মুহাররম-১৪৩৩   ||   ডিসেম্বর-২০১১

ট্রেনপথের ভালোমন্দের এক ঝলক

আবু তাশরীফ

 

ঈদুল আযহার চারদিন পর। সকাল সোয়া সাতটায় ঢাকা বিমানবন্দর রেলস্টেশন থেকে সিলেটগামী ট্রেন পারাবত-এ চড়ে বসলাম সপরিবারে। টিকেট কেটেছিলাম এরও দুদিন আগে। দুটি পূর্ণ ও একটি হাফ টিকেট। সব মিলিয়ে শোভন শ্রেণীর ভাড়া মাত্র চারশ টাকা। চড়া মূল্যের এই আকড়ার দিনে কম টাকা ভাড়ার ব্যাপারটিতে আমি খুবই আনন্দিত ও তৃপ্ত বোধ করলাম।

ট্রেনটি আধা ঘণ্টার মধ্যেই টঙ্গী পার হয়ে ছবির মতো গ্রামের পথে ঢুকে পড়ল। ট্রেনের ভেতরেও বিশেষ ভিড় ছিল না। হালকা শীতের সকাল। জানালা গলিয়ে রোদ আসছিল। ভালোই লাগছিল আমাদের। আমরা ছিলাম তিন জন। দুটি করে আসন মুখোমুখি ব্যবস্থা। এজন্য আমার পাশে অপর একজন যাত্রী বসেছিলেন। পোশাক-আষাক কেতাদুরস্ত। কিছু কথাবার্তাও হল তার সঙ্গে। তিনি এ পথে ট্রেনের প্রায় নিয়মিত যাত্রী। সকাল নয়টার দিকে তার গন্তব্যে পৌঁছে যাওয়ার কথা। ভাড়া মাত্র ষাট-পয়ষট্টি টাকা। এখনকার দিনে কম সময়েও এত কম টাকায় ঢাকা থেকে ওই গন্তব্যে পৌঁছে যাওয়ার বিষয়টি নিয়ে আমি কিছু উচ্ছ্বাস প্রকাশ করলাম। কিন্তু তার কথায় আমার উচ্ছ্বাসে বেলুন ফুটো হয়ে গেল। তিনি বললেন, আমরা টিকেট কাটি না, বিশ-পঁচিশ টাকা টিটিকে দিয়ে দেই। এতেই সিটে বসে আরামে যাওয়া যায়।

এরপর থেকে আমাদের কোচের (বগির) টিটির তৎপরতা লক্ষ করতে লাগলাম। দেখলাম কোচের গেটের কাছে দাঁড়ানো কয়েকজনের সঙ্গে দরদাম হচ্ছে তার। কখনো কখনো দেখলাম শোভন শ্রেণী থেকে কিছু যাত্রী উঠিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন অন্য কোথাও। খোঁজ নিয়ে জানলাম, টাকার বিনিময়ে এদেরকে চেয়ারকোচ (শোভন শ্রেণী থেকে একটু উন্নত) অথবা কেবিনে জায়গা করে দেওয়া হবে। সেসব কোচে নাকি আসন ফাঁকা পড়ে আছে। আমার মনে পড়ল, টিকেট কাটার দিন বহু চেষ্টা করেও চেয়ারকোচ অথবা কেবিনের টিকেট পাওয়া যায়নি। বলা হয়েছে, একটাও খালি নেই। অথচ ট্রেনে চড়ে দেখছি ভিন্ন দৃশ্য। ট্রেন একের পর এক নির্ধারিত স্টপেজে থামছে। তখন কিছু যাত্রী নামছেন তো কিছু যাত্রী আবার উঠছেনও। আমার আসনের আশেপাশেই এ রকম দৃশ্য কয়েকবার চোখে পড়ল যে, টিকেট ছাড়া যাত্রীকে টিটিই আসনের ব্যবস্থা করে দিলেন। এর পেছনে রহস্যটা কী-পাঠক নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন।

