যিলহজ্ব ১৪৪৬   ||   জুন ২০২৫

ইহরামের পোশাক : বার্তা ও শিক্ষা

মুফতী মুহাম্মাদ শফী রাহ.

[হজ্বের সফর থেকে ফেরার পথে জাহাজে, হাজ্বীদের উদ্দেশে প্রদত্ত বয়ান।

৪ মুহাররম ১৩৮২ হিজরী, জুমাবার।]

 

আল্লাহ তাআলার হাজারো লাখো শোকর, তাঁরই একান্ত মেহেরবানীতে আজ আপনারা মক্কা-মদীনার পবিত্র ভূমি থেকে হজ্ব ও উমরার মতো মহান ইবাদত করে দেশে ফিরছেন। নিঃসন্দেহে এটা আল্লাহ তাআলার অনেক বড় নিআমত।

প্রত্যেক নিআমতেরই শোকর আদায় করা উচিত। এই নিআমতের শোকরের একটি দিক হল, বরকতময় এই সফর এবং হজ্ব ও উমরার সকল আমল আপনাকে কী বার্তা দেয় সে বিষয়ে একটু চিন্তা ফিকির করা।

হজ্ব ও উমরার আমল শুরু হয় ইহরামের মাধ্যমে। তাই আপনারা বিভিন্ন ধরনের মূল্যবান পোশাক এবং উন্নত জাতের বিভিন্ন কাপড় রেখে কেবল সেলাইবিহীন দুটি চাদরে নিজেকে আবৃত করে নিয়েছিলেন। 

হজ্ব ও উমরা আদায়ের ক্ষেত্রে আল্লাহ তাআলা আপনার জন্য যে পোশাক নির্বাচন করেছেন, তা কেবল দুটি চাদর। এতে চিন্তাশীল প্রত্যেকের জন্যই রয়েছে অনেক শিক্ষা ও নির্দেশনা।

 

প্রথম শিক্ষা

আগের যে পোশাক পরে মানুষ গোনাহ করে আসছিল, সেগুলো পরিবর্তন করে ভিন্ন পোশাক পরিধানের বিধান দেওয়া হয়েছে। এতে ইঙ্গিত রয়েছে যে, এবার আপনি আপনার পোশাকের সাথে সাথে নিজের জীবনকেও পরিবর্তন করে নিন। জীবনের যাবতীয় অবস্থা বদলে ফেলুন। নিজের আমল ও আখলাকের দিকে নজর দিন। তাতে যে ভুল ও ত্রুটি আছে, সেগুলো সংশোধন করুন। সব ধরনের উদাসীনতা পরিহার করে আল্লাহর স্মরণে মগ্ন হোন। কবির ভাষায়

اپنے  دل کو بھي بدل جامہ احرام کے ساتھ

ইহরামের পোশাকের সাথে

হৃদয়টাকেও বদলে নাও।

 

দ্বিতীয় শিক্ষা

ইহরামের পোশাককে দুনিয়ার সব ধরনের স্বাভাবিক পোশাক থেকে ভিন্ন করা হয়েছে। যেন পোশাক দেখেই ইহরামের কথা মনে পড়ে। মুহূর্তের জন্যও ইহরামের খেলাফ কোনো কাজ না হয়ে যায়। অর্থাৎ এ পোশাক নিজেই আপনাকে সব সময় স্মরণ করিয়ে দেবে আপনি কোথায় আছেন, কোন্ অবস্থায় আছেন এবং এ অবস্থায় আপনার করণীয় কী?

 

তৃতীয় শিক্ষা

এই পোশাকের মাধ্যমে বোঝানো হয় পোশাকের মৌলিক প্রয়োজন কেবল এতটুকু কাপড় দিয়েই পূরণ হতে পারে। এর চেয়ে বেশি যেটুকু পরিধান করা হয় তা প্রয়োজন অতিরিক্ত।

তাছাড়া এই পোশাক আপনাকে সাদামাটা জীবন ও সরল আচরণের প্রতি আহ্বান জানায়; যাতে রয়েছে মানুষের অর্থনৈতিক সংকট ও জীবন সমস্যার উত্তম সমাধান।

