যিলহজ্ব ১৪৪৫   ||   জুন ২০২৪

ট্রান্সজেন্ডারবাদ একটি কুফরী মতবাদ

[আল-হাইআতুল উলয়া লিল-জামিআতিল কাওমিয়া বাংলাদেশ-এর জাতীয় মুফতি বোর্ড কর্তৃক প্রণীত শরীয়তের দৃষ্টিতে ট্রান্সজেন্ডার ও ট্রান্সজেন্ডার মতবাদ, একটি প্রামাণ্য ফতোয়া শিরোনামের বিস্তারিত ফতোয়া গত ১২ যিলকদ ১৪৪৫ হিজরী মোতাবেক ২১ মে ২০২৪ ঈসায়ী জাতীয় মুফতি বোর্ড-এর সভায় চূড়ান্তভাবে অনুমোদিত হয়। ইতোমধ্যে তা বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে

প্রকাশ করা হয়েছে।

কাছাকাছি সময়ে হাইআ-এর পক্ষ থেকে তা পুস্তিকাকারেও প্রকাশিত হবে, ইনশাআল্লাহ। উক্ত বিস্তারিত ফতোয়ার একটি সার-সংক্ষেপও জাতীয় মুফতি বোর্ড কর্তৃক প্রণীত হয়ে প্রকাশিত হয়েছে, যেন তা জনসাধারণের মাঝে ব্যাপকভাবে বিতরণ করা যায় এবং খতীব সাহেবগণ এ বিষয়ে মুসল্লিয়ানে কেরামকে
অবহিত করতে পারেন।

বিষয়বস্তুর গুরুত্ব বিবেচনায় ব্যাপক প্রচারণার স্বার্থে ফতোয়ার সার-সংক্ষেপটি মাসিক আলকাউসারে ছাপা হল।]

আল্লাহ তাআলা পুরুষকে পুরুষ বানিয়েছেন এবং নারীকে নারী বানিয়েছেন। পুরুষকে পুরুষ হিসেবে শরীয়তের বিধান দিয়েছেন এবং নারীকে নারী হিসেবে শরীয়তের বিধান দিয়েছেন। আল্লাহ তাআলা যাকে পুরুষ বানিয়েছেন সে পুরুষ হিসেবেই জীবনযাপন করবে আর যাকে নারী বানিয়েছেন সে নারী হিসেবেই জীবনযাপন করবে। এটি নারী ও পুরুষের প্রতি মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের বিধান। বর্তমানকালের একটি কুফরী মতবাদের দাবি এর সম্পূর্ণ বিপরীত। মতবাদটি ট্রান্সজেন্ডারবাদ নামে ইতোমধ্যে পশ্চিমা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছে। ট্রান্সজেন্ডারবাদের মূলকথা হল, কোনো পুরুষ যদি নিজেকে নারী দাবি করে, তাহলে সে নারী, সবার তাকে নারী বলে মেনে নিতে হবে। তেমনিভাবে কোনো নারী যদি নিজেকে পুরুষ দাবি করে, তাহলে সে পুরুষ, সবার তাকে পুরুষ বলে মেনে নিতে হবে। নাউযুবিল্লাহ। এটি একটি স্পষ্ট কুফরী মতবাদ। পশ্চিমা যৌনবিকারগ্রস্ত কিছু অমুসলিম গবেষক এ মতবাদের জন্ম দিয়েছে। একশ্রেণির মিডিয়া এবং পশ্চিমা মদদপুষ্ট কিছু এনজিও আমাদের দেশে এ ভয়ংকর মতবাদ প্রচার ও প্রতিষ্ঠার পাঁয়তারা করছে। এ দেশের ঈমানদার মুসলিম জনগণ এটা কিছুতেই মেনে নেবে না।

আল্লাহ তাআলা যাকে পুরুষ বানিয়েছেন তাকে নারী বলা, যাকে নারী বানিয়েছেন তাকে পুরুষ বলা, এটি আল্লাহর সৃষ্টিতে বিকৃতি সাধন। আল্লাহর হুকুমের সুস্পষ্ট বিরুদ্ধাচরণ। আল্লাহর শ্বাশ্বত বাণীর চরম লংঘন। এটা শয়তানী চেষ্টা, শয়তানই মানুষকে দিয়ে এমন কাজ করিয়েছে। দেখুন, কুরআন মাজীদ সুস্পষ্টভাবে বলেছে, আল্লাহর সৃষ্টিতে পরিবর্তন সাধন শয়তানের কাজ। এজন্য আল্লাহ তাআলা শয়তানকে অভিসম্পাত করেছেন।

