নবীজীর কুরবানী : কিছু দিক কিছু নির্দেশনা
মাওলানা আবু রাজী মুহাম্মাদ ইমরান
আল্লাহ তাআলা তাঁর রাসূলকে সম্বোধন করে বলেছেন–
اِنَّاۤ اَعْطَیْنٰكَ الْكَوْثَرَ ، فَصَلِّ لِرَبِّكَ وَ انْحَرْ.
(হে রাসূল!) নিশ্চয়ই আমি তোমাকে কাওসার দান করেছি। সুতরাং তুমি নিজ প্রতিপালকের (সন্তুষ্টি অর্জনের) জন্য নামায পড় ও কুরবানী দাও। –সূরা কাউসার (১০৮) : ১-২
এখানে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি আল্লাহর একটি বিশেষ নিআমতের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এরপর সে নিআমতের কৃতজ্ঞতাস্বরূপ তাঁকে নামায আদায় ও কুরবানী করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আজীবন কুরবানী করে গেছেন।
আবদুল্লাহ ইবনে উমর রা. থেকে বর্ণিত একটি হাদীসে এসেছে–
أَقَامَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ بِالْمَدِينَةِ عَشْرَ سِنِينَ يُضَحِّي كُلَّ سَنَةٍ.
قال الترمذي: حديث حسن.
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দশ বছর মদীনায় অবস্থান করেছেন। প্রতি বছর কুরবানী করেছেন। –জামে তিরমিযী, হাদীস ১৫০৭; মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ১৫৮৪
উপরোক্ত আয়াতে যদিও সরাসরি নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে সম্বোধন করা হয়েছে এবং তাঁর প্রতি কুরবানীর নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। তবে এখানে উদ্দেশ্য হল, নবীজীর মাধ্যমে তাঁর উম্মতকেও কুরবানীর নির্দেশ প্রদান করা। বিষয়টি নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এভাবে ব্যক্ত করেছেন–
أُمِرْتُ بِيَوْمِ الْأَضْحَى عِيدًا جَعَلَهُ اللهُ لِهَذِهِ الْأُمَّةِ.
আমি আযহার দিনের (অর্থাৎ ঈদের দিন কুরবানী করার) ব্যাপারে আদিষ্ট হয়েছি। এ দিনটিকে আল্লাহ তাআলা এই উম্মতের জন্য ঈদ নির্ধারণ করেছেন। –সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ২৭৮৯; সুনানে নাসায়ী, হাদীস ৪৩৬৫; সহীহ ইবনে হিব্বান, হাদীস ৫৯১৪
ফলে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যেমন ঈদের দিন কুরবানী করতেন, তাঁর সাহাবীগণও সেদিন কুরবানী করতেন।
মুহাম্মাদ ইবনে সীরীন রাহ. বলেন–
سَأَلْتُ ابْنَ عُمَرَ عَنْ الضَّحَايَا: أَوَاجِبَةٌ هِيَ؟
আবদুল্লাহ ইবনে উমর রা.-কে জিজ্ঞেস করলাম, কুরবানী কি ফরয?
তিনি জবাব দিলেন–
ضَحَّى رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وَالْمُسْلِمُونَ مِنْ بَعْدِه، وَجَرَتْ بِهِ السُّنَّةُ (حديث حسن.)
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কুরবানী করেছেন। তাঁর পরে মুসলিমগণও কুরবানী করেছেন। এটিই ধারাবাহিক অনুসৃত আমল ও সুন্নাহ। –সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস ৩১২৪; জামে তিরমিযী, হাদীস ১৫০৬
নবীজীর কাছে কুরবানীর কী পরিমাণ গুরুত্ব ছিল, একটি হাদীস থেকে বিষয়টি আরও পরিষ্কারভাবে ফুটে ওঠে।
আবু হুরায়রা রা. বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন–
مَنْ وَجَدَ سَعَةً فَلَمْ يُضَحِّ، فَلَا يَقْرَبَنَّ مُصَلَّانَا. (إسناده حسن.)
