আওয়ামী লীগের কার্যক্রমে নিষেধাজ্ঞা
আব্দুল হামিদের দেশত্যাগ : প্রসঙ্গ কথা
আবুন নূর
অবশেষে আওয়ামী লীগের রাজনীতি নিষিদ্ধ করে প্রজ্ঞাপন জারি করল অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। আওয়ামী ফ্যাসিবাদের মূল হোতাদের অধিকাংশ দেশ থেকে পালিয়েছে ৯ মাস হতে চলল। এর মধ্যে অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে সাধারণ জনগণের সবচেয়ে বড় চাওয়াটি ছিল, ইতিহাসের সবচেয়ে জঘন্যতম জালেম গোষ্ঠীর বিচার এবং তাদের রাজনীতি এদেশে চিরতরে নিষিদ্ধ করা। যেন ভবিষ্যতের জন্য এগুলো দৃষ্টান্ত হয়ে থাকে এবং আগামীতে আর কেউ এদেশের মানুষের ওপর প্রভুত্ব দেখানোর সাহস না করে। কারও যেন স্পর্ধা না হয়– এই দেশ এবং এদেশের মানুষকে নিজেদের পৈতৃক সম্পদ এবং গোলাম বা চাকর-বাকর মনে করে যাচ্ছেতাই আচরণ করার। কিন্তু এদেশের শান্তিকামী মানুষ বড়ই হতাশ চোখে প্রত্যক্ষ করে আসছে যে, গণ আন্দোলনের সফলতার সুবিধাভোগী অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এ দুটি কাজেই মনোযোগ দিয়েছে কম। আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার ব্যাপারে তারা প্রকাশ্যে অনীহার কথা বলেছেন অনেকবার। ফ্যাসিবাদের দোসরদের যারা পালিয়ে গেছে, তাদের কাউকে ফিরিয়ে আনা গেছে বলে এখনো দেখা যাচ্ছে না। দেশের যে লক্ষ লক্ষ কোটি টাকা তারা পাচার করেছে, সেগুলোর কিয়দংশও ফেরত এসেছে বলে শোনা যায়নি। তাদের যেসব নেতা ভাগ্যদোষে পালাতে ব্যর্থ হয়েছেন, তারাও নাকি বেশ আয়েশেই জেল খাটছেন। মাঝেমধ্যে যখন তাঁদেরকে আদালতে হাজির করা হয়, তখন তাদের চেহারা-সুরতও এমনটিই জানান দেয়। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালসহ অন্যান্য আদালতে তাদের বিচার প্রক্রিয়াও চলছে শ্লথ গতিতে। এসব দেখে সাধারণ জনগণ শুধু হতাশই নয়, বরং তাদের মধ্যে একধরনের শঙ্কাও কাজ করছে। শঙ্কার পেছনের কারণ হল, যদি বিগত ফ্যাসিবাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দ্রুততম সময়ে নিশ্চিত না করা যায়, তাহলে ভবিষ্যতে এ ধরনের ফ্যাসিবাদ তৈরি হওয়ার সমূহ আশঙ্কা থাকে। আওয়ামী লীগের বিদায়ের পরপরই এদেশের কোনো কোনো পুরোনো রাজনৈতিক দলের একশ্রেণির নেতাকর্মীদের আচার-আচরণ সে আশঙ্কাকে দ্বিগুণ করেছে। এরই মধ্যে এই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সময়েই দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন উবায়দুল কাদেরসহ একাধিক দুষ্কৃতিকারী বড় বড় রাঘববোয়াল। সর্বশেষ কয়েক দিন আগে আওয়ামী লীগের এবং শেখ হাসিনার খাস ব্যক্তি, সাবেক স্পিকার ও দুই মেয়াদের রাষ্ট্রপতি একেবারে রাজধানীর আন্তর্জাতিক এয়ারপোর্ট দিয়েই দেশ ত্যাগ করেছেন। অথচ উপর মহলের গ্রিন সিগনাল ছাড়া এটি কোনোভাবেই সম্ভব হওয়ার কথা নয়।
