মুমিনের যিন্দেগী হবে খুশূর যিন্দেগী
আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের মেহেরবানী, তিনি আমাদেরকে আবারও আরেকটি দ্বীনী মজলিসে হাজির হওয়ার তাওফীক দান করেছেন, আলহামদু লিল্লাহ।
اَللّٰهُمَّ مَا أَصْبَحَ بِيْ مِنْ نِّعْمَةٍ أَوْ بِأَحَدٍ مِّنْ خَلْقِكَ، فَمِنْكَ وَحْدَكَ لَا شَرِيْكَ لَكَ، فَلَكَ الْحَمْدُ وَلَكَ الشُّكْرُ.
اَللّٰهُمَّ إِنِّيْ أَصْبَحْتُ، أُشْهِدُكَ وَأُشْهِدُ حَمَلَةَ عَرْشِكَ، وَمَلَائِكَتَكَ، وَجَمِيعَ خَلْقِكَ، أَنَّكَ أَنْتَ اللهُ، لَا إِلهَ إِلَّا أَنْتَ وَحْدَكَ لَاشَرِيْكَ لَكَ، وَأَنَّ مُحَمَّدًا عَبْدُكَ وَرَسُولُكَ.
কুরআন কারীমের ২১তম সূরা সূরাতুল আম্বিয়া। এই সূরার ৯০ নম্বর আয়াতে আল্লাহ তাআলা নবীগণের বিভিন্ন সিফাত ও গুণের বর্ণনা দিয়েছেন। বলেছেন–
اِنَّهُمْ كَانُوْا یُسٰرِعُوْنَ فِی الْخَیْرٰتِ وَ یَدْعُوْنَنَا رَغَبًا وَّرَهَبًا وَكَانُوْا لَنَا خٰشِعِیْنَ.
নিশ্চয়ই তারা সৎকাজে দ্রুতগমন করত এবং আশা ও ভীতির সাথে আমাকে ডাকত আর তাদের অন্তর ছিল আমার সামনে বিনীত। –সূরা আম্বিয়া (২১) : ৯০
বলা হয়েছে, নবীগণ নেককাজে বড় অগ্রগামী ছিলেন। নেককাজে বিলম্ব করতেন না। কোনো একটা নেককাজের সময় এসেছে বা সুযোগ পাওয়া গিয়েছে, বিলম্ব না করে কীভাবে কাজটা করা যাবে, সেই প্রচেষ্টায় থাকতেন।
আল্লাহ তাআলা বলেন–
وَ یَدْعُوْنَنَا رَغَبًا وَّرَهَبًا.
তারা আমাকে ডাকে এবং আমার দরবারে দুআ ও প্রার্থনা করে আমার রহমতের আশা এবং আমার পাকড়াওয়ের ভয় নিয়ে।
মূলত নবীগণের বৈশিষ্ট্য এমনই। নেককাজে দেরি না করা, আল্লাহকে বেশি বেশি ডাকা, আল্লাহর রহমতের আশা ও তাঁর পাকড়াওয়ের ভয়ে তাঁর দরবারে খুব বেশি দুআয় মগ্ন থাকা।
আম্বিয়ায়ে কেরামের আরেক বৈশিষ্ট্য বলা হয়েছে–
وَ كَانُوْا لَنَا خٰشِعِیْنَ.
তারা আমার সামনে সবদিক থেকে বিনয়ী হয়ে থাকে।
‘খশিঈন’ [خٰشِعِيْنَ] শব্দটা ‘খুশূ’ থেকে এসেছে। নামাযের ব্যাপারে আমরা বলি খুশূ-খুযূর সঙ্গে নামায আদায় করা। সেই খুশূ [خشوع] থেকে খাশে‘ [خَاشِع] তার বহুবচন হল ‘খশিঊন’ [خاشعون]।
এক হল কোনো আমলের মধ্যে খুশূ-খুযূ থাকা। আরেক হল পুরো যিন্দেগীটাই খুশূ-খুযূর যিন্দেগীতে পরিণত হওয়া। আল্লাহ তাআলা বলেন, আমার সঙ্গে নবীগণের সম্পর্কই এমন যে, তাঁদের পুরো যিন্দেগীর মধ্যেই রয়েছে খুশূ আর খুযূ। কেবল নামায নয়; বরং তাঁদের পুরো যিন্দেগীটাই খুশূর যিন্দেগী। আল্লাহর সঙ্গে বান্দার সম্পর্কের ধরনই এমন হওয়া চাই!
এজন্য এটি নবীওয়ালা এক তাৎপর্যপূর্ণ সিফাত। মুমিনের পুরো যিন্দেগীটাই খুশূ-এর যিন্দেগী। তার যিন্দেগীর সবকিছুতেই খুশূ বিদ্যমান।
খুশূর প্রথম শর্ত তাওহীদ ও তাকওয়া
যিন্দেগীর খুশূ কী এবং কীভাবে অর্জিত হয়? খুশূ মূলত অনেকগুলো ঈমানী সিফাতের মাধ্যমে হাসিল হয়। যিন্দেগী খুশূপূর্ণ হওয়ার জন্য অনেকগুলো ঈমানী সিফাতের প্রয়োজন। কতগুলো ঈমানী সিফাতের সম্মিলন ঘটলেই যিন্দেগীটা খুশূপূর্ণ হয় এবং পুরো জীবনই খুশূ-এর জীবন হয়। যে কথা আল্লাহ তাআলা নবীদের ব্যপারে বলেছেন যে, তাঁদের প্রত্যেকেই খুশূওয়ালা ছিলেন। আমার সঙ্গে তাঁদের সম্পর্কটা ছিল খুশূ-এর সম্পর্ক।
যেসব ঈমানী সিফাতের মাধ্যমে যিন্দেগী খুশূওয়ালা হয়, তাকওয়া বা আল্লাহর ভয় তার অন্যতম। যাকে অন্যান্য শব্দে ‘খওফ’ ও ‘খাশিয়্যাত’-ও বলা যায়। সবগুলো শব্দই কুরআন কারীমে রয়েছে।
ঈমানী যিন্দেগীর খূশূ-এর জন্য একেবারে প্রথম যে সিফাতের প্রয়োজন সেটি তাওহীদ। তাওহীদ ছাড়া তাকওয়া হয় কীভাবে!