যে ব্যক্তির কুরবানী করার সামর্থ্য আছে, তা সত্ত্বেও সে কুরবানী করল না, সে যেন আমাদের ঈদগাহের নিকটেও না আসে। –সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস ৩১২৩; মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ৮২৭৩; মুস্তাদরাকে হাকেম, হাদীস ৭৫৬৫
এখানে সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও কুরবানী না করার ওপর কঠিন হুঁশিয়ারী উচ্চারিত হয়েছে। এ থেকে কুরবানীর গুরুত্ব সহজেই অনুমিত হয়।
নবীজী সামর্থ্য অনুযায়ী এক বা একাধিক পশু কুরবানী করতেন
নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কখনো একটি দুম্বা কুরবানী করেছেন।
উম্মুল মুমিনীন আয়েশা রা. বলেন–
أَنَّ رَسُولَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ أَمَرَ بِكَبْشٍ أَقْرَنَ، يَطَأُ فِي سَوَادٍ، وَيَبْرُكُ فِي سَوَادٍ، وَيَنْظُرُ فِي سَوَادٍ، فَأُتِيَ بِهِ لِيُضَحِّيَ بِه، فَقَالَ لَهَا: يَا عَائِشَةُ، هَلُمِّي الْمُدْيَةَ. ثُمَّ قَالَ: اشْحَذِيهَا بِحَجَرٍ، فَفَعَلَتْ ثُمَّ أَخَذَهَا وَأَخَذَ الْكَبْشَ فَأَضْجَعَه ثُمَّ ذَبَحَه.
একদা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কুরবানী করার জন্য শিংবিশিষ্ট একটি দুম্বা আনার নির্দেশ দিলেন, যার হাত-পা কালো, চোখও কালো। দুম্বাটি আনা হল। তিনি বললেন, আয়েশা! ছুরি নিয়ে আসো।
(ছুরি আনা হল।) বললেন, পাথরে ঘষে ধার কর। আয়েশা রা. ধার করে আনলেন। তখন তিনি ছুরিটা নিলেন। এরপর দুম্বাটিকে শোয়ালেন এবং যবেহ করলেন। –সহীহ মুসলিম, হাদীস ১৯৬৭; সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ২৭৯২
কোনো কোনো সময় দুইটি দুম্বা কুরবানী করেছেন।
আনাস ইবনে মালেক রা. বলেন–
كَانَ النَّبِيُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يُضَحِّي بِكَبْشَيْنِ وَأَنَا أُضَحِّي بِكَبْشَيْنِ.
নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দুইটি দুম্বা কুরবানী করতেন। আমিও দুইটি দুম্বা কুরবানী করি। –সহীহ বুখারী, হাদীস ৫৫৫৩; সহীহ মুসলিম, হাদীস ১৯৬৬
নবীজী যে ধরনের পশু কুরবানী করতেন
আনাস ইবনে মালেক রা. বলেন–
كَانَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يُضَحِّي بِكَبْشَيْنِ أَمْلَحَيْنِ أَقْرَنَيْنِ سَمِينَيْنِ. (قال الحافظ : هَذَا الْإِسْنَاد صَحِيح)
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কালোমিশ্রিত সাদা, শিংবিশিষ্ট, মোটাতাজা দুম্বা কুরবানী করতেন। –সহীহ আবু আওয়ানা : তাগলীকুত তা‘লীক ৫/৪
ইউনুস ইবনে মাইসারা ইবনে হালবাস রাহ. বলেন, আমরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাহাবী আবু সাঈদ যুরাকী রা.-এর সঙ্গে কুরবানীর পশু কিনতে যাই।
ইউনুস ইবনে মাইসারা রাহ. বলেন–
فَأَشَارَ أَبُو سَعِيدٍ إِلَى كَبْشٍ أَدْغَمَ، لَيْسَ بِالْمُرْتَفِعِ وَلَا الْمُتضِعِ فِي جِسْمِهِ، فَقَالَ: اشْتَرِ لِي هَذَا، كَأَنَّهُ شَبَّهَهُ بِكَبْشِ رَسُولِ اللهِ صلى الله عليه وسلم
