মানবিক বিপর্যয়কে হাতিয়ার বানানোর পাঁয়তারা
ওয়াসআতুল্লাহ খান
বর্তমানে হামাসের হাতে প্রায় ৫৬ জন বন্দি আছে। যার মধ্যে ২৩ জন জীবিত আছে বলে দাবি করা হচ্ছে। স্থায়ী যুদ্ধবিরতি ও গাজা থেকে সব সৈন্য প্রত্যাহারের শর্তে তারা অপহৃত সব বন্দি ও মৃতদের মরদেহ ইসরাইলের কাছে হস্তান্তর করতে পুরোপুরি প্রস্তুত। ট্রাম্পের মধ্যপ্রাচ্য সফরকালে আমেরিকান বংশোদ্ভূত দ্বৈত নাগরিকত্বের অধিকারী এক ইসরাইলী সৈন্যের নিকট রেডক্রসের মাধ্যমে হামাস এ প্রস্তাব দিয়েছে।
শুধু নেতানিয়াহুর মন্ত্রী পরিষদ ছাড়া অপহৃতদের সকল আত্মীয়-স্বজন, দেশটির সকল বিরোধী দল ও ৭৫ ভাগ ইসরাইলী নাগরিক এখন যুদ্ধবিরতি চায়; কিন্তু নেতানিয়াহুর মন্ত্রী পরিষদ অপহৃতদের পরিবর্তে মানবশূন্য ও পূর্ণ গাজা চায়। তাদের এ চাওয়া কোনো গোপন বিষয় নয়।
ইসরাইলের অর্থমন্ত্রী বেজালেল স্মুতরিচ (Bezalel Smotrich) ও জাতীয় নিরাপত্তা বিষয়ক মন্ত্রী ইতামার বেন-গাভির (Itamar Ben-Gvir) বলেছে, হামাস সব অপহৃতদের মুক্তি দিয়ে দিলেও ইসরাইল গাজার সামরিক অধিকার প্রত্যাহার করবে না। ফিলিস্তিনীদের জন্য সবশেষ সুযোগ হল, তারা সেখান থেকে চলে যাবে।
৫ মে ইসরাইলের নিরাপত্তা পরিষদ ‘গিদিয়োন চেরিয়েটস’ (Gideon’s Chariots) অভিযানের অনুমোদন দিয়েছে। এ উপলক্ষ্যে নেতানিয়াহু জানিয়েছে, আমরা আর কোনো ইসরাইলীকে হারাতে চাই না। আমরা চাই শুধু ফিলিস্তিনীরাই মারা যাক। এই সুপারিশের একটা উদ্দেশ্য এটাও হতে পারে, ফিলিস্তিনীরা যদি নিজেদের মাটি আঁকড়ে থাকে, তাহলে ক্ষুধা ও পিপাসায় মারা পড়বে। কেননা বোমার আঘাতে এ পর্যন্ত ২৪ লক্ষ জনসংখ্যার কেবল ৫৫ হাজার মানুষ মৃত্যুবরণ করেছে।
বর্তমানে গাজার পার্শ্ববর্তী অঞ্চলগুলোতে জাতিসংঘের বিভিন্ন এজেন্সির গুদামে ১ লক্ষ ৭১ হাজার মেট্রিক টন খাদ্য মজুদ আছে। যা গাজার জনসংখ্যার জন্য মাত্র ৪ মাসের খাদ্য। কিন্তু ইসরাইল ক্ষুধা ও তৃষ্ণাকে জাতি নিধনের মোক্ষম হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে।
জাতিসংঘের প্রতিবেদন অনুযায়ী, বর্তমানে গাজায় চলছে বিশ্বের ভয়াবহ কৃত্রিম দুর্ভিক্ষ। ২ মার্চ থেকে আরোপিত অবরোধ আরও এক মাস অব্যাহত থাকলে গাজার ২৫ শতাংশ মানুষ ক্ষুধায় মারা যেত। যার বড় অংশই হত শিশু। ক্ষুধা ও পিপাসায় এখন পর্যন্ত যে ৫৮ জনের মৃত্যু হয়েছে; তার ৫১ জনই শিশু। যাদের বয়স শূন্য থেকে ১০ বছরের মধ্যে।
