জুমাদাল উলা ১৪৪৭   ||   নভেম্বর ২০২৫

তলাবায়ে কেরাম!
‖ নিজেকে রক্ষার বিষয়ে সতর্ক হোন

মাওলানা মুহাম্মাদ আব্দুল মালেক

الحمد لله، وسلام على عباده الذين اصطفى، أما بعد!

আল্লাহ রাব্বুল আলামীন দ্বীনী মাদারিসের চারপাশে দ্বীন-ঈমান, আকীদা-বিশ্বাস, চিন্তা-চেতনা, আদব-আখলাক, আযমত-মহব্বত তালীম-তরবিয়তের এমন মজবুত প্রাচীর তৈরি করে দিয়েছেন যে, বাইরের অসংখ্য ফেতনার ঢেউ এই প্রাচীরের কাছে এসে মিলিয়ে যায় তাই দেখা যায়, বাইরের মানুষেরা নানা রকম ফেতনায় জর্জরিত হয়ে আছে অথচ এই নিরাপদ সুরক্ষিত মজবুত দুর্গের ভেতরে যারা অবস্থান করছে, তাদের এসব ফেতনা ছুঁতেও পারেনি এমনকি অনেকের কল্পনায়ও আসেনি এরকম ফেতনায় কেউ লিপ্ত হতে পারে

কিন্তু আমাদের কর্মকাণ্ডে মনে হচ্ছে, আমরা নিজেরাই নিজেদের হাতে সেই প্রাচীর ভেঙে ফেলছি আর বাইরের ফেতনা আমাদেরও গ্রাস করে ফেলছে এবং সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তা কেবল বেড়েই চলেছে

কওমী পড়ুয়াদের কারও কারও মধ্যে নাস্তিকতার অনুপ্রবেশ, কাদিয়ানিয়াত ঈসাইয়্যাতের সহযোগিতা, মুলহিদ-যিন্দীক লোকদের অনুসরণ এবং বিভিন্ন ভ্রান্ত চিন্তা-চেতনার সমর্থন এর দলীল

যারা আকাবিরে দ্বীন আসাতিযায়ে কেরাম থেকে দ্বীনের তালীম তরবিয়ত যথাযথভাবে হাসিল করে না, উল্টো যেসব মাধ্যমে ফেতনার অনুপ্রবেশ ঘটে, সেগুলো অবলম্বন করে, তাদের এসব ফেতনায় আক্রান্ত হওয়াটাই তো স্বাভাবিক

সন্তানের হাতে বাবা-মা নিহত হওয়ার ঘটনা এখন অহরহ ঘটছে আল্লাহ তাআলা এই গযব থেকে আমাদের সমাজকে রক্ষা করুন কিন্তু দ্বীনী পরিবারের কোনো ছেলের হাতে বাবা খুন হওয়ার কথা কি কেউ কল্পনা করেছিল কখনো? কিন্তু সেটাও ঘটল সংবাদের বিবরণ অনুযায়ী, সেই ছেলে এই জঘন্য পাপকাজে উদ্বুদ্ধ হয়েছে মোবাইলের মাধ্যমে এই ঘটনা অনেক বড় অশনিসংকেত বহন করে

প্রিয় তালিবে ইলম ভাইয়েরা! নিজেকে রক্ষার বিষয়ে সতর্ক হোন নিজের কল্যাণের জন্যই মোবাইলসহ ফেতনার সমস্ত আসবাব থেকে দূরে থাকুন মন্দ সংশ্রব থেকে বেঁচে থাকুন ফেতনায় আক্রান্ত হওয়ার বিষয়টি শুরুতেই বোঝা যায় না; কিন্তু যখন বোঝা যায়, তখন হয়তো কিছুই করার থাকে না কারণ ততদিনে সেটা বিশাল বিষবৃক্ষে পরিণত হয়ে গেছে

হাদীস শরীফে ইরশাদ হয়েছে

تُعْرَضُ الْفِتَنُ عَلَى الْقُلُوبِ كَالْحَصِيرِ عُودًا عُودًا.

فَأَيُّ قَلْبٍ أُشْرِبَهَا، نُكِتَ فِيهِ نُكْتَةٌ سَوْدَاءُ، وَأَيُّ قَلْبٍ أَنْكَرَهَا، نُكِتَ فِيهِ نُكْتَةٌ بَيْضَاءُ.

حَتَّى تَصِيرَ عَلَى قَلْبَيْنِ :

عَلَى أَبْيَضَ مِثْلِ الصَّفَا، فَلَا تَضُرُّهُ فِتْنَةٌ مَا دَامَتِ السَّمَاوَاتُ وَالْأَرْضُ.

وَالْآخَرُ أَسْوَدُ مُرْبَادًّا كَالْكُوزِ، مُجَخِّيًا، لَا يَعْرِفُ مَعْرُوفًا، وَلَا يُنْكِرُ مُنْكَرًا، إِلَّا مَا أُشْرِبَ مِنْ هَوَاهُ.

