মুহাররম-১৪৩৩   ||   ডিসেম্বর-২০১১

ঈদের পর : ইসলামের নির্দশনের প্রতি অশ্রদ্ধা ইসলাম-বিদ্বেষরই বহিঃপ্রকাশ

ঈদ ইসলামের একটি শিআর। শিআর অর্থ নিদর্শন। যেসকল ইবাদত প্রকাশ্যে সম্মিলিতভাবে আদায় করা হয় এগুলো ইসলামের নিদর্শনের অন্তর্ভুক্ত। এ কারণে জুমআ, জামাআত, ঈদ ও এ জাতীয় ইবাদত ইসলামের দৃষ্টিতে অত্যন্ত মহিমান্বিত ও সংবেদনশীল।

ঈদুল আযহার গুরুত্বপূর্ণ অংশ কুরবানী, যা কুরআন মজীদের বিভিন্ন আয়াত এবং আল্লাহর রাসূলের হাদীস ও সুন্নাহ দ্বারা প্রমাণিত। এ কারণে মুসলিমউম্মাহ অত্যন্ত আগ্রহ-উদ্দীপনার সাথে কুরবানী করে থাকেন। কিন্তু সম্প্রতি দেখা যাচ্ছে, প্রতি বছরই কুরবানীর ঈদ উদযাপিত হওয়ার পর একটি বিশেষ মহলের পক্ষ থেকে কুরবানী সম্পর্কে বিষোদগার হয়। কখনো সরাসরি, কখনো অপ্রাসঙ্গিক কোনো বিষয়ের অবতারণা করা হয়।

এ নিবন্ধে দুটি উদাহরণ পাঠকবৃন্দের বিবেচনার জন্য তুলে ধরছি।

ঈদের একদিন পর (বৃহস্পতিবার) ডেইলি স্টারের একটি সাপ্লিমেন্ট-রাইজিং স্টারস-এর শেষ পৃষ্ঠায় (১০ নভেম্বর, ১১ পৃষ্ঠা : ৮) একটা কার্টুন ছাপা হয়েছে। তাতে দেখা যাচ্ছে, একটি কিশোর বই পড়ছে। হঠাৎ সে দরজায় নক করার আওয়াজ শুনতে পেল। সে জিজ্ঞেস করল, কে? উত্তর এল, পালিয়ে আসা একটি গরু! কিশোরটি কৌতুহলী হয়ে চেয়ার ছেড়ে দরজার কাছে গেল এবং দরজার উপরের কাঁচ লাগানো অংশ দিয়ে তাকিয়ে দেখল, একটি গরু কোত্থেকে যেন ছুটে এসেছে। গরুটি নিজের ভাষায় তাকে কী যেন বলল এবং সে হতবিহবল হয়ে তাকিয়ে রইল। কার্টুনটির শিরোনাম ছিল-‘Hre’s a cow that escaped last week’s murder and mayhem. এখানে একটি গরু আছে, যা গত সপ্তাহের হত্যাযজ্ঞ থেকে প্রাণ বাঁচিয়ে পালিয়ে এসেছে!)

প্রশ্ন হচ্ছে, কুরআনের বিধান কুরবানী কি হত্যাযজ্ঞ?!

এখানে আমরা দেখছি, এক ধরনের অবাস্তব ভাবাবেগ তৈরির প্রচেষ্টা! বাংলাদেশে কি কুরবানীর দিন ছাড়া গরু জবাই হয় না? হয়, দৈনিক হয় এবং হাজার হাজার গরু জবাই হয়। আর গরুই কি একমাত্র প্রাণী, যা মানুষের খাদ্য? সারা দেশে প্রতিদিন হাজার হাজার ছাগল-ভেড়া জবাই হয়, হাজার কেজি মোরগ-মুরগি জবাই হয়, শত শত টন মাছ নদী ও সাগর থেকে ধরা হয়।

এসব প্রাণীকে আল্লাহ মানুষের খাদ্য বানিয়েছেন। আল্লাহর অনুগত বান্দারাও এ খাদ্য গ্রহণ করেন, বিদ্রোহীরাও করে। তবে অনুগত বান্দারা আল্লাহর নেয়ামত গ্রহণ করে শোকরগোযারী করে আর বিদ্রোহী, অকৃতজ্ঞ লোকেরা আল্লাহর নেয়ামত চেটেপুটে খেয়ে মুখ মুছে চলে যায়। একবার আলহামদুলিল্লাহও বলে না!

