সফর ১৪৩৪   ||   জানুয়ারি ২০১৩

রোহিঙ্গা মুসলিম ও এ দেশে বসতকারী মগদের ব্যাপারে দ্বৈত নীতি কেন?

মাওলানা আবদুল্লাহ বিন সায়ীদ জালালাবাদী

 

সমাজতান্ত্রিক বিশ্বের একটা মশহুর  শ্লোগান হচ্ছে, ‘দুনিয়ার মজদুর এক হও!’ আর তথাকথিত গণতান্ত্রিক ধনতান্ত্রিক বিশ্বে একটি উদ্ধৃতি খুব বেশী ব্যবহৃত হয়-‘তোমার সাথে আমি একমত না হতে পারি, তবে তোমার মত প্রকাশের অধিকার রক্ষার জন্যে আমি প্রাণ দিতে পারি।’ কার্যত মুসলিমবিশ্বের দেড় শ‘ কোটি আদমসন্তানকে  এরা উভয় পক্ষই বাদ দিয়ে রেখেছে। অর্থাৎ ঐ দু’টো কথার বাস্তব রূপ হচ্ছে-‘দুনিয়ার মজদুর এক হও-তবে মুসলমান মজদুররা নয়।’ ‘তোমার মত প্রকাশের অধিকার রক্ষার জন্যে আমি প্রাণ দিতে পারি-যদি তুমি মুসলিম না হও।’ মুসলিম হলে তোমার মত কি তোমাদের হাজার হাজার লাখ লাখ লোকের প্রাণেরও কোন মূল্য আমার কাছে নেই! এমনকি তোমাদের কোনো রাষ্ট্রসত্তা, তোমাদের ঐতিহ্য, প্রত্নতত্ত্বও আমার কাছে মূল্যবান কিছু নয়! কার্যত পশ্চিমা বিশ্ব, হিন্দু ভারত ও প্রাচ্যের সমাজতান্ত্রিক বিশ্ব-সকলের মনোভাবই অভিন্ন। যতসব শ্রুতিমধুর বুলি, সভ্যতা-ভব্যতাবোধক বাণী সেগুলো কেবল অমুসলিমদের জন্যে প্রযোজ্য। কোনো মুসলিমসন্তান কোনোরূপ মানবীয় সহানুভূতি পাওয়ারও হকদার নয়।  এর নমুনা কমবেশী সকল যুগেই দেখা গেছে। ইদানীং তা আরো প্রকটভাবে সম্মুখে আসছে।

বর্তমান বিশ্বের  একক পরাশক্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় খ্রিস্টবাদী রাষ্ট্রগুলো তো সেই যে মধ্যযুগে ক্রুসেডযুদ্ধ শুরু করেছিল, তা আজো অবিশ্রান্ত গতিতে চলছেই চলছে!। এ যেন কিয়ামতের আগে আর শেষ হবার নয়। পাঁচটি পশ্চিমা রাষ্ট্র মিসরে হামলা চালিয়ে ১৯৫৬ সালে দেশটিকে তছনছ করে দেয়। ১৯৬৭ সালের যুদ্ধে ইস্রাঈল  মিসরের বিমান বাহিনীকে সম্পূর্ণরূপে অচল করে দেয়, সে দেশের সিনাই উপত্যকা ও আন্তর্জাতিক ধর্মীয় মর্যাদাপূর্ণ জেরুযালেম নগরীসহ ফিলিস্তীনের সিংহভাগ দখলে নিয়ে নেয়। ইতিপূর্বে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধশেষে বিশ্ব-মোড়লরা ফিলিস্তীনের আসল বাসিন্দাদেরকে ঘরছাড়া করে একেবারে মুসলিমবিশ্বের মধ্যিখানে বিষফোড়া রূপে ফিলিস্তীনের তেলআবিবে ইহুদীরাষ্ট্র কায়েম করে দেয়। তাদের এ জারজসন্তান দিয়ে এখন তারা গোটা মুসলিমবিশ্বকে সন্ত্রস্ত করে রাখছে! জর্দান, মিসর, লেবানন, ইরাক কোথায় বর্ষিত হয়নি ইস্রাঈলী বোমা? এখন ইরান ও