সেলাইবিহীন কাপড় পরিধান করা তো ইহরামের জন্য জরুরি। তবে সাধারণ সময়ে এ জাতীয় কাপড়ও সেলাই করে পরা যায়। তাতে সাদামাটা অবস্থা বজায় থাকবে; যা সর্বাবস্থায়ই প্রশংসিত। আম্বিয়া আলাইহিমুস সালাম ও আকাবির বুযুর্গদের পোশাকের ক্ষেত্রে সাদামাটা অবস্থাই ছিল গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য।

 

পোশাক পরিধানের উদ্দেশ্য

পোশাক মানুষ এজন্য পরিধান করে যে, তার মাধ্যমে লজ্জাস্থান আবৃত করবে। শীত ও গরমের কষ্ট থেকে নিজেকে রক্ষা করবে। আব্রুঢাকা হয়ে স্বস্তি ও আরাম লাভ করবে। যা সাদামাটা পোশাকেও পরিপূর্ণরূপে হাসিল হয়; বরং লোক দেখানো পোশাকের চেয়ে অনেক বেশি হাসিল হয়।

পোশাক পরিধানের আরেকটি উদ্দেশ্য হল, সৌন্দর্য ধারণ করা। পাশাপাশি অন্যের দৃষ্টিতে মর্যাদাবান হওয়া।

এ উদ্দেশ্য সাদামাটা পোশাকে খুব বেশি হাসিল হয় না ঠিক। তবে চিন্তা করলে দেখা যায়, পোশাকের সৌন্দর্য ও মর্যাদার বিষয়টি মূলত সমাজ ও প্রচলনের ওপর নির্ভর করে। যে যুগে যে পোশাক এবং পোশাকের যে ডিজাইন বা ফ্যাশন মানুষ ব্যাপকভাবে গ্রহণ করে, সে যুগে সেই পোশাকই মর্যাদার বলে বিবেচিত হয়। সেটাকেই সৌন্দর্য হিসেবে ধরে নেওয়া হয়। পক্ষান্তরে যে পোশাক এবং পোশাকের যে ডিজাইন বা ফ্যাশন মানুষ ব্যাপকভাবে পরিত্যাগ করে, সেটা আগের যুগে যত সম্মান-মর্যাদা বা সৌন্দর্যের প্রতীকই হোক না কেন, যুগ পরিবর্তনের পর সেটা বেমানান লাগে। তাতে না কোনো সৌন্দর্য বা আকর্ষণ থাকে; না সম্মান ও মর্যাদা।

এ থেকে বোঝা যায়, পোশাকের সৌন্দর্য ও সম্মান নির্দিষ্ট কোনো ডিজাইন বা ফ্যাশনের সঙ্গে যুক্ত নয়। এসবের ভিত্তি হল যুগ, সমাজ ও প্রচলনের ওপর। যদি কোনো সমাজ, জাতি বা দল সাদামাটা পোশাক গ্রহণ করে এবং ব্যাপকভাবে তা পরিধান করে, তাতে সম্মান ও সৌন্দর্য না থাকার কোনো কারণ থাকবে না।

নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের লেবাস-পোশাক, খাওয়া-দাওয়া, ঘুম-জাগরণ ও যাবতীয় জীবনাচারের ক্ষেত্রে সুন্নত ছিল এটাই যে, তা হবে সাদামাটা, অকৃত্রিম। সাধারণ অবস্থায় মানুষ যে পোশাক পরিধান করত সেটাকেই তিনি সজ্জা হিসেবে গ্রহণ করেছেন। তবে হঠাৎ কোনো উন্নত পোশাক এসে গেলে সেটাকেও কৃতজ্ঞতার সাথে ব্যবহার করেছেন। কেননা ব্যাপক আয়োজন ও কষ্ট মেহনত ছাড়া কোনো বৈধ জিনিস হাসিল হলে সেটা পরিত্যাগ করাও একধরনের কৃত্রিমতা।

 

