রবিউল আউয়াল ১৪৪৬   ||   সেপ্টেম্বর ২০২৪

গাজার হালহাকীকত নিয়ে দুটি লেখা

ওয়াসআতুল্লাহ খান

[ওয়াসআতুল্লাহ খান। সিনিয়র সাংবাদিক এবং বিবিসি উর্দূ ও এক্সপ্রেস নিউজ নেটওয়ার্ক-এর নিয়মিত কলাম লেখক।

তূফানুল আকসা শুরুর পর তিনি ফিলিস্তিন-হামাস নিয়ে নিয়মিত লিখে চলেছেন। যার প্রতিটি লেখাই বস্তুনিষ্ঠ ও তথ্যবহুল।

প্রাসঙ্গিক বিবেচনায় এক্সপ্রেস নিউজ থেকে তার দুটি লেখা মাসিক আলকাউসার-এর পাঠকদের খেদমতে পেশ করা হল।

বাংলায় অনুবাদ করেছেন -মাওলানা মুহাম্মাদ আবদুল্লাহ ফাহাদ]

 

এক লক্ষ ছিয়াশি হাজার ফিলিস্তিনীর হতাহতের আশঙ্কা

দ্যা লান্সেট (The Lancet) আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানের সবচেয়ে প্রাচীন ব্রিটিশ সাপ্তাহিক। আজ থেকে ২০১ বছর আগে ১৮২৩ সালে থমাস ওয়াকলে (Thomas Wakley) সাময়িকীটি শুরু করেছিলেন। আজ অবধি ধারাবাহিকভাবে তা প্রকাশিত হয়ে আসছে। বস্তুনিষ্ঠতা, পেশাদারত্ব ও শিক্ষা অনুরাগের বিবেচনায় দ্যা লান্সেট বিশে^র সেরা পত্রিকাগুলোর একটি। সাময়িকীটির অতি সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে যে, গত ৯ মাসে গাজায় হতাহতের যে ঘটনা ঘটেছে তার সম্ভাব্য সংখ্যা এখন পর্যন্ত ফিলিস্তিনের স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে প্রকাশিত ও নির্ভরযোগ্য পরিসংখ্যান (৩৮,০০০) থেকেও কয়েক গুণ বেশি।

ফিলিস্তিনী স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নথিপত্র অনুযায়ী হতাহতের পরিসংখ্যানে ঐসব লোক অন্তর্ভুক্ত নেই, যারা ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়ে মারা গিয়েছেন অথবা যারা বর্তমান পরিস্থিতি থেকে সৃষ্ট রোগ-ব্যধি, মহামারি কিংবা চিকিৎসা না পেয়ে অথবা প্রচণ্ড ক্ষুধা ও তৃষ্ণার দরুন প্রাণে বাঁচতে পারেননি কিংবা একেবারেই নিখোঁজ রয়েছেন।

কেননা ৭ অক্টোবরের পর থেকে ইসরাইল গাজা উপত্যকায় এত কঠোর ও শক্ত অবরোধ আরোপ করে রেখেছে যে, একটি শস্যদানা এবং ক্ষতস্থানে বাঁধার জন্য এক টুকরো ব্যান্ডেজও অনুমতি ছাড়া ভেতরে প্রবেশ করতে পারেনি। আজ যুদ্ধ বন্ধ হয়ে গেলেও এর প্রতিক্রিয়ায় আগামী কয়েক বছর মানুষের মৃত্যু হতে থাকবে। যারা বেঁচে আছেন তাদেরও ভুগতে হবে দীর্ঘ সময় দুরারোগ্য বিভিন্ন ব্যাধিতে।

দ্যা লান্সেট-এর অভিজ্ঞতা হল, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এশিয়া, আফ্রিকা ও ল্যাটিন আমেরিকায় মানবিক বিপর্যয়গুলোতে একটি প্রত্যক্ষ মৃত্যুর জেরে নানাবিধ পরোক্ষ কারণে আরো অন্তত পনেরোটি মৃত্যু সংঘটিত হয়ে থাকে। আর নির্ভরযোগ্য ও বাস্তব হিসাব অনুযায়ী এখন পর্যন্ত নিহতের সংখ্যাকে ১৫-এর পরিবর্তে পরোক্ষ বিভিন্ন কারণে গড়ে চারটি মৃত্যু হিসেবে গুণ করা হলেও আগস্টের শুরু পর্যন্ত গাজায় মূলত এক লক্ষ ছিয়াশি হাজার মানুষের মৃত্যু ঘটেছে।