اِنِّيْ وَجَّهْتُ وَجْهِيَ لِلَّذِيْ فَطَرَ السَّمٰوٰتِ وَالْاَرْضَ حَنِيْفًا وَّ مَاۤ اَنَا مِنَ الْمُشْرِكِيْنَ.
দিলটা আল্লাহ অভিমুখী হওয়া। যেমন আমি বলছি, আল্লাহ ছাড়া কোনো ইলাহ ও মাবুদ নেই, তেমনি আল্লাহ ছাড়া কোনো মাকসূদও নেই। এজন্য মুমিনের একটা সিফাত হল ‘হানীফ’, অর্থাৎ সে একমাত্র আল্লাহ অভিমুখী হয়েছে, ব্যস, অন্যদিকে তার কোনো মনোনিবেশ নেই। আল্লাহর ওপর ঈমান এনেছে, একমাত্র আল্লাহরই ইবাদত করছে। একমাত্র আল্লাহর কাছেই প্রার্থনা করছে। দুআর হাত অন্য কোনো দরবারে বা অন্য কারও কাছে সে তোলে না। সে একমাত্র আল্লাহর ঘর বাইতুল্লাহ্রই তাওয়াফ করে, কোনো কবর, মাজার বা কোনো দরবারের তাওয়াফ করে না।
তাওহীদ যত পূর্ণ হবে, যিন্দেগী তত খুশূ-সম্পন্ন হবে। নবীজীকে আল্লাহ তাআলা নির্দেশ দিচ্ছেন–
قُلْ اِنَّ صَلَاتِيْ وَ نُسُكِيْ وَ مَحْيَايَ وَ مَمَاتِيْ لِلهِ رَبِّ الْعٰلَمِيْنَ، لَا شَرِيْكَ لَهٗ وَبِذٰلِكَ اُمِرْتُ وَاَنَا اَوَّلُ الْمُسْلِمِيْنَ.
অর্থাৎ আপনি বলুন, নিশ্চয়ই আমার সালাত, আমার যাবতীয় ইবাদত-বন্দেগী, আমার কুরবানী, এককথায় আমার জীবন ও মরণ সবই একমাত্র আল্লাহর জন্য।
এজন্য খুশূ-এর যিন্দেগী হওয়ার জন্য প্রথম বিষয় তাওহীদ। দ্বিতীয় বিষয় আল্লাহর খওফ ও খাশিয়্যাত। এর আরও পরিচিত ও গভীর অর্থবহ শব্দ হল তাকওয়া।
তদ্রূপ ইখলাস। এ ছাড়া যেমন কোনো ইবাদত কবুল হয় না; তেমনি এই সিফাত ছাড়া খুশূ-এর যিন্দেগীও লাভ হয় না।
প্রসঙ্গ ইহ্সান
প্রত্যেক আমলের মধ্যে ইহ্সান থাকতে হবে। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যে আমল যেভাবে শিখিয়েছেন সেটি সেভাবেই হতে হবে। অর্থাৎ সুন্নত মোতাবেক হতে হবে এবং আল্লাহকে হাযির-নাযির মনে করে দিলের উপস্থিতির সঙ্গে হতে হবে। এটা ন্যূনতম ইহ্সান। ইহ্সান-এর এক অর্থ অন্যের প্রতি দয়া করা। সেটি তো ভিন্ন এক বড় নেক আমল। কিন্তু ঈমান, ইসলাম, ইহ্সান– এই ধারায় যে ‘ইহ্সান’ শব্দ আসে, সেখানে ইহ্সান-এর অর্থ হল সকল ইবাদত ও সকল আমল যথাযথভাবে আঞ্জাম দেওয়া। ইবাদত ও আমলের ভেতর-বাহির সুন্দর হওয়া। ভালো হওয়া। ইসলামী যত আদব রয়েছে, সবগুলো আদব মেনে চলা। অন্য ভাষায় বললে, আমার চালচলন, কথাবার্তা, আচার-আচরণ, ওঠা-বসা সবকিছুতে ইসলামী আদব ও শিষ্টাচারগুলো পাওয়া যাওয়া, ইসলামী আখলাকের চর্চা হওয়া। খুশূ-সম্পন্ন যিন্দেগী গঠনের জন্য এসব খুবই জরুরি। এ ছাড়া যিন্দেগী কখনো খুশূ-এর যিন্দেগী হবে না।
খুশূ পরিপন্থি একটি বাহ্যিক স্বভাব
চলার পথে খামোখা কোনো জরুরত ছাড়া ডানেবামে তাকানো খুশূ-এর যিন্দেগী পরিপন্থি। আর যদি এমন কিছুর দিকে তাকানো হয়, যা হারাম ও গোনাহের, তাহলে তো বলার আর কিছু নেই। প্রয়োজনে ডানেবামে তাকানো ভিন্ন বিষয়; কিন্তু খামোখাই এদিক সেদিক তাকাতে থাকা কেবল ইসলামী আদব ও শিষ্টাচার পরিপন্থি নয়; বরং শরয়ী বিধানেরও পরিপন্থি। কারণ চলার পথে বিনা প্রয়োজনে এদিক-সেদিক না তাকানোর বিধান এসেছে। সুতরাং চলার সময় যার এদিক-সেদিক তাকানোর অভ্যাস রয়েছে, তাকে কখনো বলা হবে না খাশে‘। কারণ খুশূ শব্দের আভিধানিক অর্থই হল স্থির থাকা। যার চালচলনের মধ্যে অস্থিরতা থাকে, তাকে খাশে‘ বা স্থির কীভাবে বলা হবে! আসলে প্রত্যেক বিষয়েই ইসলামে আদব রয়েছে। আদবগুলো যথাযথ পালন করে চললে বান্দার যিন্দেগীতে খুশূ-এর বড় একটা দিক এসে যায়। আর আদব পরিপন্থিভাবে পালন করা হলে সেটি খুশূ-এর অভাব ও কমতিরই ইঙ্গিত করে। যেমন চলার আদব সম্পর্কে কুরআন কারীমের বিধান–
وَلَا تَمْشِ فِي الْاَرْضِ مَرَحًا اِنَّكَ لَنْ تَخْرِقَ الْاَرْضَ وَ لَنْ تَبْلُغَ الْجِبَالَ طُوْلًا.