চাটাই বুননের মতো এক এক করে ফেতনা মানুষের অন্তরে আসতে থাকবে

যে অন্তরে কোনো ফেতনা ঢুকবে, তাতে একটি কালো দাগ পড়ে যাবে আর যে অন্তর তা প্রত্যাখ্যান করবে, তাতে একটি শুভ্রোজ্জ্বল চিহ্ন পড়বে

এভাবে একপর্যায়ে অন্তরগুলো দুই ধরনের হয়ে যায়

এক প্রকার হয় শ্বেতপাথরের মতো আসমান জমিন যতদিন থাকবে, কোনো ফেতনা তার কোনো ক্ষতি করতে পারবে না

আরেক প্রকার হয় উল্টানো কালো কলসির মতো কোনো ভালোকে সে ভালো মনে করে না এবং কোনো মন্দকে সে মন্দ মনে করে না তার ভেতরে যে প্রবৃত্তি ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে, কেবল সেটারই সে অনুসরণ করে সহীহ মুসলিম, হাদীস ১৪৪

নিয়মিত কুরআন তিলাওয়াত করুন যারা তারজামাতু মাআনিল কুরআনিল কারীম অধ্যয়নের পর্যায়ে পৌঁছেছেন তারা সামান্য সময়ের জন্য হলেও তাদাব্বুর তাযাক্কুরের সঙ্গে কুরআন মুতালাআ করুন সঙ্গে আততরীক ইলা তাফসীরিল কুরআনিল কারীম, আসান তাফসীরে কুরআন, তাফসীরে তাওযীহুল কুরআন, তাফসীরে উসমানী বা বুরহানুল কুরআনের মতো সংক্ষিপ্ত কোনো তাফসীর রাখুন

উস্তাযগণের সঙ্গে সম্পর্ক মজবুত রাখুন কেবল নিয়মের সম্পর্ক নয়; উসতায-শাগরিদের যে পবিত্র নিসবত, সেটাকে যিন্দা করার চেষ্টা করুন

মনে রাখবেন, আসাতিযায়ে কেরাম থেকে যারাই বিচ্ছিন্ন হয়েছে, তারাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে আসাতিযায়ে কেরাম থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে কেউ কখনো তাফাক্কুহ হাসিল করতে পারেনি তাই তাদের থেকে আদব-আখলাক শিখুন, দ্বীনের সমঝ, আফকার যওক হাসিলের চেষ্টা করুন তাদের তাম্বীহ তরবিয়ত ইকরাম মহব্বতের সঙ্গে গ্রহণ করুন আজকাল এর বড়ই অভাব

অনেক ছাত্র সন্তান উসতায বাবা-মায়ের তরবিয়ত শাসন যথাযথভাবে গ্রহণ করে না মনে রাখা উচিত, বাবা-মা আসাতিযায়ে কেরামই আমাদের সবচেয়ে বড় কল্যাণকামী আমাদের কল্যাণের জন্যই তারা আমাদের সতর্ক করেন এবং শাসন করেন এই অনুভূতি যদি আমাদের মধ্যে জাগ্রত থাকে, তাহলে মুরব্বীদের শাসন ধমকের দ্বারা আমাদের অন্তরে তাদের প্রতি আরও মহব্বত আযমত তৈরি হবে, যেটা আমাদের যিন্দেগীতে আরও নূর বরকত নিয়ে আসবে নতুবা কেবল ক্ষতি আর ক্ষতি

আকাবির আসলাফের জীবনী এবং তাদের মালফুযাত মাকতুবাত অধ্যয়নের প্রতি যত্নবান হোন এর জন্য বিরতির সময়গুলোকে কাজে লাগান

কওমী মাদরাসার আদর্শ-ঐতিহ্য চিন্তা-চেতনা সম্পর্কে ইতিপূর্বে বিভাগে অনেক প্রবন্ধ-নিবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে অবসরে সেগুলো পুনরায় পড়ে নিলে ফায়দা হবে ইনশাআল্লাহ

হাদীস শরীফে শয়তানের ওয়াসওয়াসা, নফসের অনিষ্ট এবং ফেতনা গোমরাহী থেকে আত্মরক্ষার অনেক দুআ বর্ণিত হয়েছে সেগুলোর বিষয়ে আমাদের যত্নবান হওয়া উচিত ধরনের কিছু দুআ এই :

. কুরআন কারীমের দুআ

رَبَّنَا لَا تُزِغْ قُلُوْبَنَا بَعْدَ اِذْ هَدَیْتَنَا وَ هَبْ لَنَا مِنْ لَّدُنْكَ رَحْمَةً اِنَّكَ اَنْتَ الْوَهَّابُ.