৭ অক্টোবরের আগে গাজার জনসংখ্যা ছিল তেইশ লক্ষ। দ্যা লান্সেট-এর অনুমান সঠিক হলে এর অর্থ দাঁড়ায়, গত ১০ মাসে গাজার ৮ শতাংশ মানুষ শহীদ হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। প্রতিবেদনে আরো বলা হয়েছে যে, ফিলিস্তিনের স্বাস্থ্য অধিদপ্তর নিহতের সংখ্যা বাড়িয়ে প্রকাশ করেছে- ইসরাইলের এমন অভিযোগ সত্য নয়। বরং তাদের এই পরিসংখ্যান এতটাই গ্রহণযোগ্য যে, খোদ ইসরাইলের গোয়েন্দা সংস্থা, জাতিসংঘ ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাও নিজেদের প্রতিবেদনগুলোতে একাধিকবার এর উদ্ধৃতি দিয়েছে।

৭ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত গাজায় নিহতের নির্ভরযোগ্য সংখ্যা ছিল প্রায় ২৮০০০। তখন দ্যা লান্সেট-এর আশঙ্কা ছিল, যদি ৬ আগস্ট পর্যন্ত যুদ্ধবিরতি না হয় আর কোনো দুর্যোগ কিংবা মহামারিও না ছড়ায়, তবুও শুধু বোমা বর্ষণ, গোলাগুলি এবং বিভিন্ন স্থাপনা ও ভবন ধ্বসের কারণে হতাহতের সংখ্যা ৫৮ হাজারে পৌঁছে যাবে। আর যদি কোনো মহামারি ছড়িয়ে পড়ে, তাহলে এ সংখ্যা ৮৬ হাজার হয়ে যেতে পারে। তবে জান-মালের ভয়াবহ ক্ষয়ক্ষতি দেখে দ্যা লান্সেট-এর সাম্প্রতিক আশঙ্কা, বর্তমান দুর্যোগপূর্ণ অবস্থায় আগস্টের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত যেকোনো কারণে ১ লক্ষ ৮৬ হাজার ফিলিস্তিনীর মৃত্যু হলেও এতে উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই।

বর্তমানে ফিলিস্তিনের স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের জন্য নিহতের সংখ্যা নিরূপণ, সংরক্ষণ এবং এতে নিজেদের গ্রহণযোগ্যতা ধরে রাখাই কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। গাজার বড় বড় হাসপাতালের কার্যক্রম যতদিন চালু ছিল তখন প্রতিদিন সেখানে আগত লাশ ও আহতের সংখ্যা নিরূপণ করা তুলনামূলক সহজ ছিল। এছাড়াও নিহতের বিষয়ে দায়িত্বশীল ও পেশাদার মিডিয়ার সংগৃহীত নির্ভরযোগ্য তথ্যও পরিসংখ্যানে অন্তর্ভুক্ত করা হত।

কিন্তু নৃশংসভাবে মানব হত্যার অভিযোগ থেকে বাঁচার জন্য ইসরাইল গাজার হাসপাতালগুলোকে লক্ষ্যবস্তু বানিয়ে একে একে ধ্বংস করে দিয়েছেআর একশর বেশি সাংবাদিক ও মিডিয়া ব্যক্তিত্বকে বেছে বেছে শুধু হত্যাই করেনি; তাদের অনেককে সপরিবারে শেষ করে দিয়েছে। অনেক ব্লগার ও সাংবাদিক একপর্যায়ে গাজা ত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছেন। ডাক্তার ও স্বাস্থ্যকর্মীদেরকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করেছে। আর বেঁচে যাওয়া অনেক স্বাস্থ্যকর্মীকে দক্ষিণ ইসরাইলের টর্চার সেলগুলোতে নিয়ে অমানবিক জুলুম-নির্যাতন করা হচ্ছে।

এহেন বিরূপ পরিস্থিতিতে ফিলিস্তিনের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় কর্তৃপক্ষ ও সংশ্লিষ্টদের পক্ষে নিহতের হিসাব রাখা প্রায় অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে। তবে তারা সাহস হারাননি। যেসব নিহত ও আহতকে তার কোনো আত্মীয় কিংবা পরিচিতজন শনাক্ত করতে পেরেছে, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এখন থেকে তাদের তথ্য পৃথকভাবে সংরক্ষণ করার চেষ্টা করছে। আর যাদেরকে শনাক্ত করা সম্ভব হয়নি তাদের তথ্য পৃথকভাবে নথিভুক্ত করে রাখছে। যেন যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর সরাসরি কিংবা ডিএনএ টেস্টের মাধ্যমে তাদের বেশিরভাগের শনাক্ত করা সহজ হয়। এতদিনে যারা শাহাদত বরণ করেছেন তাদের প্রায় ৩০ শতাংশের এখনো শনাক্ত করা সম্ভব হয়নি।