পাকিস্তানের আণবিক কেন্দ্রগুলো ওদের টার্গেট এবং তারা প্রকাশ্যে এ হুমকি দিয়েও যাচ্ছে! এতে জাতিসংঘের পক্ষ থেকে কোনো উদ্বেগ বা বাধাও নেই! ইরাক, আফগানিস্তান ও লিবিয়াকে রক্ষার নামে ওরা হাজার হাজার বার ঐসব দেশে বিমান হামলা চালিয়ে লাখ লাখ লোককে হত্যা করেছে এবং ঐসব দেশের প্রাচীন সভ্যতা ও আধুনিক প্রযুক্তিগত উন্নতিকে সম্পূর্ণ ধ্বংস করার প্রয়াস পেয়েছে এবং আজো পাচ্ছে! অথচ মুসলিমবিশ্বের প্রতি তারা সুন্দর সুন্দর বুলি কপচায়, অহরহ ওরা বন্ধুত্বের মুনাফিকী ভান করে যাচ্ছে! ইদানীং তারা বিশ্বমুসলিমের প্রিয়নবীর বিরুদ্ধে উস্কানীমূলক প্রচারণা চালিয়ে, ফিল্ম, কার্টুন প্রচার করে গোটা বিশ্বকে উত্তেজিত করছে এবং ওদেরকে আঘাত করার জন্যে প্ররোচিত করে যাচ্ছে! আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস, এর প্রতিক্রিয়াকে উপলক্ষ করে নতুনভাবে মুসলিমবিশ্বকে প্রত্যাঘাত করার অসৎ পরিকল্পনা এর পেছনে সক্রিয়। তাই আমাদের সতর্ক থাকতে হবে। এগুলো কোনো আকস্মিক ব্যাপার নয়। সুইডেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এমনকি সভ্য দেশ বলে প্রচারিত ফ্রান্সের প্রচার-মাধ্যমে যেভাবে দীর্ঘকাল ধরে এ জাতীয় হীন প্রচেষ্টা চালিয়ে যাওয়া হচ্ছে, আর তথাকথিত ব্যক্তিস্বাধীনতার নামে ঐসব রাষ্ট্রের দায়িত্বশীলরা যেভাবে ঐগুলো বন্ধ না করে ওগুলোর পৃষ্ঠপোষকতা করে যাচ্ছেন, তা রীতিমত লজ্জাজনক। মালয়েশিয়ান নেতা মাহাথির মুহম্মদ যথার্থই বলেছেন, ‘পশ্চিমাদের নৈতিকতার কাঠামো ধ্বংস হয়ে গেছে।’