অর্থনৈতিক দুরবস্থা থেকে মুক্তি

আজ আমরা যদি শুধু এই একটি বিষয় বুঝে সংকল্প করি যে, অন্যদের পোশাক ও ভিনদেশি আচার-সংস্কৃতি বাদ দিয়ে নিজেদের পোশাক ও সংস্কৃতি গ্রহণ করব। ফ্যাশন-পূজা আর বিলাসী জীবনের যে সরঞ্জামাদি ভিনদেশিরা আমাদের সমাজে অন্তর্ভুক্ত করে দিয়েছে, সেগুলো থেকে আমরা আমাদেরকে মুক্ত করে নেব, তাহলে নিশ্চিত থাকুন আমরা অর্থনৈতিক দুরবস্থা থেকেও মুক্তি পাব। শুধু তাই নয়, এর মাধ্যমে ব্যাপকভাবে ঘুষ ও হারাম উপার্জনের চাহিদা কমে যাবে।

 

ফ্যাশন-পূজার পরিণাম

বর্তমানে আমাদের অবস্থা হল, ফ্যাশন-পূজা ও ভিনদেশি কালচার আমাদের জীবনকে এতটা কঠিন বানিয়ে দিয়েছে, যত অর্থই উপার্জন করি, সংসারের ব্যয়সমুদ্রে সবকিছু হারিয়ে যায়। এমনকি ভালো আয়-উপার্জনের লোকেরাও শূন্যহস্ত থাকে; বরং ঋণগ্রস্ত হয়ে যায়। ভিনদেশিদের অন্ধ অনুসরণ, তাদের অভ্যাস-আচরণের অযাচিত অনুকরণ এবং প্রতিনিয়ত পরিবর্তন হওয়া ফ্যাশন ও কালচার গ্রহণ করতে গিয়ে যখন হালাল উপার্জনে যথেষ্ট হয় না, তখন ব্যবসা-বাণিজ্যে সুদ ও জুয়া, চাকরিতে ঘুষ ও দুর্নীতি, মজদুরিতে ধোঁকা ও প্রতারণা ইত্যাদি শুরু হয়। রাষ্ট্রীয় হাজার নিয়ম নীতির ভেতরেও নানা অপরাধ দিন দিন বেড়েই চলে।

পক্ষান্তরে যদি তারা সাদাসিধে জীবনে অভ্যস্ত হয় এবং হৃদয়ে সামান্য পরিমাণেও আল্লাহর ভয় ও পরকালের কথা স্মরণে থাকে, তাহলে ঐসকল হারাম কাজ ও কবীরা গোনাহ থেকে বেঁচে থাকা যায়, যার গভীর গিরিখাদে পুরো জাতি কেবলই ডেবে যাচ্ছে। উক্ত ভালো পরিবেশ তৈরি হলে আশা করা যায়, সমাজে অপরাধ নির্মূলের চেষ্টা-প্রচেষ্টাও সফল হতে দেখা যাবে।

কিন্তু আফসোসের কথা হল, সমাজের চিন্তাশীল ব্যক্তিরা যখন অর্থনৈতিক দুরবস্থার প্রতি মনোযোগ দেয়, তখন শুধু ফিকির করে কীভাবে মানুষের আয়-উপার্জন বাড়ানো যায়! এই ফিকির করে না কীভাবে অনর্থ খরচ ও অপব্যয় থেকে মানুষকে রক্ষা করা যায়।  অথচ অভিজ্ঞতা বলে, সচ্ছলতার ক্ষেত্রে অধিক উপার্জন যতটা ভূমিকা রাখে, তার চেয়ে অনেক বেশি ভূমিকা রাখে অপব্যয় থেকে বেঁচে থাকা।

তাছাড়া পশ্চিমা যে জীবনধারা আমরা গ্রহণ করছি, সেটা ইউরোপের দেশে উপকারী বা আরামদায়ক হলেও, আমাদের মতো উষ্ণ বায়ুমণ্ডলীয় দেশে উপকারী নয়। তাতে না আছে আরাম ও স্বস্তি আর না তা স্বাস্থ্য ও সুস্থতার জন্য উপযোগী।

ডাক্তার চিকিৎসকেরাও তো এ বিষয়ে একমত যে, সংকীর্ণ ও টাইট পোশাক মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর। পক্ষান্তরে ঢিলেঢালা সাদামাটা পোশাক উপকারী।

কিন্তু আমরা কি কখনো এই দৃষ্টিকোণ থেকে বিবেচনা করেছি যে, আমাদের পোশাকে স্বাস্থ্যগত উপকারিতা আছে কি না! আমরা তো কোনো জিনিসকে উপকারী বিবেচনা করে গ্রহণ করি না! আমরা কেবল ভিনদেশিদের যা করতে দেখি, সেটাকেই সম্মান ও মর্যাদার বিষয় মনে করি। এ কথাটাও ভাবি না যে, আমাদের আয়-উপার্জন এ ধরনের ব্যয়ভার বহন করতে পারে কি না এবং আমাদের দেশের আবহাওয়া ওসবের জন্য উপযোগী কি না!

