শাওয়াল ১৪৩০   ||   অক্টোবর ২০০৯

হজ্জ্বের সফরনামা: কিছু অনুভব-অনুভূতি

মাওলানা মুহাম্মাদ আব্দুল মালেক

আল্লাহ তাআলার মেহেরবানী যে, বা-বরকত সফরনামাটি দীর্ঘ দিন যাবত ধারাবাহিকভাবে আলকাউসারে প্রকাশিত হয়েছে। পাঠকবৃন্দের মতো অধমও নিজ যোগ্যতা অনুযায়ী তা থেকে গ্রহণ করার চেষ্টা করেছি। বহুবার মনে হয়েছে যে, সফরনামা থেকে আমি যে বিষয়গুলো আহরণ করেছি এবং পাঠকবৃন্দের যে অনুভব-অনুভূতি সরাসরি বা নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানতে পেরেছি তা সংক্ষিপ্তভাবে সবার সামনে পেশ করব। কিন' আজ কাল করতে করতে যখন সফরনামাটির শুভসমাপ্তিও হয়ে গেল তখন এই চিন-া আরো শক্তিশালী হল এবং কলম নিয়ে বসার তাওফীক হল। সকল প্রশংসা আল্লাহর এবং সকল কৃতজ্ঞতা তাঁরই জন্য। সফরের বিষয়ে মুসলিম জাতি, বিশেষত আমাদের পূর্বসূরীগণ সর্বদা অগ্রগামী ছিলেন। অন্য কোনো জাতিই এ বিষয়ে তাদের সমকক্ষতা অর্জন করতে পারেনি। কেননা, সফরের পার্থিব প্রয়োজন ও সফরের স্বভাবগত আকর্ষণ ছাড়াও বহু দ্বীনী ও ঈমানী প্রেরণা তাঁদেরকে এ বিষয়ে উদ্বুদ্ধ করেছে। স্বয়ং কুরআন হাকীম অতীত জাতি ও সমপ্রদায়ের পরিণাম থেকে শিক্ষাগ্রহণের জন্য ভ্রমণ করার আদেশ করেছে। তদ্রূপ ইলম ও ফিকহ অর্জনের জন্য, জিহাদের জন্য এবং হজ্বের জন্য সফরের তাকীদ করা হয়েছে। অতএব ভ্রমণের স্বাভাবিক আগ্রহের সঙ্গে যখন এইসব দ্বীনী ও ঈমানী প্রেরণা সংযুক্ত হল তখন অন্য কোনো জাতি এ বিষয়ে মুসলমানদের মোকাবেলা করবে তা কীভাবে সম্ভব হতে পারে? তবে সকল সফরের বিস-ারিত বিবরণ তো দূরের কথা, সংক্ষিপ্ত ইতিহাসও লিপিবদ্ধ হয়নি। আর তার প্রয়োজনও ছিল না। কেননা, যেটুকু আল্লাহ তাআলা সংরক্ষণ করেছেন তা অনাগত প্রজন্মের শিক্ষাগ্রহণের জন্য যথেষ্ট। ইতিহাস ও জীবনীগ্রন'সমূহে ছড়িয়ে থাকা সফরের ঘটনাগুলো সংকলন করা হলে শত খণ্ডের সুদীর্ঘ বিশ্বকোষ তৈরি হতে পারে। শুধু ‘আররিহলা’ বা ‘সফরনামা’ শিরোনামে বিভিন্ন ভাষায় যত গ্রন' রচিত হয়েছে তা কোনো প্রকার অতিরঞ্জন ছাড়াই হাজারের ঘর অতিক্রম করে যাবে। শুধু হজ্বের সফরনামা এবং আল্লাহর ঘরের মুসাফিরদের সফরের বিবরণই রয়েছে শত শত। এইসব সফরনামা সমসাময়িক ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ দলীল। প্রতি যুগের অতীত ও বর্তমানের বিস-ারিত বা সংক্ষিপ্ত বিবরণ এতে সংরক্ষিত হয়েছে। দ্বীনী ও ইলমী প্রসঙ্গের পাশাপাশি ভৌগোলিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক মোটকথা সব ধরনের ঐতিহাসিক তথ্যে এই সফরনামাগুলো কমবেশি সমৃদ্ধ। জীবনী ও ভ্রমণ কাহিনীর এই বিপুল ভাণ্ডার বাহ্যদর্শীদের নিকট শুধু ইতিহাসের বিষয়, কিন' চিন-াশীল ব্যক্তিদের নিকট তা আরো গভীর তাৎপর্য বহন করে। তারা এখান থেকে গ্রহণ করেন আদব ও আখলাকের পুঁজি এবং কলব ও রূহের গিযা। জোনায়েদ বাগদাদী রাহ. বলেন, ‘ঘটনাবলি হচ্ছে আল্লাহর সৈনিক, যার দ্বারা আল্লাহ তার বিশেষ বান্দাদের অন-রকে শক্তিশালী করেন।’ জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি নিম্নোক্ত আয়াত তেলাওয়াত করেন- ইমাম আবু হানীফা রাহ. বলেন, ‘আলিমদের বৈশিষ্ট্য ও ঘটনা আমার নিকট অনেক বেশি ফিকহের চেয়েও অধিক পছন্দীয়। কেননা তা সালাফের জীবন-সৌন্দর্য ও চরিত্র-সুষমার ধারক।’ এ প্রসঙ্গে প্রশ্ন করা হলে তিনি নিম্নোক্ত আয়াত তেলাওয়াত করেন, মুহাম্মাদ ইবনে ইউনুস রাহ. বলেন, ‘আমি নেককারদের আলোচনার চেয়ে কলবের জন্য অধিক উপকারী আর কিছু দেখিনি।’ সালাফের ঘটনাবলির উপরোক্ত সুফল সম্পর্কে অনেক মনীষী পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। হযরতুল উস-ায শায়খ আবদুল ফাত্তাহ আবু গুদ্দাহ রা. (১৩৩৬-১৪২০ হিজরী) ‘রিসাতুল মুসতারশিদীনে’র ভূমিকায় তাঁদের অনেক বাণী বরাতসহ উল্লেখ করেছেন। তাঁর এই গ্রন' অর্থাৎ রিসাতুল মুসতারশিদীনের টীকা, ‘সাফাহাত মিন সাবরিল উলামা আলা শাদাইদিল ইলমি ওয়াত তাহসীল’, ‘কীমাতুয যামান ইনদাল উলামা’ এবং ‘নামাযিজু মিন রাসাইলিল আইম্মাতি ওয়া আদাবিহিমুল ইলমী’ ইত্যাদি এই দৃষ্টিকোণ থেকেই রচিত ও সংকলিত হয়েছে। উদ্যমী ব্যক্তিদের জন্য এ প্রসঙ্গে করার মতো অনেক কাজের সুযোগ এখনও রয়েছে। মোটকথা, জীবনী ও সফরনামার সফল গ্রন'সমূহে তথ্য ও ইতিহাসের চেয়ে অধিক থাকে জীবন গঠনের উপাদান। সচেতন পাঠক তা থেকে গ্রহণ করতে পারেন সমষ্টিগত জীবনের নিয়মকানূন, চিন-ার বিশুদ্ধতা, আত্মার পরিশুদ্ধি ও হৃদয়ে উত্তাপ। আর এই উপাদানগুলো সবচেয়ে বেশি পাওয়া যায় হজ্বের সফরনামায় এবং বাইতুল্লাহর মুসাফিরদের ভ্রমণকাহিনীতে। বিশেষত আল্লাহর ঘরের মুসাফির যদি হন চিন-া, হৃদয় ও লেখনীর অধিকারী তাহলে তার রচনা অতীত উদাসীন লোকদেরও জাগ্রত করে দেয়। তাদের মৃত হৃদয়ে জাগে জীবনের কিছু স্পন্দন, আবেগ ও অনুরাগের কিছু উত্তাপ আর তাঁদের শুষ্ক চোখেও জাগে অশ্রুর সজীবতা। পাঠকবৃন্দের অনুভূতি এই যে, আলকাউসারে প্রকাশিত এই সফরনামায় উপরোক্ত সকল বৈশিষ্ট্যই বিদ্যমান। বস'ত, এটি কোনো সূক্ষ্ম তাৎপর্যগত বিষয় নয়; বরং ইন্দ্রিয় দ্বারা অনুভব করার মতো বিষয়। যে কোনো পাঠকই তা অনুভব করবেন। হযরত মাওলানা সাইয়েদ সুলায়মান নদভী রাহ. মাওলানা আবদুল মাজেদ দরিয়াবাদী রাহ.-এর ‘সফরে হিজায’ সম্পর্কে লিখেছেন, ‘আমার দৃষ্টিতে এই সফরনামার প্রকৃত পরিচয় ও মর্যাদা দুটি : এক. এর রচনা-কুশলতা। এতে সরল-সৌন্দর্য্যের সর্বোত্তম প্রকাশ ঘটেছে এবং সহজ সহজ শব্দ ও জটিলতাহীন সরল বাক্যমালার সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে কাব্যিক কল্পনা। তাই সাহিত্যের বিচারেও এর যথেষ্ট গুরুত্ব রয়েছে। দ্বিতীয় বিষয় হচ্ছে, গ্রনে'র প্রতিটি বাক্যে প্রকাশিত ভাব ও অনুভূতি; যেন হৃদয়বান লেখক তার হৃদয়কে শত টুকরা করে গ্রনে'র পাতায় পাতায় ছড়িয়ে দিয়েছেন। আমি একে হিজায-সফরের বরকত মনে করি যে, লেখকের কলম তাঁর কলবের এমন প্রতিনিধিত্ব করেছে এবং তাঁর রূহ বর্ণমালার ভাঁজে এমনই মূর্ত হয়ে উঠেছে যে, (হৃদয় ও আত্মার সকল ভাব) যা ছিল সুপ্ত ও অপ্রকাশিত তা যেন (আকার ধারণ করে) দৃষ্টির সম্মুখে দৃশ্যমান হয়ে উঠেছে। আমি আশা করি যে, তাঁর রচনাবলির মধ্যে তার কলমের এই সহজ সরল রচনাটিই সর্বাধিক স'ায়ী, সবচেয়ে উপকরী এবং সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য হবে। তিনি এর মাধ্যমে আমাদের ভাষা ও সাহিত্য, ইতিহাস, ভূগোল ও তাসাওউফ সকল বিষয়েই অনুগ্রহ করেছেন। বাহ্য-অবাহ্য, শব্দ ও মর্ম এবং দেহ ও আত্মার বিভিন্ন দৃশ্য এমনই নিপুণতায় অঙ্কন করেছেন যে প্রত্যেক চিন-া ও রুচির ব্যক্তি নিজ নিজ চিন-া ও রুচি অনুযায়ী তা থেকে গ্রহণ করতে পারবেন।’ হযরত মাওলানা সাইয়েদ আবুল হাসান আলী নদভী রাহ. লিখেছেন, ‘যদ্দুর মনে পড়ে, এটি ছিল মাওলানার প্রথম গ্রন', যা আমি আদ্যোপান- পাঠ করেছি অত্যন- আগ্রহ ও মনোযোগের সঙ্গে। আর মাওলানার শক্তিশালী লেখনী ও চিত্তাকর্ষক রচনাশৈলীর আবেশে, যাতে সাহিত্যের ছন্দ ও হৃদয়ের অনুভূতির অপূর্ব সম্মিলন ছিল দুলতে থেকেছি।’ স্বয়ং বাইতুল্লাহর মুসাফির ওই সফরনামা সম্পর্কে লিখেছেন, ‘‘এ কিতাব নিছক কোনো সফরনামা ছিল না, ছিল আল্লাহর ঘরে আল্লাহর এক প্রেমিক বান্দার জীবন- সফর, জীবন- হজ্ব এবং জীবন- যিয়ারত। অবশ্যই এ কিতাব ছিল একটি জাদু, তবে অন্যদের মতো আমি বলব না, কলমের জাদু। এটি ছিল প্রেম ও ভালবাসার জাদু এবং হৃদয় ও মহব্বতের কারিশমা। এটি ছিল ভাব ও আবেগের তরঙ্গ-উচ্ছ্বাস এবং হৃদয় ও আত্মার আলোক উদ্ভাস। কলম শুধু কালি ঝরিয়েছে এবং আলো ছড়িয়েছে। আর হৃদয় থেকে হৃদয় সে আলো গ্রহণ করেছে, আল্লাহ যাকে যতটুকু তাওফীক দান করেছেন। হযরত আলী নদভী রাহ. তাঁর জীবনের প্রথম হজ্বসফরে এ সফরনামা সঙ্গে রেখেছিলেন ভাব ও আবেগের উত্তাপে হৃদয়কে উত্তাপ রাখার জন্য এবং ইশক ও মহব্বতের তড়পে কলবকে বে-তাব রাখার জন্য।’’ যিনি আমাদের এই সফরনামা পাঠ করেছেন তাকে বলে দিতে হবে না যে, ‘সফরে হিজায’ সম্পর্কে উপরের তিন বুযুর্গ যা কিছু উল্লেখ করেছে তা আমাদের এই সফর নামা সম্পর্কেও অক্ষরে অক্ষরে সত্য। তবে পার্থক্য এই যে, যুগের অবক্ষয়ের কারণে ‘সফরে হিজাযে’র মতো সমঝদার পাঠক পাওয়া তার জন্য কঠিন। পাঠক যখন আমার মতো কেউ হয় তখন তো প্রতিক্রিয়া প্রকাশের ভাষাও ধার নেওয়া ছাড়া উপায় থাকে না। একজন লেখক আলিম আমাকে বলেছেন যে, ‘এই সফরনামায় ‘আদবিয়্যাত’ ও ‘রূহানিয়্যতে’র উত্তম মিলন ঘটেছে।’ আমার না আছে অনুভবের যোগ্যতা, না আছে প্রকাশের শক্তি। তবে যে কোনো পাঠকেরই পাঠ-প্রতিক্রিয়া থাকে। সে হিসেবে আমার মনে হয় রূহানিয়্যাতের একটি স্পষ্ট আলামত এই যে, এর প্রতিটি বাক্য অন-রে প্রভাব বিস-ার করে এবং চোখ অশ্রুসজল করে দেয়, যেন ‘হার চে আয দিল খীযাদ বর দিল রীযাদ’ এর দৃষ্টান-। আর আদবিয়্যাত বা সাহিত্যের বিষয়টা সাহিত্যিকরাই বলতে পারবেন। তবে এটুকু উল্লেখ করা যায় যে, এই সফরনামা সম্পর্কে ভিন্ন ধারার একাধিক লেখকের প্রশংসা আমি নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানতে পেরেছি। বেশ ক’জন লেখক-সাহিত্যিক মন-ব্য করেছেন যে, এর দ্বারা সফরনামা বিষয়ে বাংলাভাষায় যে শূন্যতা ছিল তা পূরণ হয়েছে। আল্লাহ তাআলার শোকর, এই শূন্যতা একজন আলিমের কলম দ্বারা পূরণ হল যখন সাধারণভাবে আলিমদেরকে এ অঙ্গণে নিতান- অপরিচিতই মনে করা হয়। এটা তো হচ্ছে ভাষা ও সাহিত্যের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের অনুভূতি। আমার অনুভূতি শুধু এটুকু যে, আমি আরবী ভাষায় ‘মুখতারাত’ শিরোনামে বেশ কিছু গ্রন' দেখেছি। সে হিসাবে আমার মনে হয়, কেউ যদি শুধু এই সফরনামা থেকে উত্তম সাহিত্যের নমুনা চয়ন করতে চায় তবে একটি স্বতন্ত্র গ্রন' রচিত হবে। সাহিত্য ও আধ্যাত্মিকতার এই সম্মিলনের কারণ এই যে, এর রচয়িতার মাঝেও কলম ও কলবের উত্তম সম্মিলন ঘটেছে। তিনি নিজেই কোনো এক প্রসঙ্গে লিখেছেন, ‘‘কলমের যা কিছু দান, তা রাব্বুল কলমের ইহাসন। কারণ মানুষকে তিনি শিক্ষা দান করেছেন কলমের মাধ্যমে। সুতরাং কলমের দান পেতে হলে তোমাকে যেতে হবে রব্বুল কলমের দুয়ারে, চাইতে হবে দু’হাত পেতে। শোনো বন্ধু! তুমি যদি শুধু কলম চালনা করো, তাহলে কলম তোমাকে পরিচালনা করবে কখনো এদিকে, কখনো সেদিকে, কখনো ঠিক পথে, কখনো ভুল পথে। কলমের অনুশীলনে তুমি শুধু লেখক হতে পারো, সাহিত্যের সাধক হতে পারো না। এজন্য প্রয়োজন কলমের সঙ্গে কলবের বন্ধন। কলম ও কলব, এ দুয়ের শুভ মিলনেরই নাম সাহিত্যের সাধনা। তুমি যদি হতে পারো এ দুয়ের মিলনক্ষেত্র তাহলে তুমি পেয়ে গেলে মহাসত্যের আলোকরেখা। তোমাকে করতে হবে না আর পথের সন্ধান। পথ নিজে ডাকবে তোমাকে। তুমি শুধু চলবে, সামনে আরো সামনে এবং পৌঁছে যাবে আলো ঝরণাধারার নিকটে। তোমার কলম থেকে ঝরবে আলোর শব্দ, আলোর মর্ম। কারণ লেখাতো কিছু না, শুধু রেখা, তাতে তুমি পাবে না সত্যের দেখা। জীবন সফরে কলমের পথে সত্যের দেখা যদি পেতে চাও তাহলে আগে, সবার আগে কলমের স্রষ্টার নৈকট্য অর্জন করো। হৃদয় যদি স্রষ্টার ডাকে সাড়া দিতে পারে, হৃদয় যদি সৃষ্টির সৌন্দর্যের বাণী শ্রবণ করতে পারে তাহলে তোমার সামনে পরম সত্যের প্রকাশ এবং সুপ্ত রহস্যের উদ্ভাস ঘটবে। তখন তোমার কলম জীবন- হবে, সৃজনশীল হবে। সাহিত্যের সাধনায় তুমি সফল হবে। তোমার সাহিত্য সত্য ও সুন্দরের এবং শুভ ও কল্যাণের ধারক হবে।’’ যিনি সাহিত্যকে এই দৃষ্টিতে দেখেন তার রচনার সাহিত্য মান কেমন হবে এবং তাতে আধ্যাত্মিকতা ও হৃদয়ের আবেগ-অনুভূতির কেমন সম্মিলন ঘটবে তা তো বলাই বাহুল্য। অন্যান্য প্রসঙ্গ আদবিয়াত ও রূহানিয়াতের উত্তম সম্মিলন ছাড়াও তা আরো অনেক বৈশিষ্ট্যের অধিকারী। ১. হযরত হাফেজ্জী হুজুর রাহ.-এর হজ্ব সফরনামা যদিও একে লেখকেরই হজ্বসফরনামা বলা হবে, কিন' প্রকৃতপক্ষে তা হচ্ছে হযরত হাফেজ্জী হুজুর রাহ. এবং সেসময়ের আরো কয়েকজন আকাবিরের হজ্ব সফরনামা। হাফেজ্জী হুজুর রাহ.-এর জীবনী রচনার কাজ ঠিক তেমনি অবহেলিত যেমন স্বয়ং হযরত হাফেজ্জী হুজুর রাহ. তাঁর জীবদ্দশায় অবহেলিত ছিলেন। আল্লাহর শোকর যে, এই সফরনামায় তাঁর জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য সংরক্ষিত হয়েছে। বিশেষভাবে হযরত রাহ.-এর বিচক্ষণতা ও দূরদর্শিতা এবং অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য প্রকাশিত হয়ে সামনে এসেছে। ২. খেলাফত আন্দোলনের ইতিহাস হযরত হাফেজ্জী হুজুর রা.-এর খেলাফত আন্দোলন বা তওবার রাজনীতি, যা এ অঞ্চলের ইসলামী দাওয়াত ও সিয়াসতের অত্যন- গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়, তারও সঠিক ইতিহাস আজ পর্যন- সংকলিত হয়নি। এই সফরনামায় এ আন্দোলনের কিছু অংশ এবং তার প্রেক্ষাপট ও কার্যকারণ অত্যন- সতর্কতার সঙ্গে অতি পরিমিত বাক্যে উল্লেখিত হয়েছে। ৩. সফরনামায় উল্লেখিত দেশগুলোর ধর্মীয় ও রাজনৈতিক ইতিহাসের কিছু অংশ, বিশেষত ইরাক ও ইরাকের প্রেসিডেন্টের জীবন ও ইতিহাসের কিছু বিস্মৃত অধ্যায় এতে উল্লেখিত হয়েছে। সফরনামায় বিভিন্ন ব্যক্তি, দল বা দেশ সম্পর্কে যে পর্যবেক্ষণ বা প্রতিক্রিয়া উল্লেখিত হয়েছে সে সম্পর্কে লেখকের রুচি, পর্যবেক্ষণ ও দ্ব্যর্থহীনতা আমার মতে সাইয়েদ আবুল হাসান আলী নদভী রাহ.-এর সঙ্গে তুলনীয়। আর এমন হওয়াই স্বাভাবিক। কেননা, লেখক যে বুযুর্গ মনীষীদের চিন-া ও হৃদয়ের উত্তরাধিকারী তাঁদের মধ্যে হযরত আলী মিয়াঁ রাহ. অন্যতম। ‘মুযাককিরাতু ছাইহিন ফিশ শারকিল আরবী’ গ্রনে'র ভূমিকায় আলী মিয়াঁ রাহ. লেখেন, ‘এ রচনায় লেখকের নীতি এই যে, আলোচনা ও অভিজ্ঞতা বর্ণনার ক্ষেত্রে নিজের চিন-া ও অনুভূতি সম্পূর্ণ উল্লেখ করা হবে এবং ঘটনা থেকে যে প্রতিক্রিয়া বা অনুভূতি হয়েছে তা কোনো অস্পষ্টতা ও সতর্কতা এবং কোনো আশ্রয় নেওয়া ছাড়া দ্ব্যর্থহীন ভাষায় লিপিবদ্ধ করা হবে। এটা একজন জীবন- মানুষের চিত্রণ, যার বুকে একটি হৃদয় রয়েছে এবং যার কিছু নীতি, বিশ্বাস ও মূল্যবোধ রয়েছে। যার রয়েছে এই দেশগুলোর সঙ্গে ভালবাসার সম্পর্ক এবং এই ভূখণ্ডের অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যতের সঙ্গে যে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। যে নিজেকে এই খানদানেরই একজন সদস্য বলে মনে করে এবং তাদের আনন্দ-বেদনা এবং সফলতা ও ব্যর্থতা সকল বিষয়ে নিজেকেও শরীক মনে করে। আর যার বিশ্বাস এই যে, ইসলামই সকল কিছুর মাণদণ্ড। কর্ম ও চরিত্র এবং ব্যক্তি ও ব্যক্তিত্ব সকল কিছুই এই মাণদণ্ডে পরিমাণ করা উচিত। এটি এই গ্রনে'র এমন এক বৈশিষ্ট্য, যার জন্য লেখকের কোনো ওযরখাহীর প্রয়োজন নেই। অতঃপর এই দেশগুলো থেকে