সফর-১৪৩৩   ||   জানুয়ারি-২০১২

পারিবারিক নির্যাতন : ওরও চারটি আঙ্গুল কেটে ফেলা হোক

আমাদের অস্থিমজ্জায় মিশে গেছে প্রান্তিকতা। তাই জীবনের কোনো ক্ষেত্রেই আমরা ভারসাম্যের পরিচয় দিতে পারছি না। অধীনস্তদের বৈশিষ্ট্য, অবাধ্যতা ও পরোয়াহীনতা। আর কর্তাদের বৈশিষ্ট্য, নির্যাতন ও চরমপন্থা। এ আসলে ভারসাম্যের ধর্ম ইসলামের শিক্ষা ত্যাগ করার পরিণাম।

গত ১৫ ও ১৬ ডিসেম্বর বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকে একটি সংবাদ গুরুত্বের সাথে ছাপা হয়েছে, যার সারসংক্ষেপ হল, নরসিংদী সরকারি কলেজের শিক্ষার্থী হাওয়া আক্তার জুঁইয়ের হাতের চারটি আঙ্গুল কেটে নিয়েছে স্বামী রফিকুল ইসলাম। দশম শ্রেণীতে পড়ার সময় মেয়েটির বিয়ে হয়। কিছুদিন পর স্বামী দুবাই চলে যায়। কলেজে ভর্তি হওয়ার প্রবল আগ্রহের কারণে স্বামীর অসম্মতি সত্ত্বেও বাবা তাকে কলেজে ভর্তি করেন। গত কয়েকদিন আগে স্বামী দেশে ফিরে আসে এবং কৌশলে ঢাকায় বোনের বাড়িতে এনে তার ডান হাতের চারটি আঙ্গুল কেটে নেয়।

এই বর্বরতার নিন্দা জানানোর ভাষা আমাদের নেই। যে নরপশু নিজের স্ত্রীর আঙ্গুল কেটে নিতে পারে তার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হওয়া অপরিহার্য। এ পাষন্ডের হয়ত শাস্তি হবে। কারণ ঘটনাটি মিডিয়ায় প্রচারিত হয়েছে। এটা এ জাতির দুর্ভাগ্য যে, বিচারের ক্ষেত্রে অর্থ-বিত্ত, মিডিয়া, সামাজিক প্রভাব এবং এ জাতীয় বাইরের চাপ এদেশে অতি গুরুত্বপূর্ণ। এরপরও প্রশ্ন হচ্ছে, বিচার হলেও কী বিচার হবে। জেল-জরিমানা হবে। কিছুদিন পর নিপীড়ক জামিনে মুক্তি পাবে। আবার সে সাহস করবে অপরাধ সংঘটনের। এ কারণে যারা বলেন, অপরাধ বিস্তারের জন্য আইন ও বিচারের প্রচলিত কাঠামোই বহুলাংশে দায়ী তাদের কথা আমাদের কাছে অযৌক্তিক মনে হয় না।

যথাযথ দলিল-প্রমাণ দ্বারা অপরাধী সাব্যস্ত হলে এ নরপশুরও হাতের চারটি আঙ্গুল কেটে নেওয়া হোক। আর তা কাটা হোক প্রকাশ্যে, শত শত মানুষের সামনে। এরপর মিডিয়ায় তা প্রচার করা হোক। যেন ভবিষ্যতে আর কোনো স্বামী তার স্ত্রীর উপর এ রকম নৃশংসতা চালানোর সাহস না করে। তবে আমরা শতভাগ নিশ্চিত, নারীর অধিকার রক্ষায় সোচ্চার ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানগুলোই এ দন্ডের প্রতিবাদে সবার আগে সরব হবে। তারা এখানে তুলে আনবে মানবাধিকারের প্রসঙ্গ। বর্তমান সময়ের মানবাধিকারের শ্লোগানই যে মানবাধিকারের সবচেয়ে বড় শত্রু তা তো এসকল দৃষ্টান্ত থেকেই বোঝা যায়।

তবুও আমরা বলব এবং বারবার বলব, একজন, দুজন নরপশুর উপর শরীয়তের কিসাস-বিধান (অঙ্গের ক্ষেত্রে অঙ্গ, প্রাণের ক্ষেত্রে প্রাণ) শরীয়তসম্মত পন্থায় কার্যকর করুন। শত শত নিরপরাধ নারী-পুরুষ বেঁচে যাবেন সম্ভাব্য অঙ্গহানী ও প্রাণহানী থেকে।

এ ঘটনা এবং এ জাতীয় ঘটনাসমূহের আরও কিছু দিক আছে, যা ভাবাবেগমুক্ত হয়ে বিবেচনা করা অতি প্রয়োজন।