হাঁ, সচেতন কোনো ব্যক্তি যদি বিজাতীয় সংস্কৃতি-পোশাকের ক্ষতিকর বিষয় সম্পর্কে জানতে পারে, সেও ভাবে আমি যদি সমাজের রীতি-প্রথার বিপরীত কিছু করি, মানুষ আমাকে নিয়ে হাসবে। কিন্তু আসল কথা হল

ہنسنے جانے سے جب تک ہم ڈريں گے

زمانہ ہم پہ ہنستا ہي رہے گا

যতদিন পর্যন্ত আমরা মানুষের হাসিকে ভয় পাব।

যামানা আমাদের নিয়ে হাসতেই থাকবে।

দেখুন তো, তাদের জীবনাচার অবলম্বনের ফলে আমাদের কি কোনো সম্মান মর্যাদা বেড়েছে? নাকি যে চারিত্রিক অবক্ষয় ও অবনতি হয়েছে, তা আমাদেরকে আরও বেশি হাসির পাত্র বানিয়ে ছেড়েছে?

অতএব আল্লাহর ওয়াস্তে একটু ভাবুন। হজ্ব ও উমরার ইহরাম থেকে এই ফায়েদা গ্রহণ করুন। ফ্যাশন-পূজা আর লৌকিকতা ছেড়ে সাদামাটা জীবনে ফিরে আসুন। যার মাঝে আম্বিয়ায়ে কেরামের সুন্নতের সওয়াবও আছে, নিজেদের স্বস্তি-সুবিধার বিষয়ও আছে।

নিজেদের সমাজ এবং পরিচিতজনকেও এ বিষয়ে দাওয়াত দিন। আর দুআ করুন, যেন আল্লাহ তাআলা এই সমাজের হুঁশ ফিরিয়ে দেন। তারা যেন সাদামাটা জীবনযাপনের উপকারিতা বুঝতে পারে এবং তা অবলম্বনে আগ্রহী হয়।

সমাজের নেতৃস্থানীয় ও অনুসরণীয় কিছু মানুষের যদি এ কথাটা বুঝে এসে যায় এবং তারা যদি নিজেদের জীবনরীতি পরিবর্তনের সূচনা করে, তাহলে হাসির পাত্র হওয়ার ভয়ও দূর হয়ে যাবে, পুরো জাতির জন্যও এই নীতি অবলম্বন করা সহজ হবে।

 

চতুর্থ শিক্ষা

ইহরামের পোশাক আপনাকে ইসলামী সাম্য ও সমতার বার্তা দেয়। পূর্ব-পশ্চিম, আরব-অনারব, হিন্দি-সিন্ধি, হাবাশী, রূমী এবং বাদশাহ-ভিখারি সকলে এক পোশাকে আপন রবের সামনে দণ্ডায়মান হয়। যেন ঐ মহান সত্তার দরবারে হাজির হওয়ার উপযুক্ত কেবল তখনই হওয়া যায়, যখন দেশীয় ও বংশীয় জাতীয়তার আভরণ খুলে ফেলে কেবল মুসলিম পরিচয়ে যাওয়া যায়। এসব ছাড়া সেখানে প্রবেশের কোনো অনুমতিই নেই।

এটা আসলে ইসলামী রাজনীতির গুরুত্বপূর্ণ মূলনীতি, যা হযরত রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মদীনায় হিজরতের পরপর প্রতিষ্ঠা করেছেন। তখন বেলাল হাবাশী, সুহাইব রূমী, সালমান ফারসী এবং আনসার ও মুহাজির ইত্যাদি সব ধরনের ভিন্নতা মুছে সবাইকে ভাই ভাই বানিয়ে দিয়েছেন।

কুরআন মাজীদেও এ বিষয়ে স্পষ্ট ঘোষণা রয়েছে। ইরশাদ হয়েছে

اِنَّمَا الْمُؤْمِنُوْنَ اِخْوَةٌ.