প্রত্যাবর্তনের সময় সে বিদায়ী দৃষ্টিতে তাদের অবলোকন করে এবং তাদের গুণাবলি ও দুর্বলতা দুটোই উল্লেখ করে। যে বিষয়গুলো তার কাছে ভালো মনে হয় এবং যা তাকে দুঃখিত করে, যে বিষয়গুলোকে সে এই দেশের ভবিষ্যতের জন্য আশঙ্কাজনক মনে করে এবং যা তার কাছে অরুচিকর ও স্বভাববিরোধী মনে হয় সবই কোনো হ্রাস-বৃদ্ধি ছাড়া পূর্ণ আমানতদারীর সঙ্গে উল্লেখ করে। এ প্রসঙ্গে সে ভ্রূক্ষেপ করে না যে, এটা তার বন্ধুদের ভালো লাগবে, না তাদের কষ্টের কারণ হবে। কেননা, একজন আরব কবি বলে গেছেন যে, ‘অভিযোগ ও ... প্রকাশ হল জীবন- ও অনুভূতিশীল জাতির পরিচয়।’’-শারকে আওসাত কী ডায়েরী পৃ. ২৩ আমার নাকিস খেয়াল এই যে, সফরনামার পর্যবেক্ষণ ও প্রতিক্রিয়াগুলোতেও উপরোক্ত বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান। ৪. প্রাসঙ্গিক বিভিন্ন বিষয় ‘মাদরাসাতুল মদীনা’য় অনুষ্ঠিত লেখকের পাক্ষিক মজলিস সম্পর্কে আমি একবার আরজ করেছিলাম যে, ‘এই মজলিসগুলোর সুফল হচ্ছে তাহযীবুল আখলাকি ওয়াল আদাব, তাহযীবুল আফকার ও তাহযীবুল লিসান।’ (অর্থাৎ ভাষা, চিন-া ও আচরণের পরিশুদ্ধি) পরে যখন ‘সফরনামা’ শুরু হল তখন দেখলাম তাতে উপরোক্ত তিন বৈশিষ্ট্য পূর্ণমাত্রায় বিদ্যমান। চতুর্থ বিষয় ‘ইকাযুল হিমাম ওয়া তাশহীযুল জিনান’ সাহসিকতা ও হৃদয়ের উত্তাপ সৃষ্টির প্রচেষ্টা। আর তার কারণ হল লেখক নিজে দিলে দর্দেমন্দ, ফিকরে আরজমন্দ ও যবানে হূশমন্দ অর্থাৎ দরদী দিল, সমুন্নত চিন-া ও প্রজ্ঞাপূর্ণ ভাষার অধিকারী। অতএব তাঁর রচনায় এই বৈশিষ্ট্যসমূহের প্রতিফলন থাকা খুবই স্বাভাবিক। কোনো তালিবে ইলম যদি তা মনোযোগের সঙ্গে পাঠ করে তবে তা থেকে ‘আদাবুল ইলম’ ও ‘আদাবুল মুতাআল্লিমীন’ বিষয়ে এমন গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আহরণ করতে পারবে যা বর্তমান সময়ে হয় একেবারেই বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছে কিংবা দুষপ্রাপ্য তো বটেই। কোনো ইনসান যদি তা শিক্ষা গ্রহণের নিয়তে পাঠ করে তবে ‘আদাবুল মুআশারা’ ও ‘আদাবে ইনসানিয়াতে’র এমন অনেক দিক তার সামনে উন্মোচিত হবে যা আমাদের সমাজে চরমভাবে অবহেলিত। কেউ যদি তা থেকে উন্নত চিন-ার শিক্ষা গ্রহণ করতে চায় তবে তার অসংখ্য দৃষ্টান- বিদ্যমান রয়েছে। কেউ যদি ভাষা ও সাহিত্যের পুঁজি সংগ্রহ করতে চায় তবে তো তা আদ্যোপান- এই বিষয়েরই জন্য। কেননা, এর সাহিত্যমান এর একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য। এতে আরো আছে হৃদয় জগতের পরিচর্যা ও পরিশুদ্ধির বহু উপাদান। বস'ত ‘রূহানিয়াত’ হচ্ছে এই রচনার সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য। আদাবে মুতাআল্লিম প্রসঙ্গে এই সফরনামার সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য আমার মতে তালিবে ইলমদের এই চিন-াগত তরবিয়ত যে, উস-াদের সঙ্গে তার শুধু নিয়মের সম্পর্ক না হয়ে ভক্তি ও ভালবাসার এবং আস'া ও আনুগত্যের সম্পর্ক হওয়া উচিত এবং উস-াদের সঙ্গে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রক্ষা করে চলা উচিত। আদাবে ইনসানিয়াত বা মনুষ্যত্ব বিষয়ে কৃতজ্ঞতা ও মায়ের প্রতি ভালবাসার যে প্রেরণা জাগ্রত করার চেষ্টা করা হয়েছে তা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। মনোজগতের পরিচর্যার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিষয়সমূহের মধ্যে তাওহীদ, তাফবীয, রিযা বিল কাযা এবং মহব্বত ও তাওয়াক্কুলের সবক বিশেষভাবে গ্রহণীয়। চিন-াগত ক্ষেত্রে দায়িত্বের অনুভূতি, কর্তব্য সচেতনতা, মানুষের সম্পদের প্রতি আকর্ষণহীনতা এবং