল। বাংলাদেশসহ মিশরের বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় তার লেখা সুনামের সাথে ছাপা হয়েছে। অনেক প্রবন্ধ-প্রতিযোগিতায় তিনি পুরস্কার পেয়েছেন। বাংলাদেশী ছাত্রদের নিয়ে তিনি অনেক ভাবতেন। তাদেরকে একই প্লাটফর্মে দাড় করানোর জন্য বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করেন। একপর্যায়ে কওমী ভাবাদর্শের অনুসারীদের একত্র করার জন্য প্রতিষ্ঠা করেন একটি অরাজনৈতিক সংগঠন। বর্তমানে যা ‘আযহারী এসোসিয়েশন বাংলাদেশ’ নামে পরিচালিত। যার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সুবিস-ৃত। বিশেষ করে আলআযহার থেকে শিক্ষা সমাপনকারী ছাত্রদের মাধ্যমে দেশ-বিদেশে ইসলামের দাওয়াত পৌঁছে দেওয়া, ইসলামী গবেষণা কেন্দ্র স'াপন করা, শিক্ষা-সংস্কৃতির উন্নয়নে যুগোপযোগী পদক্ষেপ নেওয়া, জনসেবামুলক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করা, ইসলাম সমর্থিত পন'ায় ব্যবসা-বাণিজ্য করে স্বাবলম্বী হওয়ার চেষ্টা করা এগুলো হল প্রাথমিক কার্যক্রম। তিনি এ সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছিলেন এবং আমৃত্যু এ দায়িত্ব সুনামের সাথে পালন করেছেন। এই সংগঠনের মাধ্যমে ছাত্রদের মাঝে এক নবজাগরণ সৃষ্টি হয়েছিল। এরপরে সম্মিলিত ঐক্য প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে তিনি অন্যদের সাথে মতবিনিময় করেন। তাদের সম্মতিক্রমে প্রতিষ্ঠা করেন ‘বাংলাদেশ স্টুডেন্টস অর্গানাইজেশন কায়রো’ নামে একটি সংগঠন। তিনি এই সংগঠনের প্রথম সভাপতি নির্বাচিত হন। এর ফলে মিশরে বাংলাদেশী ছাত্ররা একটি শক্তিতে পরিণত হয়। মৃত্যুর এই বছরটিতেও তিনি এ সংগঠনের সভাপতির দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন। বাংলাদেশী ছাত্ররা তার এই বিশাল অবদানকে শ্রদ্ধার সাথে আজীবন স্মরণ করবে। তার একটি বিশেষ গুণ ছিল। পরিচিত- অপরিচিত সবার সাথে আপন হয়ে কথা বলা। যে কেউ যে কোনো বিষয়ে তার সাথে খোলামেলা আলোচনা করতে পারত। আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের যুগে আমাদের ইলমী তারাক্কী কীভাবে হতে পারে এ সম্পর্কে একদিন তার সাথে আলোচনা করার সুযোগ হয়েছিল। তিনি আমাকে বিভিন্ন বিষয়ে দিক নির্দেশনা দিয়েছিলেন। বিশেষ করে একটি বিষয়ের উপর জোর তাগিদ প্রদান করেছিলেন। তার বক্তব্যের সারসংক্ষেপ হল, আমরা যেহেতু বিজ্ঞানের উৎকর্ষের যুগে বাস করছি তাই আমাদের প্রযুক্তি