নিশ্চয়ই মুমিনগণ পরস্পরে ভাই ভাই। সূরা হুজুরাত (৪৯) : ১০

চিন্তা করলে দেখা যাবে, এই সাম্য, সমতা ও ইনসাফপূর্ণ জীবনব্যবস্থার ফলেই এত দ্রুত ইসলাম পুরো দুনিয়ায় ছড়িয়ে পড়েছে। ইসলামে প্রবেশ করার পর বাদশা ও ভিখারির মাঝে পার্থক্যরেখা দূর হয়ে গেছে। সাদা-কালো, আরব-অনারবহাবাশী-রূমী সবার মাঝে সম্মান ও মর্যাদার ভিত্তি হয়ে গেছে কেবল এটিই যে, কে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্যে বেশি অগ্রসর! এ বিষয়টিই বেলাল হাবাশীকে দুনিয়ার সকল বাদশার সরদার বানিয়ে দিয়েছে।

ইসলামের এই মূলনীতি তো প্রথম দিন থেকেই ছিল। এর প্রতি গুরুত্বারোপ করা হয়েছে সব সময়, সর্বাবস্থায়। তবে হজ্বের মৌসুমে সেটাকে বিশেষভাবে তুলে ধরে নবায়ন ও স্মরণ করিয়ে দেওয়া হয়েছে। যেন প্রত্যেকে নতুনভাবে নিজ অবস্থার খোঁজ নিতে পারে। দেশীয় কিংবা বংশগত সম্প্রদায়িকতা যদি কারো মাঝে কোনো প্রভাব ফেলে থাকে, সে যেন নিজেকে পরিবর্তন ও সংশোধন করে নিতে পারে।

কিন্তু আফসোস! আমাদেরকে দুর্বল করার জন্য ভিনদেশিদের গোপন চেষ্টা ও ষড়যন্ত্র আমাদের ভেতর দেশীয় ও বংশীয় জাতীয়তার জাল বিছিয়ে রেখেছে। সাদা-কালোর মাঝে বিভেদরেখা তৈরি করে রেখেছে। আরব ও তুর্কির মাঝে যুদ্ধ বাঁধিয়ে দিয়েছে। আর আমরা আমাদের জীবনরীতি ও মৌলিক নীতিমালা সম্পর্কে বেখবর হয়ে আছি। পরিণাম সম্পর্কে হয়ে আছি উদাসীন। আমাদের অদূরদর্শিতার কারণে নিজেরাই নিজেদের আস্তিনে জাতীয়তার ফেতনাকে জিইয়ে রেখেছি। মরহুম ইকবাল বড় চমৎকার বলেছেন

ان تازہ خداؤں ميں بڑا سب سے وطن ہے

جو پيرہن اس کا ہے وہ ملت کا کفن ہے

এই জীবন্ত খোদাগুলোর মাঝে সবচেয়ে বড় হল দেশ ও জাতীয়তা।

তার যা পোশাক তা আসলে জাতির কাফন।

আরও আফসোসের কথা হল, আমরা যদি কখনো নিজেদের মাঝে ঐক্য গড়ার প্রতি মনোযোগী হই, নিজেদের রাষ্ট্র বা জাতীয়তার ভিত্তিতেই ঐক্য গড়ার চিন্তা করি; মুসলিম উম্মাহ্র কথা ভেবেও দেখি না।

রাষ্ট্র বা জাতীয়তার ভিত্তিতে ঐক্যের অর্থ কী? এই ঐক্য তো পুরো ইসলামী বিশ্বের সামনে ব্যক্তি থেকে ব্যক্তির বিচ্ছিন্নতা। ফলে তা-ই ইসলামী ঐক্য ও ভ্রাতৃত্ব নিঃশেষকারী।

আফসোস! আরব অনারবের সকল মুসলমান আজ এই জাতীয়তা-ফেতনার শিকার হয়ে গেছে। ফলে আজ আমরা হয়তো পাঞ্জাবী কিংবা বাঙালী, হিন্দি বা সিন্ধি, বেলুচি বা আফগানী। আমরা এমন অনেক কিছুই; শুধু মুসলিম নই।