একদিকে যখন বর্বর হত্যাযজ্ঞ অব্যাহতভাবে চলছে আর অসংখ্য মানুষ এখনো ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়ে আছে তখন হতাহতের যথাযথ পরিসংখ্যান বের করা খুবই কঠিন। তবে এটি ঠিক যে, হতাহতের যে সংখ্যাটি এতদিন স্বীকৃতি পেয়েছে (৩৮ হাজার) কমপক্ষে তার সমান সংখ্যক ফিলিস্তিনী এখনো নিখোঁজ আছেন। 

দ্রুত কিংবা বিলম্বে হলেও ধ্বংসযজ্ঞের ব্যাপকতা ও ভয়াবহতা নির্ণয়ের জন্য সকল নিহতের তথ্য সংরক্ষণ করা জরুরি।  আন্তর্জাতিক আইন অনুসারেও এই তথ্য সংরক্ষিত রাখা আবশ্যক। যেন এর ভিত্তিতে মানবতাবিরোধী অপরাধ অথবা প্রতিটি মৃত্যুর বিরুদ্ধে অতি শীঘ্র মোকাদ্দমা প্রস্তুত করা ও ন্যায় বিচার পাওয়া সহজ হয়। তাছাড়া এই পরিসংখ্যানের ওপর ভিত্তি করে ভবিষ্যত পরিকল্পনা গ্রহণ করাও সহজ হবে।

জানুয়ারিতে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত নিজেদের এক সিদ্ধান্ত অনুসারে ইসরাইলের ওপর আইনী বাধ্যবাধকতা আরোপ করেছে যে, জাতি নিধনের আন্তর্জাতিক জেনেভা কনভেনশন ১৯৪৯-এর চুক্তি অনুযায়ী জান-মালের ক্ষয়ক্ষতির তথ্য সংরক্ষণে ইসরাইল শুধু সহযোগিতাই করবে না; বরং এর সাক্ষ্য-প্রমাণ নষ্ট করা কিংবা কোনো উপায়ে তা পরিবর্তন করা থেকেও বিরত থাকবে। যদিও আন্তর্জাতিক আদালত ভালো করেই জানে, ইসরাইলকে তার কোনো আইনী দায়িত্বের কথা বলা মূলত বিড়ালকে দুধ দেখভালের দায়িত্ব দেওয়ার নামান্তর।

 

গাজায় না আছে ক্ষেত, আর না কৃষক

একটি জাতিকে পঙ্গু বানাতে চাইলে অবকাঠামো ধ্বংস করার বদলে তার খাদ্যব্যবস্থার রশি গলায় পেচিয়ে ধর। এরপর ধুঁকে ধুঁকে মরার জন্য তাকে ছেড়ে দাও। রাষ্ট্রব্যবস্থা অস্তিত্ব লাভের পর থেকে শক্তিশালী রাষ্ট্রগুলোর সেনারা এ কাজই করে আসছে। আজকের কথিত সভ্যতার যুগেও এ কাজটি অসম নীতির পরিবর্তে তুলনামূলক নিখুঁত ও নিষ্ঠুরতার সাথে ঘটে চলছে। যার অতি সাম্প্রতিক এক দৃষ্টান্ত হল গাজা।

৭ অক্টোবর যখন রক্তাক্ত অধ্যায়টির সূচনা হয় তখনো গাজার ক্ষেতগুলোতে ছিল সবুজের সমারোহ। যায়তুনের গাছগুলো ছিল ফলের ভারে ন্যুব্জ। অপেক্ষা শুধু ফল আহরণের। ফলের ভারে হেলে পড়া গাছগুলোর ছিল বাগানমালিকের প্রতীক্ষা। উপযুক্ত মওসুম ও ভূ-মধ্যসাগরের (Mediterranean Sea) তীরবর্তী হওয়ায় প্রকৃতি যেন গাজায় জরুরি খাদ্যশস্যের মহা নিআমত দিয়ে ভরে রেখেছে। হয়তো এর জোরেই ২০০৭ থেকে ২০২৩-এর ৭ অক্টোবর পর্যন্ত ইসরাইলের আরোপিত লাগাতার অবরুদ্ধ পরিস্থিতি সামলে নিতে পেরেছে। কিন্তু পরবর্তী ৯ মাসে সবকিছুই বদলে গেছে।