আবু সাঈদ রা. একটি ‘আদগাম’ দুম্বার দিকে ইশারা করেছেন, যা খুব মোটাও নয় এবং একেবারে জীর্ণও নয়। দুম্বাটির দিকে ইশারা করে বললেন, আমার জন্য এটি খরিদ কর। তিনি যেন এই দুম্বাটিকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দুম্বার সদৃশ গণ্য করেছেন। –সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস ৩১২৯
আবু সাঈদ খুদরী রা. বলেছেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শিংবিশিষ্ট একটি মোটাতাজা দুম্বা যবেহ করেছেন, যার চোখ, মুখ ও হাত-পা ছিল কালো। –সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ২৭৯৬; জামে তিরমিযী, হাদীস ৩১২৮; সুনানে নাসায়ী, হাদীস ৪৪৬৪
নবীজী কুরবানী করতেন ঈদের নামাযের পর
বারা ইবনে আযেব রা. বলেন, নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন–
إِنَّ أَوَّلَ مَا نَبْدَأُ فِي يَوْمِنَا هذَا أَنْ نُصَلِّيَ، ثُمَّ نَرْجِعَ فَنَنْحَرَ، فَمَنْ فَعَلَ ذَلِكَ فَقَدْ أَصَابَ سُنَّتَنَا، وَمَنْ نَحَرَ قَبْلَ الصَّلَاةِ، فَإِنَّمَا هُوَ لَحْمٌ قَدَّمَهُ لِأَهْلِهِ، لَيْسَ مِنَ النُّسُكِ فِي شَيْءٍ.
আজকের দিন আমরা সর্ব প্রথম ঈদের নামায আদায় করব। এরপর ফিরে গিয়ে কুরবানী করব। যে ব্যক্তি এভাবে করল, সে আমাদের সুন্নাহ (আদর্শ) অবলম্বন করল। পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি ঈদের নামাযের আগেই যবেহ করে নিল, সে তো কেবল তার পরিবারের জন্য গোশতের ব্যবস্থা করল, কুরবানীর সাথে এর কোনো সম্পর্ক রইল না। –সহীহ বুখারী, হাদীস ৯৬৫; সহীহ মুসলিম, হাদীস ১৯৬১
জুনদুব ইবনে সুফিয়ান বাজালী রা. বলেন, একবার ঈদের দিন আমরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে কুরবানী করলাম। হঠাৎ দেখা গেল, কিছু লোক নামায পড়ার আগেই পশু যবেহ করে ফেলেছে। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নামায থেকে ফিরে যখন এ অবস্থা দেখলেন, বললেন, যে নামাযের আগে যবেহ করেছে, সে যেন এর পরিবর্তে আরেকটি পশু যবেহ করে। আর যে এখনো যবেহ করেনি, সে যেন আল্লাহর নামে যবেহ করে। –সহীহ বুখারী, হাদীস ৫৫০০; সহীহ মুসলিম, হাদীস ১৯৬০
নবীজী সকাল সকাল কুরবানী করতেন
কুরবানীর ক্ষেত্রে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের একটি নীতি ছিল, ভোর-সকালেই তিনি কুরবানী করে নিতেন। সূর্য ওঠার পর বেশি দেরি না করে প্রভাতেই সালাতুল ঈদ আদায় করতেন। সালাত শেষ করার পর অবিলম্বে কুরবানী সম্পন্ন করে ফেলতেন। এত সকালে কুরবানী করতেন যে, কুরবানীর গোশত দিয়েই সকালের প্রথম আহার গ্রহণ করতেন।
বুরাইদা ইবনে হুছাইব আসলামী রা. বলেন–
أَنَّ النَّبِيَّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ كَانَ لَا يَخْرُجُ يَوْمَ الْفِطْرِ حَتَّى يَطْعَمَ، وَكَانَ لَا يَأْكُلُ يَوْمَ النَّحْرِ شَيْئًا حَتَّى يَرْجِعَ، فَيَأْكُلُ مِنْ أُضْحِيَّتِه.
(صححه ابن القطان الفاسي.)
