হজ্বের কিছু আয়াত : তাৎপর্য ও বিধান
মাওলানা আবু রুশায়দ
আল্লাহ তাআলা কুরআন কারীমে ইরশাদ করেছেন–
اِنَّ اَوَّلَ بَيْتٍ وُّضِعَ لِلنَّاسِ لَلَّذِيْ بِبَكَّةَ مُبٰرَكًا وَّ هُدًي لِّلْعٰلَمِيْنَ، فِيْهِ اٰيٰتٌۢ بَيِّنٰتٌ مَّقَامُ اِبْرٰهِيْمَ وَ مَنْ دَخَلَهٗ كَانَ اٰمِنًا وَ لِلهِ عَلَي النَّاسِ حِجُّ الْبَيْتِ مَنِ اسْتَطَاعَ اِلَيْهِ سَبِيْلًا وَمَنْ كَفَرَ فَاِنَّ اللهَ غَنِيٌّ عَنِ الْعٰلَمِيْنَ.
বাস্তবতা এই যে, মানুষের (ইবাদতের) জন্য সর্বপ্রথম যে ঘর তৈরি করা হয়, নিশ্চয়ই তা সেটি, যা মক্কায় অবস্থিত, যা বরকতময় এবং সমগ্র জগতের মানুষের জন্য হেদায়েতের উপায়। তাতে আছে সুস্পষ্ট নিদর্শনাবলি, মাকামে ইবরাহীম। যে তাতে প্রবেশ করে, সে নিরাপদ হয়ে যায়। মানুষের মধ্যে যারা সেখানে পৌঁছার সামর্থ্য রাখে, তাদের ওপর আল্লাহর জন্য এ ঘরের হজ্ব করা ফরয। কেউ (এটা) অস্বীকার করলে আল্লাহ তো বিশ্ব জগতের সমস্ত মানুষ থেকে বেনিয়ায। –সূরা আলে ইমরান (০৩) : ৯৬-৯৭
আয়াতদ্বয়ে শুরুতে আল্লাহ তাআলা বলেছেন, মক্কায় অবস্থিত এই ঘর তথা কা‘বা শরীফ মানুষের ইবাদতের জন্য নির্মিত প্রথম ঘর। কা‘বা ঘর নির্মাণের উদ্দেশ্য হল, এটা হবে আল্লাহর ইবাদতের অন্যতম প্রধান কেন্দ্র। ইবরাহীম আলাইহিস সালামকে আল্লাহ তাআলা কা‘বা শরীফ সম্পর্কে যে নির্দেশনা দিয়েছিলেন, তাতেও এ কথা স্পষ্ট। আল্লাহ তাআলা বলেছেন–
وَاِذْ بَوَّاْنَا لِاِبْرٰهِيْمَ مَكَانَ الْبَيْتِ اَنْ لَّا تُشْرِكْ بِيْ شَيْـًٔا وَّ طَهِّرْ بَيْتِيَ لِلطَّآىِٕفِيْنَ وَالْقَآىِٕمِيْنَ وَالرُّكَّعِ السُّجُوْدِ.