জাতিসংঘের তথ্যমতে, গাজার ২৪ লক্ষ জনসংখ্যার ৯৬ শতাংশই গত ৯ মাস ধরে খাদ্য নিরাপত্তাহীনতার সম্মুখীন। আর নগরীর প্রায় ৫ লক্ষ বাসিন্দা অনাহারে ভুগছে। স্যাটেলাইটের তোলা ছবি দেখে ধারণা হয় যে, ইসরাইলের অব্যাহত হামলার ফলে গাজার ৬০ শতাংশ কৃষিজমি চাষাবাদের অযোগ্য অথবা ধ্বংস হয়ে গিয়েছে। আর কৃষিজমির মালিক অনেক কৃষককেই সপরিবারে শহীদ করে দেওয়া হয়েছে। তাদের সম্পত্তির মালিকানা লাভ করার মতো কোনো উত্তরাধিকারীও আর দুনিয়াতে বেঁচে নেই।

৭ অক্টোবরের আগেও উত্তর গাজার বাইত লাহিয়া অঞ্চলটি আলুবুখারা ও রসালো স্ট্রবেরির জন্য প্রসিদ্ধ ছিল। এখানকার স্ট্রবেরি এত উন্নতমানের যে, এটি লাল সোনার (Red Gold) খ্যাতি লাভ করেছিল। বুলডোজার ও ভারি যন্ত্রপাতি দ্বারা ইসরাইল এসব জমিকে গভীর থেকে চাষাবাদের অযোগ্য বানিয়ে দিয়েছে। ফলে স্ট্রবেরির জুস তৈরির পেশায় জড়িত হাজার হাজার মানুষ বেকার হয়ে পড়েন। জানা নেই, তাদের কজনইবা এখন বেঁচে আছেনআর যারা বেঁচে আছেন, তারা ধ্বংসস্তূপে পরিণত হওয়া দালানকোঠার মধ্যবর্তী জমি পরিষ্কার করে কিংবা ভাঙা কাঁচের বোতল বা কন্টেইনারে যতটুকু সম্ভব ফলানোর চেষ্টা করে চলেছেন। জুলুমের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের এরচে উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত আর কী হতে পারে?

গাজা নগরীতে ছিল হতভাগা এই উপত্যকাটির এক তৃতীয়াংশ মানুষের বাস। এর প্রতিটি বাড়িতে দুয়েকটি ফলজ গাছ অবশ্যই ছিল। অলিগলির চিত্রও এমনই। গাজা নগরীর এক এলাকার নামই যায়তুন। কিন্তু ৭ অক্টোবরের পর হামলাকারীদের আগ্রাসন থেকে একটি গাছও রক্ষা পায়নি। ঐতিহ্যগতভাবে যায়তুন ফিলিস্তিনবাসীর কাছে খুবই প্রিয় এবং প্রতিরোধের প্রতীকও বটে। এ কারণে গাছটি ইসরাইলের চক্ষুশূলে পরিণত হয়েছে।

উত্তর গাজায় দেইর আলবালাহ অঞ্চলও রয়েছে। এর অর্থ খেজুরের কেন্দ্র। দেইর আলবালাহ মূলত একটি কৃষিঅঞ্চল। খেজুর ছাড়াও এখানকার মাল্টা ও যায়তুনের মানও অনেক উন্নত।

দক্ষিণের খান ইউনিস মাল্টা ও আঙ্গুর উৎপাদনের জন্য বিখ্যাত। এটি গাজা উপত্যকার সবচেয়ে বড় জেলা এবং উপত্যকাটির ৩০ শতাংশ আবাদি ভূমি এর সীমারেখায় অবস্থিত। অথচ খান ইউনিসে এখন একটি বাগান বা ক্ষেতও অক্ষত নেই।

গাজার সর্বদক্ষিণের এলাকা রাফার জনসংখ্যা ৭ অক্টোবরের আগেও ছিল পৌনে তিন লাখ। পরবর্তীতে রাতারাতি এ সংখ্যা ১৫ লাখে গিয়ে পৌঁছে। আর বর্তমানে এখানকার জনসংখ্যা এক লাখেরও কম। এই এলাকা দিয়ে মিশরের বিভিন্ন অঞ্চলে পণ্য ও মানুষ যাতায়াত করে থাকে। গাজার খাদ্যশস্যও এই অঞ্চল দিয়ে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে রপ্তানি করা হত। কিন্তু এখন সে যাতায়াতব্যবস্থাও ধ্বংস হয়ে গিয়েছে। এটি ভিন্ন প্রসঙ্গ যে, যুদ্ধ শুরুর আগেও ইসরাইল গাজায় আগমন ও বহির্গমনের প্রতিটি বিষয়ে নজরদারি করত। কিন্তু এবার মানুষের সাথে সাথে রাফার ক্ষেত-খামারও ইসরাইলের বুলডোজারে ধ্বংস হয়ে গিয়েছে।

