যিলহজ্ব ১৪৪৬   ||   জুন ২০২৫

কুরআন থেকে কুরবানীর শিক্ষা
ইখলাস ও লিল্লাহিয়্যাতে ভাস্বর এক ইবাদত

মাওলানা ফজলুদ্দীন মিকদাদ

আল্লাহ তাআলা কুরআন কারীমে ইরশাদ করেন

وَ الْبُدْنَ جَعَلْنٰهَا لَكُمْ مِّنْ شَعَآىِٕرِ اللهِ لَكُمْ فِيْهَا خَيْرٌ فَاذْكُرُوا اسْمَ اللهِ عَلَيْهَا صَوَآفَّ فَاِذَا وَجَبَتْ جُنُوْبُهَا فَكُلُوْا مِنْهَا وَ اَطْعِمُوا الْقَانِعَ وَالْمُعْتَرَّ  كَذٰلِكَ سَخَّرْنٰهَا لَكُمْ لَعَلَّكُمْ تَشْكُرُوْنَ، لَنْ يَّنَالَ اللهَ لُحُوْمُهَا وَلَا دِمَآؤُهَا وَلٰكِنْ يَّنَالُهُ التَّقْوٰي مِنْكُمْ كَذٰلِكَ سَخَّرَهَا لَكُمْ لِتُكَبِّرُوا اللهَ عَلٰي مَا هَدٰىكُمْ وَبَشِّرِ الْمُحْسِنِيْنَ.

কুরবানীর উট (ও গরু ছাগল ইত্যাদি)-কে তোমাদের জন্য আল্লাহর ‘শাআইর’-এর অন্তর্ভুক্ত করেছি। তোমাদের পক্ষে তাতে আছে কল্যাণ। সুতরাং যখন তা সারিবদ্ধ অবস্থায় দাঁড়ানো থাকে, তোমরা তার ওপর আল্লাহর নাম নেবে। তারপর যখন (যবেহ হয়ে যাওয়ার পর) তা কাত হয়ে মাটিতে পড়ে যায়, তখন তার গোশত থেকে নিজেরাও খাও এবং ধৈর্যশীল অভাবগ্রস্তকেও খাওয়াও এবং তাকেও, যে নিজ অভাব প্রকাশ করে। এভাবেই আমি এসব পশুকে তোমাদের বশীভূত করে দিয়েছি, যাতে তোমরা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর। আল্লাহর কাছে তাদের গোশত পৌঁছে না আর তাদের রক্তও না, বরং তাঁর কাছে তোমাদের তাকওয়াই পৌঁছে। এভাবেই তিনি এসব পশুকে তোমাদের বশীভূত করে দিয়েছেন, যাতে তোমরা আল্লাহর মহিমা ঘোষণা কর, তিনি তোমাদেরকে হেদায়েত দান করেছেন বলে। যারা সুচারুরূপে সৎকর্ম করে তাদেরকে সুসংবাদ দাও। সূরা হজ্ব (২২) : ৩৬-৩৭

কুরবানী ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ একটি ইবাদত। শরীয়তে এর যে পদ্ধতি নির্দেশিত হয়েছে, তার মূল সূত্র হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালামের কুরবানী থেকে গৃহীত। এজন্য আমাদের কুরবানীকে বলা হয় ‘সুন্নতে ইবরাহীমী’। আল্লাহ তাআলা ইবরাহীম আলাইহিস সালামকে স্বপ্নে নির্দেশ দিলেন আপন পুত্র ইসমাঈল আলাইহিস সালামকে কুরবানী করতে। এর পরের ঘটনা আমাদের জানা রয়েছে। কুরআন কারীমে সূরা সফ্ফাতে তা বিবৃত হয়েছে। আল্লাহর হুকুম পালন করতে গিয়ে মহান পিতাপুত্র সর্বোচ্চ ত্যাগ, সমর্পণ ও আল্লাহমুখিতার যে পরিচয় দিয়েছেন, আল্লাহ তাআলা তা অত্যন্ত পছন্দ করেছেন। তাই কিয়ামত পর্যন্ত আগত সকলের জন্য নির্ধারিত দিনে নির্দিষ্ট পদ্ধতিতে পশু কুরবানী করার বিধান দিয়েছেন।

কুরবানীর অনেক শিক্ষা রয়েছে। এর মধ্যে একটি শিক্ষা হল, আল্লাহর নৈকট্য অর্জনের জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা করা। এর জন্য নিজেকে ও নিজের সবকিছু আল্লাহর জন্য নিবেদিত ও উৎসর্গিত করার মতো ঈমান রাখা। সকল নেক কাজ একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য করা। আল্লাহর হুকুম পালনে যে কোনো ত্যাগ স্বীকার করার মানসিকতা রাখা। মহান পিতাপুত্রের ঘটনায় এ শিক্ষা একেবারে স্পষ্ট। ইবরাহীম আলাইহিস সালাম ছুরি হাতে নিয়েছিলেন পুত্রকে যবেহ করার জন্য। ইসমাঈল আলাইহিস সালামও দ্বিধাহীন চিত্তে ছুরির নিচে গলা পেতে দিয়েছিলেন। পিতাপুত্র উভয়েই আল্লাহর জন্য সর্বোচ্চ নিবেদন ও উৎসর্গের পরাকাষ্ঠা দেখিয়েছেন। উভয়েরই একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল আল্লাহর নৈকট্য অর্জন করা এবং সমর্পিত চিত্তে তাঁর আদেশ শিরোধার্য করা। আল্লাহর সন্তুষ্টি হাসিলের জন্য সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করতে তারা বিন্দুমাত্র দ্বিধা করেননি।