বিত্তশীল ও ক্ষমতাশালীদের সঙ্গে সম্পর্কের রীতি ও ধরন ইত্যাদি বিশেষভাবে লক্ষ্যণীয়। আদাবুল মুআশারা প্রসঙ্গে পাত্র অনুযায়ী আচরণ এবং চাল-চলন ও কথাবার্তায় প্রজ্ঞা ও সতর্কতা রক্ষা অত্যন- গুরুত্বপূর্ণ। বুলন্দ হিম্মতীর শিক্ষার মধ্যে এই সফরনামায় ‘জিহাদের জযবা’ অর্জন করা হচ্ছে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ। আমার ইচ্ছা হচ্ছিল উপরোক্ত সকল বিষয়ের কিছু দৃষ্টান-ও সফরনামা থেকে তুলে দেই, কিন' শুধু এজন্য তা থেকে বিরত থাকছি যে, প্রত্যেক বিষয়েই এত অধিক দৃষ্টান- এতে রয়েছে যে, অতঃপর নির্বাচন করা অত্যন- কঠিন কাজ। পক্ষান-রে সকল দৃষ্টান- উল্লেখ করাও সম্ভব নয়। যার পুরোটাই সারবস' তা থেকে কি চয়ন করা সম্ভব! হজ্ব ও যিয়ারত হজ্ব ও যিয়ারত তো সফরনামার মূল বিষয়। যে রচনায় প্রাসঙ্গিক বিষয় এত রয়েছে তাতে মূল বিষয়ে কত কিছু থাকবে তা তো বলাই বাহুল্য। সংক্ষেপে বলা যায় যে, হজ্ব ও যিয়ারতের ইসলামী ফালসাফা এবং এর প্রতিটি আমলের রহস্য ও তাৎপর্য সম্পর্কে এ পর্যন- যা কিছু লিখিত হয়েছে তার উত্তম অংশ এবং আরো কিছু ইলহামী সংযোজন এতে এসে গেছে। পার্থক্য এই যে, অন্যান্য কিতাবে এই বিষয়গুলো উল্লেখিত হয় তাৎপর্য আকারে আর এতে তা এসেছে বাস-ব অভিজ্ঞতারূপে। এদিক থেকে এই সফরনামা আল্লাহ তাআলার অনেক বড় নেয়ামত যে, এর মাধ্যমে হজ্বের মতো বুনিয়াদী আমলে রূহ পয়দা করার, খুশু-খুযূ এবং ইহসান ও ইহতিসাব পয়দা করার প্রচুর উপাদান অত্যন- সহজভাবে সন্নিবেশিত হয়েছে। প্রসঙ্গত নামায, যিকর ও দুআর মতো আমলসমূহেও এই অনুভূতি পয়দা করার বাস-ব দৃষ্টান- সামনে এসেছে। এই দিক থেকে আমি একে একটি আসমানী তোহফা মনে করি, যা আল্লাহ তাআলা লেখকের মাধ্যমে বাংলা ভাষাভাষীদেরকে দান করেছেন। এ প্রসঙ্গে গোটা সফরনামায় কিছু বিষয় বারবার এসেছে এক. সকল আমলের তাৎপর্য অনুধাবন করা এবং তা স্মৃতিতে জাগরুক রাখা। দুই. নিজেকে হজ্ব ও হজ্বের বিভিন্ন স'ানে দূর অতীতে বিলীন করে দেওয়া, অন-ত তার সঙ্গে যুক্ত করে দেওয়া। তিন. সূক্ষ্ম থেকে সূক্ষতর এবং উচ্চ থেকে উচ্চতর ভাব ও অনুভূতিতে নিজেকে ডুবিয়ে দেওয়া। বলা বাহুল্য, এই তিনটি বিষয় হচ্ছে হজ্বের মধ্যে রূহ পয়দা করা, খুশূ-খুযূ পয়দা করা এবং ইহসান ও ইহতিসাবের হালত পয়দা করা, হজ্বের ঈমানী ও বাতেনী সুফল অর্জন করার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও শক্তিশালী উপায়। আজকাল যেহেতু ইবাদতকে জীবন- ও অনুভূতিপূর্ণ করার বিষয়টি চরম অবহেলার শিকার তাই সালাফের এ বিষয়ক বাণী ও ঘটনার চর্চা অত্যন- হ্রাস পেয়েছে। এজন্য আমার মতো শুষ্ক তালিবে ইলমদের কোথাও কোথাও ‘তাকাল্লুফ’ মনে হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে, বিশেষত যখন শুষ্ক তালিবে ইলমের সাধারণ রীতি এই দাঁড়াচ্ছে যে, তারা ইবাদতকে ফিকহী জায়েয-না-জায়েযের সীমায় সীমাবদ্ধ রাখে। যখন নামাযের মাঝেই খুশূ-খুযূ, ইহসান ও ইহতিসাব কিংবা আবেগ ও অনুভূতিকে জাগ্রত রাখা মুস-াহাব তখন হজ্বে মুস-াহাবের চেয়ে অধিক আর কী হবে? তাদের জানা নেই যে, এ বিষয়গুলো ফরয আদায়ের ক্ষেত্রে মুস-াহাব আর সেটিই হচ্ছে ইলমে ফিকহের বিষয়বস'। অথচ ইবাদতে রূহ পয়দা করার জন্য এটিই ফরযের মতো জরুরি। ফিকহী হুকুমের দিক থেকে মুস-াহাব হওয়ার সঙ্গে এর কোনো সংঘর্ষ নেই। যাহোক যদি কোনো তালিবে ইলম শুধু আবুল বাকা ইবনুয যিয়া আলমক্কী (৮৫৪ হি.)