সিলেট থেকে ঢাকায় ফেরার সময়ও একই ঘটনা আরেকটু বিস্তৃত অবয়বে দেখলাম। যেদিন আসতে চাইলাম সেদিনের টিকেটই পাওয়া গেল না। তার পরের দিন সকালের টিকেটও খালি নেই। অতএব সেই পারাবত-বিকাল তিনটায় ছেড়ে আসার ট্রেন। এবং সেই শোভন শ্রেণী। ভালো কোনো কোচের আসন নাকি একটাও ফাঁকা নেই। যথারীতি ট্রেনে চড়ে বসলাম। ঘণ্টা দুয়েকের মধ্যে খাবার গাড়িতে (ভেতরের ক্যান্টিনে) যাওয়ার প্রয়োজনে পাঁচ-ছয়টা কোচ অতিক্রম করে দেখলাম, চেয়ার কোচের বহু আসন ফাঁকা। কোনো কোনো কোচে দাঁড়ানো কিছু যাত্রীকে দেখলাম টিটি এনে চেয়ারকোচে বসাচ্ছেন। অদ্ভুত লাগল বিষয়টি আমার কাছে। টিকেট কাউন্টারে বলা হয়, আসন খালি নাই। সেগুলো ইচ্ছা থাকলেও কেনা যায় না। ট্রেনে উঠে দেখা যায়, আসনগুলো খালি পড়ে আছে। সেগুলোতে বসছেন বিনা টিকেটের যাত্রীরা। এবং সেখানে টিটির সঙ্গে অবৈধ লেনদেনের ব্যাপারটাই চালু থাকছে। জিজ্ঞেস করায় আমাকে একজন যাত্রী বললেন, অবৈধ লেনদেনের টাকা টিটি থেকে কাউন্টার-সব জায়গায় বাটোয়ারা হয়। কাউন্টার থেকে বলা হয় টিকেট নাই (বিশেষ বিশেষ কোচ ও আসনের ক্ষেত্রে)। আর ট্রেনের মধ্যে টিটিরা সেসব আসন নগদ অর্থে বিক্রি করে। পরস্পরের প্রতি সহযোগিতার হাত তারা প্রসারিত রাখে। এসব তথ্যের বাস্তবতা কতটুকু যাচাই করা আমার পক্ষে সম্ভব হয়নি। কিন্তু মনটা নানা কারণে খারাপ হয়ে গেল।

কম ভাড়ায় স্বস্তির সঙ্গে যেখানে ট্রেনে চলাফেরার ব্যবস্থা রয়েছে, সেখানে এতসব অনৈতিকতার পথে না গেলে কি চলত না যাত্রীদের। রেল বিভাগের কর্মচারীরা (টিটি থেকে কাউন্টার পর্যন্ত) যদি এভাবে সমঝোতার ভিত্তিতে অসততা ধরে রাখে তাহলে এ বিভাগটির অস্তিত্ব টিকবে কিভাবে! যেসব যাত্রী স্বচ্ছল-সক্ষম তারাও কি নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে সড়ক পথের তুলনায় চার-পাঁচ ভাগের এক ভাগ ভাড়া দিয়ে ট্রেন-পথে চলতে পারেন না? ব্যাপারটা যদি এ রকম হয়ে যায় যে, যেখানেই অনৈতিকতার অবকাশ আছে, সেখানেই সুযোগ নিতে হবে-তাহলে তো বড়ই বেদনার কথা। এতে তো গুনাহর পাল্লা ভারি হবেই। ভালো সব পদ্ধতি বা নিয়ম-শৃঙ্খলাও ভেঙ্গে পড়বে। এতে শেষ পর্যন্ত অনৈতিক সুবিধা গ্রহণকারীরাও সংকটের মুখে পড়তে বাধ্য হবে।

সপরিবারে দীর্ঘ পথে বাসের সফরে অনেকেই উৎসাহী হতে পারেন না। বাসের দীর্ঘ সফরে কারো কারো মাঝে স্পর্শকারতাও দেখা যায়। এজন্য একটু স্বস্তি পেতে ট্রেনের সফরকে অনেকেই প্রাধান্য দেন। কিন্তু এ ট্রেন পথের অনৈতিক জঞ্জাল দূর করতে না পারলে এতে তো পদে পদে অস্বস্তি ও বিড়ম্বনার ব্যাপার থেকেই যাবে। রাষ্ট্রকে ঠকানোর খেয়ানতও তো বড় খেয়ানত। যাত্রী ও রেলকর্মচারী যারা এ খেয়ানতের সঙ্গে জড়িত তারা আসলে যে গাছের ডালে বসে আছেন সে গাছেরই গোড়ায় করাত চালাচ্ছেন। এটা বড়ই আত্মঘাতী।

আল্লাহর ভয় ও জবাবদিহির চিন্তা না করলে নিজেকে এবং নিজেদের স্বস্তি ও সুবিধাকে ধ্বংস করার এই করাত বন্ধ হবে না। 

 

 

 

advertisement