নিরামেষভোজী কিছু মানুষের অস্তিত্বও নাকি কোথাও কোথাও আছে, কিন্তু একে তো তারা সংখ্যায় অতি নগণ্য। দ্বিতীয়ত গাছের যে প্রাণ নেই-একথা তাদের কে বলল?

তো এই ফালতু সেন্টিমেন্টের অর্থ কী?

আসল কথা হচ্ছে, কুরবানী ইসলামের একটি নিদর্শন। গোটা দেশে প্রকাশ্যে, সম্মিলিতভাবে পূর্ণ উৎসাহ ও উদ্দীপনার সাথে তা পালিত হচ্ছে, এতে ইসলাম-বিদ্বেষী চক্রের মৃত্যু-যন্ত্রণা ও নরকযন্ত্রণা শুরু হয়ে যায়। এরই বহিঃপ্রকাশ ঘটে যায় তাদের আচরণে এবং উচ্চারণে। ইসলামপ্রিয় জনগণের শক্তিকে এরা ভয় পায় তাই নানা উপায়ে তাদেরকে ও তাদের নতুন প্রজন্মকে বিভ্রান্ত করতে চায়। আমরা মনে করি, এদের পরিচয় সম্পর্কে কোনো ঈমানদারের সংশয় থাকা উচিত নয়।

প্রশ্ন হতে পারে, কুরবানীর সময় পরিচ্ছন্নতার বিষয়ে ত্রুটি করা হয়। এ আপত্তি সঠিক, কিন্তু এ তো আমাদের জাতীয় চরিত্র। আমাদের রাস্তাঘাট, ড্রেন-নর্দমা কি সারা বছর পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকে? আমাদের অফিস-আদালত, বাসটার্মিনাল, ট্রেনস্টেশন, এমনকি বিমানবন্দরের পরিচ্ছন্নতাও কি মানসম্পন্ন? জাতি হিসেবে আমরা এখনও শৃঙ্খলা ও পরিচ্ছন্নতার বৈশিষ্ট্য অর্জন করতে পারিনি। আর কোনো আত্মবিস্মৃত জাতি তা অর্জন করতেও পারে না। আজ আমাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি অভাব যে বিষযের তা হচ্ছে আত্মগঠন ও সমাজ গঠনের প্রেরণা। আর যে বিষয়টি আমাদেরকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে এসেছে তা হচ্ছে, আত্মঘাত ও অন্তর্ঘাতের প্রবণতা। তো কীভাবে আমরা শৃঙ্খলা, সময়ানুবর্তিতা ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার মতো মানবীয় বৃত্তিগুলো রপ্ত করব?

ইসলাম তো শৃঙ্খলা ও পরিচ্ছন্নতার উপর সকল ধর্মের চেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়েছে। মানবীয় সৌন্দর্যের সর্বোত্তম শিক্ষা তো ইসলামই দান করেছে, যে শিক্ষার ছিঁটেফোটা গ্রহণ করেই পশ্চিমারা অনেক দূর এগিয়ে গিয়েছে। কিন্তু মুসলিম হয়েও আমরা ইসলামকে প্রত্যাখ্যান করছি জলাতঙ্কগ্রস্ত রোগীর মতো।