ইরশাদ হয়েছে-

... لَّعَنَهُ اللهُ وَ قَالَ لَاَتَّخِذَنَّ مِنْ عِبَادِكَ نَصِيْبًا مَّفْرُوْضًا، وَّ لَاُضِلَّنَّهُمْ وَ لَاُمَنِّيَنَّهُمْ وَ لَاٰمُرَنَّهُمْ فَلَيُبَتِّكُنَّ اٰذَانَ الْاَنْعَامِ وَ لَاٰمُرَنَّهُمْ فَلَيُغَيِّرُنَّ خَلْقَ اللهِ وَ مَنْ يَّتَّخِذِ الشَّيْطٰنَ وَلِيًّا مِّنْ دُوْنِ اللهِ فَقَدْ خَسِرَ خُسْرَانًا مُّبِيْنًا، يَعِدُهُمْ وَ يُمَنِّيْهِمْ وَ مَا يَعِدُهُمُ الشَّيْطٰنُ اِلَّا غُرُوْرًا، اُولٰٓىِٕكَ مَاْوٰىهُمْ جَهَنَّمُ  وَ لَا يَجِدُوْنَ عَنْهَا مَحِيْصًا.

...শয়তানকে আল্লাহ লানত করেছেন। সে (আল্লাহকে) বলেছিল, আমি তোমার বান্দাদের মধ্য থেকে নির্ধারিত এক অংশকে নিয়ে নেব। এবং আমি তাদেরকে সরল পথ থেকে নিশ্চিতভাবে বিচ্যুত করব, তাদেরকে (অনেক) আশা-ভরসা দেব এবং তাদেরকে আদেশ করব, ফলে তারা চতুষ্পদ জন্তুর কান চিরে ফেলবে এবং তাদেরকে আদেশ করব, ফলে তারা আল্লাহর সৃষ্টিকে বিকৃত করবে। যে ব্যক্তি আল্লাহর পরিবর্তে শয়তানকে বন্ধু বানায়, সে সুস্পষ্ট লোকসানের মধ্যে পড়ে যায়। সে ওদের প্রতিশ্রুতি দেয় এবং আশা-ভরসা দেয়। প্রকৃতপক্ষে শয়তান তাদেরকে যে প্রতিশ্রুতি দেয় তা ধোঁকা ছাড়া আর কিছু নয়। তাদের সকলের ঠিকানা জাহান্নাম। তারা তা থেকে বাঁচার জন্য পালানোর কোনো পথ পাবে না। -সূরা নিসা (০৪) : ১১৮-১২১

শয়তান মানুষকে আল্লাহ তাআলার সৃষ্টিকে পরিবর্তন করে দেওয়ার হুকুম করে। পক্ষান্তরে আল্লাহ তাআলার হুকুম হল-

فَاَقِمْ وَجْهَكَ لِلدِّيْنِ حَنِيْفًا  فِطْرَتَ اللهِ الَّتِيْ فَطَرَ النَّاسَ عَلَيْهَا  لَا تَبْدِيْلَ لِخَلْقِ اللهِ ذٰلِكَ الدِّيْنُ الْقَيِّمُ وَ لٰكِنَّ اَكْثَرَ النَّاسِ لَا يَعْلَمُوْنَ.

সুতরাং তুমি নিজ চেহারাকে একনিষ্ঠভাবে এই দ্বীনের অভিমুখী রাখ। আল্লাহর সেই ফিতরত অনুযায়ী চল, যে ফিতরতের উপর তিনি মানুষকে সৃষ্টি করেছেন। আল্লাহর সৃষ্টিতে কোনো পরিবর্তন সাধন নেই (অর্থাৎ কোনো পরিবর্তন করো না)। এটাই সম্পূর্ণ সরল দ্বীন। কিন্তু অধিকাংশ মানুষ জানে না। -সূরা রূম (৩০) : ৩০

কুরআন কারীমের এ আয়াতগুলো একটু খেয়াল করে পাঠ করলে এ কথা স্পষ্ট হয়ে যায় যে, ট্রান্সজেন্ডারবাদ পুরোপুরি শয়তানী মতবাদ। আল্লাহ তাআলার দেওয়া হেদায়েত এবং তাঁর নাযিলকৃত শরীয়তের সাথে এর ন্যূনতম সম্পর্ক নেই; বরং তা সম্পূর্ণরূপে কুরআন-সুন্নাহ ও শরীয়তের সাথে সাংঘর্ষিক।