জমিনের বুকে দম্ভভরে চলো না। তুমি তো জমিনকে বিদীর্ণ করতে পারবে না এবং উচ্চতায় পাহাড় পর্যন্ত পৌঁছতে পারবে না। –সূরা বনী ইসরাঈল (১৭) : ৩৭
অর্থাৎ আল্লাহর জমিনে তুমি অহংকারীর বেশে হাঁটবে না। বরং তোমার হাঁটাচলা হতে হবে মার্জিত। দ্রুত হাঁটতে আপত্তি নেই, কিন্তু অহংকারীর বেশে নয়। তুমি যে অহংকারীর মতো চলতে চাও, কত দূর যেতে পারবে? পাহাড় পর্যন্ত উঠতে পারবে? জমিনকে পা দিয়ে একেবারে চিড়ে ফেলতে পারবে? কখনো না। এই জমিন তো আল্লাহ্ই আমার অনুগামী বানিয়ে দিয়েছেন। আল্লাহর রহমত ও কুদরত যদি না হত, তাহলে কি আমি জমিনের ওপর হাঁটাচলা করতে পারতাম? আমার পায়ের আঙুলও তো স্থির হয়ে বসত না জমিনে। এই আমি যে জমিনে পা স্থির রাখতে পারছি, এক পা রেখে আরেক পা ওঠাতে পারছি, এটি কি মহান মালিকের রহমত নয়? আল্লাহর রহমত যদি না হয়, জমিনে পা পড়ার পর আর ওঠানো সম্ভব নয় এবং ওঠানোর পর আর ফেলাও সম্ভব নয়। কাজেই জমিনে চলার সময় একথা স্মরণ রাখো যে, এটা আল্লাহর মেহেরবানী, ফযল ও করম। আল্লাহর জমিনে আল্লাহর দেওয়া শক্তি দিয়েই হাঁটছি, এই হাঁটাচলাতে যদি আদবের কথা স্মরণে না থাকে, আল্লাহর মেহেরবানীর কথা কারও স্মরণে না থাকে, তবে সে হাঁটাচলা খুশূওয়ালা হয় কীভাবে? খুশূওয়ালা হতে হলে চলাফেরার ক্ষেত্রেও আমাকে ইসলামী আদবের কথা স্মরণ রাখতে হবে। আল্লাহ তাআলার ফযল ও করম এবং রহমতের কথা স্মরণ রাখতে হবে।
কথা বলার আওয়াজ বিষয়ে কুরআন কারীমে এসেছে–
وَ خَشَعَتِ الْاَصْوَاتُ لِلرَّحْمٰنِ فَلَا تَسْمَعُ اِلَّا هَمْسًا.
(হাশরের ময়দানে) দয়াময় আল্লাহর সামনে সব আওয়াজ স্তব্ধ হয়ে যাবে। ফলে আপনি পায়ের মৃদু আওয়াজ ছাড়া কিছুই শুনতে পাবেন না। –সূরা ত্বহা (২০) : ১০৮
وَاقْصِدْ فِيْ مَشْيِكَ وَاغْضُضْ مِنْ صَوْتِكَ اِنَّ اَنْكَرَ الْاَصْوَاتِ لَصَوْتُ الْحَمِيْرِ.
নিজ পদচারণায় মধ্যপন্থা অবলম্বন কর এবং নিজ কণ্ঠস্বর সংযত রাখ। নিশ্চয়ই সর্বাপেক্ষা নিকৃষ্ট স্বর গাধারই স্বর। –সূরা লুকমান (৩১) : ১৯
মূলত খুশূ-সম্পন্ন জীবনটাই এমন যে, অন্তরে আল্লাহর স্মরণ জাগ্রত থাকে এবং আল্লাহ আমাকে দেখছেন– এই অনুভূতিতে আওয়াজ শান্ত-স্থির থাকে। অপ্রয়োজনে আওয়াজ উঁচু হয় না।
আওয়াজের মধ্যেও একধরনের খুশূ থাকতে হয়। আমি যিকির করছি, তো কত জোরে যিকির করব? চিৎকার করে যিকির করা নিষেধ। যিকির করতে হবে হয়তো নিম্নস্বরে, নয়তো সামান্য আওয়াজ করে। কুরআন কারীমে যিকিরের দুটো পন্থার কথা এসেছে। কিন্তু সাথে একথা বলা হয়েছে–
وَاذْكُرْ رَّبَّكَ فِيْ نَفْسِكَ تَضَرُّعًا وَّخِيْفَةً وَّدُوْنَ الْجَهْرِ مِنَ الْقَوْلِ...