ঈদুল ফিতরের দিন নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কিছু না খেয়ে (নামাযের উদ্দেশে) বের হতেন না। কিন্তু ঈদুল আযহার দিন (নামায থেকে) ফেরার আগে কিছুই খেতেন না। ফিরে এসে (কুরবানী করতেন এবং) কুরবানীর গোশত থেকে আহার করতেন। –সুনানে দারাকুতনী, হাদীস ১৭১৫; মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ২২৯৮৪
নবীজী যবেহ করার সময় দুআ পড়তেন
জাবের ইবনে আবদুল্লাহ রা. বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঈদের দিন দুইটি দুম্বা কুরবানী করেছেন। যখন তিনি দুম্বাগুলোকে কেবলামুখী করে শুইয়েছেন তখন বলেছেন–
إِنِّي وَجَّهْتُ وَجْهِيَ لِلَّذِي فَطَرَ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضَ حَنِيفًا مُسْلِمًا وَمَا أَنَا مِنَ الْمُشْرِكِينَ، إِنَّ صَلَاتِي وَنُسُكِي وَمَحْيَايَ وَمَمَاتِي لِلهِ رَبِّ الْعَالَمِينَ، لَا شَرِيكَ لَه وَبِذلِكَ أُمِرْتُ وَأَنَا أَوَّلُ الْمُسْلِمِينَ، بِاسْمِ اللهِ واللهُ أَكْبَرُ، اَللّٰهُمَّ مِنْكَ وَلَكَ.
অর্থ : আমি সম্পূর্ণ একনিষ্ঠভাবে সেই সত্তার দিকে নিজের মুখ ফেরালাম, যিনি আকাশমণ্ডল ও পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন এবং যারা শিরক করে আমি তাদের অন্তর্ভুক্ত নই। নিশ্চয়ই আমার নামায, আমার ইবাদত ও আমার জীবন-মরণ সবই আল্লাহর জন্য, যিনি জগৎসমূহের রব [মালিক ও প্রতিপালক]। তাঁর কোনো শরীক নেই। আমাকে এরই হুকুম দেওয়া হয়েছে এবং আমিই (এই উম্মতের) প্রথম আনুগত্য স্বীকারকারী। বিসমিল্লাহি আল্লাহু আকবার। হে আল্লাহ! এ পশু আপনারই পক্ষ থেকে [অর্জন হয়েছে] এবং আপনারই জন্য [কুরবানী করছি।]) –মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ১৫০২২; সহীহ ইবনে খুযায়মা, হাদীস ২৮৯৯; মুস্তাদরাকে হাকেম, হাদীস ১৭১৬
কখনো কুরবানী করার সময় শুধু বলেছেন–
بِاسْمِ اللهِ وَاللهُ أَكْبَرُ.
আনাস ইবনে মালেক রা. বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দুইটি দুম্বা যবেহ করতেন।
وَكَانَ يُسَمِّي وَيُكَبِّرُ.
যবেহ করার সময় আল্লাহর নাম নিতেন ও তাকবীর বলতেন। –মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ১১৯৬০; সহীহ বুখারী, হাদীস ৫৫৫৮; সহীহ মুসলিম, হাদীস ১৯৬৬
সহীহ মুসলিমে বর্ণিত এক রেওয়ায়েতে এসেছে, আনাস রা. বলেন–
وَيَقُولُ: بِاسْمِ اللهِ وَاللهُ أَكْبَرُ.
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তখন بِاسْمِ اللهِ وَاللهُ أَكْبَرُ বলতেন। –সহীহ মুসলিম, হাদীস ১৯৬৬
জাবের ইবনে আবদুল্লাহ রা. বলেন–
صَلَّيْتُ مَعَ رَسُولِ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ عِيدَ الْأَضْحَى، فَلَمَّا انْصَرَفَ أُتِي بِكَبْشٍ، فَذَبَحَهُ، فَقَالَ: بِاسْمِ اللهِ، وَاللهُ أَكْبَرُ.
(صححه الحاكم ووافقه الذهبي.)