এ মতবাদ অনুযায়ী কোনো পুরুষ যদি নিজেকে নারী দাবি করে, তাহলে তার দাবি সবাইকে মেনে নিতে হবে। সে এখন অপর ছেলেকে বিয়ে করতে পারবে। রাষ্ট্রের আইন এবং সমাজ তাকে বাধা দিতে পারবে না। অথচ ছেলে ছেলে বিয়ে স্পষ্ট সমকামিতা। একইভাবে কোনো নারী যদি নিজেকে পুরুষ দাবি করে, তাহলে তার দাবি সবাইকে মেনে নিতে হবে। সে এখন অপর নারীকে বিয়ে করতে পারবে। রাষ্ট্রের আইন এবং সমাজ তাকে বাধা দিতে পারবে না। অথচ নারীতে নারীতে বিয়ে স্পষ্ট সমকামিতা। আর শরীয়তের দৃষ্টিতে সমকামিতা যে জঘন্য হারাম কাজ, তা তো সবারই জানা। এ অপরাধের কারণেই হযরত লূত আলাইহিস সালামের কওমের উপর কঠিন আসমানী আযাব এসেছিল, যা কুরআন কারীমের বহু সূরায় বর্ণিত হয়েছে।

সূরা আরাফে ইরশাদ হয়েছে-

وَ لُوْطًا اِذْ قَالَ لِقَوْمِهٖۤ اَتَاْتُوْنَ الْفَاحِشَةَ مَا سَبَقَكُمْ بِهَا مِنْ اَحَدٍ مِّنَ الْعٰلَمِيْنَ، اِنَّكُمْ لَتَاْتُوْنَ الرِّجَالَ شَهْوَةً مِّنْ دُوْنِ النِّسَآءِ بَلْ اَنْتُمْ قَوْمٌ مُّسْرِفُوْنَ، وَ مَا كَانَ جَوَابَ قَوْمِهٖۤ اِلَّاۤ اَنْ قَالُوْۤا اَخْرِجُوْهُمْ مِّنْ قَرْيَتِكُمْ  اِنَّهُمْ اُنَاسٌ يَّتَطَهَّرُوْنَ ، فَاَنْجَيْنٰهُ وَ اَهْلَهٗۤ اِلَّا امْرَاَتَهٗ  كَانَتْ مِنَ الْغٰبِرِيْنَ ، وَ اَمْطَرْنَا عَلَيْهِمْ مَّطَرًا فَانْظُرْ كَيْفَ كَانَ عَاقِبَةُ الْمُجْرِمِيْنَ.

এবং লূতকে (পাঠালাম)। যখন সে নিজ সম্প্রদায়কে বলল, তোমরা কি এমন অশ্লীল কাজ করছ, যা তোমাদের আগে সারা বিশ্বে কেউ করেনি? তোমরা তো কামেচ্ছা পূরণের জন্য নারীদেরকে ছেড়ে পুরুষের কাছে যাও! বরং তোমরা এক সীমালঙ্ঘনকারী সম্প্রদায়। তার সম্প্রদায়ের উত্তর ছিল কেবল এই কথা যে, এদেরকে তোমাদের জনপদ থেকে বের করে দাও। এরা তো এমন লোক, যারা বড় পবিত্র থাকতে চায়পরিণামে আমি তাকে (অর্থাৎ হযরত লূত আলাইহিস সালামকে) ও তার পরিবারবর্গকে (জনপদ থেকে বের করে) রক্ষা করলাম, তবে তার স্ত্রী ছাড়া। সে অবশিষ্ট লোকদের মধ্যে শামিল থাকল (যারা আযাবের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়)। আর আমি তাদের উপর (পাথরের) প্রচণ্ড বৃষ্টি বর্ষণ করলাম। সুতরাং দেখ, সে অপরাধীদের পরিণাম কেমন (ভয়াবহ) হয়েছিল। -সূরা আরাফ (০৭) : ৮০-৮৪

ধর্ম ও সমাজ উভয় দিক থেকেই সমকামিতা মারাত্মক অপরাধ। আমাদের দেশের আইনেও তা শাস্তিযোগ্য অপরাধ।