আর সকাল-সন্ধ্যায় নিজের প্রতিপালককে স্মরণ কর ভীতির সাথে, মনে মনে এবং অনুচ্চ স্বরে...। –সূরা আরাফ (৭) : ২০৫
অর্থাৎ চিৎকার করা অপেক্ষা বা চিৎকার করার চেয়ে কম আওয়াজে তুমি যিকির করবে। একটু উঁচু আওয়াজে করলেও সেটি চিৎকার করার মতো আওয়াজে যেন না হয়। বরং তার চেয়ে কম আওয়াজে যেন হয়। আর নিম্নস্বরে করলে তো হলই।
সারকথা, চিৎকার করে যিকির করা খুশূ পরিপন্থি এবং নিষিদ্ধ কাজ।
তদ্রূপ তিলাওয়াতও। আমি আল্লাহর কালামের তিলাওয়াত করছি, এই তিলাওয়াতের মধ্যেও অতি আওয়াজ করে তিলাওয়াত করা বাঞ্ছনীয় নয়। কুরআন কারীমে আল্লাহ তাআলা বলে দিয়েছেন–
وَ ابْتَغِ بَيْنَ ذٰلِكَ سَبِيْلًا.
অর্থাৎ অতি উচ্চ আওয়াজেও নয়, নিচু আওয়াজেও নয়; বরং এর মাঝামাঝি আওয়াজে।
আমরা যে নামাযে আওয়াজ করে তিলাওয়াত করছি, সেখানেও অনেক জোরে নয়। আর এমনিতেও আওয়াজ করে যে তিলাওয়াত করব, তাও মধ্যম আওয়াজে মার্জিত স্বরে হতে হবে। অনেক জোর আওয়াজে তিলাওয়াত করা তিলাওয়াতের খুশূ-এর খেলাফ।
মুরব্বিদের সামনে কথা বলার সময় আওয়াজ উঁচু করা বেআদবি। বিশেষত নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে আল্লাহ তাআলা যখন হায়াতে রেখেছিলেন, তখন তাঁর সামনেও যেন আওয়াজ খুব বড় না হয়, সেই বিধান সরাসরি কুরআন কারীমেই এসেছে–
يٰۤاَيُّهَا الَّذِيْنَ اٰمَنُوْا لَا تَرْفَعُوْۤا اَصْوَاتَكُمْ فَوْقَ صَوْتِ النَّبِيِّ وَ لَا تَجْهَرُوْا لَهٗ بِالْقَوْلِ كَجَهْرِ بَعْضِكُمْ لِبَعْضٍ...
হে মুমিনগণ! নিজের আওয়াজকে নবীর আওয়াজ থেকে উঁচু করো না এবং তাঁর সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে এমন উচ্চৈঃস্বরে বলো না, যেমন তোমরা একে অন্যের সঙ্গে উচ্চৈঃস্বরে কথা বলে থাক। যেন তোমাদের অজান্তেই তোমাদের আমল নিষ্ফল না হয়ে যায়। –সূরা হুজুরাত (৪৯) : ২
তবে একটি বিষয় হল, আওয়াজ উঁচু না হওয়া মানে অনেক উঁচু না হওয়া। কিন্তু কথা বোঝার জন্য যতটুকু আওয়াজ দরকার, ততটুকু আওয়াজ তো হতেই হবে।
এই যে আওয়াজ, এর মধ্যেও একটা খুশূ আছে। এর বিপরীত হল আযান, যেখানে উদ্দেশ্যই আওয়াজ উঁচু করা। কিন্তু সেখানেও কথা হল যত উঁচু আওয়াজেই আযান দেওয়া হোক, তা অবশ্যই মার্জিত আওয়াজে হতে হবে। হাদীসের ভাষা–
فَإِنَّه أَنْدَى وَأَمَدُّ صَوْتًا مِنْكَ.
অর্থাৎ আওয়াজটা দীর্ঘ, কিন্তু আবার মধুরও।
এভাবে আমরা যদি ইসলামের বিধান ও শিক্ষাগুলোর দিকে লক্ষ করি, দেখব প্রত্যেক অধ্যায়ের মধ্যেই রয়েছে খুশূ ও খুযূ। যিন্দেগীর সবদিক যখন খুশূ-এর আওতায় আসবে, তবেই ব্যক্তি হবে খাশে‘ ও আল্লাহর প্রতি বিনয়ী। সেটাই আল্লাহ তাআলা নবীদের সম্পর্কে বলেছেন–
وَ كَانُوْا لَنَا خٰشِعِيْنَ.
তাঁদের প্রত্যেকেই আমার খাশে‘ বান্দা।
দান-সদকায় খুশূ
আমি আল্লাহর রাস্তায় দান-সদকা বা যাকাত আদায় করছি। অথবা অন্য কোনোভাবে আল্লাহর রাস্তায় খরচ করছি, সেখানেও রয়েছে খুশূ। কিন্তু কীভাবে সেখানে খুশূ-এর প্রকাশ ঘটবে? কুরআন কারীমে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন–
وَ الَّذِيْنَ يُؤْتُوْنَ مَاۤ اٰتَوْا وَّ قُلُوْبُهُمْ وَجِلَةٌ اَنَّهُمْ اِلٰي رَبِّهِمْ رٰجِعُوْنَ.
...এবং যারা তাদের প্রতিপালকের নিকট প্রত্যাবর্তন করবে– এই বিশ্বাসে তাদের যা দান করার, তা দান করে ভীত-কম্পিত হৃদয়ে। –সূরা মুমিনূন (২৩) : ৬০
এই আয়াতে আল্লাহ তাআলা মুমিনদের সিফাত বয়ান করেছেন। কোনো কিছু দান করার সময় তাদের অন্তরের অবস্থা হয় এমন–
وَّ قُلُوْبُهُمْ وَجِلَةٌ.
অর্থাৎ তাদের অন্তরগুলো ভয়ে প্রকম্পিত থাকে; এজন্য যে, আমরা আল্লাহর কাছে যখন ফিরে যাব, তখন তো বোঝা যাবে, আমার এই দান করা কেবল আল্লাহর জন্য ছিল কি না!