ইদানীং আমাদের নিকট প্রতিবেশী মায়ানমারে রোহিঙ্গা মুসলমানদের উপর যে অমানুষিক নির্যাতন চলছে, তাকে বিশ্বসংস্থা ও অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল নিন্দা করছে এবং এজন্যে উদ্বেগ প্রকাশ করছে। কিন্তু লিবিয়ায় যারা গাদ্দাফীবিরোধীদেরকে যথারীতি যুদ্ধ করতে সর্বাত্মক সাহায্য করলেন, সিরিয়ার সরকার বিরোধীদের সাহায্যার্থে যারা যুদ্ধ প্রস্ত্ততি গ্রহণ করছেন এবং অপর মুসলিম রাষ্ট্র তুরস্ককে যুদ্ধের জন্যে প্ররোচিত করছেন, তারা মায়ানমারের সামরিক জান্তার মানবতাবিরোধী অপরাধের বিরুদ্ধে সেরূপ কিছু করার গরজ করছেন না কেন? যারা বৃহত্তম মুসলিমরাষ্ট্র্ ইন্দোনেশিয়াকে মাত্র পাঁচ লাখ খ্রিস্টানের জন্যে পূর্বতিমূর ছেড়ে দিয়ে স্বাধীন খ্রিস্টান রাষ্ট্র গড়ে দিতে বাধ্য করলেন, ষাট বছরেরও অধিককাল ধরে সংগ্রামরত এক কোটি কাশ্মীরীদের জন্যে সেরূপ করতে ভারতকে তারা বাধ্য করতে পারলেন না কেন? আজো তারা সে গরজ বোধ করছে না! আফ্রিকা মহাদেশের বৃহত্তম মুসলিম রাষ্ট্র নাইজেরিয়ার তেলসমৃদ্ধ দক্ষিণাংশকে বিচ্ছিন্ন করে একটি পৃথক খ্রিস্টান রাষ্ট্রের পত্তনই বা এত জরুরী বিবেচিত হলো কেন? যে পাকিস্তানের ঘাড়ে বন্দুক রেখে এতকাল মার্কিনীরা তাদের সুদীর্ঘকালের  প্রতিদ্বন্দ্বী পরাশক্তি রাশিয়া ও আফগানিস্তানে লড়াই চালিয়ে গেছে এখন তাকেই প্রতিদিন রক্তচক্ষু দেখিয়ে দেখিয়ে তার সীমান্তে তো নয় একেবারে তার ভূখন্ডের মধ্যে ওয়াজিরিস্তানে ড্রোন হামলা চালিয়ে প্রতিদিনই  ৫/১০ জন পাকিস্তানী নাগরিককে হত্যা করে চলেছে কেন? আমাদের তিনদিক ঘেরা বিশাল ভারত মুখে বন্ধুত্বের বুলি কপচিয়েও আবহমান কাল ধরে বহমান নদীগুলোর উজানে বাঁধ দিয়ে দিয়ে পানি প্রত্যাহার করে যে আমাদের টুঁটি চেপে ধরে রেখেছে এবং প্রতিদিনই সীমান্তে আমাদের নাগরিকদেরকে পাখীর মত গুলী করে মারছে এ নিয়ে বিশ্ব মোড়লরা নির্বিকার ও নির্বাক কেন? এ সব ‘কেন’-এর জওয়াব একটিই-মুসলমানরা মানুষ বটে, কিন্তু মানবাধিকার তাদের থাকতে নেই। এটা বিশ্বের তাবত কাফির-গোষ্ঠির সম্মিলিত অভিমত। এটা কোনো লিখিত চুক্তি না হলেও এটাই মুসলমানদের ভাগ্যলিপি। এজন্যেই বিশ্বের সবচাইতে সত্যবাদী ও   বাস্তববাদী মহাপুরুষ (তাঁর প্রতি কোটি কোটি সালাম ও রহমত বর্ষিত হোক) বলেছেন ‘‘বিশ্বের তাবত কাফির এক অভিন্ন জাতি।’’ এজন্যই ইসলাম ও মুসলিমবিরোধী সব কর্মকান্ডে তাদেরকে ঐক্যবদ্ধ দেখা যায়।

কক্সবাজার জেলার রামুতে দুঃখজনকভাবে বৌদ্ধদের উপর হামলা ও ভাংচুর হয়েছে। এটা নিন্দনীয় সন্দেহ নেই। যে কুরআন অবমাননার অভিযোগে এরূপ অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেছে, সে সম্পর্কে কিন্তু কেউ কিছু বলছেন না। সাম্প্রদায়িক হামলা সৃষ্টির উস্কানিদাতারা কি কোনো অংশেই কম দায়ী ?