-এর ‘আলবাহরুল আমীক ফী মানাসিকিল মু’তামিরি ওয়াল হাজ্জি ইলা বাইতিল্লাহিল আতীক’ (যা তিন বছর পূর্বে পাঁচটি বৃহৎ খণ্ডে শানদারভাবে প্রকাশিত হয়েছে)-এর আল বাবুছ ছানী (দ্বিতীয় অধ্যায়টি) পাঠ করেন তাহলে দেখবেন যে, হজ্বের আমলসমূহে সালাফে ছালেহীন ভাব ও অনুভবের সাগরে কেমন নিমজ্জিত থাকতেন। ‘‘তাবাকাতে ইবনে সা’দ’’ ও ‘‘হিলয়াতুল আওলিয়া’’ গ্রনে' হযরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর রা.-এর ঘটনা উল্লেখিত হয়েছে। উরওয়া ইবনুয যুবাইর রাহ. বে-খেয়ালিতে তওয়াফের হালতে কোনো বিষয়ে তাঁর সঙ্গে কথা বলেছিলেন, কিন' ইবনে ওমর রা. কোনো উত্তর দেননি। উরওয়া পেরেশান হলেন। পরে সাক্ষাতে আবদুল্লাহ ইবনে ওমর রা. তাকে বললেন, তুমি কথাটা এমন সময় বলেছিলে যখন আমি তওয়াফের হালতে ছিলাম, এরপরের বাক্যটি এই- ‘আমরা তওয়াফের হালতে আল্লাহ তাআলাকে কল্পনা করি, যেন তিনি আমাদের দৃষ্টির সম্মুখে।’ হিলয়াতুল আওলিয়া গ্রনে'ই নাফে রাহ. থেকে বর্ণিত আছে যে, ইবনে উমর রা. উটের মাথা ঘুরিয়ে দিচ্ছিলেন যেন তা এঁকে বেঁকে যায় এবং বলছিলেন, ‘হয়তো তার পাও সেখানে পড়বে যেখানে পড়েছিল নবীজীর উটের পা।’ হজরে আসওয়াদে চুম্বন প্রসঙ্গে কবি ইবনে নুবাতাহ (৭৬৮ হি.)-এর অনুভূতি এই - হয়তো আমার মুখ সেই স'ানের স্পর্শ লাভ করবে, যা ধন্য হয়েছে তাঁর মুখের চুম্বন-স্পর্শে। উস-ায উমার আমীরী (১৪১২ হি.)-এর অনুভূতি এই - অর্থাৎ যে পবিত্র যবানে ওহী উচ্চারিত হত তা যে স'ানকে চুম্বন করেছিল আমিও সেই স'ানে চু্ম্বন করেছি, যেন এই সূত্রে আমি তাঁর সঙ্গে যুক্ত হই। (ফযলুল হাজরিল আসওয়াদ ওয়া মাকামি ইবরাহীম আ., সাইদ বাকদাশ পৃ. ৪৮, ৪৯) লক্ষ করুন, উপরোক্ত দু’ তিনটি ঘটনায় ওই তিনটি বুনিয়াদী নীতি কার্যকর রয়েছে, যা সফরনামায় বারবার এসেছে। লেখাটি দীর্ঘ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা না হলে আমি শরীয়তের দলীল থেকে লেখকের উপরোক্ত নীতি এবং অন্যান্য নীতির সূত্র উপসি'ত করে দিতাম কিন' প্রকৃতপক্ষে তা দলীল-প্রমাণের বিষয় নয়, অনুভব ও অনুভূতির বিষয়। আহা! মেহেরবান আল্লাহ যদি আমাদেরকেও তা থেকে এক ফোঁটা দান করতেন। আল্লাহুম্মা আমীন। হজ্বের আমলসমূহের রহস্য ও তাৎপর্য বিভিন্ন ঘটনা ও আলোচনার মধ্য দিয়ে প্রকাশ করে দেওয়া হচ্ছে এই সফরনামার এমন একটি বৈশিষ্ট্য, যার কারণে তা হজ্বের মধ্যে রূহানিয়াত পয়দা করতে আগ্রহী প্রত্যেক হাজীর সঙ্গী হওয়ার অধিকার রাখে। এজন্য যখন তা ধারাবাহিকভাবে আলকাউসারে প্রকাশিত হচ্ছিল তখন অনেকে পত্রিকার সংখ্যাগুলো হজ্ব ও ওমরার সফরে সঙ্গে রেখেছেন এবং আলকাউসারে তা পাঠ করে অনেক পাঠক প্রথম হজ্ব বা পরবর্তী হজ্বের সংকল্প করেছেন। মসজিদে হারাম ও অন্যান্য স'ানে একাধিক ব্যক্তিকে তাদের উপরোক্ত অনুভূতি লেখকের নিকট প্রকাশ করতে দেখেছি। কোনো হজ্ব-সফরনামার কবূলিয়াত ও মকবূলিয়াতের এর চেয়ে বড় দলীল আর কী হতে পারে? আল্লাহ তাআলা কিয়ামত পর্যন- একে সদকায়ে জারিয়া বানিয়ে দিন এবং এর ফুয়ূয ব্যাপক ও পরিপূর্ণ করে দিন। আমীন। সফরনামার লেখককে আল্লাহ তাআলা হায়াতে তাইয়্যেবা তবীলাহ দান করুন এবং তাঁর সকল মনোবাঞ্ছা গায়েব থেকে পূরণ করে দিন। মোটকথা, এই সফরনামার অসংখ্য উপকারিতার মধ্যে আমার ধারণায় সবচেয়ে বড় উপকারিতা এই যে, এর মাধ্যমে এমন একজন সফরসঙ্গী প্রস'ত হয়েছে যে ইনশাআল্লাহ অতি গাফেল মানুষের হজ্বের মাঝেও নূরানিয়াত ও পয়দা করতে অবদান রাখবে। দ্বিতীয় বড় উপকারিতা এই যে, এর পাঠকের গাফলত থেকে মুক্ত হওয়া ছাড়া উপায় নেই। বর্ণনা এতই আকর্ষণীয় যে, তা পাঠককে ভিন্ন জগতে নিয়ে যায়। হৃদয়ে উত্তাপ ও যন্ত্রণা সৃষ্টি করে এবং চোখকে অশ্রুসজল করে দেয়। এর দ্বারা পাঠক যদি সামান্য সময়ের জন্যও একান- নির্জনতায় রবের