এবং সেই সময়কে স্মরণ কর, যখন আমি ইবরাহীমকে সেই ঘর (অর্থাৎ কা‘বাগৃহ)-এর স্থান জানিয়ে দিয়েছিলাম। (এবং হুকুম দিয়েছিলাম,) আমার সাথে কাউকে শরীক করো না এবং আমার ঘরকে সেইসকল লোকের জন্য পবিত্র রেখ, যারা (এখানে) তাওয়াফ করে, ইবাদতের জন্য দাঁড়ায় এবং রুকু-সিজদা আদায় করে। –সূরা হজ্ব (২২) : ২৬
আরও দ্রষ্টব্য : সূরা বাকারা (০২) : ১২৫
এ আয়াতে স্পষ্ট যে, আল্লাহ তাআলা ইবরাহীম আলাইহিস সালামকে যখন কা‘বা ঘর পুনর্নির্মাণের নির্দেশনা দিয়েছেন, তখন তাওহীদেরও আদেশ করেছেন এবং অবস্থানকারী ও নামায আদায়কারী সবার জন্য কা‘বাকে পাক-পবিত্র রাখারও নির্দেশ করেছেন। সুতরাং বোঝা গেল, কা‘বা ঘর নির্মাণের অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য– এখানে খালেস তাওহীদ বা আল্লাহর একত্ববাদ চর্চিত হবে এবং এখান থেকে তাওহীদের শিক্ষা প্রচারিত হবে। সেইসাথে এটা হবে হজ্ব ও নামায ইত্যাদি ইবাদতের প্রাণকেন্দ্র। তারই ধারাবাহিকতায় এ ঘরের তাওয়াফ বা প্রদক্ষিণ হজ্বের আমলের গুরুত্বপূর্ণ অংশ এবং এর দিকে মুখ করেই নামায আদায় করা হয়।
উক্ত আয়াতে আল্লাহ তাআলা কা‘বাকে পবিত্র রাখার যে নির্দেশ দিয়েছেন, তার ব্যাপকতার মধ্যে পরিচ্ছন্ন করার বিষয়টি যেমন রয়েছে, তেমনি তাতে একথাও অন্তর্ভুক্ত যে, কা‘বাকে শিরক ও কুফর মুক্ত রাখ। এখানে রাব্বুল আলামীন আল্লাহ ছাড়া আর কারো উপাসনা হবে না; কেবল এক আল্লাহর ইবাদত হবে। যে কথা তিনি এর আগের বাক্যে বলেছেন, ‘আমার সাথে কাউকে শরীক করো না।’ সুতরাং বাইতুল্লাহ বা কা‘বা কেন্দ্রিক ইবাদতের মধ্যে তাওহীদের শিক্ষা ও ঘোষণা সুস্পষ্ট। এ তাওহীদ বা আল্লাহর প্রতি একনিষ্ঠতা –যার চর্চা সেখানে হয়েই থাকে– হাজ্বীগণের গভীরভাবে গ্রহণ করা দরকার।
পূর্বে বর্ণিত সূরা আলে ইমরানের আয়াতে আল্লাহ তাআলা কা‘বা শরীফ সম্পর্কে আরও বলছেন, ‘যা বরকতময় এবং সমস্ত মানুষের জন্য হেদায়েতের উপায়।’ বাইতুল্লাহ ছাড়াও হজ্বের সঙ্গে সাফা-মারওয়াসহ এমন সব স্থান জড়িত, যেগুলোকে আল্লাহ তাআলা রহমত ও বরকতের উৎস বানিয়েছেন। তাই হজ্বের কার্যাদি আদায়ের পাশাপাশি সেখানকার বরকত ও হেদায়েত হাসিল করার প্রতিও মনোনিবেশ করা উচিত।
তার পরে আল্লাহ বলেছেন, পুণ্যময় মক্কা নগরে আল্লাহর অনেক নিদর্শন রয়েছে; এর মধ্যে একটি হল মাকামে ইবরাহীম। ইবরাহীম আলাইহিস সালাম কা‘বা ঘর পুনর্নির্মাণের সময় যে পাথরে দাঁড়িয়ে কাজ করেছিলেন, সেটিকে বলা হয় ‘মাকামে ইবরাহীম’। আল্লাহ তাআলা কুরআনে বলেছেন, ‘তোমরা ‘মাকামে ইবরাহীম’কে সালাতের স্থান হিসেবে গ্রহণ করো।’ [দ্রষ্টব্য : সূরা বাকারা (০২) : ১২৫] তাওয়াফ পরবর্তী ওয়াজিব দুই রাকাত নামায মাকামে ইবরাহীমের পেছনেই আদায় করতে হয়।
সূরা আলে ইমরানের আয়াতে তার পরে আল্লাহ তাআলা বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি মক্কায় প্রবেশ করে, সে নিরাপদ হয়ে যায়।’ আল্লাহ তাআলা মক্কা নগরকে সকলের জন্যই নিরাপদ ও শান্তির জায়গা বানিয়েছেন। সূরা আনকাবূতের (২৯) ৬৭ নম্বর আয়াতেও আল্লাহ সে কথা বলেছেন। এটা ইবরাহীম আলাইহিস সালামের দুআর ফল। তিনি আল্লাহর কাছে দুআ করেছিলেন, হে আল্লাহ! আপনি এ শহরকে অর্থাৎ মক্কাকে শান্তিপূর্ণ বানিয়ে দিন। [দ্রষ্টব্য : সূরা ইবরাহীম (১৪) : ৩৫]
কা‘বা ঘর বা বাইতুল্লাহ সম্পর্কে কুরআনে অন্যত্র ইরশাদ হয়েছে–
وَ اِذْ جَعَلْنَا الْبَيْتَ مَثَابَةً لِّلنَّاسِ وَ اَمْنًا.