সম্পর্কে প্রয়োজনীয় জ্ঞান রাখতে হবে। বিশেষ করে যেগুলোর সাথে ইলম ও গবেষণার সম্পর্ক রয়েছে। কারণ ইসলামের শত্রুরা এগুলো ব্যবহার করে দ্রুত সমাজের মাঝে বাতিল ছড়িয়ে দিতে সক্ষম হচ্ছে। অতএব তাদেরকে প্রতিহত করার জন্য এবং সঠিক বিষয় মানুষের সামনে পেশ করার জন্য আমাদেরকেও তা অবলম্বন করতে হবে। উদাহরণ দিয়ে বলেন, বর্তমান যুগে কম্পিউটার ও ইন্টারনেট দ্বারা গবেষণার ক্ষেত্রে অনেক সুবিধা পাওয়া যায়। ইন্টারনেটের মাধ্যমে যেমন বিভিন্ন কুতুবখানা এবং দুষপ্রাপ্য ও বিরল কিতাব সম্পর্কে জানা যায় তেমনি আধুনিক খবরাখবর, সংশ্লিষ্ট বিষয়ের প্রবন্ধ ও প্রয়োজনীয় তথ্য সংগ্রহ করা যায়। আহলে বাতিল কিন' এটাকে কাজে লাগিয়ে তাদের উদ্দেশ্য হাসিল করে নিচ্ছে। সুতরাং আমাদের প্রাধান্য বিস-ার করতে হলে তাদেরকে তাদের পদ্ধতিতে ঘায়েল করতে হবে। তবে ইন্টারনেট ব্যবহারের ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রণ থাকা অবশ্যই জরুরি। কারণ অনেক মন্দ দিকও এতে রয়েছে। যেগুলো থেকে বেঁচে থাকা আমার-তোমার সবারই কর্তব্য। আমরা যদি ইলম চর্চা ও গবেষণার ময়দানে অন্যান্য উপায় উপকরণের সাথে এগুলো যুক্ত করে নেই তাহলে ইনশাআল্লাহ আমাদের খেদমত আরো অগ্রগামী হবে। তবে আফসোস আমরা অনেকেই এ বিষয়ে গুরুত্ব দেই না। আর যারা দিয়ে থাকি তাদের সবাই এর সঠিক ব্যবহার করি না। আল্লাহ তাআলা আমাদের সবাইকে সঠিক বুঝ দান করুন। এরপর সরাসরি আমাকেই প্রশ্ন করে বসলেন, তুমি কি ইন্টারনেট ব্যবহার করতে জান? ইন্টারনেট সম্পর্কিত আরো অনেকগুলো প্রশ্ন করলেন। আমি উত্তরে প্রথমে শুধু বললাম, এ বিষয়ে আমি একেবারেই অজ্ঞ। এরপর বললাম, কিছুদিন হল বাংলাদেশ থেকে এসেছি। আর সেখানে পরিবেশ ও সুযোগ পাইনি। তিনি বললেন, ঠিক আছে। এস, আমি তোমাকে প্রাথমিক কিছু শিখিয়ে দিচ্ছি। আমাকে তার কম্পিউটারের সামনে বসালেন এবং ইন্টারনেটের কয়েকটি প্রোগ্রাম বের করে দেখিয়ে দিলেন। বার বার এগুলো প্র্যাকটিস করতে বললেন। মূলত তিনি এ বিষয়ে জ্ঞান অর্জন করতে আমাকে উদ্বুদ্ধ করলেন। বড় হয়ে ছোটদের প্রতি এমন মহানুভবতা আমার জীবনে খুবই কম দেখেছি। ব্যস-তার কারণে হয়ত তিনি সামান্য সময় আমাকে দিতে পেরেছিলেন। কিন' সেটুকু পুঁজি করেই তো আমার সামনে চলা। হে আল্লাহ! তুমি তাকে এর উত্তম প্রতিদান দাও। যারা আমীন বলবে তাদেরকেও। এ মুহূর্তে আরো অনেকের অবদান আমার চোখের সামনে ভেসে উঠছে। আল্লাহ তাদের সবাইকে