প্রবল সম্ভাবনা ছিল এ জাতির মুক্তি ও উন্নতির। এদেশের অধিকাংশ মানুষ ধর্মভীরু ও ইসলামপ্রিয়। তাই সর্বস্তরে ইসলামী শিক্ষা ও আদর্শের প্রচার-প্রসারের মাধ্যমে এ জাতিকে একটি আদর্শ জাতিতে পরিণত করা সম্ভব ছিল, কিন্তু জাতীয় উন্নতির এ প্রধান সূত্রটিকেই পরিকল্পিতভাবে অকার্যকর করে রাখা হয়েছে ; বরং সুকৌশলে ইসলাম-বিদ্বেষী আবহ সৃষ্টির অপপ্রয়াস চালানো হয়েছে। তাই আমরা মনে করি, আলোচিত উদাহরণটি বিছিন্ন কোনো ঘটনা নয়। সেই পরিকল্পিত অপপ্রয়াসের অসংখ্য দৃষ্টান্তের একটিমাত্র।

দ্বিতীয় উদাহরণ হচ্ছে দৈনিক কালের কণ্ঠে (১২ নভেম্বর শনিবার) প্রকাশিত একটি সংবাদ ও বক্তব্য। শেষ পৃষ্ঠায় প্রকাশিত সংবাদটির শিরোনাম ছিল, জবাই না করে কোরবানীর ২৬ টি গরু দরিদ্রদের মাঝে বিতরণ। সংবাদটিতে বলা হয়েছে হাক্কানী মিশন নামের একটি প্রতিষ্ঠান এবারের কোরবানী ঈদে নরসিংদীর বেলাব উপজেলার ভাটের চর গ্রামের ২৬টি পরিবারকে গাভী ও বকনা বাছুর কিনে দিয়েছে। এ উপলক্ষে তারা একটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করে, তাতে ঐ পত্রিকার বিবরণ অনুযায়ী হাক্কানী মিশন বাংলাদেশের সভাপতি এমদাদুল হক (কাজল) বলেন, আমাদের দেশে এমন বহু পরিবার আছে, যাদের কাছে ঈদুল আযহার দিনে একটি পশু কুরবানী করার চেয়ে পরিবারের ভরণ-পোষণ করার মতো সক্ষম একজন ব্যক্তি অনেক বেশি

 প্রয়োজনীয় ও বরণীয়। তাই আমাদের পশু কুরবানীর টাকাটা যদি ঐ ব্যক্তিকে দিই এবং সে যদি একজন সক্ষম ও উপার্জনক্ষম ব্যক্তিতে পরিণত হতে পারে, সেটাই হবে উত্তম। আর এ ব্যবস্থাই পশু কোরবানির বিকল্প হয়ে উঠতে পারে। সম্ভবত নিজের সমসাময়িক মুসলিমসমাজের জন্য এ জাতীয় একটি কল্যাণবোধ থেকেই হযরত বিলাল রা. এ রীতিটির প্রচলন ঘটিয়েছিলেন। তিনি দাবি করেন, পৃথিবীর বৃহত্তম মুসলিম দেশ ইন্দোনেশিয়ায় কোরবানির ঈদে রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে একটি কোরবানি দেওয়া হয়।

আশ্চর্যের বিষয় এই যে, আল্লাহ যে বিধান দান করেছেন বান্দা দিচ্ছে তার বিকল্প! আরো ন্যাক্কারজনক বিষয় হচ্ছে এই ঔদ্ধত্য ও নির্বুদ্ধিতাকে সম্বন্ধ করা হয়েছে আল্লাহর রাসূলের একজন বিখ্যাত সাহাবীর সাথে! সাম্প্রতিককালের স্বঘোষিত কোনো নাস্তিক থেকেও তো আমরা এই মিথ্যাচার শুনিনি যে, কোনো সাহাবী আল্লাহর কোনো বিধানের বিকল্প প্রস্তাব করেছেন?!