আমাদের সরকার, বিরোধীদল ও বামপন্থী সমাজতন্ত্রী নেতারা এর বিরুদ্ধে যে চরম উৎকণ্ঠা প্রকাশ করছেন ও তৎপরতা দেখাচ্ছেন তা উত্তম সন্দেহ নেই, কিন্তু আজ রোহিঙ্গারা যে সমাজতান্ত্রিক মায়ানমারের আরাকান অঞ্চল থেকে বন্দুকের মুখে প্রাণরক্ষার উদ্দেশ্যে আমাদের মুসলিমপ্রধান দেশকে নিরাপদ আবাস ভেবে ছুটে আসছে, তাদেরকে আবার জেনে শুনে সেই মৃত্যুপুরীতে ঠেলে দেয়াটা কতটুকু যুক্তিযুক্ত হচ্ছে? এ ব্যাপারে আমরা কী করে উৎকণ্ঠামু্ক্ত থাকতে পারি? কেউ আমাদেরকে সাম্প্রদায়িক  বা গোঁড়া অনুদার বলে ফেলবে সে ভয়ে না হয় ইসলামী ভ্রাতৃত্বের  কথা ছেড়েই দিলাম , মানবীয় দায়িত্ব হিসাবে ঐ রোহিঙ্গা নিরীহ বাস্ত্তত্যাগী মুসলমানদের প্রাণরক্ষার অধিকারটুকু রক্ষাও কি আমাদের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে না? বন্দুকের মুখে ঘরছাড়া মানুষ কি আল্লাহর দুনিয়ায় আশ্রয় পাবে না? অথচ আমরা শান্তির জন্যে নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্ত জাতি! আমাদের প্রধানমন্ত্রীও আরেকটি শান্তি পুরস্কার নিয়ে আসুন সেটাও অনেকের কামনা! দেড় দু শ’ বছর আগে আমাদের দেশে এসে বসত শুরু করা রোহিঙ্গাদেরই এলাকার আরাকানী মগরা আমাদের এদেশের পূর্ণ সহানুভূতির হকদার, অথচ ঐ একই সময় থেকে যে বাংলাভাষী ও ইসলামঅনুসারীরা ঐ দেশে বসত করে আসছেন তাদেরকে সমুদ্রে ভাসিয়ে দেয়া বা গভীর বনজঙ্গল অতিক্রম করে এদেশের দ্বারপ্রান্তে এসে হুমড়ি খেয়ে পড়তে বাধ্য করা কি কম নিন্দনীয়? আমাদের সমাজতন্ত্রী দলগুলো এবং তাদের মন্ত্রীযন্ত্রী নেতারা কি এ ব্যাপারে আদৌ কোনো দায়িত্ব পালন করছেন? উল্লেখ্য, ঐ রোহিঙ্গারাও নেহাতই জেলে-মাঝি ও ভূমি মজুরশ্রেণীর লোক, কিন্তু মুসলমান হওয়ার অপরাধে তারা আমাদের সমাজতন্ত্রীদের সহানুভূতি পাওয়ার হকদার নন! তারা  তাদের সমাজতান্ত্রিক আদর্শের ভিত্তিতে রাখাইন দেশের মুসলমানদের উপর অমানুষিক অত্যাচারের প্রতিবাদ করতে পারেন না। একসময়ে বাঙ্গালীদের প্রতি অত্যাচারের জন্য বর্গী নামে কুখ্যাতদের জন্যে তাদের দরদেরই বা কী যুক্তি থাকতে পারে? ‘‘ছেলে ঘুমালো পাড়া জুড়ালো বর্গী এলো দেশে ...’’ কিন্তু আজো ওদের অমানুষিক অত্যাচারের কথা এদেশবাসীকে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে! আর সমাজতন্ত্রী বন্ধুরা অত্যাচারী মগ-বর্গীদের পক্ষে জোরালো ভূমিকা রাখলেও নিরীহ রোহিঙ্গা মুসলিমদের অনুকূলে কোনো কথা বলছেন না। তারা অত্যাচারীর পক্ষে দাঁড়াচ্ছেন, অত্যাচারিতের পাশে যাচ্ছেন না। সেটা কি কেবল এজন্যই যে, এই অত্যাচারিত গোষ্ঠী ইসলামে বিশ্বাসী? তারা যতই সাম্প্রদায়িকতা ও জঙ্গীবাদ জঙ্গীবাদ বলে তারস্বরে চীৎকার করুন না কেন, শাহজালাল, শাহ মখদূমসহ হাজারো ওলী-আবদালের হাতে হাত দিয়ে যাদের পূর্বপুরুষরা একদিন নাস্তিকতা ও পৌত্তলিকতা বিসর্জন দিয়ে ইসলামের সুশীতল ছায়াতলে আশ্রয় নিয়ে মানুষের মর্যাদা পেয়েছিলেন  অমানুষদের প্ররোচণায় তারা প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তাদের ধর্ম গ্রন্থ আল-কুরআনের মায়া ত্যাগে কোনোদিনই সম্মত হবেন না।

গোটা মুসলিম বিশ্বকে ঐক্যবদ্ধভাবে অত্যন্ত ঠান্ডা মাথায় প্রজ্ঞার সাথে তাবৎ মুনাফিকী মোকাবেলার উপায় বের করতে হবে।

আল্লাহ আমাদেরকে সে তাওফীক দান করুন। আমীন!!

 

 

 

advertisement