(সূরা আলে ইমরান (০৩) : ০৮)

. সকাল-সন্ধ্যা রাতে ঘুমানোর সময়

اَللّٰهُمَّ عَالِمَ الْغَيْبِ وَالشَّهَادَةِ، فَاطِرَ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ، رَبَّ كُلِّ شَيْءٍ وَمَلِيكَه، أَشْهَدُ أَنْ لَا إِلٰهَ إِلَّا أَنْتَ وَحْدَكَ، لَا شَرِيْكَ لَكَ، وَأَنَّ مُحَمَّدًا عَبْدُكَ وَرَسُوْلُكَ، أَعُوْذُ بِكَ مِنْ شَرِّ نَفْسِيْ، وَمِنْ شَرِّ الشَّيْطَانِ وَشِرْكِه، وَأَنْ أَقْتَرِفَ عَلٰى نَفْسِيْ سُوْءًا، أَوْ أَجُرَّه إِلٰى مُسْلِمٍ.

নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আবু বকর রা.-কে তার আবেদনের প্রেক্ষিতে এই দুই শিখিয়েছেন

(মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ৫১, ৮১; সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ৫০৬৭; জামে তিরমিযী, হাদীস ৩৩৯২, ৩৫২৯)

. উম্মুল মুমিনীন আয়েশা রা.-কে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দুআ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন, নবীজী এই দুআ করতেন

اَللّٰهُمَّ إِنِّيْ أَعُوْذُ بِكَ مِنْ شَرِّ مَا عَمِلْتُ، وَمِنْ شَرِّ مَا لَمْ أَعْمَلْ.

(সহীহ মুসলিম, হাদীস ২৭১৬)

. শাকাল ইবনে হুমাইদ রা. একবার নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে একটি দুআ শেখানোর আবেদন করলেন, যার মাধ্যমে তিনি আল্লাহর আশ্রয় গ্রহণ করবেন তখন নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার হাত ধরলেন এবং ইরশাদ করলেন, বলো

اَللّٰهُمَّ إِنِّي أَعُوذُ بِكَ مِنْ شَرِّ سَمْعِي، وَمِنْ شَرِّ بَصَرِي، وَمِنْ شَرِّ لِسَانِي، وَمِنْ شَرِّ قَلْبِي، وَمِنْ شَرِّ مَنِيِّي.

(সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ১৫৫১; জামে তিরমিযী, হাদীস ৩৪৯২; মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা, হাদীস ২৯৭৫৫)

. এক হাদীসে আছে, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবায়ে কেরামের উদ্দেশে আরয করলেন

تَعَوَّذُوا بِاللهِ مِنَ الْفِتَنِ، مَا ظَهَرَ مِنْهَا وَمَا بَطَنَ.

তোমরা প্রকাশ্য-গোপন সমস্ত ফেতনা থেকে আল্লাহর আশ্রয় গ্রহণ করো

সাহাবায়ে কেরাম বললেন

نَعُوْذُ بِاللهِ مِنَ الْفِتَنِ، مَا ظَهَرَ مِنْهَا وَمَا بَطَنَ.

আমরা প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য সমস্ত ফেতনা থেকে আল্লাহর আশ্রয় গ্রহণ করছি সহীহ মুসলিম, হাদীস ২৮৬৭

. নামাযের শেষ বৈঠকে নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এই দুআও পড়তেন

اَللّٰهُمَّ إِنِّيْ أَعُوْذُ بِكَ مِنْ عَذَابِ الْقَبْرِ، وَأَعُوْذُ بِكَ مِنْ فِتْنَةِ الْمَسِيْحِ الدَّجَّالِ، وَأَعُوذُ بِكَ مِنْ فِتْنَةِ الْمَحْيَا وَالْمَمَاتِ، اَللّٰهُمَّ إِنِّيْ أَعُوْذُ بِكَ مِنَ الْمَأْثَمِ وَالْمَغْرَمِ.

(সহীহ বুখারী, হাদীস ৮৩২; সহীহ মুসলিম, হাদীস ৫৮৯)

. আরেকটি দুআ

اَللّٰهُمَّ إِنِّيْ أَعُوْذُ بِكَ مِنَ العَجْزِ وَالكَسَلِ، وَالجُبْنِ وَالبُخْلِ وَالهَرَمِ، وَأَعُوذُ بِكَ مِنْ عَذَابِ القَبْرِ، وَأَعُوذُ بِكَ مِنْ فِتْنَةِ المَحْيَا وَالمَمَاتِ.

(সহীহ বুখারী, হাদীস ৬৩৬৭)

আল্লাহ তাআলা আমাদের সবাইকে সমস্ত ফেতনা থেকে হেফাযতে রাখুন আমীন

وآخر دعوانا أن الحمد لله رب العالمين.

 

 

advertisement