আল্লাহ চান তাঁর সকল বান্দাই এই রকম ঈমান, সমর্পণ ও আল্লাহমুখিতা লালন করবে। আল্লাহ তাআলা কুরআন কারীমে নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে উদ্দেশ্য করে বলেছেন

قُلْ اِنَّنِيْ هَدٰىنِيْ رَبِّيْۤ اِلٰي صِرَاطٍ مُّسْتَقِيْمٍ، دِيْنًا قِيَمًا مِّلَّةَ اِبْرٰهِيْمَ حَنِيْفًا وَمَا كَانَ مِنَ الْمُشْرِكِيْنَ، قُلْ اِنَّ صَلَاتِيْ وَنُسُكِيْ وَمَحْيَايَ وَمَمَاتِي لِلهِ رَبِّ الْعٰلَمِيْنَ، لَا شَرِيْكَ لَهٗ وَبِذٰلِكَ اُمِرْتُ وَاَنَا اَوَّلُ الْمُسْلِمِيْنَ.

(হে নবী!) আপনি বলুন, আমার প্রতিপালক আমাকে সরলপথ প্রদর্শন করেছেন, যা বিশুদ্ধ দ্বীন, ইবরাহীমের মিল্লাত, যিনি ছিলেন একনিষ্ঠ এবং তিনি মুশরিকদের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন না। আপনি বলুন, নিশ্চয়ই আমার নামায, আমার কুরবানী, আমার জীবন ও আমার মৃত্যু জগৎসমূহের প্রতিপালক আল্লাহর জন্য। তাঁর কোনো শরীক নেই। এরই আদেশ করা হয়েছে আমাকে এবং আমিই (এই উম্মতের) প্রথম আনুগত্যকারী। সূরা আনআম (০৬) : ১৬১-১৬৩

এ আয়াতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে সম্বোধন করে সকল মুমিন মুসলিমকে এই হেদায়েত দেওয়া হয়েছে যে, মুমিনের জীবনের সবকিছুই হবে একমাত্র আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টি ও নৈকট্য অর্জনের লক্ষ্যে। কুরবানীসহ সকল ইবাদত কেবল আল্লাহর জন্যই করবে। আর আল্লাহ তাআলা যখন যে হুকুম করবেন, তৎক্ষণাৎ তা পালন করতে প্রস্তুত থাকবে। প্রাণোৎসর্গ করতেও দ্বিধা করবে না।

উক্ত আয়াতে যে কথা বলা হয়েছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামও কুরবানীর পশু যবেহ করার সময় সে বাক্য উচ্চারণ করেছেন। হাদীসে বর্ণিত আছে, নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঈদের দিন দুম্বা যবেহ করার সময় বলেছেন

إِنِّي وَجَّهْتُ وَجْهِيَ لِلَّذِيْ فَطَرَ السَّموَاتِ وَالأَرْضَ، عَلى مِلَّةِ إِبْرَاهِيْمَ حَنِيْفًا، وَمَا أَنَا مِنَ الْمُشْرِكِيْنَ، إِنَّ صَلَاتِيْ وَنُسُكِيْ وَمَحْيَايَ وَمَمَاتِيْ   لِلهِ رَبِّ الْعَالَمِينَ. لَا شَرِيْكَ لَه، وَبِذلِكَ أُمِرْتُ وَأَنَا مِنَ الْمُسْلِمِيْنَ.

আমি আমার মুখ তাঁর অভিমুখী করলাম, যিনি আসমান ও জমিন সৃষ্টি করেছেন, ইবরাহীমের মিল্লাতের ওপর, যিনি একনিষ্ঠ ছিলেন এবং আমি মুশরিকদের অন্তর্ভুক্ত নই। নিশ্চয়ই আমার নামায, আমার কুরবানী, আমার জীবন ও আমার মৃত্যু জগৎসমূহের প্রতিপালক আল্লাহর জন্য। তাঁর কোনো শরীক নেই। আমাকে এরই আদেশ করা হয়েছে এবং আমি আনুগত্যকারীদের অন্তর্ভুক্ত। সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ২৭৯৫; মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ১৫০২২; সহীহ ইবনে খুযাইমা, হাদীস ২৮৯৯

আল্লাহ তাআলা বান্দার কাছে এমন ঈমান ও আল্লাহর প্রতি নিবেদনই চান। পশু যবেহ হল, আল্লাহর হুকুম মতো কুরবানী আদায়ের বাহ্যিক রূপ। কুরবানী এভাবেই করতে হবে। কিন্তু কুরবানীর পশুর গোশত তো বান্দাই ভোগ করে এবং এটা আল্লাহর পক্ষ থেকে বান্দার জন্য মেহমানদারী। কুরবানীর পশুর কোনো অংশই আল্লাহর কাছে পৌঁছে না। তাহলে আল্লাহর কাছে কী পৌঁছে? আল্লাহর কাছে পৌঁছে বান্দার তাকওয়া, ইখলাস, অন্তরের নিয়ত। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেছেন

لَنْ يَّنَالَ اللهَ لُحُوْمُهَا وَلَا دِمَآؤُهَا وَلٰكِنْ يَّنَالُهُ التَّقْوٰي مِنْكُمْ.