শরীয়ত দান করার যে আদব শিখিয়েছে, এই দান করা সেই আদব মোতাবেক হয়েছে কি না! দান যেমন ইখলাসের সাথে হওয়া দরকার, তেমনি সুন্নত তরীকায় এবং ইসলামী আদব মোতাবেকও হওয়া চাই। দানের অন্যতম সুন্নত ও আদব হল দান খোঁটামুক্ত হওয়া। দান করে কেউ যদি মনে করে– আমি গ্রহীতার প্রতি দয়া করেছি– এটাও একধরনের খোঁটা। বরং অনুভূতি থাকতে হবে, সে মেহেরবানী করে ‘আমার দান’ গ্রহণ করেছে। আল্লাহ তাকে রাজি করে দিয়েছেন, সে আমার দানটাকে গ্রহণ করেছে। নতুবা আমি যে মানুষ, আমার দান তো গ্রহণ করার ছিল না। হৃদয়ে এই অনুভূতি জাগ্রত রাখা এত সহজ কাজ না। বিশেষত যখন আমি দেখছি, লোকটা দান পাওয়ার জন্য অনেক প্রস্তুত হয়ে আছে। বরং আমার কাছে চেয়ে বসেছে এবং লালায়িত হয়ে আছে, ঠিক তখন অন্তরে একথা চিন্তা করা যে, তার পক্ষ থেকে আমার এই দান গ্রহণ হওয়া আমার সৌভাগ্য! চিন্তা করুন, তখন এটা ভাবা কি এত সহজ? কিন্তু হাঁ, যার অন্তরে খুশূ আছে, সে তখনো ভাবতে পারে এবং ভেবে থাকে। তার অন্তর থাকে ভয়ে প্রকম্পিত– আমার দান করাটা যথাযথ পন্থায় হল কি না? আল্লাহ তাআলা কবুল করেছেন তো? আল্লাহর বিধান মতো আমার দান করা হয়েছে তো? এসব চিন্তায় দিলটা প্রকম্পিত থাকা– দান-সদকার মধ্যে খুশূ।
হজ্বের মধ্যে খুশূ
এমনিভাবে হজ্বের মধ্যেও খুশূ আছে। হজ্ব এমন ইবাদত, যার আগাগোড়া পুরোটাই খুশূ। ‘লাব্বাইক’ থেকে শুরু করে ‘বিদায় তাওয়াফ’ পর্যন্ত পুরোটাই খুশূতে ভরা। তালবিয়ার প্রতিটি শব্দের প্রতিটি অংশে কী পরিমাণ খুশূ, ভাবলেই তো...। সেই অনুভূতি নিয়ে যদি আমি তালাবিয়া পড়তে পারি, পুরো হজ্বটাই যদি আমার সেই অনুভূতিতে আদায় হয়ে যায়, কত সুন্দর হজ্ব হবে! কারণ হজ্বের আদ্যোপান্ত পুরোটাই খুশূ।
‘লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক, লাব্বাইকা লা-শারীকালাকা লাব্বাইক, ইন্নাল হামদা ওয়ান নি‘মাতা লাকা ওয়াল মুলক, লা-শারীকা লাক!’
এভাবে প্রত্যেক ইবাদত, বরং যিন্দেগীর প্রত্যেক আমলের মধ্যেই খুশূ আছে। যিন্দেগীর প্রত্যেক অঙ্গনে খুশূ আছে। এবং এতটুকু আমাদের সবাই আল্লাহর রহমতে জানি। কাজেই সেই খুশূ আমাকে হাসিল করতে হবে।
উজব ও আত্ম-মুগ্ধতা খুশূ পরিপন্থি একটি বিষয়
এই যে আখলাকি বিষয়গুলো, আমার মধ্যে তাওয়াযু থাকতে হবে, অহংকার থাকতে পারবে না। উজব বা আত্ম-মুগ্ধতা, অর্থাৎ আমার নিজেকে নিজের ভালো লাগে, এটা থাকতে পারবে না। অনেক সময় এমন হয় যে, নিজের সবকিছুকেই কেবল ভালো মনে হয়। কোনো একটা কাজ করলাম, মনে হয় খুব ভালো করেছি। অনেক সুন্দর করেছি। অথচ হতে পারে অনেক ত্রুটি আছে এটাতে, কিন্তু সেটা আমার খবর নেই। এই যে ‘উজব’ বা আত্ম-মুগ্ধতা, এটি বড় কঠিন রোগ ও ব্যাধি! এর বিভিন্ন দিক রয়েছে। এক তো নিজের শুধু খূবী ও ভালো দেখা, ত্রুটিগুলো নজরে না আসা। আরেক হল কেবল অন্যের ত্রুটিই দেখতে পাওয়া, তার ভালো কিছু চোখে না পড়া। এটা উজবের এক ভয়ংকর দিক।
তাছাড়া নিজের যেসব খূবী নজরে পড়ে, সবগুলো কিন্তু বাস্তব খূবী নয়, বরং অনেক কিছুই কল্পিত। আমি মনে করি, আমার কাছে এটা আছে, আসলে কিন্তু নেই। খূবীর প্রতি যতই নজর পড়ছে, কেবল ফুলে যাচ্ছি! তাহলে তো আরও ভয়ংকর! কিন্তু বাস্তব কোনো খূবী যদি আমার মধ্যে থেকেও থাকে, তার প্রতি নজর পড়লে আমার কাছে কেবল ভালো লাগে, কিন্তু শোকর আসে না, ফুলে যাচ্ছি, কিন্তু শোকর করছি না, দিলেও না, যবানেও না, তাহলে এটা উজবের এক বড় দিক।