উত্তম বিনিময় দান করুন। আমীন। আদীব হুজুরকে তিনি মনে প্রাণে ভালোবাসতেন। তার চিন-া-চেতনার (যতটুকু জানতেন) পরিপূর্ণ সমর্থক ছিলেন। বিভিন্ন সময় আমার কাছে আদীব হুজুর সম্পর্কে জানতে চাইতেন। আমি ‘ছোট্ট’ মানুষ ‘বড়দের’ সম্পর্কে যতটুকু জানতাম বলার চেষ্টা করতাম। তার কাছে ‘পুষ্পসমগ্র’ ছিল না। আমার কাছে দেখতে পেয়ে খুব আগ্রহের সাথে সেটা হাতে নিলেন। তার হাতে নেওয়া দেখেই বুঝলাম, দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর আজ সাক্ষাত হল। তিনি আদীব হুজুরের লেখার প্রশংসায় পঞ্চমুখ ছিলেন। পুষ্পের ভূমিকাটি পড়ে খুবই অভিভুত হয়েছিলেন। মাওলানা আবদুল মালেক সাহেব সম্পর্কেও অনেক কিছু জানতে পেরেছিলেন। আলকাউসার পড়ে তিনি আশ্বস- হয়েছিলেন এবং এর প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেছিলেন। তার একান- কামনা ছিল ‘পুষ্প’ ও ‘আলকাউসার’ মিশরেও ছাত্রদের হাতে পৌছুক। যাতে তারা মাতৃভাষা চর্চায় ও সাহিত্য সাধনায় আত্মনিয়োগ করতে পারে এবং চিন-ার জগতে, ইলমের ময়দানে ও নফসের সংশোধনে উন্নতি লাভ করতে পারে। এ ক্ষেত্রে আযহারী এসোসিয়েশনের পক্ষ থেকে ব্যয়ভার গ্রহণ করার কথা বলেছিলেন। পরবর্তীতে কোনো কারণে তা সম্ভব হয়ে উঠেনি। তবে আল্লাহর সাহায্যের ব্যাপারে এখনো আমরা দৃঢ় আশাবাদী। তার অনেক গুণের মধ্যে একটি বিশেষ গুণ ছিল মেহমানদারী। এতে তিনি খুব আনন্দ পেতেন। বিদেশ ভূমিতে স্বাভাবিকভাবে মেহমানদারী করাতেন। কোনো সময় বাসায় মেহমানদের জন্য ব্যবস'া না থাকলে বাইরে থেকে ব্যবস'া করতেন। একবার তাবলীগের মারকায থেকে একটি দল তাশকীলের জন্য তার এলাকায় পাঠানোর সিদ্ধান- হল। তিনি নিজ থেকে তাদের মেহমানদারীর দায়িত্ব নিলেন। নিজ হাতে রান্না করে তাদের সামনে পরিবেশন করলেন। সাথীরা সবাই তৃপ্ত হয়ে খেলেন। আল্লাহর শোকরিয়া আদায় করলেন। মেহমানদের প্রতি তার আন-রিকতায় সবাই অবাক হয়েছিল। সেদিন দেখেছি, মেহমানদারী করে তিনি অন-রে কী সুখ অনুভব করতেন। স্বাভাবিক মেহমানদারী ছাড়াও বিভিন্ন সময় বিভিন্ন জনকে দাওয়াত দিতেন। অযোগ্য সত্ত্বেও আমাকেও অনেক সময় বাসায় দাওয়াত দিতেন। এমনভাবে বলতেন আর না করে পারতাম না। বিশেষ করে ‘সিদ্দীক আম’ নামে মিশরে এক প্রকার আম পাওয়া যায়। তিনি এই আম খুব পছন্দ করতেন। এই আম আসলে আমাকে ডাকতেন। আরো অনেককেই দাওয়াত দিয়ে আপ্যায়ন করতেন। মিশরের নতুন-প্রাচীন কুতুবখানা সম্পর্কে তার দীর্ঘ অভিজ্ঞতা ছিল। বিভিন্ন লাইব্রেরীর সাথে গভীর সম্পর্কও ছিল। বিষয় ভিত্তিক অনেক কিতাব তার মুতালাআয় ছিল। সব সময় তুরাসী ও গুরুত্বপূর্ণ কিতাবাদির খোঁজ খবর রাখতেন। কিতাবের কঠিন থেকে কঠিনতম ইবারতগুলো সহজে বুঝতে পারতেন। এক ভাই তার কিতাব মুতালাআর কথা বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন, এক বার হেদায়েত ভাই আমাকে বললেন, ‘কোনো কিতাব মুতালাআ যখন শুরু করি শেষ না হওয়া পর্যন- আর কিছু ভালো লাগে না।’ সাধারণত কিতাব মুতালাআর ক্ষেত্রে তার নিয়ম ছিল সারা রাত মুতালাআ করা এবং কঠিন ও জটিল কিতাবগুলো আগাগোড়া কয়েক বার পড়ে বিষয়গুলো আত্মস' করা। একটি আদর্শ পাঠাগার তৈরির খুব ইচ্ছা তার ছিল। অনেক কিতাব সংগ্রহও করেছিলেন। একবার উলূমুল কুরআন সম্পর্কে তার সাথে আলোচনা করেছিলাম। কথা প্রসঙ্গে বললেন, আমি উলূমুল কুরআন সম্পর্কিত কিতাবের একটি সূচি তৈরি করেছি প্রায় পঞ্চাশ পৃষ্ঠা ব্যাপী। মৌলিক কিতাবাদির দিক বিবেচনা করে দশ বারো পৃষ্ঠায় তার সারসংক্ষেপও করে রেখেছি। আমি শোনামাত্র এক নূসখা ফটোকপি করার জন্য আবেদন জানালাম। তিনি আশ্বাস দিয়েছিলেন। কিন' তাকদীর যেন সব কিছু উলট পালট করে দিল। তবে এখনো আশা ছাড়িনি। আল্লাহ তাআলা তাওফীক দান করুন। মৃত্যুর এক দেড় মাস আগের কথা। আমরা দুই তিন জন তাবলীগের মারকাযে তার পাশে বসা ছিলাম। তিনি হঠাৎ আমাদেরকে প্রশ্ন করলেন, এবার তোমরা বইমেলা থেকে কিতাব কেনার জন্য কে কত টাকা বাজেট করেছ? আমরা প্রত্যেকে যার যার বাজেটের অংক বললাম। শোনে বললেন, ঠিক আছে। দেখি তোমাদেরকে কিছু ব্যবস'া করে দিতে পারি কি না। বইমেলা শুরু হওয়ার আগে তিনি অসুস' হয়ে পড়লেন। এরপরও তিনি আমাদের কথা ভুলেননি। অসুস'তার মাঝে একদিন আমাদের একজনকে আফসোস করে বললেন, আমার খুব ইচ্ছা ছিল তোমাদের কিছু সহযোগিতা করার। কিন' অসুস'তার কারণে কিছুই করতে পারলাম না।’ আসলে জগতের ভালো মানুষ যারা তারা এমনই হয়ে থাকেন। কষ্টের মাঝেও তারা অন্যের সুখ কামনা করেন। হায়, তাকে যদি বলতে পারতাম, ‘এই না পারার আফসোস’ থেকে আমরা কি অনেক শিক্ষা গ্রহণ করতে পরিনি? অনেক কিছু অর্জন করতে পারিনি? অর্থ দিয়ে কী মানুষ সব কিছু শিখতে পারে? সব কিছু হাসিল করতে পারে? গতবার বইমেলায় প্রায় প্রতিদিন তিনি হাজির হতেন। যারা নতুন তাদেরকে বই চেনাতেন। কখনো নিজে বই পছন্দ করে দিতেন। আর বেছে বেছে নিজের পছন্দের বই সংগ্রহ করতেন। এ বছরও বইমেলা শুরু