আল্লাহর কাছে সেগুলোর গোশত পৌঁছে না এবং সেগুলোর রক্তও না; বরং তাঁর কাছে পৌঁছে তোমাদের তাকওয়া। সূরা হজ্ব (২২) : ৩৭

অর্থাৎ কুরবানীতে পশু যবেহের ভেতর দিয়েই আল্লাহ দেখেন, তাঁর প্রতি বান্দা কেমন ঈমান রাখে। আল্লাহর হুকুম পালন ও তাঁর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করার মনোভাব তার আছে কি না। তার মধ্যে কতটুকু তাকওয়া আছে? কুরবানীসহ সকল ইবাদত কেবল আল্লাহর জন্য করার মতো নিয়ত ও ইখলাস আছে কি না। আর সেইসাথে স্মর্তব্য, আল্লাহর হুকুম পালন করতে হবে আল্লাহর নির্দেশিত পন্থায়। যে আমলের যেই পদ্ধতি তিনি ও তাঁর রাসূল বলেছেন, সেই পদ্ধতিতেই  পালন করেত হবে। অতএব তাকওয়া ও ইখলাসের সাথে কেউ যদি যথাযথভাবে কুরবানী করে, তাহলে এর বিনিময়ে তিনি মহাপ্রতিদান দেবেন। তা না হলে এ কুরবানীর বিনিময়ে আখেরাতে কোনো প্রতিদান পাওয়া যাবে না। নবীজীর হাদীস থেকেও স্পষ্ট যে, আল্লাহ দেখেন, নিয়ত ও ইখলাস এবং বান্দা আমলের প্রতি কতটা যত্নবান। ইরশাদ হয়েছে

إِنَّ اللهَ لَا يَنْظُرُ إِلَى صُوَرِكُمْ وَأَمْوَالِكُمْ، وَلَكِنْ يَنْظُرُ إِلَى قُلُوبِكُمْ وَأَعْمَالِكُمْ.

আল্লাহ তোমাদের রূপ ও আকৃতি এবং সম্পদের দিকে তাকান না, বরং তিনি দেখেন তোমাদের অন্তর ও আমল। সহীহ মুসলিম, হাদীস ২৫৬৪; মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ৭৮২৭

সুতরাং কুরবানী আদায়ের মাধ্যমে আমরা এই শিক্ষা হৃদয়ে জাগরূক রাখব আমাদের জীবনের সবকিছু আল্লাহর জন্যই। তাঁর সন্তুষ্টি ও নৈকট্য অর্জনের জন্যই আমরা কুরবানীসহ সকল ইবাদত করব। আর আল্লাহর বিধানাবলি পালনে সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করতে প্রস্তুত থাকব। থাকব সমর্পিত চিত্ত ও সদা প্রস্তুত।

স্মরণ রাখি, কুরবানী যেহেতু আমি আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্যই করছি, তাই আমার উচিত, কুরবানীর পশু কেনা থেকে নিয়ে তা যবেহ ও গোশত বণ্টন ইত্যাদি সর্বক্ষেত্রে বিনয় ও নম্রতা প্রদর্শন করা এবং কৃতজ্ঞতার পরিচয় দেওয়া। লালসা, শক্তিমত্তা ও অহংকার প্রকাশ করা কিছুতেই কাম্য নয়। আল্লাহ তাওফীক দিয়েছেন বলেই আমি তাঁর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য এ পশু কুরবানী করতে পারছি। তাই প্রতিটি ক্ষেত্রে আমরা ইসলামের শিক্ষা মেনে চলার চেষ্টা করব।

পশু কেনার সময় ত্রুটিমুক্ত সুস্থ পশু কিনব। এ সম্পর্কে একাধিক হাদীস রয়েছে। পশু ক্রয়ের পরে সেটিকে কোনো প্রকার কষ্ট দেব না। যবেহ করার সময় ধারালো ছুরি দিয়ে যবেহ করব, যেন পশুটির কষ্ট কম হয়।

যখন গোশত বণ্টন করব, তখনও বিনয়ী ও নম্র আচরণ করব এবং সুন্নাহসম্মত পদ্ধতিতে বণ্টন করব। যদি প্রতিটি ক্ষেত্রে আমরা এভাবে কুরআন-হাদীসের শিক্ষা মেনে চলি তাহলে আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে কুরবানী আদায়ের বিনিময়ে মহাপ্রতিদান দান করবেন।

 

 

advertisement