এখানে পরোক্ষভাবে একটি কুরআনী বিধানকে অস্বীকার করা হয়েছে। আমরা এখানে কুরবানী ওয়াজিব কি সুন্নত-এই বিষয়টি আলোচনাও করতে চাই না। কারণ তা একটি ইলমী ও শাস্ত্রীয় বিষয়। কুরবানীর বিধানকে পূর্ণ মর্যাদা ও মাহাত্মের সাথে স্বীকার করার পর বিশেষজ্ঞদের মাঝে এ নিয়ে মতভেদ হয়েছে যে, সাধারণ কুরবানীর বিধান শরীয়তের যে নসগুলোতে (বক্তব্যগুলোতে) আছে সেগুলো কি কুরবানী আদায়ের অপরিহার্যতা নির্দেশ করে না এ বিধানে কিছু অবকাশও আছে। এই মতভেদের সাথে কুরবানীর বিকল্প অন্বেষণ, অন্যভাষায় কুরবানী অস্বীকারের কোনো সম্পর্ক নেই। সুতরাং এ প্রসঙ্গে এমন কোনো মনীষীকে উদ্ধৃত করা, যিনি হয়তো সাধারণ কুরবানীকে সুন্নত মনে করতেন, প্রতারণা ছাড়া আর কিছুই নয়। এতো গেল দ্বীনী বিবেচনা। এ জাতীয় ক্ষেত্রে যে প্রশ্ন যে কারো মনে জাগতে পারে তা হচ্ছে, একশ্রেণীর মানুষ দরিদ্রের সহযোগিতার প্রসঙ্গে শুধু হজ্ব কোরবানির মতো ইসলামী ইবাদতগুলোকে নিয়ে আসেন কেন? মদ-জুয়া, ঘরে ঘরে ডিশ সংযোগ, অশ্লীল বিনোদন, বিয়ে-শাদি ও অন্যান্য অনুষ্ঠানে সীমাচীন অপচয়ের ক্ষেত্রে তারা কেন একটি শব্দও ব্যয় করেন না। কারণ আল্লাহ তাআলার নিকট ঐ ইবাদত পছন্দনীয় ও মকবুল, যা সুন্দরভাবে আদায় করা হয়। আর কুরবানী করে আশপাশের জায়গা অপরিচ্ছন্ন রেখে দিলে তা যে সুন্দর কুরবানী হল না তা তো বলাই বাহুল্য।

সবশেষে যে কথাটা বলতে চাই তা এই যে, আমরা যারা উৎসাহের সাথে কুরবানী করি তাদের যে কিছু ভুল-ত্রুটি হয় না তা নয়। এ নিবন্ধে ঐসকল ভুল-ত্রুটির পক্ষে সাফাই দেওয়া উদ্দেশ্য নয়। যেমন একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা। এ বিষয়ে অবহেলা হলে ইবাদতের পূর্ণ সুফল পাওয়া যাবে না। তাছাড়া এর দ্বারা পরিবেশ দুষিত হয়, অন্যের কষ্ট হয়, যা একটি গুনাহর কাজ।

দ্বিতীয় বিষয় হচ্ছে, খ্যাতি ও প্রচারের প্রবণতা। কারো কারো আচরণে এ ধরনের প্রবণতা ফুটে ওঠে। এটা খুবই নিন্দনীয়। ইখলাস ছাড়া কোনো ইবাদতই আল্লাহর দরবারে কবুল হয় না।

তৃতীয় হচ্ছে, কুরবানীর গোশত বণ্টনের প্রসঙ্গ। যদিও কুরবানীদাতার জন্য গোটা কুরবানীর গোশত রেখে দেওয়ার অবকাশ আছে, কিন্তু তা শরীয়তের শিক্ষা নয়। শরীয়তের শিক্ষা হচ্ছে, কুরবানীর গোশত নিজে ভোগ করবে, আত্মীয়স্বজনকেও দিবে এবং সমাজের গরীব-মিসকীনকেও দান করবে।

আমরা যদি নিয়ম মতো কুরবানী করি তাহলেও যে বিদ্বেষীচক্রের মুখ বন্ধ হবে তা নয়। তাদের মুখ বন্ধ হোক না হোক, আমরা সঠিকভাবে শরীয়তের নিয়ম মেনে কুরবানী করব শুধু আমাদের পালনকর্তাকে সন্তুষ্ট করার জন্য।

আল্লাহ তাআলা আমাদের তাওফীক দান করুন। আমীন।

 

 

advertisement