সান্নিধ্য অনুভব করার সুযোগ হয় তবে তা এক মহা নেয়ামত যার তুলনায় গোটা বিশ্বজগত নিতান-ই তুচ্ছ। উর্দূ ===== অন্যান্য প্রাসঙ্গিক বিষয় ছেড়ে দিলেও শুধু এই এক বিষয়েই যদি চিন-া করা হয় তাহলেও এই সফরনামা এমন এক নেয়ামত যা আমরা সম্পূর্ণ বিনাশ্রমে পেয়ে গেছি। সফরনামার ভাষা ও সাহিত্যের মাণ এ বিষয়ের পারদর্শী ব্যক্তিগণই অনুধাবন করতে পারবেন। আমি তো এমন লোক, আলকাউসারের পাঠকগণ জানেন যে, আমার সকল লেখা অনুবাদ হয়ে পাঠকের সামনে আসে। সাধারণত এই খেদমত আঞ্জাম দিয়ে থাকেন আমার খাস দোস্ত মাওলানা যাকারিয়া আবদুল্লাহ। আল্লাহ তাআলা তাকে জাযায়ে খায়ের নসীব করুন এবং তাফাককুহ ফিদ্দীন, রুসূখ ফিল ইলম, তাকওয়া-তহারাত এবং ইখলাস ও উদ্যমের সঙ্গে বেশি থেকে বেশি দ্বীনের খিদমতের তাওফীক দান করুন। আমীন। কয়েকটি নিবেদন ১. এই সফরনামা তৈরি হওয়ার পিছনে বড় অবদান উস-াযুল আসাতিযা হযরত মাওলানা আবদুল হাই পাহাড়পুরী দামাত বারাকাতুহুম-এর। দীর্ঘ দিন যাবত হযরত অত্যন- অসুস'; বরং এক রকম শয্যাশায়ী। পাঠকবৃন্দের নিকটে দরখাস- এই যে, তারা যেন হযরতের পূর্ণ সুস'তা ও হায়াতে তাইয়েবা তবীলার জন্য আল্লাহর দরবারে দুআ করেন।২. এই সফরনামার নূরানিয়াত ও তাছীরের একটি বাতেনী কারণ এই যে, এর পূর্ণ ‘মুসাওয়াদা’ অযুর হালতে মসজিদে ই’তিকাফরত অবস'ায় সমাপ্ত হয়েছে। বিষয়টি যেহেতু আমার জানা ছিল তাই তা উল্লেখ করে দিলাম, যেন ইলমী কাজে আমরা তা থেকে শিক্ষা নিতে পারি। ৩. হুজুর (বাইতুল্লাহর মুসাফির হযরত মাওলানা আবু তাহের মিসবাহ দামাত বারাকাতুহুম)-এর সাধারণ নিয়ম হল তিনি বার বার সম্পাদনার মাধ্যমে লেখার দীর্ঘ পরিচর্যা করা ছাড়া তা প্রকাশ করতে প্রস'ত হন না। এজন্য তার লেখা কোনো সাময়িকীতে প্রকাশ করতেও রাজি হন না। কোনো লেখা প্রকাশিত হওয়ার আগে কখনো কখনো তা দশ বারের অধিক সম্পাদনা হয়ে থাকে এবং তা প্রকাশিত হওয়ার পরও সম্পাদনা অব্যহত থাকে। এই সাধারণ নিয়মের বিপরীতে বারংবার অনুরোধ করে তার পূর্ণ স্বসি-র পূর্বেই সফরনামাটি ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়েছে। এতে আনন্দের বিষয় তো এই যে, কাজটি তাড়াতাড়ি সমাপ্ত হয়ে সামনে এসে গেছে। কিন' একই সঙ্গে আফসোসও হচ্ছে যে, নীতির উপর অটল মানুষকে তার যথার্থ নীতি থেকে (কিছুটা হলেও) সরে আসতে অনুরোধ করেছি। আল্লাহ তাআলা আমাদের ক্ষমা করুন এবং এতে যদি কোনো অকল্যাণ থাকে তাহলে তা থেকে আমাদের সবাইকে নিরাপদ রাখুন। যখন হুজুর জানলেন যে, আকাউসারে আমি আমার কিছু অনুভূতি ভাঙ্গাচোরা ভাষায় পেশ করছি তখন বললেন, সফরনামা যখন গ্রন'াকারে আসবে তখন তিনি তা এর ভূমিকায় প্রকাশ করবেন। আমি খুবই আশ্চর্য বোধ করেছি কিন' আমার সঙ্গে তার ‘যারয়ে নাওয়াযী’ (ক্ষুদ্রের প্রতি মহত্ত্ব)-এর এত অধিক দৃষ্টান- রয়েছে যে, এতে আর আশ্চর্যের কী? আমার জন্য তো এটা এক সৌভাগ্য যে, এই সামান্য অনুভব-অনুভূতি অসামান্য বিশিষ্টতায় পূর্ণ হয়ে গেল কিন' আফসোস হচ্ছে এই যে, এতে তো ‘মাখমাল মে টাট কী পায়ওয়ান্দ’ রেশমী চাদরে চটের তালি’র মতো দৃষ্টিকটু দৃষ্টান- হয়ে গেল। আল্লাহ তাআলাই অনুগ্রহ ====== করতে পারেন। দুআ করি এবং পাঠকবৃন্দের কাছেও দুআ প্রার্থনা করি যে, আল্লাহ তাআলা ‘মাদরাসাতুল মদীনাহ’ ও এই সফরনামাকে আলকলম (পুষ্প) পত্রিকার জন্য এবং মারকাযুদ দাওয়াহ ও ‘আলকাউসারে’র জন্য কবূলিয়াত ও মাকবূলিয়াতের অসীলা বানান। আমীন। একে আমাদের ঈমান তাযা করার উপায় এবং বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের মানোত্তীর্ণ ও অমর কীর্তি বানিয়ে দিন। আমীন।

 

advertisement