এবং (সেই সময়কে স্মরণ কর) যখন আমি বাইতুল্লাহকে পরিণত করি মানুষের বারবার ফিরে আসার জায়গা এবং পরিপূর্ণ নিরাপত্তার স্থানে। –সূরা বাকারা (০২) : ১২৫
আল্লাহ তাআলা ইবরাহীম আলাইহিস সালামের দুআর বরকতে ও বাইতুল্লাহ্র মর্যাদায় এর আশপাশকে এমন নিরাপদ স্থান বানিয়েছেন যে, কেবল মসজিদুল হারামই নয়, বরং তার চতুষ্পার্শ্বস্থ হারামের বিস্তীর্ণ এলাকায় হত্যা, যুদ্ধ-বিগ্রহ ও কোনো পশু শিকার করা জায়েয নেই। এমনকি কোনো গাছ ওপড়ানো কিংবা কোনো প্রাণীকে আটকে রাখাও বৈধ নয়। এ স্থান কেবল মানুষের জন্যই নয়, বরং জীবজন্তু ও উদ্ভিদের জন্যও নিরাপত্তাস্থল। ইসলামপূর্ব যুগেও সেখানকার বাসিন্দারা এ জায়গার সম্মান ও মর্যাদা রক্ষা করত।
তার পরে উল্লিখিত আয়াতদ্বয়ে আল্লাহ তাআলা হজ্ব ফরয হওয়ার ঘোষণা দিয়ে বলেছেন– ‘মানুষের মধ্যে যারা সেখানে পৌঁছার সামর্থ্য রাখে, তাদের ওপর আল্লাহর জন্য এ ঘরের হজ্ব করা ফরয।’
হজ্বের কিছু আয়াত
কুরআন কারীমে আল্লাহ তাআলা হজ্ব বিষয়ক অনেক আয়াতে বিভিন্ন বিধান ও করণীয়-বর্জনীয় উল্লেখ করেছেন। এর মধ্যে কয়েকটি আয়াত নিম্নে আলোচনা করা হল–
হজ্ব ও উমরা একমাত্র আল্লাহর জন্যই
আল্লাহ তাআলা বলেন–
وَ اَتِمُّوا الْحَجَّ وَ الْعُمْرَةَ لِلهِ.
আর তোমরা আল্লাহর (সন্তুষ্টির) জন্য হজ্ব ও উমরা কর। –সূরা বাকারা (০২) : ১৯৬
মিনায় অবস্থান
হজ্বের আমলগুলো মিনা থেকেই শুরু হয় এবং মিনাকে কেন্দ্র করেই আদায় করা হয়। হজ্বের সময় ৮ যিলহজ্বে সর্বপ্রথম মিনা প্রান্তরে যেতে হবে। সেখানে যোহর থেকে পরদিন ৯ তারিখ ফজর পর্যন্ত পাঁচ ওয়াক্ত নামায আদায় করা ও রাতযাপন করা সুন্নত। তারপর হজ্বের অন্যান্য কাজ সেরে জামরায়ে আকাবায় রমী (পাথর নিক্ষেপ)-এর জন্য ১০ তারিখে আবার মিনায় যেতে হবে। ১১ ও ১২ তারিখের রাতে মিনায় অবস্থান করা সুন্নত এবং এ দিনগুলোতেও জামরাসমূহে পাথর নিক্ষেপের আমল রয়েছে। আল্লাহ তাআলা কুরআন কারীমে ইরশাদ করেন–
وَ اذْكُرُوا اللهَ فِيْۤ اَيَّامٍ مَّعْدُوْدٰتٍ فَمَنْ تَعَجَّلَ فِيْ يَوْمَيْنِ فَلَاۤ اِثْمَ عَلَيْهِ وَمَنْ تَاَخَّرَ فَلَاۤ اِثْمَ عَلَيْهِ لِمَنِ اتَّقٰي وَ اتَّقُوا اللهَ وَاعْلَمُوْۤا اَنَّكُمْ اِلَيْهِ تُحْشَرُوْنَ.