হল, কিন' তিনি হাজির হতে পারলেন না। অসুস'তার মাঝে একবার বলেছিলেন, আর একটু সুস' হলে বইমেলায় যাব এবং কিছু কিতাব কিনব, নতুন কোনো ভালো কিতাব এসেছে কি না খোঁজ খবর নিব। অবস'া যখন অপরিবর্তিত তখনও তিনি কিতাবের প্রতি হৃদয়ের টানে বলেছিলেন, ‘ইচ্ছা হয় মেলা কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিয়ে একটি গাড়িতে করে মেলার ভিতরটা ঘুরে আসি।’ যদিও সেটা কখনোই সম্ভব ছিল না। একথা তিনি নিজেও জানতেন, অন্যরাও জানত। তবুও তার মনকে মানাতে পারেননি। আসলে সারা জীবন যিনি ছিলেন কিতাবের রোগী, এই স্বল্প সময়ের শারীরিক ব্যাধি কি তাকে রুখতে পারে? ইলমের জন্য তিনি জীবনকে ফানা করে দিয়েছিলেন। দীর্ঘ এগারো বছরের অধিক সময় মা-বাবা, পরিবার-পরিজনের মায়া ত্যাগ করে মিশরের মাটিতে ইলম অর্জনের জন্য অবিরাম সাধনা করে গেছেন। একটি বারের জন্যও দেশে যেতে পারেননি। বৈবাহিক বন্ধন থেকেও নিজেকে মুক্ত রেখেছিলেন। শুধু তার সামনে ছিল দ্বীনী ইলম অর্জনের এক মহৎ সাধনা। ইলম পিপাসুদের জন্য তিনি ত্যাগ ও কুরবানীর উজ্জ্বল নমুনা হয়ে রইলেন। তার আশা ছিল, এ বছর মোটামুটি কাজ গুছিয়ে দেশে যাবেন। কাজ গোছালেন ঠিকই কিন' দেশের পথে নয়, আখেরাতের সফরে এবং যার জন্য ঘর ছেড়েছিলেন সেই মহান প্রভূর দরবারে। সত্যিই জীবন তার ধন্য হল। পবিত্র সফর থেকে চিরস'ায়ী সফর শুরু হল। যার প্রতিটি মুহূর্ত আমলনামায় আল্লাহর পথে থাকার ছওয়াব লেখা হবে এবং আশা করি, শহীদের মর্যাদা তাকে দেওয়া হবে। তার মৃত্যুতে আমরা হারিয়েছি একজন যোগ্য আলেম ও নিবেদিত গবেষককে এবং একজন পরম শুভাকাঙ্খী ও দায়িত্ববান মুরব্বীকে। আর জাতি হারিয়েছে তার এক যোগ্য সন-ানকে। তার আকস্মিক মৃত্যুতে আমরা সবাই শোকাহত। আল্লাহ তার শোকসন-প্ত পরিবারকে ও শুভাকাঙ্খীদেরকে সবরে জামিল অবলম্বন করার তাওফীক দান করুন এবং যোগ্য উত্তরসূরীর দ্বারা তার শূন্যস'ান পূরণ করুন। হে আল্লাহ! আমাদের প্রিয় মাওলানা হেদায়াত ভাইকে তুমি সুখে রেখো। তার কবরকে তোমার রহমতের বারিধারায় সিক্ত করো এবং তাকে জান্নাতুল ফিরদাউস দান করো। আমীন। তার জীবনের অনেক কিছুর মধ্যে সামান্য কিছু লেখা হল। এলোমেলোভাবে যা হৃদয়ে উদিত হয়েছিল। তার ভবিষ্যত পরিকল্পনা সম্পর্কে কোনো কিছু লেখা থেকে নিজেকে বিরত রাখলাম। কারণ এখন কথার চেয়ে কাজের লোকের প্রয়োজন অনেক বেশি। আল্লাহ তাআলা আমাদের সবাইকে তাঁর রাস-ায় কবুল করুন। আমীন।

 

advertisement