এ মতবাদ বৈধতা পেলে সমাজে যিনা-ব্যভিচার ও অবাধ যৌনাচারের ব্যাপক বিস্তার ঘটবে। কোনো পুরুষ যদি নিজেকে নারী দাবি করে আর দেশের আইন তা মেনে নেয়, তাহলে সে আবাসিক হোটেল বা বাসা-বাড়িতে কিংবা স্কুল-কলেজ-ভার্সিটির ছাত্রী হোস্টেলে নারীদের সাথে থাকার সুযোগ পাবে। মেয়েদের জন্য নির্ধারিত সকল স্থানে অনায়াসে যেতে পারবে। অনুরূপভাবে কোনো নারী যদি নিজেকে পুরুষ দাবি করে আর দেশের আইন তাকে পুরুষ বলে মেনে নেয়, তাহলে সে আবাসিক হোটেলে, বাসা বাড়িতে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের হোস্টেলে পুরুষদের সাথে থাকার সুযোগ পাবে। এর পরিণতি যে কত ভয়াবহ হবে তা বলাই বাহুল্য।

১৭ জুলাই ২০২২ ঈসায়ীতে নিউইয়র্ক পোস্টের এক খবরে বেরিয়েছিল, আমেরিকার নিউজার্সি রাজ্যের জেলখানায় ডেমি মাইনর নামের এক পুরুষ কয়েদী হঠাৎ করে নিজেকে নারী দাবি করতে শুরু করে। পরে জেলখানা কর্তৃপক্ষ ট্রান্সজেন্ডার মতবাদ অনুযায়ী তাকে মহিলা কারাগারে স্থানান্তরিত করে। কারাগারে নারীদের সাথেই রাখা হয় আপাদমস্তক পুরুষ ডেমিকে। ফলে তার সান্নিধ্যে গর্ভবতী হয়ে পড়ে দুই নারী কয়েদী। এ ঘটনার পর তাকে পুনরায় পুরুষের কারাগারে পাঠানো হয়।

এ মতবাদ সমাজে স্থান পেলে শুধু যিনা-ব্যভিচারই নয়, যৌন নির্যাতন ও ধর্ষণও অতি সহজে সমাজে ছড়িয়ে পড়বে। কোনো নারী নিজের সমলিঙ্গের মনে করে নারীরূপী কোনো পুরুষের সাথে থাকলে তার কাছ থেকে ধর্ষণ ও যৌন নিপীড়নের শিকার হওয়া একেবারেই স্বাভাবিক। অসৎ লোকেরা ধর্ষণ ও যৌন নিপীড়নের উদ্দেশ্যে সহজে নারীদের কাছে পৌঁছার জন্য এই পথ বেছে নেবে। ফলে সমাজে নারীদের জন্য নিরাপদ স্থান পাওয়া কঠিন হয়ে যাবে।

এ ছাড়া পরিবার ও সংসারেও দেখা দিবে চরম বিশৃঙ্খলা। কে পিতা, কে মাতা, কে ভাই, কে বোন তা নিয়েই তৈরি হবে অনিশেঃষ জটিলতা। এত দিন ধরে যিনি পিতা ছিলেন, হঠাৎ তিনি নারী হয়ে গেলে, তেমনিভাবে এতদিন ধরে যিনি মা ছিলেন, হঠাৎ তিনি পুরুষ হয়ে গেলে পরিবার ও সংসারের কী হবে!!

ইসলামী শরীয়াতে যেখানে পুরুষকে নারীর পোশাক পরতে নিষেধ করা হয়েছে, নারীকে পুরুষের বেশ-ভূষা গ্রহণ করতে নিষেধ করা হয়েছে, সেখানে ট্রান্সজেন্ডারবাদ তো এর চেয়ে অনেক বেশি ভয়াবহ। এ মতবাদ শুধু পোশাক আর বেশভূষা পরিবর্তন নয়, গোটা পরিচয়ই পাল্টে দিতে বলছে। আপাদমস্তক পুরুষকে বলা হচ্ছে নারী! আপাদমস্তক নারীকে বলা হচ্ছে পুরুষ! কত মারাত্মক বিকৃতি!!

হাদীস শরীফে এসেছে, আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন-

لَعَنَ النَّبِيُّ صلى الله عليه وسلم الْمُخَنَّثِينَ مِنَ الرِّجَالِ، وَالْمُتَرَجِّلَاتِ مِنَ النِّسَاءِ، وَقَالَ: أَخْرِجُوهُمْ مِنْ بُيُوتِكُمْ، قَالَ: فَأَخْرَجَ النَّبِيُّ صلى الله عليه وسلم فُلَانًا، وَأَخْرَجَ عُمَرُ فُلَانًا.