আপনারা যদি প্রকৃত অর্থে হজ্ব-উমরার ফায়েদা ও বরকত হাসিল করতে চান, তাহলে এই শিক্ষাকে গ্রহণ করুন। দেশীয় কিংবা বংশীয় জাতীয়তাকে চূর্ণ করে ইসলামী ঐক্যের ফিকির করুন। আল্লাহ তাআলা আমাকে এবং আপনাদের সবাইকে সেই তাওফীক দান করুন।

 

হজ্বে তিনটি জিনিস হারাম

উপরিউক্ত বিষয়গুলো ছিল ইহরামের পোশাক থেকে পাওয়া শিক্ষা। এবার ঐ বিষয়গুলোও শুনুন, যেগুলোকে কুরআন মাজীদ ইহরামের সাথে জরুরি ও আবশ্যক করে দিয়েছে। আল্লাহ তাআলা বলেছেন

فَمَنْ فَرَضَ فِيْهِنَّ الْحَجَّ فَلَا رَفَثَ وَ لَا فُسُوْقَ وَ لَا جِدَالَ فِي الْحَجِّ .

যে ব্যক্তি সেসব মাসে (ইহরাম বেঁধে) নিজের ওপর হজ্ব অবধারিত করে নেয়, সে হজ্বের সময়ে কোনো অশ্লীল কথা বলবে না, কোনো গোনাহ করবে না এবং ঝগড়াও নয়। সূরা বাকারা (০২) : ১৯৭

এখানে এ কথা বলা হয়নি, হজ্বে এইসব কাজ করো না। বলা হয়েছে, হজ্বে এইসব কাজ করা যায় না। এই বিশেষ উপস্থাপনের মাধ্যমে ইশারা করা হয়েছে, এইসব কাজ ইহরাম অবস্থায় করার মতো নয়।

এই তিনটি বিষয়কে বিশেষভাবে উল্লেখ করার একটি কারণ এটাও যে, হজ্বে নারী পুরুষ সকলের বড় সমাগম হয়। সবাই সাধারণত নিজ পরিবার [অর্থাৎ স্বামী বা স্ত্রী] রেখে দীর্ঘ সময় পার করে। সেজন্য এই আশঙ্কা দূরবর্তী থাকে না যে, শয়তান কাউকে কোনো গোনাহের মধ্যে লিপ্ত করে দেবে। তাই সর্বপ্রথমرفث  তথা অশালীন কথার ব্যাপারে নিষেধ করা হয়েছে।

এটি ইসলামের একটি মুজেযা এবং হজ্বের একটি বৈশিষ্ট্য যে, এত বিশাল জনসমাগম; যেখানে নারীদের থেকে পুরুষদের আলাদা থাকা সম্ভবও নয়। এই পরিবেশেও কখনো এমন শোনা যায়নি যে, মন্দ কোনো ঘটনা ঘটেছে! অন্য কোথাও এই পরিবেশ থাকলে দুনিয়া দেখত তাতে কী ঘটে!

এমনিভাবে এই বিরাট জনসমাগমে এবং দীর্ঘ সফরে সফরসঙ্গীদের মাঝে পরস্পরের কোনো ঝগড়া বিতর্কের পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে। এজন্যجدال  তথা তর্ক-ঝগড়া থেকে বেঁচে থাকার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।

এমনিভাবে فسوق তথা নাফরমানী বা হুকুম অমান্যতাকে নিষেধ করা হয়েছে। এসব তো সর্বত্র এবং সর্বাবস্থায়ই হারাম। হজ্বের সফরে আরও বেশি হারাম।

فسوق -এর মাঝে ছোট বড় সব গোনাহ অন্তর্ভুক্ত। এমন ব্যাপক অর্থবোধক শব্দের মাধ্যমে নিষেধ করে এ কথা বোঝানো হয়েছে যে, ইহরাম অবস্থায় এ বিষয়ে খুব বেশি ফিকির করা উচিত। যেন কোনো ক্ষেত্রেই শরয়ী বিধানের বিপরীত কোনো কাজ হয়ে না যায়।