আর তোমরা নির্দিষ্ট কয়েকটি দিনে আল্লাহকে স্মরণ কর। অতঃপর যে ব্যক্তি তাড়াতাড়ি করে চলে যাবে দুই দিনের মধ্যেই, তার কোনো গোনাহ নেই। আর যে (এক দিন) পরে যাবে তারও কোনো গোনাহ নেই। এটা তার জন্য, যে আল্লাহকে ভয় করে। আর তোমরা আল্লাহভীতি অবলম্বন কর এবং জেনে রাখ, তোমাদের সকলকে তাঁরই নিকট সমবেত করা হবে। –সূরা বাকারা (০২) : ২০৩
এ আয়াতে ‘নির্দিষ্ট কয়েকটি দিন’ বলে যিলহজ্ব মাসের ১১, ১২ ও ১৩ তারিখের কথা বোঝানো হয়েছে। এ দিনগুলোতে মিনায় অবস্থান করা হয় এবং জামরাসমূহে পাথর নিক্ষেপ করা হয়। আল্লাহ বলছেন, এ দিনগুলোতে তোমরা আল্লাহকে স্মরণ কর। তারপর বলেছেন, কেউ যদি এই তিন দিনের মধ্যে দুই দিন তথা ১১ ও ১২ তারিখে মিনায় অবস্থান করে এবং জামরাসমূহে রমী করে চলে আসে, তাহলে এতে কোনো গোনাহ নেই। তবে তিন দিন অবস্থান করাই উত্তম। তারপর আল্লাহ তাআলা সকলকে সর্বাবস্থায় তাকওয়া অবলম্বন করার নির্দেশনা দিয়েছেন।
আরাফায় অবস্থান
আল্লাহ তাআলা আরাফায় অবস্থান সম্পর্কে ইরশাদ করেছেন–
ثُمَّ اَفِيْضُوْا مِنْ حَيْثُ اَفَاضَ النَّاسُ وَاسْتَغْفِرُوا اللهَ اِنَّ اللهَ غَفُوْرٌ رَّحِيْمٌ.
অতঃপর তোমরাও (তাওয়াফের জন্য) সে স্থান থেকে প্রত্যাবর্তন কর, যে স্থান থেকে সবাই প্রত্যাবর্তন করে। আর আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা কর। নিশ্চয়ই আল্লাহ অতি ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু। –সূরা বাকারা (০২) : ১৯৯
যিলহজ্বের ৯ তারিখ সূর্য ঢলে যাওয়ার পর থেকে সূর্যাস্তের আগ পর্যন্ত আরাফায় অবস্থান (উকূফ) করা হজ্বের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ রুকন। এটাকে উকূফে আরাফা বলা হয়। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, হজ্ব হল (উকূফে) আরাফা। [দ্রষ্টব্য : জামে তিরমিযী, হাদীস ৮৮৯; মুসনাদে আহমদ, হাদীস ১৮৭৭৪]
জাহেলী যুগেও হাজ্বীরা আরাফায় অবস্থান করে সেখান থেকে মুযদালিফায় এসে তারপর তাওয়াফ করতে আসত। কিন্তু আরাফা যেহেতু মক্কার হারামের সীমানার বাইরে। তাই সে যুগে মক্কার লোকেরা বলত, ‘আমরা হারামের বাসিন্দা, আমরা হারাম থেকে বের হয়ে অন্যদের মতো আরাফায় গিয়ে অবস্থান করব না।’ তাই তারা ৯ যিলহজ্বে আরাফায় যেত না; বরং হারামের সীমানার ভেতরে মুযদালিফায় অবস্থান করে সেখান থেকে তাওয়াফ করতে আসত। আল্লাহ তাআলা উক্ত আয়াতে তাদেরকে আদেশ করছেন, তোমরাও তাওয়াফের জন্য সেখান থেকে ফিরে আস, যেখান থেকে সবাই তাওয়াফ করতে আসে, অর্থাৎ আরাফা থেকে। আল্লাহর ইবাদতের ক্ষেত্রে সবাই সমান, কারো কোনো বিশেষ মর্যাদা নেই।
মুযদালিফায় অবস্থান
আল্লাহ তাআলা বলেন–
فَاِذَاۤ اَفَضْتُمْ مِّنْ عَرَفٰتٍ فَاذْكُرُوا اللهَ عِنْدَ الْمَشْعَرِ الْحَرَامِ وَاذْكُرُوْهُ كَمَا هَدٰىكُمْ.