২০২২ সালে গাজার ক্ষুদ্র একটি মহল্লার কৃষকরা সাড়ে চার কোটি ডলারের খাদ্যপণ্য রপ্তানি করেছিল। আজ তাদের সন্তানরাই দুমুঠো খাদ্যের জন্য ছুটে বেড়াচ্ছে। ইসরাইলের অবরোধের কারণে গাজার উৎপাদিত খাদ্যশস্য শুধু নির্দিষ্ট কিছু দেশেই রপ্তানি করার অনুমতি ছিল (ইসরাইল, জর্ডান ও উপসাগরীয় সাহায্য সংস্থা ইত্যাদি)। রপ্তানিশস্যের তালিকায় সবচেয়ে বেশি ছিল স্ট্রবেরি, টমেটো ও খিরা। এছাড়া অল্প পরিমাণে বেগুন, ক্যাপসিকাম, কাঁচামরিচ, তৌরি, আলু ও মিষ্টি আলু ইত্যাদিও বিদেশী ক্রেতাদের কাছে পাঠানো হত। কিন্তু অবরোধের কারণে এ অঞ্চলের ৮০ শতাংশ শস্য অধিকৃত পশ্চিম তীরে বসবাসরত ফিলিস্তিনীদের কাছেই বিক্রি করতে হত। যার অর্থ, ৭ অক্টোবরের আগেও গাজার কৃষকদের ফলানো খাদ্য-শস্য জাতীয় বাজারে না পৌঁছার কারণে তা অর্ধেক দামে বিক্রি হত। আর এখন সেখানে না আছে ক্ষেত, না আছে কৃষক; আর না আছে ফসল মাড়াইয়ের খলেন।

৭ অক্টোবরের আগে গাজার ৪ হাজার জেলে বাহীরায়ে রোম থেকে বার্ষিক প্রায় ৫ হাজার টন মাছ আহরণ করত। কিন্তু গত ৯ মাসে ইসরাইলের আকাশ ও সমুদ্রপথের হামলায় তাদের অর্ধেক নৌকা ধ্বংস হয়ে গিয়েছে। আর বাকি নৌকাগুলোও গাজার একমাত্র ধ্বংসপ্রাপ্ত সমুদ্র বন্দর এলাকায় বালুতে পড়ে আছে। একসময় যে জেলেরা গোটা শহরবাসীকে প্রোটিন সরবরাহ করত, আজ তারাই পান করার বিশুদ্ধ পানির তৃষ্ণায় কাতর হয়ে আছে। 

বিশ্ব খাদ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, বিগত ৯ মাসে গাজার খেতখামার ছাড়াও ২৭ শতাংশ গ্রিন হাউজ, ৬২৪টি কুয়া, ৩০৭টি মাড়াই-খলেন, ২৩৫টি মুরগির খামার, ২০৩টি ভেড়ার খামার এবং বিভিন্ন প্রাণীর ১১৯টি আশ্রয়কেন্দ্রও ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে।

গাজার কৃষি জমি ও সেচব্যবস্থা ৯ মাস যাবত স্থল, আকাশ ও সমুদ্র পথের অব্যাহত হামলায় এত বারুদের মুখোমুখি হয়েছে যে, এখন এর পুনর্গঠনের জন্য বড় সহায়তা এবং কয়েক বছরের পরিকল্পিত ও কঠোর পরিশ্রম প্রয়োজন।

কিন্তু এ প্রেক্ষিতে ফিলিস্তিনের আর্চ বিশপ জোসেফ নুমানের গত ক্রিসমাসের বক্তব্যটি মনে পড়ছে। তিনি সেখানে বলেছেন, আমরা ফিলিস্তিনীরা বংশ পরম্পরায় হোঁচট খেয়েও আবার উঠে দাঁড়াতে এবং আবারও পড়ে গেলে নতুন করে ঘুরে দাঁড়াতে অভ্যস্ত। বর্তমান পরিস্থিতিরও অবসান হবে। আমরা আবারো ঘুরে দাঁড়াব। আমাদের বিপদে যাদের হৃদয় ব্যথিত আমরা তাদের অবাক করে দেব। 

 

 

advertisement