এই তিন বিষয় থেকে বিশেষভাবে নিষেধ করার আরেকটি কারণ এটাও যে, মূলত এই বিষয়গুলোই সকল গোনাহের প্রবেশ পথ, সকল অন্যায়-অপরাধের সম্মুখদ্বার। 

মানুষ যত ধরনের গোনাহ করে, তা হয়তো কামভাব কেন্দ্রিক অথবা সম্পদ ও আসবাবকেন্দ্রিক। আর ঝগড়া বিতর্কও তো এসব বিষয় নিয়েই তৈরি হয়। তাই যে ব্যক্তি এই দুই বিষয়ের ক্ষেত্রে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে, সে অধিকাংশ গোনাহ থেকে বেঁচে যায় এবং অনেক অন্যায় অপরাধ থেকে নিরাপদে থাকে। সেজন্য হাদীস শরীফে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন

مَنْ يَضْمَنْ لِي مَا بَيْنَ لَحْيَيْهِ وَمَا بَيْنَ رِجْلَيْهِ، أَضْمَنْ لَهُ الْجَنَّةَ.

যে ব্যক্তি তার দুই চোয়ালের মধ্যবর্তী জিনিস (অর্থাৎ জিহ্বা) এবং দুই পায়ের মধ্যবর্তী জিনিস (অর্থাৎ লজ্জাস্থান)-এর জামানত দেবে (যে, তার মাধ্যমে কোনো গোনাহ হবে না)। আমি তার জন্য জান্নাতের জামিন হব। সহীহ বুখারী, হাদীস ৬৪৭৪

হজ্ব ও উমরায় এ বিষয়গুলোর আমলী মশক বা প্রায়োগিক অনুশীলনের দ্বারা উদ্দেশ্য কেবল এটা নয় যে, ইহরাম থেকে মুক্ত হয়ে গেলে আবার এসব মন্দ কাজে জড়িয়ে পড়বে। আবার সেই ঝগড়া-ফাসাদ করবে। সেইসব মন্দ কাজে আবার লিপ্ত হবে। বরং উদ্দেশ্য হল ঐ সময়ের মোজাহাদা ও আমলী মশক ভবিষ্যতেও যেন মানুষের কাজে আসে।

কেননা দুনিয়ায় যত ঝগড়া হয়, যদি সেগুলো জায়েযও হয়, তবুও সেগুলো হয় মূলত নিজের অধিকার দাবি করা এবং প্রতিপক্ষকে প্রতিরোধ করার জন্য। কিন্তু হজ্বে ঝগড়া করতে নিষেধ করে এই উত্তম আখলাকের ওপর প্রতিষ্ঠিত হওয়ার শিক্ষা দেওয়া হয়েছে যে, নিজের হক ও প্রাপ্যের ক্ষেত্রে ক্ষমা ও উদারতার পরিচয় দেবে। এসবের জন্য কখনো ঝগড়া-তর্ক করবে না। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন

أنا زعِيم بِبيتِ في رَبَضِ الجنةِ، لمن تركَ المِراء وإن كان مُحِقَّاً.

আমি ঐ ব্যক্তির জন্য জান্নাতের মাঝখানে (উৎকৃষ্টতম অংশে) একটি বাড়ির দায়িত্ব নিলাম, যে হকদার বা নিজ দাবিতে সত্য হওয়া সত্ত্বেও ঝগড়া-তর্ক পরিহার করে। সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ৪৮০০; জামে তিরমিযী, হাদীস ১৯৯৩

কুরআন মাজীদেও এ বিষয়ে উদ্বুদ্ধ করা হয়েছে যে, তোমরা নিজের হকের ব্যাপারে ছাড়, উদারতা ও ক্ষমার আচরণ করবে। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ‘খুলুকে আযীম’ তথা সুমহান চরিত্র এমনই ছিল। তিনি কখনো নিজের বিষয়ে কারো থেকে প্রতিশোধ নেননি। (দ্র. সহীহ বুখারী, হাদীস ৬৭৮৬, ৬৮৫৩)

মোটকথা, এই তিনটি বিষয় থেকে বিরত রেখে মানুষকে পবিত্র দৃষ্টি, পবিত্র হৃদয় ও সুমহান চরিত্রের প্রতি আগ্রহী করে তোলা হয়েছে।

