জুমাদাল উলা-১৪৩২   ||   এপ্রিল-২০১১

ফতোয়াবিরোধী অপপ্রচার : ফতোয়া শব্দের অবমাননা বন্ধ করুন

 

 

ফতোয়া দ্বীন ও শরীয়তের মুখপত্র এবং ফতোয়া দ্বীনী ইলমের বিস্তার ও দ্বীনের বিধান প্রতিষ্ঠার গুরুত্বপূর্ণ উপায়। ইসলামের প্রথম যুগ থেকেই তা ছিল এবং যতদিন দ্বীন ও শরীয়ত থাকবে ততদিন ফতোয়াও থাকবে ইনশাআল্লাহ। সুতরাং ফতোয়ার অবমাননা দ্বীন ও শরীয়তের অবমাননা এবং ফতোয়ার বিরোধিতা দ্বীন ও শরীয়তেরই বিরোধিতা। কোনো ঈমানদারের পক্ষে স্বেচ্ছায়  ও স্বজ্ঞানে এমন কাজে লিপ্ত হওয়া কখনো সম্ভব নয়।  

সম্প্রতি ফতোয়া নতুন করে আলোচনায় এসেছে একটি বিশেষ মহলের অপব্যাখ্যা ও অপপ্রচারের শিকার হয়ে। তাই ঈমানের হেফাযতের জন্যই এ বিষয়ে পরিষ্কার ধারণা থাকা প্রয়োজন।  

ফতোয়া কুরআন-সুন্নাহর শব্দ এবং দ্বীন ও শরীয়তের পরিভাষা। এর অর্থ এতই সুস্পষ্ট যে, এখানে বিভ্রান্তির কোনো অবকাশ নেই। আলকামূসুল মুহীত, লিসানুল আরব প্রভৃতি বিখ্যাত অভিধান-গ্রন্থে এবং আলমিসবাহুল মুনীর প্রভৃতি কিতাবে ফতোয়ার সংজ্ঞায় বলা হয়েছে-আলফাতওয়া মা আফতা বিহীল ফকীহ। অর্থাৎ কারো প্রশ্নের জবাবে ফিকহ ও ফতোয়ায় বিশেষজ্ঞ ব্যক্তি শরীয়তের যে বিধান বর্ণনা করেন তা-ই ফতোয়া। সুতরাং ফতোয়া দেওয়ার অধিকার তাঁদেরই রয়েছে, যারা ফিকহ ও ফতোয়ায় বিশেষজ্ঞ। বিশেষজ্ঞতাই এখানে মানদন্ড, সরকারি নিয়োগ বা অন্য কিছু নয়। তেমনি ফতোয়া হচ্ছে বিধান বর্ণনা, বিধান প্রয়োগ নয়। সুতরাং আইনী ব্যক্তির আইনী রায় দ্বারা ফতোয়াকে সংজ্ঞায়িত করা যেমন এই শব্দের তাহরীফ ও অপব্যাখ্যা তেমনি গ্রাম্য সালিশের রায় ও তার প্রয়োগকে ফতোয়া বলে আখ্যায়িত করাও এই শব্দের চূড়ান্ত অপপ্রয়োগ।  

ফতোয়া যেহেতু শরীয়তের বিধান বর্ণনা তাই তা ইকামতে দ্বীন তথা দ্বীনের অনুসরণ ও জীবনের সকল অঙ্গনে দ্বীন প্রতিষ্ঠার অন্যতম উপায়। আর এ কারণেই তা ধর্মবিদ্বেষীদের আক্রমণ ও বিষোদগারের লক্ষ্যবস্ত্ত। ৯০ ভাগ মুসলিমের দেশে সরাসরি কুরআন-সুন্নাহকে আক্রমণ করা নিরাপদ নয় বলে এরা কপটতার আশ্রয় নেয় এবং অপব্যাখ্যা ও অপপ্রচারের মাধ্যমে দ্বীনের প্রচার ও প্রতিষ্ঠা বাধাগ্রস্ত করতে চায়।

দ্বীন ও ইকামতে দ্বীনের বিরুদ্ধে অসত্য প্রচারণা নতুন কিছু নয়। তেমনি দ্বীনের প্রতিক ও পরিভাষার অবমাননাও ধর্ম-বিদ্বেষীদের পুরানো প্রবণতা। সর্বযুগের ইসলাম-বিদ্বেষী চক্র এই জাতীয় পরিচয় বহন করে এসেছে।

এই অঞ্চলেও বিদ্বেষ ও প্রতিহিংসা থেকে ইসলামী পরিভাষার বিকৃতি ও অবমাননার অনেক দৃষ্টান্ত রয়েছে। এখানে শুধু দুটি শব্দের উদাহরণ দিচ্ছি।

ফতোয়ার মতোই গুরুত্বপূর্ণ দুটি পরিভাষা হচ্ছে কাযাখিলাফা। প্রথমটি ইসলামের বিচার-ব্যবস্থা ও দ্বিতীয়টি শাসন-ব্যবস্থার দিকে ইঙ্গিত করে।

কাযা অর্থ বিচার। কুরআন মজীদের অনেক জায়গায় এ শব্দটি আছে। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর অন্যতম মহান দায়িত্ব ছিল কাযা ও বিচার। কুরআন মজীদে আল্লাহ তাআলা বলেন-

فلا وربك لا يؤمنون حتى يحكموك فيما شجر بينهم ثم لا يجدوا فى انفسهم حرجا مما قضيت وسلموا تسليما

অতএব আপনার প্রতিপালকের কসম! তারা মুমিন হবে না যতক্ষণ না তাদের বিবাদ-বিসংবাদের বিষয়ে আপনাকে বিচারক বলে গ্রহণ করে। অতপর আপনার মীমাংসার বিষয়ে অন্তরে কেনোরূপ দ্বিধা পোষণ না করে এবং সমর্পিত চিত্তে তা গ্রহণ করে। (সূরা নিসা : ৬৫)

কুরআন মজীদের উপরোক্ত ঘোষণা থেকে জানা যায়, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শুধু আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে কাযা ও বিচারের অধিকারপ্রাপ্তই নন, বরং বিবাদ-বিসংবাদে তাঁর শরণাপন্ন হওয়া এবং তাঁর ফয়সালা সর্বান্তকরণে মেনে নেওয়া উম্মতের জন্য অপরিহার্য।

নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর পর খোলাফায়ে রাশেদীন ও সাহাবায়ে কেরাম মুসলিম-জাহানের বিভিন্ন অঞ্চলে কাযা ও বিচারের দায়িত্ব পালন করেছেন। তাঁদের পর তাবেয়ীন, তাবে-তাবেয়ীন ও অনেক মুজতাহিদ ইমাম কাযার মসনদে সমাসীন হয়েছেন। ইসলামী খেলাফত ও মুসলিম-শাসনামলের শেষ পর্যন্ত কুরআন-সুন্নাহ ও ফিকহে ইসলামী অনুসারে বিচারকার্য পরিচালিত হয়েছে। এই উপমহাদেশে ইংরেজ বেনিয়াদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার আগ পর্যন্ত ইসলামী বিচার-ব্যবস্থা কার্যকর ছিল। দীর্ঘ মুসলিম-শাসনামলে ইসলামী আইন অনুযায়ী বিবাদ-বিসংবাদের নিষ্পত্তি হয়েছে এবং ইনসাফ ও সুবিচার নিশ্চিত হয়েছে। কাযাকাযী শব্দ দুটি এই উজ্জ্বল ইতিহাসের ধারক। অথচ দেখুন, হিন্দু বাবুরা কীভাবে এই ইতিহাসকে বিকৃত করার চেষ্টা করেছেন। কলকাতা সাহিত্য-সংসদ থেকে প্রকাশিত সংসদ বাঙ্গালা অভিধানে কাযী শব্দের ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে-কাজী, কাজি-বি. মুসলমান বিচারক বা ব্যবস্থাপক। [আ.কাজী]। কাজীর বিচার- ন্যায়ধর্মহীন বা একচোখা বিচার। (সংসদ বাঙ্গালা অভিধান, চতুর্থ সংস্করণ, ঊনবিংশ মুদ্রন)

দ্বীন ও শরীয়তের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ পরিভাষা হল, খলীফা। ইসলামের চার খলীফা হযরত আবু বকর সিদ্দীক রা., হযরত উমর ফারুক রা., হযরত উছমান ইবনে আফফান রা. ও হযরত আলী ইবনে আবু তালিব রা. ছিলেন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সবচেয়ে মর্যাদাবান সাহাবী। কুরআন মজীদের অনেক জায়গায় তাঁদের ও অন্যান্য সাহাবীদের উচ্চ মর্যাদা ঘোষণা করা হয়েছে। হাদীস শরীফের ভাষায় তাঁরা ছিলেন খোলাফায়ে রাশেদীন। অর্থাৎ রাজ্য শাসনে আল্লাহর নবীর যথার্থ উত্তরসূরী। সুতরাং খলীফাখিলাফত অতি মর্যাদাপূর্ণ শব্দ, যা নবী-যুগের পর ইসলামী ইতিহাসের সর্বাধিক মহিমান্বিত অংশের ধারক। সুতরাং এ শব্দও যে হিন্দু বাবুদের বিদ্বেষ ও প্রতিহিংসার শিকার হবে তা সহজেই অনুমান করা যায়। একই অভিধানে এই শব্দের ব্যাখ্যা করা হয়েছে এভাবে :

খলিফা, খলীফা-(১) বি. ওস্তাদ, কারিগর, দরজী; মুসলমান জগতের শ্রেষ্ঠ নৃপতি ও ধর্ম-নেতার উপাধি; (ব্যঙ্গে) ওস্তাদ বা ধুর্ত ব্যক্তি। (২) বিণ. (ব্যঙ্গে) ওস্তাদ বা ধুর্ত। [আ.খলীফা]

