ডোনাল্ড ট্রাম্পের মধ্যপ্রাচ্য সফর : কী পেল উপসাগরীয় দেশগুলো?
আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প মধ্যপ্রাচ্য সফর করে গেলেন খুব ঢাকঢোল পিটিয়ে। আগেরবার যখন তিনি রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন তখনও প্রথম বিদেশ সফর করেন সৌদি আরব। এবারও ক্ষমতায় আসীন হওয়ার পর তিনি প্রথম সৌদি আরবে এলেন। এরপর গেলেন কাতার ও আরব আমিরাতে। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের এবারের সফর নিয়ে একটু বেশিই মাতামাতি হচ্ছে। একদিক থেকে সৌদি আরব, কাতার ও আরব আমিরাতের শাসকদের উচ্ছ্বাস ও মাতামাতি, অন্যদিক থেকে বিশ্বের সাধারণ মুসলমানদের এ সফর নিয়ে হরেক প্রকার মূল্যায়ন। ট্রাম্পের সফরকে ঘিরে সংশ্লিষ্ট দেশগুলো মনে হয়েছে একেবারে দিশেহারা হয়ে পড়েছিল। কীভাবে তাকে অভ্যর্থনা জানাবে, কীভাবে তার আপ্যায়ন হবে, তার জন্য কোন্ কোন্ ধরনের বিনোদন আয়োজন করতে হবে, কী কী বন্ধ রাখতে হবে– এসব নিয়ে আরব দেশগুলোর শাসকবর্গের চিন্তার অন্ত ছিল না।
পবিত্র মক্কা-মদীনার সেবক খেতাবধারী দেশ সৌদি আরব তো আমেরিকান প্রেসিডেন্টের জন্য অভ্যর্থনার বিশ্বব্যাপী চলতি ধারাই পরিবর্তন করে ফেলেছে। তারা লাল-গালিচা সংবর্ধনার বদলে ট্রাম্পকে জাম রংয়ের কার্পেট বিছিয়ে সম্ভাষণ করেছে। কারণ, ডোনাল্ড ট্রাম্প যে টাই পরে সৌদি আরবে নেমেছেন সে টাইয়ের রং ছিল জাম রং। ট্রাম্পের গায়েও নীল রংয়ের স্যুট ছিল। সেগুলোর সাথে মানানসই করতেই নাকি লাল-গালিচার বদলে ভিন্ন রংয়ের গালিচা বিছানো হয়েছিল। সৌদি যুবরাজ, যিনি মূলত বাদশাহ্র দায়িত্ব পালন করে থাকেন। ডোনাল্ড ট্রাম্পকে নিয়ে কথাবার্তায় এতটাই উচ্ছ্বসিত ছিলেন যে, তার হাত তালি ও অন্যরকম খুশি-ফুর্তি দেখে কারও মনে হতে পারে, তিনি হয়তো কোনো খেলার মাঠে আছেন এবং নিজ দলের বিজয়ে উল্লাস প্রকাশ করছেন।
কাতার ও আরব আমিরাতের অভ্যর্থনার আয়োজনগুলো ট্রাম্পকে বেশ খুশি করেছে। আরব আমিরাত তো শুধু মেয়েদের চুল দোলানো-নাচ দিয়েই তাকে বরণ করেনি, বরং তার জন্য আবুধাবির গ্রান্ড মসজিদে কয়েক ওয়াক্তের নামাযও বন্ধ রেখেছে; যা শুনে ট্রাম্প খুব সম্মানিত বোধ করেছেন।
আজকে অবশ্য এসব কিছু বলা উদ্দেশ্য নয়। ইসলামের কেন্দ্রভূমি এবং হাজার বছর থেকে ইসলামী শাসনের কেন্দ্রবিন্দুতে থাকা এ রাষ্ট্রগুলোর আমেরিকা-প্রেম নতুন কিছু নয়। বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে নির্যাতিত, নিপীড়িত মুসলিম সমাজ এবং মুসলিম দেশগুলোর স্বার্থের চেয়ে বরাবরই এদেশগুলোর কাছে ইহুদী-নাসারাদের স্বার্থ প্রাধান্য পেয়ে থাকে। এদেশগুলোসহ মধ্যপ্রাচ্যের বেশ কয়েকটি দেশেই স্থায়ীভাবে মার্কিন সেনা ঘাঁটি রয়েছে। এদেশগুলোর শাসকরা মনে করে থাকে, তাদের ক্ষমতায় স্থায়ী থাকার জন্য আমেরিকা পাহারাদারের কাজ করবে। আমেরিকা এদেশগুলোতে নিজেদের সামরিক ঘাঁটি রেখে শুধু কি রাজা-বাদশাহদের পাহারার দায়িত্ব আদায় করে, নাকি এই পুরো অঞ্চলে তাদের আগ্রাসন ও আধিপত্য পাকাপোক্ত রাখার জন্য একে বড় হাতিয়ার হিসেবে কাজে লাগায়– এ কথা জ্ঞানী লোকদের বুঝতে অসুবিধা হয় না।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প শুধু আপ্যায়ন ও আদর যত্নে খুশি থাকার পাত্র নন। তিনি একজন বিলিয়নিয়র ব্যবসায়ী। তিনি পরিকল্পনা করেই মধ্যপ্রাচ্যের তেলসমৃদ্ধ এই ধনাঢ্য দেশগুলোর সফরকে অগ্রাধিকার দিয়েছেন। পৃথিবীতে অর্থ, শিল্প, শিক্ষা ও সামরিকভাবে কত শক্তশালী ও সমৃদ্ধ দেশই তো রয়েছে, সেগুলোতে তো তিনি যাননি। গেছেন কাতার ও আরব আমিরাতের মতো ছোট দুটি দেশে; যেগুলো আয়তন, জনসংখ্যা ও অন্যান্য দিক থেকে বেশ ছোট। কেন তিনি এমনটি করেছেন, সেটি এ সফরের ফলাফল থেকেই বিশ্ববাসীর কাছে স্পষ্ট হয়েছে।
ডোনাল্ড ট্রাম্পকে ওই তিনটি দেশ তার প্রত্যাশা থেকেও অনেক বেশি দিয়েছে। ট্রাম্প ঝুলি ভরে মধ্যপ্রাচ্য ত্যাগ করেছেন। একেকটি দেশ ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়ন ডলারের চুক্তি করেছে আমেরিকার সাথে। প্রায় সকল ক্ষেত্রেই বিক্রেতা আমেরিকা; ক্রেতা সৌদি আরব, কাতার বা আরব আমিরাত।
কয়েক দশক আগে পরিস্থিতি যাই থাকুক, মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো এখন অর্থবিত্তে অসাধারণ সমৃদ্ধ। পুরোটাই আল্লাহর দেওয়া খনিজ সম্পদ দিয়ে। বিনা কষ্টে পাওয়া এই অর্থ বর্তমান শাসকদের পূর্বসূরিরা কিছুটা ভেবেচিন্তে খরচ করলেও মুহাম্মাদ বিন সালমান, মুহাম্মাদ বিন যায়েদ, তামীম বিন হাম্মাদ আলসানীর মতো হাল আমলের যুবক শাসকেরা আমোদ-ফুর্তি এবং ভিনদেশি ভিন জাতিকে খুশি করার পথে খরচ করাকেই বেশি বেছে নিচ্ছে। স্বজাতি, স্বভাষী ফিলিস্তিন ও গাজাবাসী থেকে তাদের কাছে ভিন জাতির, ভিন ধর্মের লোকদের গুরুত্বই বেশি বলে তারা নিজ নিজ কর্ম দ্বারা বারবার জানান দিচ্ছেন। তারা হয়তো ভাবছেন, এভাবেই তারা অনন্তকাল দেশগুলো শাসন করে যাবেন, বিশ্ব মুসলমানদের সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ ও প্রাণপ্রিয় জায়গা হারামাইনের কর্তৃত্ব আঁকড়ে রাখবেন, কোনো দিক থেকে কোনো আওয়াজ এলেই আমেরিকা তাদেরকে রক্ষা করবে। এভাবে কি শেষ রক্ষা হবে?
মুসলিম বিশ্ব বিশেষত আরব বিশ্বের নেতাদের খুব কাছের ইতিহাসগুলোও যদি দেখা যায়, তাতেও তারা চিন্তার খোরাক পাবেন। ইরাক, লিবিয়া, মিশর, সিরিয়া– এসব দেশে কী ঘটেছে। সাদ্দাম-গাদ্দাফির মতো লোকেরা কি এদের চেয়ে কম প্রভাবশালী ছিল? এসব কিছু চিন্তা করেই হয়তোবা ট্রাম্পের এবারের মধ্যপ্রাচ্য সফরের রোয়েদাদ বিশ্বের চিন্তাশীল মুসলমানদের ভাবাচ্ছে!