অতঃপর যখন (তাওয়াফের জন্য) আরাফা থেকে প্রত্যাবর্তন কর, তখন মাশআরুল হারামের নিকট আল্লাহর যিকির কর এবং তার যিকির সেভাবে কর, যেভাবে তিনি তোমাদের শিখিয়েছেন। –সূরা বাকারা (০২) : ১৯৮
মাশআরুল হারাম একটি পাহাড়ের নাম, যা মুযদালিফায় অবস্থিত। সেখানে এ নামে একটি মসজিদও নির্মাণ করা হয়েছে। ৯ যিলহজ্ব সূর্যাস্তের পরে আরাফা থেকে রওয়ানা হয়ে মুযদালিফায় এসে ১০ যিলহজ্ব সূর্যোদয়ের পূর্ব পর্যন্ত অবস্থান করতে হয়। এক্ষেত্রে মুযদালিফায় রাতযাপন করা সুন্নত। আর সুবহে সাদিক থেকে সূর্যোদয়ের আগে চারপাশ আলোকিত হওয়া পর্যন্ত অবস্থান করা ওয়াজিব। এটাকে উকূফে মুযদালিফা বলা হয়। সে সময় হাজ্বীগণ আল্লাহ তাআলার যিকির ও দুআ-মুনাজাত করবেন। সেদিকেই আয়াতে ইশারা করা হয়েছে। আল্লাহ তাআলা বলেছেন, তোমরা আরাফা থেকে মুযদালিফায় মাশআরুল হারামে এসে আল্লাহর যিকির কর। আর তাঁর যিকির সেভাবে কর, যেভাবে তিনি তোমাদের শিখিয়েছেন। অর্থাৎ একনিষ্ঠভাবে কেবলই আল্লাহর যিকির কর, তাঁকে স্মরণ কর, তাঁর কাছেই প্রার্থনা কর।
কা‘বা শরীফ তাওয়াফ করা (তাওয়াফে যিয়ারত)
আল্লাহ তাআলা কুরআন কারীমে ইরশাদ করেন–
وَ لْيَطَّوَّفُوْا بِالْبَيْتِ الْعَتِيْقِ.
এবং তারা যেন এ প্রাচীন ঘরের তাওয়াফ করে। –সূরা হজ্ব (২২) : ২৯
১০ যিলহজ্ব সূর্যোদয়ের আগে আগে আবার মিনার উদ্দেশে রওয়ানা হবে। মিনায় এসে জামরায়ে আকাবায় কঙ্কর নিক্ষেপ করবে। তারপর দমে শোকর বা হজ্বের কুরবানী করবে। তারপর মাথা মুণ্ডন করবে। তার পর কা‘বা শরীফের তাওয়াফ করবে। একে তাওয়াফে যিয়ারত বলা হয়। এটা হজ্বের ফরয বিধান।
এ তাওয়াফের সময়সীমা যিলহজ্বের ১২ তারিখের সূর্যাস্ত পর্যন্ত।
সাফা মারওয়া সায়ী করা
اِنَّ الصَّفَا وَالْمَرْوَةَ مِنْ شَعَآىِٕرِ اللهِ فَمَنْ حَجَّ الْبَيْتَ اَوِاعْتَمَرَ فَلَا جُنَاحَ عَلَيْهِ اَنْ يَّطَّوَّفَ بِهِمَا.