আল্লাহ কোনো নিআমত বা গুণ দান করলে সেই গুণ বা খূবীর দিকে দৃষ্টি যেতেই পারে, কিন্তু তখন যদি দিল থেকে ‘আলহামদু লিল্লাহ’ আসে, এটা আল্লাহর মেহেরবানী। আমি কে যে, আমার মধ্যে এই খূবী থাকবে, এই ভালো দিকটা থাকবে, এই ভালো সিফাত থাকবে, এই ভালো আমল হয়ে যাবে আমার দ্বারা? এ তো কেবল এক আল্লাহরই মেহেরবানী এবং তাঁর দান! মেহেরবান আল্লাহর ফযল ও ইহ্সান! এভাবে শোকরের অনুভূতি যদি পয়দা হয়, তাহলে তো আলহামদু লিল্লাহ, অন্যথায় এটি হবে উজব, যা বড় কঠিন রোগ।
‘আখলাকে হামীদা’ ও ‘আখলাকে রযীলা’
বলতে চেয়েছিলাম, শরীয়ত আমাদেরকে আখলাকের যত অধ্যায় শিক্ষা দিয়েছে, দিলের মধ্যে কী কী ব্যাধি ও রোগ থাকতে পারবে না, কী কী ময়লা থেকে দিলকে পাক রাখতে হবে এবং কী কী ভালো সিফাত দিলের মধ্যে থাকতে হবে? এই পরিভাষা আমরা অনেকেই জানি, যাদের জানা নেই, শিখে নিতে পারি! অনেক ব্যাধি আছে, সেগুলো থেকে দিলকে পাক-সাফ করতে হবে এবং অনেক ভালো সিফাত রয়েছে, সেগুলো দিলের মধ্যে থাকতে হবে। না থাকলে ধারণ করার চেষ্টা ও মেহনত করতে হবে। যে ভালো গুণগুলো আমার মধ্যে থাকা দরকার সেগুলোকে বলা হয় ‘আখলাকে হামীদা’। যে গুণগুলোর জন্য কুরআন-হাদীসে প্রশংসা করা হয়েছে, যেগুলোর প্রতি কুরআন-হাদীসে উদ্বুদ্ধ করা হয়েছে, সেগুলো হল আখলাকে হামীদা। আর যেগুলোর নিন্দা করা হয়েছে এবং বেঁচে থাকতে বলা হয়েছে সেগুেেলা ‘আখলাকে রযীলা’।
রযীল মানে ময়লা, ব্যাধি, যা মানুষের আখলাককে নষ্ট করে দেয়। এককথায় আখলাকে হামীদা হাসিল করতে হবে এবং আখলাকে রযীলা থেকে দিলকে পাক করতে হবে।
কুরআন-হাদীসের এই যে বিশাল অধ্যায় যে, অনেকগুলো সিফাত দিলে থাকতে হবে, অনেক ময়লা থেকে দিলকে পাকসাফ রাখতে হবে– এই পুরো অধ্যায়টা খুশূ হাসিল করার জন্য। অন্তরকে যতক্ষণ পর্যন্ত সমস্ত ময়লা-আবর্জনা থেকে পবিত্র না করা হবে এবং আখলাকে হামীদা যতক্ষণ পর্যন্ত দিলে না আসবে, ততক্ষণ পর্যন্ত আমার জীবনে খুশূ আসবে না।
নিয়ন্ত্রণহীন রাগ খুশূ পরিপন্থি
মানুষ রেগে গেলে কি স্থির থাকতে পারে? রেগে গেলে স্থির থাকা এবং যবান ও হাত নিয়ন্ত্রণে রাখা খুশূর বড় এক আলামত ও প্রকাশ। তা কীভাবে সম্ভব হবে, রাগ ও তার (পারিপার্শ্বিক মন্দ প্রভাবগুলোর) মতো বড় কঠিন এই ব্যাধি যদি অন্তরে থাকে! মানুষের স্বভাবের মধ্যে রাগ থাকবেই, কিন্তু নিয়ন্ত্রণহীন রাগ বড় ব্যাধি। এ থেকে নিজেকে পবিত্র করতে হবে। দিল পাক সাফ হলেই আমার আচার-আচরণ, কথাবার্তা সবই নিয়ন্ত্রণহীন রাগ থেকে পাক সাফ হবে। রাগ নিয়ন্ত্রণ করা এমন এক সিফাত, যা ছাড়া কখনো খুশূ আসবে না।
বিষয়টা এমনিতেই আমরা ধরতে পারি। রেগে গেলে মানুষের মুখ থেকে কী বের হয়, খবরই থাকে না। হাত দিয়ে কী করছে না করছে, কাউকে মারছে, ধাক্কা দিয়ে বের করে দিচ্ছে, নাকি কিছু ভেঙে ফেলছে, নাকি নিজের শরীরেই আঘাত করছে– কিছুই বলতে পারে না। তাহলে এটা খুশূ-এর যিন্দেগী হয় কীভাবে? রাগের সময় স্থির থাকতে পারা, হাত ও যবানকে নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারা– এসব অনেক বড় খুশূ।
কলবের খুশূ কলবের ইসলাহ
এভাবে একেকটা ধরে ধরে চিন্তা করলে দেখা যাবে, খুশূ কীভাবে পুরো জীবনের মধ্যে বিস্তৃত! নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন–
أَلاَ وَإِنَّ فِي الجَسَدِ مُضْغَةً: إِذَا صَلَحَتْ صَلَحَ الجَسَدُ كُلُّه، وَإِذَا فَسَدَتْ فَسَدَ الجَسَدُ كُلُّه، أَلاَ وَهِيَ القَلْبُ.