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সঙ্গে ঈদুল আযহার নামায পড়েছি। নামায শেষ করলে তাঁর নিকট একটি দুম্বা আনা হয়। তিনি দুম্বাটি যবেহ করার সময় বললেন–
بِاسْمِ اللهِ وَاللهُ أَكْبَرُ.
–মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ১৪৮৩৭; সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ২৮১০; জামে তিরমিযী, হাদীস ১৫২১
নবীজী কুরবানীর পশু নিজ হাতে যবেহ করতেন
নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজের কুরবানীর পশু নিজ হাতে যবেহ করতেন। বিষয়টি ওপরের হাদীসসমূহ থেকেই স্পষ্ট। আরও অনেক হাদীসে এই কথা বর্ণিত হয়েছে। এখানে আরেকটি হাদীস পেশ করা হচ্ছে।
জাবের ইবনে আবদুল্লাহ রা. বলেন–
شَهِدْتُ الْأَضْحَى مَعَ رَسُولِ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ بِالْمُصَلَّى، فَلَمَّا قَضَى خُطْبَتَهُ أُتِيَ بِكَبْشٍ، فَذَبَحَهُ بِيَدِه.
(صححه الحاكم ووافقه الذهبي.)
আমি একবার রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে ঈদগাহে ঈদুল আযহার নামায আদায় করলাম। নামায শেষে তাঁর কাছে একটি দুম্বা আনা হল। তিনি নিজ হাতে দুম্বাটিকে যবেহ করলেন। –মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ১৪৮৯৩; সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ২৮১০; জামে তিরমিযী, হাদীস ১৫২১
নবীজী যথাসম্ভব পশুর কষ্ট লাঘবের চেষ্টা করতেন
কুরবানী করা আল্লাহর বিধান। সে বিধান পালনার্থে একটি পশু যবেহ করতে হয়। তাই বলে পশুটিকে অযথা কষ্ট দেওয়া তো সমীচীন নয়। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কুরবানীর পশুকে অযথা কষ্ট দিতেন না। পশু যবেহ করার আগে, বরং পশুকে মাটিতে শোয়ানোর আগেই ছুরি ধার দিয়ে নিতেন।
পূর্বে উম্মুল মুমিনীন আয়েশা রা. থেকে বর্ণিত হাদীস উল্লেখ হয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নির্দেশে শিংবিশিষ্ট একটি দুম্বা আনা হল কুরবানী করার জন্য। তখন তিনি বললেন–
يَا عَائِشَةُ، هَلُمِّي الْمُدْيَةَ. ثُمَّ قَالَ: اشْحَذِيهَا بِحَجَرٍ، فَفَعَلَتْ ثُمَّ أَخَذَهَا وَأَخَذَ الْكَبْشَ فَأَضْجَعَهُ ثُمَّ ذَبَحَه.
আয়েশা! ছুরি নিয়ে আসো। (ছুরি আনা হল।) নবীজী বললেন, ছুরিটি পাথরে ঘষে ধার কর। আয়েশা রা. ধার করে আনলেন। এরপর নবীজী দুম্বাটিকে ধরে শোয়ালেন এবং যবেহ করলেন। –সহীহ মুসলিম, হাদীস ১৯৬৭; সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ২৭৯২
নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজে দেখিয়েছেন, কীভাবে যবেহ করলে পশুর কষ্ট কম হয়। সাথে সাথে মৌখিকভাবেও নির্দেশনা দিয়েছেন– যেন উত্তম পন্থায় যবেহ করা হয়। পশুর কষ্ট কম হয়।
শাদ্দাদ ইবনে আউস রা. বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন–
إِنَّ اللهَ كَتَبَ الْإِحْسَانَ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ، فَإِذَا قَتَلْتُمْ فَأَحْسِنُوا الْقِتْلَةَ، وَإِذَا ذَبَحْتُمْ فَأَحْسِنُوا الذَّبْحَ، وَلْيُحِدَّ أَحَدُكُمْ شَفْرَتَه، فَلْيُرِحْ ذَبِيحَتَه.
আল্লাহ তাআলা সবকিছুতে সৌন্দর্য অপরিহার্য করেছেন। সুতরাং তোমরা যখন হত্যা করবে সুন্দররূপে হত্যা করবে। যখন যবেহ করবে সুন্দরভাবে যবেহ করবে। যবেহকারী যেন তার ছুরিতে শান দিয়ে নেয় এবং পশুর কষ্ট লাঘব করে। –সহীহ মুসলিম, হাদীস ১৯৫৫; সুনানে নাসায়ী, হাদীস ৪৪১৩
নবীজী কুরবানীর গোশত থেকে খেতেন
বিদায়ী হজ্বের সময় নবীজী নিজ কুরবানীতে আলী রা.-কে শরীক করেছিলেন। যবেহ করার পর তারা উভয়ে কুরবানীর পশুর গোশত খেয়েছিলেন। জাবের রা. বলেছেন–
ثُمَّ أَمَرَ مِنْ كُلِّ بَدَنَةٍ بِبَضْعَةٍ، فَجُعِلَتْ فِي قِدْرٍ، فَطُبِخَتْ، فَأَكَلَا مِنْ لَحْمِهَا، وَشَرِبَا مِنْ مَرَقِهَا.
যবেহ করার পর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রত্যেক উট থেকে এক টুকরো গোশত নিয়ে একটি পাত্রে রান্না করার নির্দেশ দিলেন। নির্দেশ মোতাবেক রান্না করা হল। তখন তিনি এবং আলী রা. সে গোশত থেকে খেলেন। সামান্য ঝোলও পান করলেন। –সহীহ মুসলিম, হাদীস ১২১৮; সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ১৯০৫; মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ১৪৪৪০
সাওবান রা. বলেন–
قَالَ لِي رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: أَصْلِحْ لَحْمَ هَذِهِ الْأُضْحِيَّةِ، فَأَصْلَحْتُه، فَلَمْ يَزَلْ يَأْكُلُ مِنْهُ حَتَّى بَلَغَ الْمَدِينَةَ.
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম (এক সফরে কুরবানী করলেন। এরপর) আমাকে বললেন, এই কুরবানীর গোশত প্রস্তুত করে রাখ। তাই আমি তা প্রস্তুত করে রাখলাম। মদীনায় পৌঁছা পর্যন্ত তিনি সে গোশত থেকে খেলেন। –সহীহ ইবনে হিব্বান, হাদীস ৫৯৩২; সহীহ মুসলিম, হাদীস ১৯৭৫
কুরবানীর গোশতের ব্যাপারে নবীজীর নির্দেশনা
বিশেষ একটি কারণে একবার রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কুরবানীর গোশত তিন দিনের বেশি খেতে নিষেধ করেছিলেন। পরবর্তীতে সে কারণ দূর হয়ে যায়। তখন যতদিন ইচ্ছা খাওয়া ও সংরক্ষণ করার অনুমতি দিয়েছেন।
আয়েশা রা. বলেন–
إِنَّمَا نَهَيْتُكُمْ مِنْ أَجْلِ الدَّافَّةِ الَّتِي دَفَّتْ، فَكُلُوا وَادَّخِرُوا وَتَصَدَّقُوا.
আগন্তুক ক্ষুধার্ত কাফেলাটির জন্য তোমাদের (তিন দিন পর) খেতে নিষেধ করেছিলাম। (সে কারণ দূর হয়ে গেছে।) সুতরাং এখন তোমরা খাও, সংরক্ষণ কর এবং দান কর। –সহীহ মুসলিম, হাদীস ১৯৭১
অন্য হাদীসে এসেছে, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন–
كُلُوا، وَادَّخِرُوا، وَأْتَجِرُوا.
খাও, সংরক্ষণ কর এবং আজর ও সওয়াবের আশায় দান কর। –সুনানে দারেমী, হাদীস ২০০১
এখানে কুরবানীর গোশত নিজে খাওয়া ও অন্যকে দান করার কথা পাওয়া যায়। তবে দান করার পরিমাণ কতটুকু, দান করার ব্যাপারে নবীজীর আদর্শ কী ছিল, তার বিবরণ এখানে নেই। সে বিবরণ পাওয়া যায় আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা.-এর বর্ণনায়।
কুরবানীর গোশতের ব্যাপারে নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আমলের বিবরণ দিতে গিয়ে আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. বলেন–
يُطْعِمُ أَهْلَ بَيْتِهِ الثُّلُثَ، وَيُطْعِمُ فُقَرَاءَ جِيرَانِهِ الثُّلُثَ، وَيَتَصَدَّقُ عَلَى السُّؤَّالِ بِالثُّلُثِ.