নিশ্চয়ই সাফা ও মারওয়া আল্লাহর নিদর্শনাবলির অন্তর্ভুক্ত। সুতরাং যে ব্যক্তিই বাইতুল্লাহ্র হজ্ব করবে বা উমরা করবে তার জন্য এ দুটোর প্রদক্ষিণ করাতে কোনো গোনাহ নেই। –সূরা বাকারা (০২) : ১৫৮
সাফা ও মারওয়া কা‘বা শরীফের নিকটে অবস্থিত দুটি ছোট পাহাড়। হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালামের স্ত্রী হাজার (هَاجَرُ) রা. শিশুপুত্র ইসমাঈল আলাইহিস সালামের জন্য পানির সন্ধানে এ দুই পাহাড়ে ছোটাছুটি করেছিলেন। আল্লাহ তাআলা হজ্ব ও উমরা আদায়ের সময় এ দুই পাহাড়ে সায়ী (ছোটাছুটি) করাকে ওয়াজিব করেছেন এবং এগুলোকে তিনি তাঁর নিদর্শনের অন্তর্ভুক্ত বলেছেন।
সায়ী করা ওয়াজিব হওয়া সত্ত্বেও এখানে যে ‘কোনো গোনাহ নেই’ বলা হয়েছে, তার কারণ, জাহেলী যুগে মুশরিকরা এ পাহাড়দুটিতে মূর্তি স্থাপন করেছিল এবং তারা সেগুলোর পূজা করত। তারা মনে করত, সায়ীর উদ্দেশ্য– সে মূর্তিগুলোর প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা। মক্কা বিজয়ের পর যদিও মূর্তিদুটিকে অপসারণ করা হয়েছিল, তবুও কোনো কোনো মুসলমানের মনে এ দ্বিধাবোধ হল যে, জাহেলী যুগে যেহেতু এ দুই পাহাড়ে মূর্তি ছিল, তাই এখনো হয়তো এ দুই পাহাড়ে সায়ী করা গোনাহ হতে পারে। আয়াতে তাদের সেই সন্দেহ দূর করে বলে দেওয়া হল– সাফা-মারওয়ার তাওয়াফ বা সায়ীতে কোনো গোনাহ বা খারাবী নেই। এগুলো মূলত আল্লাহর নিদর্শন, অতএব এগুলোতে সায়ী করাই উচিত। [দ্রষ্টব্য : সহীহ বুখারী, হাদীস ১৬৪৩, ১৭৯০; সহীহ মুসলিম, হাদীস ১২৭৭; জামে তিরমিযী, হাদীস ২৯৬৫]
ইহরাম অবস্থায় শিকার না করা
আল্লাহ তাআলা বলেছেন–
يٰۤاَيُّهَا الَّذِيْنَ اٰمَنُوْا لَا تَقْتُلُوا الصَّيْدَ وَ اَنْتُمْ حُرُمٌ وَمَنْ قَتَلَهٗ مِنْكُمْ مُّتَعَمِّدًا فَجَزَآءٌ مِّثْلُ مَا قَتَلَ مِنَ النَّعَمِ يَحْكُمُ بِهٖ ذَوَا عَدْلٍ مِّنْكُمْ هَدْيًۢا بٰلِغَ الْكَعْبَةِ اَوْ كَفَّارَةٌ طَعَامُ مَسٰكِيْنَ اَوْ عَدْلُ ذٰلِكَ صِيَامًا لِّيَذُوْقَ وَبَالَ اَمْرِهٖ.
হে মুমিনগণ! তোমরা যখন ইহরাম অবস্থায় থাক তখন কোনো শিকার হত্যা কর না। তোমাদের মধ্যে কেউ ইচ্ছাকৃতভাবে তা হত্যা করলে তার বিনিময় দেওয়া ওয়াজিব (যার নিয়ম এই,) সে যে প্রাণী হত্যা করেছে তার সমতুল্য গৃহপালিত কোনো জন্তুকে– যার ফয়সালা করবে তোমাদের মধ্যে দুজন ন্যায়বান লোক– কা‘বায় পৌঁছানো হবে কুরবানীরূপে। অথবা (তার মূল্য পরিমাণ) কাফফারা আদায় করা হবে মিসকীনদেরকে খানা খাওয়ানোর দ্বারা অথবা তার সমসংখ্যক রোযা দ্বারা। যেন সে ব্যক্তি তার কৃতকর্মের ফল ভোগ করে। –সূরা মায়েদা (০৫) : ৯৫
এ সংক্রান্ত মাসআলা বিস্তারিতভাবে ফিকহী গ্রন্থাবলিতে রয়েছে।
অশ্লীলতা, পাপাচার ও ঝগড়া-বিবাদ থেকে বিরত থাকা
হজ্ব সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা কুরআন কারীমে ইরশাদ করেছেন–
اَلْحَجُّ اَشْهُرٌ مَّعْلُوْمٰتٌ فَمَنْ فَرَضَ فِيْهِنَّ الْحَجَّ فَلَا رَفَثَ وَلَا فُسُوْقَ وَلَا جِدَالَ فِي الْحَجِّ وَمَا تَفْعَلُوْا مِنْ خَيْرٍ يَّعْلَمْهُ اللهُ وَتَزَوَّدُوْا فَاِنَّ خَيْرَ الزَّادِ التَّقْوٰي وَاتَّقُوْنِ يٰۤاُولِي الْاَلْبَابِ.