বিশ্বের ২০টি যুদ্ধ কনভেনশনের মধ্যে ১৯৪৯ সালের জেনোসাইড কনভেনশনও আছে। এতে ইসরাইল, আমেরিকা, ব্রিটেন, ফ্রান্স ও জার্মানিসহ ১৫৩টি দেশের স্বাক্ষর রয়েছে। কনভেনশনটি মূলত নাৎসি জার্মানির কনসার্নট্রেশন ক্যাম্পগুলোতে লক্ষ লক্ষ ইহুদী হত্যার প্রেক্ষিতে তৈরি হয়েছিল। কনভেনশন অনুযায়ী জাতি নিধন একটি আন্তর্জাতিক অপরাধ। আর জাতি নিধনের যে সংজ্ঞা ও পরিচয় নির্ধারণ করা হয়েছে, তাতে যে কোনো দল/গোষ্ঠীর মানুষকে ক্ষুধা ও পিপাসায় হত্যা করা এবং জাতি নিধনের উদ্দেশ্যে ঐ গোষ্ঠীর মানুষকে জোরপূর্বক অবরুদ্ধ করে রাখাও শামিল।
আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত গত এক বছরে তিন তিনবার রায় প্রদান করেছে যে, ইসরাইল পুরোপুরিভাবে না হলেও আংশিকভাবে গাজায় জাতি নিধনে লিপ্ত রয়েছে। আর নেতানিয়াহু ও তার প্রাক্তন প্রতিরক্ষা মন্ত্রী ইওভ গ্যালান্ট (Yoav Gallant )-এর বিরুদ্ধে কবে থেকেই তো গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করে রেখেছে! এ ওয়ারেন্ট পালন করা ঐসব রাষ্ট্রের জন্য অপরিহার্য, যারা আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের স্বীকৃতি প্রদান করে। (আমেরিকা ও ইসরাইল এর স্বীকৃতি দেয় না।)
ওয়ারেন্ট-এর অর্থ হল, অভিযুক্ত ব্যক্তি স্বাক্ষরকারী যে কোনো দেশের ভূমি, আকাশ ও সমুদ্রসীমা অতিক্রম করলে সংশ্লিষ্ট রাষ্ট্রের জন্য অপরিহার্য হল, তার গ্রেফতারে সহযোগিতা করা এবং আদালতে সোপর্দ করা। যদিও ওয়ারেন্ট জারির পর নেতানিয়াহু দুই বার আমেরিকা এবং একবার হাঙ্গেরি সফর করেছে। জার্মানি ও ব্রিটেনও এই ওয়ারেন্ট রক্ষার প্রতিশ্রুতি প্রদান করেছে।
উপরে ইসরাইলের মন্ত্রী পরিষদের অনুমোদন দেওয়া ‘গিদিয়োন চেরিয়েটস’ অভিযানের কথা বলা হয়েছে। অপারেশনটির নাম জনৈক ইহুদী নবী গিদিয়োন-এর একটি অভিযান অনুসারে রাখা হয়েছে। কথিত আছে, অভিযানটিতে গিদিয়োন তার রথে চড়ে সৈন্যদলের নেতৃত্ব দিয়েছিল এবং সে যুদ্ধে নিজেদের কাউকে বন্দি হতে হয়নি; বরং প্রতিপক্ষের অঞ্চলগুলো ধুলোয় মিশিয়ে দিয়ে জয়লাভ করেছিল। যেন ইহুদী শরীয়তের বর্তমান ইসরাইলী ব্যাখ্যা এই যে, গাজার জায়তুন গাছসহ কাউকেই আর জীবিত রাখা হবে না। এ কারণেই মন্ত্রী পরিষদ সিদ্ধান্ত নিয়েছে, ট্রাম্পের উপসাগরীয় দেশগুলোর সফর শেষ হওয়ার পরপরই এই অপারেশন দ্রুতসময়ে সম্পন্ন করা। যেন জাতিসংঘের পক্ষ থেকে চাপ আসার আগেই নিজেদের লক্ষ্য অর্জন করে নেওয়া যায়।