জেনে রাখো, শরীরের মধ্যে একটি গোশতের টুকরো আছে, তা যখন ঠিক হয়ে যায়, গোটা শরীরই তখন ঠিক হয়ে যায়। আর তা যখন খারাপ হয়ে যায়, গোটা শরীরই তখন খারাপ হয়ে যায়। জেনে রাখো, সেই গোশতের টুকরোটি হল কলব (অন্তর)। –সহীহ বুখারী, হাদীস ৫২; সহীহ মুসলিম, হাদীস ১৫৯৯
কলব ঠিক হলে আমার পুরো দেহের সবগুলো অঙ্গপ্রত্যঙ্গ থেকে ঘটিত সকল কাজ ঠিক হবে। আর কলব যদি ঠিক না থাকে, তা আমার কথাবার্তা, চালচলন, আচার-আচরণে প্রকাশ পেতে থাকবে। এজন্য কলবের খুশূ হল কলবের ইসলাহ।
অন্য ভাষায় বললে, কলবের মধ্যে আখলাকে হামীদা পয়দা হওয়া, কলবকে সমস্ত ব্যাধি ও ময়লা-আবর্জনা থেকে পবিত্র ও পাক সাফ করা। এটাই কলবের খুশূ। কুরআন কারীমের এক আয়াতে আল্লাহ তাআলা কলবের খুশূ-এর কথা বলেছেন এভাবে–
اَلَمْ يَاْنِ لِلَّذِيْنَ اٰمَنُوْۤا اَنْ تَخْشَعَ قُلُوْبُهُمْ لِذِكْرِ اللهِ وَمَا نَزَلَ مِنَ الْحَقِّ وَلَا يَكُوْنُوْا كَالَّذِيْنَ اُوْتُوا الْكِتٰبَ مِنْ قَبْلُ فَطَالَ عَلَيْهِمُ الْاَمَدُ فَقَسَتْ قُلُوْبُهُمْ وَكَثِيْرٌ مِّنْهُمْ فٰسِقُوْنَ.
ঈমানদারদের কি এখনো সেই সময় আসেনি যে, তাদের অন্তর বিগলিত হবে– আল্লাহর স্মরণের প্রতি এবং যে সত্য অবতীর্ণ হয়েছে তার প্রতি? এবং তারা ওদের মতো হবে না, যাদের ইতিপূর্বে কিতাব দেওয়া হয়েছিল। অতঃপর যখন তাদের ওপর দিয়ে দীর্ঘকাল অতিক্রান্ত হল, তখন তাদের অন্তর কঠিন হয়ে গেল। এবং তাদের অনেকেই (চরম) অবাধ্য। –সূরা হাদীদ (৫৭) : ১৬
অর্থাৎ, মুমিনদের কি এখনো সময় হয়নি যে, তাদের দিলগুলো আল্লাহর যিকিরের জন্য এবং আল্লাহ যে হক অবতীর্ণ করেছেন, সেই হক গ্রহণের জন্য নরম হয়ে যাবে? কারণ হক কবুল করতে হলে দিল নরম হতে হয়।
কঠিন হৃদয়ের কিছু আলামত ও প্রতিকার
কুরআন কারীমে শক্ত দিলের বিবরণও এসেছে–
فَوَيْلٌ لِّلْقٰسِيَةِ قُلُوْبُهُمْ مِّنْ ذِكْرِ اللهِ اُولٰٓىِٕكَ فِيْ ضَلٰلٍ مُّبِيْنٍ.
সুতরাং ধ্বংস সেই কঠোরপ্রাণদের জন্য, যারা আল্লাহর যিকির থেকে বিমুখ। তারা সুস্পষ্ট বিভ্রান্তিতে নিপতিত। –সূরা যুমার (৩৯) : ২২
অর্থাৎ দিল যাদের শক্ত, তাদের জন্য বরবাদি ও ধ্বংস।
দিল শক্ত হওয়া অন্তরের কঠিন এক ব্যাধি। যেসব ব্যাধি থেকে অন্তরকে পাক সাফ করতে হবে, তন্মধ্যে বড় একটা ব্যাধি হল দিল শক্ত হওয়া। দিল শক্ত হলে মানুষ যেসব কঠিন সমস্যার শিকার হয়, তন্মধ্যে রয়েছে, দুআ-যিকিরে মজা না পাওয়া, তিলাওয়াতে মজা না পাওয়া, নামাযে মজা না পাওয়া এবং কোনো ইবাদতেই মজা না পাওয়া। মজা না পাওয়ার চেয়ে বড় দোষ হল দিলটা প্রস্তুত না হওয়া। মসজিদে যেতে, নামায পড়তে মনটা প্রস্তুত হচ্ছে না।
এই সমস্যার প্রতিকার কী? প্রতিকার হল একটু কষ্ট করে দিলের বিরুদ্ধে কাজটা শুরু করে দেওয়া। দিলকে এভাবে ধীরে ধীরে প্রস্তুত করতে হয়। কারণ দিল ইঞ্জিনের মতো আমাকে পরিচালনা করে। ইঞ্জিনের যেমন পরিচর্যা করতে হয়, আমার দিলকেও তার চেয়ে বেশি পরিচর্যা করতে হবে। শক্ত হয়ে গেলে ধাক্কা দিয়ে তাকে ধীরে ধীরে নরম করে তুলতে হয়। দিলটা নরম হলেই আমি সকল ইবাদতের মজা পেতে থাকব। মজার চেয়ে বড় কথা হল কাজটা আদায় হয়ে যাওয়া। কিন্তু কাজ হওয়ার জন্যই যদি কারও দিল প্রস্তুত না হয়, সেটি বড় ভয়াবহ! মূলত এটাই আসলে প্রকৃত শক্ত দিল। আমলটা করে ফেললাম, আলহামদু লিল্লাহ, কিন্তু দিলে খুব মজা পেলাম না– এটা অত বড় সমস্যা নয়। দিল শক্ত হওয়া তখন পরিপূর্ণ বলা হবে, যখন জরুরি আমল পালনই হচ্ছে না, করতেও দিল প্রস্তুত নয়। এ অবস্থায় বুঝতে হবে দিল একেবারে শক্ত। আল্লাহ তাআলা বলছেন, দিলকে এ অবস্থায় ছেড়ে দেওয়া যাবে না; বরং দিলের বিরুদ্ধে কাজ করে ফেলতে হবে।
মৃত জমিনের জন্য বৃষ্টির পানি আর মুরদা দিলের জন্য ওহীর পানি
এর উদাহরণ হল অনেকদিন পর গত রাতে যে বৃষ্টি হয়েছে সেটি। দেশের কোথায় কোথায় হয়েছে, আমি ঠিক জানি না, কিন্তু আমাদের এখানে আল্লাহর রহমতে অনেক বৃষ্টি হয়েছে। মানুষ মাঝেমধ্যে একেবারে নিরাশ ও হতাশ হয়ে যায়, এত খরা হচ্ছে, আর বুঝি বৃষ্টি নামবে না! অনেকে দুআও করে। কিন্তু আসল হল তওবা-ইস্তিগফার। সেটা কিন্তু কম করা হয়। দুআও কিন্তু খুব বেশি করা হয় না। তাও কিছু হয়তো করা হয়। কিন্তু অধিকাংশ মানুষেরই তওবা-ইস্তিগফারের কথা স্মরণে থাকে না। তওবা মানে গুনাহ ছেড়ে আল্লাহর দিকে ফিরে আসা! ইস্তিগফার মানে অতীতে যা হয়েছে তার জন্য আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাওয়া! এটা হল বৃষ্টি পাওয়ার বড় উপায় ও সহায়ক। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেছেন, যখন দেখছ, একেবারে সব দিকে শুকনো আর শুকনো, জমিন মরে গিয়েছে। শুকিয়ে ফেটে চৌচির হয়ে গিয়েছে, তখন–
اِعْلَمُوْۤا اَنَّ اللهَ يُحْيِ الْاَرْضَ بَعْدَ مَوْتِهَا.