(رَوَاهُ الْحَافِظُ أَبُو مُوسَى الْأَصْفَهَانِيُّ، فِي الْوَظَائِفِ، وَقَالَ: حَدِيثٌ حَسَنٌ.)
তিনি এক তৃতীয়াংশ পরিবারের লোকদের খাওয়াতেন, এক তৃতীয়াংশ অভাবী প্রতিবেশীদের খাওয়াতেন আর এক তৃতীয়াংশ যাঞ্চাকারীদের দান করতেন । –আলমুগনী, ইবনে কুদামা ৯/৪৪৮
সাহাবায়ে কেরাম রা.-ও এই নীতির অনুসরণ করতেন। আলকামা রাহ. বলেন, আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. মক্কা শরীফের মিনায় যবেহ করার জন্য আমার সঙ্গে একটি পশু প্রেরণ করেছেন এবং বলেছেন–
كُلْ أَنْتَ وَأَصْحَابُكَ ثُلُثًا، وَتَصَدَّق بِثُلُثِه، وَابْعَثْ إِلَى آلِ أَخِي عُتْبَةَ بِثُلُثٍ.
যবেহ করার পর এক তৃতীয়াংশ তুমি ও তোমার সাথি-সঙ্গী খাবে, এক তৃতীয়াংশ সদকা করবে আর এক তৃতীয়াংশ আমার ভাই উতবার পরিবারে প্রেরণ করবে। –আলমুজামুল কাবীর, তবারানী ৯/৩৪২ (৯৭০২); কিতাবুল আছার, আবু হানীফা (রেওয়ায়েত আবু ইউসুফ), আছার ৫৮২; মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা, বর্ণনা ১৩৩৫৬
সুতরাং নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও সাহাবায়ে কেরাম রা.-এর আদর্শ ছিল এভাবে তিনটা ভাগ করা। তবে কেউ যদি আরও বেশি দান করে, তা তার জন্য উত্তম হবে। আলী রা. বলেন–
أَنَّ النَّبِيَّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ أَمَرَه أَنْ يَقُومَ عَلَى بُدْنِه، وَأَنْ يَقْسِمَ بُدْنَه كُلَّهَا، لُحُومَهَا وَجُلُودَهَا وَجِلَالَهَا.
নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে তাঁর কুরবানীর (এক শ) উটের দায়িত্ব দিয়েছেন এবং সবগুলো পশুর গোশত, চামড়া ও আচ্ছাদনের কাপড় সদকা করার নির্দেশ দিয়েছেন। –সহীহ বুখারী, হাদীস ১৭১৭; সহীহ মুসলিম, হাদীস ১৩১৭
নবীজী কুরবানীর পশুর গোশত-চামড়া কসাইকে পারিশ্রমিক হিসেবে দিতে নিষেধ করেছেন
উপরিউক্ত হাদীসের শেষে আরেকটি নির্দেশনা এসেছে। আলী রা. বলেন–
وَأَنْ لَا أُعْطِيَ الْجَزَّارَ مِنْهَا، قَالَ: نَحْنُ نُعْطِيهِ مِنْ عِنْدِنَا.
এবং (আমাকে নির্দেশ দিয়েছেন,) আমি যেন কসাইকে কুরবানীর পশুর কোনো কিছু না দিই। তিনি বলেছেন, কসাইকে আমরা আমাদের নিজেদের পক্ষ থেকে পারিশ্রমিক দিয়ে দিব। –সহীহ মুসলিম, হাদীস ১৩১৭; সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ১৭৬৯ l
টীকা
(১) : আদগাম : যে পশুর মধ্যে কালো রঙের মিশ্রণ থাকে, বিশেষ করে কানে ও চোয়ালের নিচে।