গিদিয়োন চেরিয়েটস-এর পরিকল্পনা অনুযায়ী, ৯০ ভাগ গাজা জনশূন্য করে সকল ফিলিস্তিনীকে এক প্রান্তে একত্র করা হবে। এরপর পুরো অঞ্চলকে ‘বাফার জোন’ ও ‘সেফ জোন’ হিসেবে ভাগ করে ফিলিস্তিনীদের চলাফেরা দুর্বিষহ করে তোলা হবে। ফিলিস্তিনীরা যেন কখনো নিজেদের ঘরবাড়িতে ফিরে যাওয়ার কল্পনাও করতে না পারে, সেজন্য গাজার ধ্বংসস্তূপগুলো পরিষ্কার করার পাশাপাশি এখনো যেসব স্থাপনা অক্ষত আছে সেগুলোও গুড়িয়ে দিয়ে পুরো বসতি ধ্বংস করে দেওয়া হবে। আর এসব কাজ এমনভাবে করা হবে, যেন যেকোনো সময় সেখানে নতুন স্থাপনা নির্মাণের কাজ শুরু করা যায়। (ট্রাম্প আগেই বলে এসেছে, গাজার তীরবর্তী মনোরম এই অঞ্চলটিকে সে ‘জান্নাত’ বানাতে চায়।)
অপারেশন গিদিয়োন চেরিয়েটস অনুযায়ী, ফিলিস্তিনীদের খাদ্য সহযোগিতায় ফিলিস্তিনী শরণার্থীদের জন্য জাতিসংঘের ত্রাণ ও কর্মসংস্থান সংস্থাসহ (টঘজডঅ) জাতিসংঘের অন্য এজেন্সিগুলোর কোনো ভূমিকা থাকবে না। শুধু ইসরাইলের মনোনীত ঠিকাদারদের মাধ্যমেই খাদ্য বিতরণ করা হবে। শুধু ঐসব লোকদের মাঝেই খাদ্য বিতরণ করা হবে, যাদের বিরুদ্ধে হামাস ও তাদের কার্যক্রমের সাথে প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষ কোনো প্রকার সংশ্লিষ্টতার প্রমাণ থাকবে না। পরিকল্পনা অনুযায়ী ফিলিস্তিনীদেরকে উৎসাহ দেওয়া হবে, তারা যদি নিজেদের এই অবস্থায় সন্তুষ্ট না থাকে, তবে চাইলে তৃতীয় কোনো দেশে স্বেচ্ছায় হিজরত করে যেতে পারবে। এ বিষয়ে ইসরাইল তাদের সব রকম সহযোগিতা দেবে।
রাষ্ট্রের পূর্ব ঐতিহ্য থেকে বেরিয়ে এসে ট্রাম্প তার মধ্যপ্রাচ্য সফরে ইসরাইলকে শামিল করেনি– শুধু এতেই অনেকে উল্লসিত হয়েছে। কিন্তু ইসরাইল এতে সামান্যও বিচলিত নয়। কারণ তার পেছনে আছে পুরো আমেরিকান কংগ্রেস। তাছাড়া মধ্যপ্রাচ্য দেশগুলোর সাথে সাড়ে তিন ট্রিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের যে প্রতিশ্রুতি ট্রাম্প পকেটে ভরে নিয়ে গিয়েছে, তার অংশবিশেষ তো ইসরাইলের হাই-টেক কোম্পানিগুলোর পকেটেও যাবে।
৭৭ বছর ধরে পালিত হওয়া ঐতিহাসিক ‘নাকবা দিবসে’ এবারের দিনটি মানব ইতিহাসের সবচেয়ে দীর্ঘতম একটি দিনই বটে।
[একটি বিদেশি দৈনিক থেকে অনূদিত।
অনুবাদ : মাওলানা মুহাম্মাদ আবদুল্লাহ ফাহাদ]