হজ্বের নির্দিষ্ট কয়েকটি মাস আছে। যে ব্যক্তি সেসব মাসে (ইহরাম বেঁধে) নিজের ওপর হজ্ব অবধারিত করে নেয়, সে হজ্বের সময়ে কোনো অশ্লীল কথা বলবে না, গোনাহ করবে না এবং ঝগড়াও নয়। তোমরা যা কিছু সৎকর্ম করবে আল্লাহ তা জানেন। আর (হজ্বের সফরে) পথ-খরচা সাথে নিয়ো, বস্তুত তাকওয়াই উৎকৃষ্ট অবলম্বন। আর হে বুদ্ধিমানরা! তোমরা আমাকে ভয় করে চলো। –সূরা বাকারা (০২) : ১৯৭
উল্লিখিত আয়াতে আল্লাহ তাআলা হজ্বে গিয়ে তিন ধরনের গোনাহ থেকে বিরত থাকতে বিশেষভাবে নির্দেশ দিয়েছেন :
১. কোনো অশ্লীল কথা ও কাজে লিপ্ত হবে না।
২. কোনো গোনাহ ও পাপাচারে লিপ্ত হবে না।
৩. কারো সাথে কোনো ঝগড়া-বিবাদ করবে না।
আয়াতে বর্ণিত নিষিদ্ধ কাজগুলো সবসময়ই নিষিদ্ধ। কিন্তু তবুও আল্লাহ তাআলা হাজ্বীগণকে বিশেষভাবে এসকল বিষয়ে সতর্ক করেছেন, কারণ নফসের দুর্বলতাসহ আরও বিভিন্ন কারণে হজ্বে অনেক সময় এমন পরিস্থিতি হয়ে যায় যে, গোনাহ বা কোনো সীমালঙ্ঘন হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা দেখা দেয়। তাই আল্লাহ তাআলা কুরআন মাজীদে হজ্বের সফরে বিশেষভাবে পাপাচার ও ঝগড়া-বিবাদ থেকে বেঁচে থাকার নির্দেশ দিয়েছেন। হাজ্বী তো আল্লাহর ঘরের মেহমান। আল্লাহর ঘরের মেহমানের গোনাহ করা সাজে না, ঝগড়া করা সাজে না। আল্লাহ তাআলা কুরআনে আরেক জায়গায় বলেছেন, যারা তাদের প্রতিপালকের অনুগ্রহ ও সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে পবিত্রগৃহ অভিমুখে গমন করে, তাদের অবমাননা করো না। [দ্রষ্টব্য : সূরাতুল মায়েদা (০৫) : ২] অতএব কুরআনের নির্দেশনা পালনার্থে হাজ্বী সাহেবগণের এ প্রতিজ্ঞা করা উচিত, যারা এখানে এসেছে, সবাই আল্লাহর মেহমান। তাই আমি তাদের কোনো সম্মানহানী করব না। আমার যত কষ্ট হোক, আমার সাথে যদি কেউ দুর্ব্যবহারও করে, তবুও কুরআন যখন বলেছে, হজ্বের মধ্যে কোনো ঝগড়া নেই, সুতরাং আমি কারো সাথে ঝগড়া করব না। কুরআন যখন নির্দেশ করেছে, হজ্বের সময় অশ্লীল কথা ও কাজে এবং কোনো গোনাহ ও পাপাচারে লিপ্ত না হতে, সুতরাং আমি কোনো পরিস্থিতিতেই কোনো ধরনের গোনাহে লিপ্ত হব না। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন–
مَنْ حَجَّ لِلهِ فَلَمْ يَرْفُثْ، وَلَمْ يَفْسُقْ، رَجَعَ كَيَوْمِ وَلَدَتْهُ أُمُّهُ.