এ কথা স্পষ্ট যে, মানুষকে এমনভাবে গড়ে তোলা কেবল হজ্বের অল্প কিছুদিনের জন্যই নয়; বরং উদ্দেশ্য হল, পুরো জীবন এই নীতি ও আদর্শের ওপর পরিচালনা করা।

অতএব ইহরাম ও হারামাইনের বরকতে আল্লাহ তাআলা আপনাদেরকে যেসব আমলের তাওফীক দিয়েছেন, তাতে অটল অবিচল থাকুন। একে বিরাট নিআমত মনে করুন এবং এই নিআমতকে ধরে রাখার চেষ্টা করুন। বরং তাকে আরও বাড়ানোর ফিকির ও মেহনত জারি রাখুন।

এমন যেন না হয়, এখান থেকে গিয়ে আবার মন্দ আখলাক ও বদ আমলের মধ্যে লিপ্ত হয়ে যাবেন। হাদীসের ওয়াদা মোতাবেক তো আশা করা যায়, হজ্বের মাধ্যমে অতীতের সকল গোনাহ ক্ষমা হয়ে গেছে, সেই আমলনামা যেন নতুন করে আবার গোনাহের মাধ্যমে শুরু না হয়।

ইহরাম অবস্থায় আপনাকে যারাই দেখত, নিশ্চিত হত যে, এই লোক চুরি করবে না। কাউকে কষ্ট দেবে না। মিথ্যা বলবে না। ঝগড়া-ফাসাদ করবে না। মন্দ কোনো কাজে লিপ্ত হবে না। এখান থেকে ফিরে যাওয়ার পর আপনার যাবতীয় অবস্থা, সকল আচার-আচরণ ও লেনদেন যেন ঠিক হয়ে যায়। আপনি যেন তেমন হয়ে যান, যেমন বলা হয়েছে হাদীস শরীফে

الَّذِينَ إِذَا رُؤوا، ذُكِرَ اللهُ.

(তাদেরকে দেখলে আল্লাহর কথা স্মরণ হয়। সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস ৪১২০)

আপনি যদি হজ্ব ও উমরা থেকে এইসব গুণ ও বৈশিষ্ট্য নিয়ে ফেরেন, তাহলে আপনার জন্য এই সুসংবাদ যে, আপনি সবকিছু নিয়ে ফিরছেন। এমন না হলে বুঝবেন হজ্ব-উমরার আমলের বরকত আপনার হাসিল হয়নি।

 

সারকথা

হজ্ব ও উমরার সকল আমল ও কাজের মূল উদ্দেশ্য হল, আপনাকে আল্লাহওয়ালা বানানো। যাতে আপনি আপনার জীবনের সকল ক্ষেত্রে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে নিজের জান ও মাল এবং আত্মীয়-পরিজন সকলের ওপর প্রাধান্য দেন। আপনার আখলাক যেন হয় উত্তম, উন্নত ও উচ্চস্তরের। আপনার দ্বারা কারো হক নষ্ট করা কিংবা অন্যায় পদ্ধতিতে কিছু গ্রহণ করা তো দূরের কথা; নিজের হকের ক্ষেত্রেও যেন তর্ক-ঝগড়া না হয়। সম্পদ ও সম্মানের মহব্বত থেকে হৃদয় যেন সম্পূর্ণ মুক্ত থাকে। সম্পদ ও সম্মান অবৈধ পদ্ধতিতে হাসিল করা তো দূরের কথা; বৈধ পদ্ধতিতে হাসিল করার ক্ষেত্রেও যেন কোনো লোভ না হয়।

আল্লাহ তাআলা আমাদের সবাইকে এইসব গুণ ও উত্তম অবস্থা দান করুন আমীন।

اَللّٰهُمَّ وَفِّقْنَا لِمَا تُحِبُّ وَتَرْضى مِنَ الْقَوْلِ وَالْفِعْلِ وَالْعَمَلِ وَالنِّيَّةِ، إِنَّكَ عَلى كُلِّ شَيْءٍ قَدِيرٌ.

 

 [অনুবাদ : মুহাম্মাদ তাওহীদুল ইসলাম তায়্যিব]

 

 

advertisement