বস্ত্তত এইসব হচ্ছে ইসলামের কিছু পরিভাষাকে বিকৃত ও লাঞ্ছিত করার পরিকল্পিত প্রচেষ্টা।

এ জাতীয় ব্যাখ্যায় সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ প্রকটভাবে প্রকাশিত হওয়ার কারণেই বোধ হয় বাংলা একাডেমীর ব্যবহারিক অভিধানে তা বর্জন করা হয়েছে।

কাযী ও খলীফার মতোই ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ শব্দ ফতোয়া কেও অপাংক্তেয় করার অপচেষ্টা করা হচ্ছে। পার্থক্য শুধু এইটুকু যে, আগের শব্দগুলি বিকৃত করেছেন কিছু সাম্প্রদায়িক হিন্দু, আর ফতোয়া শব্দটি বিকৃত করছেন কতিপয় উদার ও অসাম্প্রদায়িক মুসলমান। এ জাতীয় কর্মকান্ড হচ্ছে তাদের অসাম্প্রদায়িকতাধর্ম-নিরপেক্ষতার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত!

মুসলিম দেশগুলির বিচার বিভাগ ও নির্বাহী বিভাগ ইসলামের নীতি ও ব্যবস্থা থেকে আলাদা হয়ে গেলেও ব্যক্তিগতভাবে অধিকাংশ মুসলিম ইসলামী বিধিবিধান মেনে চলার চেষ্টা করেন। ঈমান-আকীদা থেকে শুরু করে ইবাদত-বন্দেগী, বিয়েশাদি,  লেনদেন ইত্যাদি সকল বিষয়ে তাঁরা আলিমদের নিকট মাসআলা জিজ্ঞাসা করেন এবং সে অনুযায়ী আমল করেন। জাতীয় শিক্ষা-ব্যবস্থায় দ্বীনী ইলম সম্পূর্ণ উপেক্ষিত হওয়ার পরও এই জিজ্ঞাসা ও জবাবের সূত্রে সাধারণ মুসলমানদের মাঝে দ্বীনী ইলমের কিছু চর্চা এখনো অব্যাহত রয়েছে। আর এ কারণেই তা ধর্মদ্রোহী চক্রের মাথাব্যাথার কারণ। তাই একদিকে তারা ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে ফতোয়া নিষিদ্ধ করার অপচেষ্টায় লিপ্ত অন্যদিকে ব্যাপক অপপ্রয়োগের মাধ্যমে ফতোয়াকে নারী-নির্যাতনের একটি উপায় হিসেবে চিহ্নিত করতে সচেষ্ট। এমনকি কোনো কোনো বেদ্বীন তো সন্ত্রাস, দুর্নীতি ও নারী-নির্যাতনের সাথে ফতোয়া শব্দটি উল্লেখ করে থাকে! (নাউযুবিল্লাহ)

খুব ভালোভাবে শুনে নেওয়া উচিত, এটি এমন ভয়াবহ অপরাধ, যার কারণে এই ভূখন্ডে নেমে আসতে পারে মহাবিপর্যয়। আল্লাহ আমাদের ক্ষমা করুন ও হেফাযত করুন।

প্রত্যেক মুমিনের ঈমানী দায়িত্ব, শরীয়তের এই পরিভাষাটির মর্যাদা-রক্ষায় সর্বশক্তি নিয়োজিত করা এবং ব্যাপক গণসচেতনতার মাধ্যমে ধর্মবিদ্বেষী চক্রের মুখোশ উন্মোচন করা। এক্ষেত্রে সম্মানিত খতীব ছাহেবান ও বিজ্ঞ ওয়ায়েজীনে কেরাম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারেন। প্রিন্ট মিডিয়া ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ায় কর্মরত ঈমানদার ভাইরাও তাঁদের ঈমানের দাবি পূরণে এগিয়ে আসতে পারেন।

আমাদের প্রথম কর্তব্য, যুক্তির ভাষায় বিষয়টি সর্বসাধারণের সামনে তুলে ধরা এবং ফতোয়া বিরোধী তৎপরতা ও ফতোয়া শব্দের অপপ্রয়োগ সম্পর্কে গণসচেতনতা সৃষ্টি করা। আমরা যদি ইখলাস ও ইতকানের সাথে এই দায়িত্ব পালনে সক্ষম হই তাহলে ইনশাআল্লাহ আল্লাহর নুসরত নাযিল হবে এবং আল্লাহর কালিমা বুলন্দ হবে।

আল্লাহ রাববুল আলামীন আমাদের তাওফীক দান করুন। আমীন।

এলান

 

  সংখ্যায় নারী উন্নয়ন নীতি ২০১১ ও প্রাসঙ্গিক কিছু বিষয়ে আলোকপাত করা হয়েছে। আগামী সংখ্যায় উত্তরাধিকার সম্পদে নারীর অংশ ও প্রাসঙ্গিক বিভিন্ন বিষয় নিয়ে একটি আয়োজন থাকবে ইনশাআল্লাহ।

 

 

advertisement