এ ঘটনায় ক্ষুব্ধ হয়ে আবার ফুঁসে উঠেছে ছাত্র জনতা। বেগবান হয়েছে আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার দাবি। বিগত কয়েক দিনের তীব্র আন্দোলনের মুখে ১২ মে ২০২৫ সরকার আওয়ামী লীগ, তার অঙ্গসংগঠন ও সহযোগী সংগঠনগুলোর কার্যক্রম ওই দলগুলোর নেতাদের বিচারকার্য সম্পন্ন হওয়া পর্যন্ত নিষিদ্ধ করে প্রজ্ঞাপন জারি করল।
প্রজ্ঞাপন থেকে স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছে, এবারও ছাত্র-জনতার দাবি মানা হয়নি। তবে সান্ত্বনামূলক তাদের কার্যক্রমের ওপর অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞা আরোপিত হয়েছে। বোঝাই যাচ্ছে, সরকার আন্দোলকারীদের বুঝ দেওয়ার জন্য একটি মাঝামাঝি অবস্থা তৈরির চেষ্টা করেছে। অন্যদিকে দেশের পুরোনো বড় বড় দল আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার ব্যাপারে তেমন আগ্রহ দেখায়নি। বরং বড় একটি দল তো প্রকাশ্যেই এ বিষয়ে বারবার অনীহা দেখিয়েছে। তারা হয়তো ভাবছে, এখন তো আর মানুষ আওয়ামী লীগকে ভোট দেবে না; তাহলে তাদের সাথে সম্পর্ক খারাপ করে লাভ কী? তাদের ব্যবসা-বাণিজ্য, তাদের সম্পদ, তাদের চাঁদাবাজির ঐতিহ্য উত্তরাধিকার সূত্রে এসবকিছুর তদারকি তো আমাদেরকেই করতে হবে।
তারা জানে না, ইতিহাস সবসময় একরকম লেখা হয় না। সে যাই হোক, ওসব দলের পক্ষ থেকে জোর চাপ এলে সরকার হয়তো আরও আগেই নিষিদ্ধ করতে বাধ্য হত।
সন্দেহ নেই, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বহু বছর পর বাংলাদেশে জনগণের জন্য কিছুটা হলেও স্বস্তি এনেছে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে মানুষের মধ্যে আশাবাদও তৈরি হয়েছিল। কিন্তু বর্তমানে যতই দিন যাচ্ছে, সরকারের বাহ্যিক ফোকাস বিভিন্ন সংস্কারের মধ্যে কেন্দ্রীভূত হয়ে আছে বলে মনে হচ্ছে। অথচ সবাই জানে, রাজনৈতিক ঐকমত্য ছাড়া কোনো সংস্কারই চূড়ান্ত রূপ পাবে না। এছাড়া খাতা-কলমের সংস্কার কতটুকুই বা ফল বয়ে আনবে? বিগত স্বৈরাচার যা কিছু করেছে, সবকিছুই তো সংবিধান, আইন-আদালতের দোহাই দিয়ে করেছে এবং তাদের পক্ষে দেশের সংবাদ মাধ্যমের বৃহদংশ, একশ্রেণির বড় বড় শিক্ষিত মানুষ, বুদ্ধিজীবী ও আমলারা নিরলস প্রচার-প্রচারণা চালিয়ে গেছে এবং সমর্থন জুগিয়ে গেছে। তো এসব লোকদের যদি চিহ্নিত না করা যায় এবং স্বৈরাচারের মূল হোতা ও তাদের সহযোগীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির আওতায় না আনা যায়, তাহলে ভবিষ্যতে ক্ষমতাবানেরা সাংবিধানিক বা অন্যান্য সংস্কারের ওপর চলবে– এমন কথা কি জোর করে বলা যায়? অথবা তারা আবার নিজেদের মতো করে সংবিধান ও আইন সাজিয়ে নেবে না– এ নিশ্চয়তাইবা কে দেবে?