এখানে আমরা দু টো প্রান্তিকতাই দেখতে পাচ্ছি। বিয়ের পর স্বামীর অনুগত থাকা স্ত্রীর কর্তব্য। শরীয়তসম্মত কারণ ছাড়া স্বামীর অবাধ্য হওয়ার সুযোগ নেই। মেয়ের বাবা মা ও অভিভাবকদেরও তা সর্বোচ্চ বিবেচনায় রাখা উচিত। তেমনি স্বামীর কর্তব্য, স্ত্রীর ন্যায্য অধিকার প্রদান করা। শরীয়তসম্মত কারণ ছাড়া তাকে বঞ্চিত করার সুযোগ নেই। আর নির্যাতন-নিপীড়নের সুযোগ না স্বামীর আছে, না স্ত্রীর; না স্বামীপক্ষের আছে, না  স্ত্রীপক্ষের। কিন্তু এখন অবস্থা সম্পূর্ণ বিপরীত। এখন স্ত্রী স্বামীর অবাধ্য হয় এবং এটাকেই মনে করে ব্যক্তিত্ব ও স্বাধীনতা। তেমনি স্বামী স্ত্রীকে নির্যাতন করে এবং এটাকেই মনে করে পৌরুষ ও গৌরব। আলোচিত ঘটনায় এ দৃশ্যই দেখতে পাচ্ছি। স্ত্রী কলেজে যেতে চায়, কিন্তু স্বামী তাতে সম্মত নয়। কেন সম্মত নয় তা তার বক্তব্য থেকেও বোঝা যায়। সে বলেছে, কলেজে পইড়া ওর চোখ-কান খুইল্যা গেছে। অনেক বন্ধু জুটছে। সে নাকি আমার মতো মূর্খ স্বামীরে ডিভোর্স দিব। তাই জিদ কইরা তার আঙ্গুলগুলা কাইটা দিছি। যাতে ও আর কারো কাছে গিয়া বিয়া বইতে না পারে। এই বিবরণ সত্য হলে ক্ষোভের কারণ বোঝা যায়। বিষয়টি নিয়ে আমাদের সমাজবিজ্ঞানীদের ভাবা উচিত।

আমরা যে কথাটি বলতে চাই তা হচ্ছে, মেয়েদেরকে অবশ্যই তাদের অবস্থান সম্পর্কে সচেতন থাকতে হবে। এটা তাদের নিজেদের স্বার্থেই। যে যাই বলুক, বিয়ের পর একজন নারী নিজের ইচ্ছেমতো চলতে পারে না। স্বামীর যুক্তিসঙ্গত ইচ্ছাকে মূল্য দেওয়া তার অবশ্যকর্তব্য। একজন স্বামী কখনো মেনে নিতে পারে না যে, স্ত্রী পরপুরুষের সাথে মেলামেশা করুক। একজন স্ত্রীও কি মেনে নিতে পারেন পরনারীর সাথে স্বামীর মেলামেশা। সুতরাং স্বামীর এ ইচ্ছা যুক্তিসঙ্গত এবং এই ইচ্ছার মূল্য অবশ্যই স্ত্রীকে দিতে হবে। নতুবা এ ধরনের সহিংসতার ঘটনা ঘটবেই।

এখানে আমরা ইসলামের পর্দা বিধানের প্রতি নারী-পুরুষ উভয়ের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই।

স্ত্রী যদি অবাধ্য ও বিপথগামী হয় তাহলে স্বামীকে বলা হয়েছে, আলোচনার মাধ্যমে তাকে সুপথে আনার চেষ্টা কর। স্বামী বুদ্ধিমান হলে অধিকাংশ ক্ষেত্রে আলোচনার দ্বারাই বিবাদ মিটে যায়। কিন্তু সাধারণত দেখা যায়, দাম্পত্যকলহ নিরসনের জন্য সোহাগ ও শাসনের যে পর্যায়ক্রম শরীয়তের পক্ষ থেকে দেওয়া হয়েছে তা অনুসরণ করা হয় না। অনুসরণ তো দূরের কথা, অনেকের জানাও নেই, কুরআন-সুন্নাহয় কত ফলপ্রসূ ও কার্যকর শিক্ষা এ বিষয়ে দেওয়া আছে। আমরা তো সবক্ষেত্রের মতো দাম্পত্য জীবনেও প্রবেশ করি দাম্পত্যের ইসলামী শিক্ষা ও বিধানগুলো না জেনেই।

কোনোভাবেই যদি স্বামী-স্ত্রীর মাঝে বনিবনা না হয় তাহলে সুযোগ আছে বিবাহবিচ্ছেদের। এক্ষেত্রে কুরআনের নির্দেশ, হয় বিধিমতো রাখ, নয় সুন্দরভাবে বিদায় দাও। (সূরা বাকারা : ২২৯)

কোনো অবস্থাতেই জুলুম-নির্যাতনের অবকাশ নেই।

পারিবারিক নির্যাতনের যে সকল ঘটনা আজ আমরা দেখছি তা থেকে মুক্তির একমাত্র উপায়, ঘরে-বাইরে ইসলামী শিক্ষার অনুসরণ ও বাস্তবায়ন। নতুবা এ ধরনের দৃশ্য দেখে যাওয়ার মানসিক প্রস্ত্ততি নিয়ে রাখতে হবে। আল্লাহ তাআলা সকলকে হেফাযত করুন। 

 

advertisement