জেনে রেখ, আল্লাহ্ই ভূমিকে তার মৃত্যুর পর জীবন দান করেন। –সূরা হাদীদ (৫৭) : ১৭
মৃত জমিনকে বৃষ্টির মাধ্যমে আল্লাহ তাআলা যেমন জীবিত করে দিচ্ছেন; তোমার দিল যদি এত কঠিন ও শক্ত হয়েছে যে মরেই গিয়েছে, এই মুরদা দিলকেও যিন্দা করা আল্লাহর জন্য সম্ভব। কাজেই আল্লাহর দিকে রুজূ করো। আল্লাহ ওহী অবতীর্ণ করেছেন, দিলের মধ্যে সে ওহীর পানি ঢালো! মৃত জমিন জীবিত হয় বৃষ্টির পানি দিয়ে আর মুরদা দিল যিন্দা হবে ওহীর পানি দিয়ে। দ্বীনের কথা শোন। মন চায় না, তাও আল্লাহর নাম নাও। দেখবে ধীরে ধীরে দিল নরম হচ্ছে। শক্ত হয়ে গিয়েছে বলে তুমি যদি এই শক্ত অবস্থায়ই রেখে দাও, তাহলে তোমার দুনিয়া-আখেরাত সবই বরবাদ! কাজেই শক্ত দিলকে নরম করার মেহনত করতে হবে। এর উপায় হল, যে আমল ছেড়ে দেওয়ার কারণে দিল নরম হয়ে গিয়েছে, আমলটা আবার শুরু কর! যথাসম্ভব শুরু কর। একটু একটু করতে থাক, দেখবে, ধীরে ধীরে দিল নরম হয়ে যাচ্ছে!
দিল নরম করা যায় যেভাবে
দিল নরম হয় তিলাওয়াতের দ্বারা। দিল নরম হয় যিকিরের দ্বারা। দিল নরম হয় নামাযের দ্বারা। দিল নরম হয় হক কথা শুনলে এবং মানলে। মন চাচ্ছে না, তাও জোর-জবরদস্তি একটা দ্বীনী মজলিসে চলে যাও, কিছু হেদায়েতের কথা শুনে আস। একটুও ভালো লাগছে না, তাও নিজেকে ঠেলে নিয়ে যাও! নিজে একা না পারলে অন্যের সহযোগিতা নাও! পথে একটা গাড়ি আটকা পড়লে যেমন অন্যদের সহযোগিতা চাওয়া হয়, ভাই, একটু গাড়িটা ঠ্যালা দিন, ঠিক নিজের ব্যাপারে এভাবে অন্যকে বলতে হবে, ভাই, আমাকে একটু হরকত করিয়ে দিন! এভাবে আমলের পরিবেশে, যিকিরের পরিবেশে যাও! এভাবে জবরদস্তি কিছু করলে এবং শুনলে আবার দিল নরম হবে, ইনশাআল্লাহ।
তো কলবের খুশূ হল আখলাকে হামীদা বা ভালো সিফাতগুলো ধারণ করা এবং অন্তরের যত ব্যাধি ও ময়লা-আবর্জনা আছে, সেগুলো থেকে অন্তরকে পাক সাফ করা।
নামাযের খুশূ, তিলাওয়াতের খুশূ ও যিকিরের খুশূ কী জিনিস, যেগুলো খুশূ-এর আসল জায়গা বলে পরিচিত এবং বহুল আলোচিত, সেগুলোর বিষয়েও কখনো আলোচনা হবে, ইনশাআল্লাহ।
(দ্র. নামাযের খুশূ বিষয়ে দেখুন : মাসিক আলকাউসার অক্টোবর ২০২৪ ঈ. সংখ্যা, পৃষ্ঠা : ১২-১৮, শিরোনাম : ‘নামাযের খুশূ হাসিল হবে যেভাবে’।
* তিলাওয়াতের খুশূ বিষয়ে দেখুন : ত্রৈমাসিক নারী, সেপ্টেম্বর-নভেম্বর ২০২৪ ঈ. সংখ্যা, পৃষ্ঠা : ৩-৪, শিরোনাম : ‘তিলাওয়াতে যেভাবে খুশূ হাসিল করা যায়’।)
[মাসিক দ্বীনী মজলিস
মারকাযুদ দাওয়াহ জামে মসজিদ,
হযরতপুর, কেরানীগঞ্জ, ঢাকা।
২৩ শাওয়াল ১৪৪৫ হি.
৩ মে ২০২৪ ঈ., জুমাবার।
শ্রুতলিখন : মুহাম্মাদুল্লাহ মাসুম]