দেশের সাধারণ মানুষ মনে করে, কোনো রাখঢাক না করেই আওয়ামী রাজনীতি সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ হওয়া দরকার। শেখ মুজিব, জয় বাংলা, নৌকা ও তথাকথিত মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি– এজাতীয় স্লোগান, যা সকল প্রকার প্রহসন ও নিপীড়নের হাতিয়ার হয়ে উঠেছিল, সেসব শব্দের ওপরও নিষেধাজ্ঞা আরোপিত হওয়া দরকার। শুধু শেখ মুজিব নয়, বাংলার যমীনে ব্যক্তি ও পরিবার বন্দনার রাজনীতি স্থায়ীভাবে নিষিদ্ধ হওয়া দরকার। জাতীয় সংসদের কত শ ঘণ্টা যে শুধু বন্দনা করে এমপিরা অপচয় করেছেন এবং রাষ্ট্রের তথা জনগণের কষ্টার্জিত কত শ কোটি টাকা যে গচ্চা গেছে, সেসব হিসাব বের করতেও অনেক দিন লেগে যাবে।
এদিকে সাবেক রাষ্ট্রপতি আব্দুল হামিদের দেশত্যাগ নিয়ে এখন চলছে তুলকালাম কাণ্ড। ইতিমধ্যেই তিনি কীভাবে দেশত্যাগ করলেন, সে বিষয়ে তদন্ত করতে তিনজন উপদেষ্টাকে নিয়ে উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত কমিটি গঠিত হয়েছে। এমন এক জাতি আমরা– বাইরের লোকেরা শুনলে কী বলবে? দেশের প্রধান বিমানবন্দর দিয়ে বিভিন্ন নিরাপত্তা বলয় এবং হরেক প্রকারের এজেন্সির চোখের সামনে দিয়ে ভিআইপি গেট হয়ে, ইমিগ্রেশন পার হয়ে একজন সাবেক রাষ্ট্রপতি কূটনৈতিক পাসপোর্ট ব্যবহার করে দেশ ত্যাগ করলেন, অথচ সরকারের উচ্চ মহলের নাকি সে ব্যাপারে কিছুই জানা নাই! স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টাও জানেন না!
আসলে সরকারের ভেতরেই যে তাদের শত্রু রয়েছে, এ কথা বোঝার জন্য খুব বেশি বিজ্ঞ হওয়ার প্রয়োজন নেই। আব্দুল হামিদ ছিলেন শেখ হাসিনার অন্যতম প্রধান আস্থাভাজন ব্যক্তি। মনে পড়ছে, একবার শেখ হাসিনা অনেক লোককে উচ্চ আদালতের বিচারপতি নিয়োগ করলেন (যাদের অনেকেই এখন পলাতক)। জনগণ অবাক হয়ে দেখল, এরা তো একেকজন থেকে একেকজন কট্টর আওয়ামী লীগার। এমনকি কারো কারো বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট হত্যা মামলাও রয়েছে। তখন কোনো কোনো গণমাধ্যমে তাদেরকে চিহ্নিত করে খবর প্রকাশিত হয়। যার দরুন তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমান তাদেরকে শপথবাক্য পাঠ করাতে দ্বিধায় পড়ে যান। চাচার এমন আচরণে মনঃক্ষুণ্ন হন ভাতিজি হাসিনা। একসময় অসুস্থ হয়ে চিকিৎসার জন্য বিদেশ চলে যান জিল্লুর রহমান। তখন শেখ হাসিনা তার বিশ্বস্ত অনুগত আব্দুল হামিদকে রাষ্ট্রপতির আসনে বসান এবং বঙ্গভবনে যাওয়ার অল্প দিনের মধ্যে তিনি ওই চিহ্নিত ব্যক্তিদের উচ্চ আদালতের বিচারপতি হিসেবে শপথবাক্য পাঠ করিয়ে নেত্রীর আনুগত্য দৃঢ়তার সাথে প্রদর্শন করেন।
আব্দুল হামিদ তাদের এতটাই আস্থাভাজন ছিলেন, হয়তো সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা না থাকলে তিনি তৃতীয় মেয়াদে অর্থাৎ বর্তমানেও দেশের রাষ্ট্রপতি থাকতেন। দেশের উপকারে যতটুকুই তিনি আসেন না কেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীদের কাছে তার একটা আকর্ষণ ছিল। কারণ তিনি সমাবর্তনগুলোতে গেলেই কৌতুক শুনিয়ে হাসাতে হাসাতে তাদের পেট ব্যথা করিয়ে ছাড়তেন। এ আব্দুল হামিদের এলাকাই বিগত দিনগুলোতে গোপালগঞ্জের পরেই অবকাঠামো উন্নতির দিক থেকে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেছিল। হাওড় এলাকায় রাস্তাঘাট, উড়াল-সড়কসহ বিভিন্ন স্থাপনা তৈরির মাধ্যমে ওই অঞ্চলের বর্ষাকালীন পানি চলাচলে ব্যাপক ব্যাঘাত ঘটেছে বলে বিশেষজ্ঞরা বারবার মত প্রকাশ করেছেন। অনেকেই সিলেটের বারবারের বন্যার জন্য এটিকেও একটি বড় কারণ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। সে আব্দুল হামিদ সাহেবই এখন লাল কূটনৈতিক পাসপোর্ট নিয়ে ভিআইপির মর্যাদায় দেশত্যাগ করলেন। স্বভাবতই এই ঘটনা জনমনে অনেক প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে!