তলাবায়ে কেরাম!
ফযীলত ও বরকতপূর্ণ সময়গুলোর কদর করি
এগুলো কিন্তু খারেজী সময়ও নয়, ছুটিও নয়
সময়ের মূল্যায়ন সম্পর্কে ইতিপূর্বে এ বিভাগে আলহামদু লিল্লাহ অনেক কিছু লেখা হয়েছে। হযরত আদীব হুযুর দামাত বারাকাতুহুমের একটি বয়ানের খোলাসা ছাপা হয়েছিল, যেটি পরবর্তীতে `তালিবানে ইলম : পথ ও পাথেয়` কিতাবেও সন্নিবেশিত হয়। তাতে একটি শিরোনাম ছিল, `সময়ের ভগ্নাংশগুলির হেফাযত করি`। এতে হযরত খুচরো সময়সমূহের গুরুত্ব এবং সেগুলোকে কাজে লাগানোর পদ্ধতি সম্পর্কে অত্যন্ত জরুরি নির্দেশনা দিয়েছেন। শিক্ষাবর্ষের শুরুতে তলাবায়ে কেরাম যদি সেই লেখাগুলো পুনরায় পড়ে নেন, আশা করি ফায়দা হবে ইনশাআল্লাহ। আর কোনো তালিবে ইলম ভাই যদি উস্তাযে মুহতারাম শায়েখ আবদুল ফাত্তাহ আবু গুদ্দাহ রাহ.-এর অনবদ্য কিতাব قيمة الزمن عند العلماء মুতালাআ করেন এবং সেখানে থেকে حفظ الوقت ও كسب الوقت -এর পন্থাগুলো আলাদাভাবে নোট করে নিজের জীবনে বাস্তবায়ন করেন, তাহলে তো বড় সৌভাগ্যের কথা।
আজকে তলাবায়ে কেরামের খেদমতে যে বিষয়টি আরয করতে চাচ্ছি তা হল, আমরা যেন ফযীলত ও বরকতপূর্ণ সময়গুলোর কদর করি।
যে কোনো মুমিনের দ্বীনী ও দুনিয়াবী তারাক্কীর জন্য এই সময়গুলোর গুরুত্ব অপরিসীম। বলার অপেক্ষা রাখে না, একজন তালিবে ইলমের যিন্দেগীতে এই সময়গুলোর গুরুত্ব আরও বেশি। এই সময়গুলোতে আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের খাস তাওয়াজ্জুহ ও রহমত থাকে। দুআ কবুলের মুহূর্ত থাকে। তাই এই সময়গুলোর কদরদানি, দুআ ও মেহনত তালিবে ইলমকে অনেক দূর অগ্রসর করে দেয়।
এ ধরনের কিছু সময় হল–
১. ফজরের আগের ও পরের সময়।
২. আযান ও ইকামতের মধ্যবর্তী সময়।
৩. আসর থেকে মাগরিব।
৪. জুমার দিন, বিশেষত জুমার দিনের আসর থেকে মাগরিব।
৫. রমযানুল মুবারক।
৬. যিলহজে¦র প্রথম ১০ দিন।
৭. ঈদুল ফিতর ইত্যাদি।
হাদীস শরীফে এই সময়গুলোর খাস ফযীলত বর্ণিত হয়েছে। কিন্তু সাধারণত এই সময়গুলোতে প্রাতিষ্ঠানিক বিরতি বা ছাড় থাকে বিধায় অনেকেই এগুলোর ব্যাপারে চরম অবহেলা করে। এটা নিঃসন্দেহে অনেক বড় ক্ষতি। অনেক বড় লোকসান।
তলাবায়ে কেরামের প্রতি আরয, আমরা যেন এই সময়গুলোর কদর করি; অবহেলা ও উদাসীনতায় নষ্ট না করি।
ফজরের আগে দুআ কবুলের সময়। তাই যদি সুবহে সাদিকের আগে উঠে লম্বা সময় তাহাজ্জুদ, যিকির-আযকার ও দ্আু-মুনাজাত করা সম্ভব না হয়, তাহলে অন্তত ১৫ মিনিট আগে উঠি। সংক্ষেপে দু-চার রাকাত তাহাজ্জুদ পড়ি। কিছু সময় দুআ করি এবং আল্লাহর দিকে মুতাওয়াজ্জিহ হই। এটা কত আফসোসের কথা যে, আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের পক্ষ থেকে দান ও সাহায্যের ঘোষণা হচ্ছে, অথচ আমি তলবহীনভাবে ঘুমিয়ে আছি।
সুবহে সাদিকের পর থেকে ফজরের নামায পর্যন্ত– এই সময়টি তিলাওয়াত, যিকির ও দুআর জন্যও গুরুত্বপূর্ণ এবং মুতালাআর জন্যও গুরুত্বপূর্ণ। তেমনিভাবে ফজরের পরে লম্বা সময় যদি না পারি, কিছু সময় নামাযের জায়গায় বসে যিকির-আযকার করি। সকাল-সন্ধ্যার দুআগুলো পড়ি। ইশরাকের নামাযের অভ্যাস গড়ে তুলি।
আযান ও ইকামতের মধ্যবর্তী সময়ের বিষয়ে হাদীস শরীফে ইরশাদ হয়েছে–
الدُّعَاءُ لاَ يُرَدُّ بَيْنَ الأَذَانِ وَالإِقَامَةِ.
আযান ও ইকামতের মাঝে দুআ ফেরত দেওয়া হয় না। –জামে তিরমিযী, হাদীস ২১২; সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ৫২১
সেজন্য আগে আগে মসজিদে যাওয়ার অভ্যাস করি। সুন্নতে রাতিবা আদায় করি, নতুবা তাহিয়্যাতুল মসজিদ পড়ি। কিছু সময় যিকির ও দুআয় মগ্ন থাকি। ইনশাআল্লাহ এর দ্বারা যিন্দেগীতে এবং ইলম ও আমলে অনেক তারাক্কী পরিলক্ষিত হবে।
আসর থেকে মাগরিব– এ সময়টুকুর ব্যাপারে আমরা অনেকে যেন ধরেই নিয়েছি যে, এ সময়টুকু হেলায়-ফেলায় কাটিয়ে দেওয়াই হল নিয়ম! ধরুন, আসর থেকে মাগরিব প্রতিদিন ১ ঘণ্টা করে হলে মাসে ৩০ ঘণ্টা যিন্দেগী থেকে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে! অথচ যারা নষ্ট করছে, তাদের এ ব্যাপারে কোনো ফিকিরই নেই; কোনো আফসোস নেই। আমরা নিজেরাই যদি নিজেদের সময় ও জীবনের মূল্য না দিই, তাহলে অন্যদের কাছে আমরা কীভাবে মূল্য আশা করতে পারি?
যাহোক আসর থেকে মাগরিব– এ সময়টুকুর বিষয়ে সচেতন হই। কিছু সময় দিরাসাতের কাজে ব্যয় করি। আর শরীর চর্চার জন্য যে সময়টুকু ব্যয় করব, চেষ্টা করব তখনো যেন আমার দিল হাজির থাকে। শরীর চর্চার মাঝেও ইস্তেগফার, দরূদ শরীফ ইত্যাদি যিকির করতে পারি। আর শরীর চর্চা তো নিশ্চয়ই সহীহ নিয়তেই করে থাকব। অর্থাৎ যেন এর দ্বারা জিসিমের হক আদায় হয় এবং ইলম-আমলে নাশাত অর্জন হয়।
তেমনিভাবে আমরা অনেকে জুমার দিনের সময়কেও অত্যন্ত বেদরদির সঙ্গে নষ্ট করি। এটা দুর্ভাগ্যজনক। আল্লাহ তাআলা সকল তালিবে ইলম ভাইকে এ থেকে হেফাযত করুন। জুমার দিনের কত ফযীলত হাদীসে বর্ণিত হয়েছে। দরূদ শরীফ, সূরা কাহ্ফ, জুমার নামাযের জন্য আগে আগে প্রস্তুতি নেওয়া এবং আগে আগে বের হওয়া– এগুলো কত ফযীলত ও বরকতপূর্ণ আমল! জুমার দিন আসর থেকে মাগরিব গুরুত্বপূর্ণ সময়। এসবের ব্যাপারে আমরা যত্নবান হই। জুমার দিন কিছু সময় আম সাফায়ী ও নিজের জরুরি কাজ সম্পাদন, কিছু সময় বিশ্রাম, কিছু সময় আগের মুতালাআর ইয়াদ এবং কিছু সময় সামনের মুতালাআর জন্য ব্যয় করা উচিত।
এমনিভাবে রমযান মাস, যিলহজ্বের প্রথম দশ দিন, ঈদুল ফিতর– এগুলোও কত ফযীলতপূর্ণ সময়। বিশেষ করে একজন তালিবে ইলমের ইলমী ও আমলী তারাক্কির জন্য এই সময়গুলো কত গুরুত্বপূর্ণ এবং কত মূল্যবান।
এ বিষয়টা আমাদের ভালোভাবে বুঝতে হবে যে, এক হল প্রাতিষ্ঠানিক নেযাম, আরেক হল আমাদের যিন্দেগীর নেযাম। প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনাগত কারণে ফযীলত ও বরকতপূর্ণ এই সময়গুলোর ক্ষেত্রে হয়তো কোনো ধরাবাঁধা নেযাম থাকে না, কিন্তু এর মানে এই নয় যে, এই সময়গুলোর কোনো নেযামই নেই! বরং এগুলোর নেযাম তো খোদ শরীয়তই নির্ধারণ করে দিয়েছে। শরীয়তই বলে দিয়েছে, এই সময়গুলো কীভাবে অতিবাহিত করতে হবে এবং কীভাবে কাজে লাগাতে হবে। যেমন, দৈনন্দিন কুরআন তিলাওয়াত, জামাতে নামায আদায়, তাকবীরে উলার ইহতিমাম। এগুলো কোনো প্রতিষ্ঠানিক নেযামের মুখাপেক্ষী নয়। এগুলো তো আমাদের সারা যিন্দেগীর বিষয়।
সাপ্তাহিক ও বার্ষিক বরকতপূর্ণ সময়গুলোকে প্রাতিষ্ঠানিক বিরতির মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করার এই হেকমতও আছে যে, আমরা যাতে এই সময়গুলো তিলাওয়াত, যিকির, দুআ ও ইবাদত-বন্দেগীতে কাটাতে পারি এবং ওইসব নেক আমলের মধ্যে এই সময়গুলো ব্যয় করতে পারি, যেগুলো প্রাতিষ্ঠানিক নেযাম চালু থাকা অবস্থায় যথাযথভাবে আঞ্জাম দেওয়া সম্ভব হয় না।
এ প্রসঙ্গে আদীব হুযুরের পুস্তিকা `আদর্শ তালিবে ইলমের আদর্শ ছুটি` এবং এ বিভাগে প্রকাশিত প্রবন্ধ `তালিবানে ইলমে নবুওত বিরতির দিনগুলো কীভাবে কাটাবেন` পড়ে নেওয়ার অনুরোধ করছি। আদীব হুযুরের পুস্তিকাটি মাসিক আলকাউসারেও এ বিভাগে ফেব্রুয়ারি ২০১১ সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছে। আর প্রবন্ধটি `তালিবানে ইলম : পথ ও পাথেয়` কিতাবে সন্নিবেশিত আছে।
সারকথা, এই সময়গুলোকে `খারেজী সময়` বা `ছুটি` মনে করে হেলায় ফেলায় নষ্ট না করি; বরং সাধ্যের মধ্যে সর্বোচ্চ কাজে লাগানোর চেষ্টা করি।
আল্লাহ তাআলা আমাদের তাওফীক দান করুন– আমীন।
[অনুলিখন : মাহমুদ বিন ইমরান
২০-১০-১৪৪৬ হি.
১৯-০৪-২০২৪ ঈ.]