যে আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য হজ্ব করে এবং সকল অশ্লীল ও গোনাহের কথা ও কাজ থেকে বিরত থাকে, সে সদ্যজাত শিশুর মতো নিষ্পাপ হয়ে ফিরে আসে। –সহীহ বুখারী, হাদীস ১৫২১; সহীহ মুসলিম, হাদীস ১৩৫০
হজ্ব এমন একটি ইবাদত, যা আদায় করতে গিয়ে আল্লাহর বান্দাগণ ব্যক্তিগত স্বার্থ ও জাগতিক কামনা-বাসনা জলাঞ্জলি দিয়ে কেবল আল্লাহরই অভিমুখী হন। তাই হজ্ব আদায়ের ভেতর দিয়ে মুমিনের জীবনে অনেক মহৎ মহৎ গুণের প্রকাশ ঘটে ও চর্চা হয়। যেমন তাকওয়া, আল্লাহমুখিতা, একনিষ্ঠতা, আনুগত্য, দাসত্ব, বিনয়, ধৈর্য, ত্যাগ-তিতিক্ষা, সহনশীলতা ইত্যাদি। তাই হজ্ব আদায়ের মাধ্যমে বিশেষভাবে এ গুণাবলি অর্জনের প্রতিও লক্ষ রাখা আবশ্যক। তাহলেই হজ্ব পূর্ণাঙ্গ হবে।
তাকওয়াই শ্রেষ্ঠ পাথেয়
উপরিউক্ত আয়াতের পরের অংশে আল্লাহ তাআলা বলেছেন–
وَ مَا تَفْعَلُوْا مِنْ خَيْرٍ يَّعْلَمْهُ اللهُ، وَتَزَوَّدُوْا فَاِنَّ خَيْرَ الزَّادِ التَّقْوٰي، وَاتَّقُوْنِ يٰۤاُولِي الْاَلْبَابِ.
তোমরা যে কোনো ভালো কাজ কর, আল্লাহ তা জানেন। তোমরা পাথেয় সংগ্রহ কর। বস্তুত তাকওয়াই সর্বোত্তম পাথেয়। আর হে বোধসম্পন্ন ব্যক্তিরা, তোমরা আমাকে ভয় কর। –সূরা বাকারা (০২) : ১৯৭
বান্দার ছোট বড় কোনো কাজই আল্লাহর অগোচরে নয়। আল্লাহ সব জানেন।
উক্ত আয়াতে আল্লাহ তাআলা আরও বলেছেন, (তরজমা) ‘তোমরা পাথেয় সংগ্রহ কর। বস্তুত তাকওয়াই সর্বোত্তম পাথেয়।’ হজ্বের সফরে নিজের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নেওয়া কেউ কেউ ভালো মনে করত না। আল্লাহ বলছেন, প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রও নাও। তবে তোমাদের সর্বোত্তম পাথেয় হল ‘তাকওয়া’। হজ্ব সংক্রান্ত বিভিন্ন আয়াতে আল্লাহ তাআলা তাকওয়া অর্জন ও অবলম্বনের কথা বলেছেন। হজ্বের সাথে তাকওয়ার সম্পর্ক অনেক গভীর। কারণ তাকওয়া ও ইখলাস না থাকলে হজ্ব পূর্ণাঙ্গ হবে না। হজ্বের উদ্দেশ্য পূরণ ও বরকত লাভ হবে না। তাকওয়া ও ইখলাস থাকলেই হজ্বের আসল উদ্দেশ্য ও বরকত হাসিল হবে। তাই আল্লাহ তাআলা হজ্বের সময় বিশেষভাবে তাকওয়া হাসিল করতে বলেছেন।
কুরআন কারীমে হজ্বের বিধানাবলি সম্পর্কে আরও একাধিক আয়াত বর্ণিত হয়েছে এবং বহু হেদায়েত দেওয়া হয়েছে। হজ্ব আদায়ের সময় কেউ যদি কুরআনের এসকল শিক্ষা ও হেদায়েত মেনে চলে, তাহলে এর মাধ্যমে সে সত্যিকারের মুমিন হয়ে উঠবে এবং নবীজীর হাদীস অনুযায়ী সদ্যজাত শিশুর মতো নিষ্পাপ হয়ে ফিরবে। আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে মাকবূল ও মাবরূর হজ্ব করার তাওফীক দান করুন।