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নারীরূপ ধারণকারী পুরুষদের উপর এবং পুরুষরূপ ধারণকারী নারীদের উপর লানত করেছেন এবং বলেছেন, তাদেরকে তোমাদের ঘর থেকে বের করে দাও।

বর্ণনাকারী বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অমুককে (তাঁর ঘরে আসলে) বের করে দিয়েছেন এবং অমুককে উমর রা. বের করে দিয়েছেন। -সহীহ বুখারী, হাদীস ৫৮৮৬

অপর হাদীসে এসেছে, আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন-

لَعَنَ اللهُ الوَاشِمَاتِ وَالمُوتَشِمَاتِ، وَالمُتَنَمِّصَاتِ وَالمُتَفَلِّجَاتِ لِلْحُسْنِ المُغَيِّرَاتِ خَلْقَ اللهِ.

আল্লাহ লানত করেন আল্লাহর সৃষ্টিতে বিকৃতি সাধনকারী ঐ সকল নারীর প্রতি, যারা অন্যের শরীরে উল্কি অঙ্কন করে এবং নিজ শরীরে উল্কি অঙ্কন করায়। যারা সৌন্দর্যের জন্য ভ্রু-চুল উপড়িয়ে ফেলে এবং দাঁতের মাঝে ফাঁক সৃষ্টি করে। -সহীহ বুখারী, হাদীস ৪৮৮৬

আরেক হাদীসে বর্ণিত হয়েছে-

لَعَنَ رَسُولُ اللهِ صلى الله عليه وسلم الْمُتَشَبِّهِينَ مِنَ الرِّجَالِ بِالنِّسَاءِ، وَالْمُتَشَبِّهَاتِ مِنَ النِّسَاءِ بِالرِّجَالِ.

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঐসব পুরুষকে লানত করেছেন, যারা নারীর বেশ ধারণ করে এবং ঐসব নারীকে লানত করেছেন, যারা পুরুষের বেশ ধারণ করে। -সহীহ বুখারী, হাদীস ৫৮৮৫

অপর হাদীসে এসেছে, আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন-

أَنَّ رَسُولَ اللهِ صلى الله عليه وسلم لَعَنَ الرَّجُلَ يَلْبَسُ لِبْسَةَ الْمَرْأَةِ، وَالْمَرْأَةَ تَلْبَسُ لِبْسَةَ الرَّجُلِ.

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম লানত করেছেন এমন পুরুষের উপর, যে নারীর মতো পোশাক পরিধান করে এবং এমন নারীর উপর, যে পুরুষের মতো পোশাক পরিধান করে। -মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ৮৩০৯

ট্রান্সজেন্ডারবাদে আল্লাহর দেওয়া শরীয়ত ও কুরআন-সুন্নাহর অসংখ্য বিধানের স্পষ্ট বিরুদ্ধাচরণ রয়েছে। এর মাধ্যমে ইসলামের সালাত, হজ্ব, বিয়ে, তালাক, ইদ্দত, বংশপরিচয়, পর্দা-সতর, শাহাদাহ (সাক্ষ্যদান), কাযা, ইমামাত (নামাযের ইমামতি) ও মীরাস-উত্তরাধিকারসহ নারী-পুরুষ সংক্রান্ত কুরআন-সুন্নাহ ও ইসলামের বহু বিধান সরাসরি লঙ্ঘিত হয়। এর দ্বারা কুরআন কারীমের এক-দুটি আয়াত নয়; বরং দুশরও অধিক আয়াতের বিরুদ্ধাচরণ করা হবে। এমনিভাবে সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ নবী হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের শত শত হাদীসেরও বিরুদ্ধাচরণ হবে। তাছাড়া এটি হবে সকল নবী, রাসূল, সাহাবী, তাবেয়ী ও তাবে-তাবেয়ীসহ সকল মুমিন-মুসলিমের পথ তথা জান্নাতের পথ ছেড়ে অভিশপ্ত শয়তানের পথ তথা জাহান্নামের পথ অবলম্বন।

ইসলামী শরীয়ত অনুযায়ী বিবাহ হবে নারী ও পুরুষের মাঝে। কিন্তু এ মতবাদ মেনে নিলে একজন ট্রান্সনারী (বাস্তবে পুরুষ) অপর পুরুষকে বিবাহ করার সুযোগ পাবে। অনুরূপভাবে একজন ট্রান্সপুরুষ (বাস্তবে নারী) অপর নারীকে বিবাহ করার সুযোগ পাবে। পুরুষে পুরুষে বিয়ে বা নারীতে নারীতে বিয়ে তো স্পষ্ট সমকামিতা।

শরীয়ত মোতাবেক একজন নারীর জন্য একসঙ্গে একাধিক স্বামী রাখার অনুমতি নেই। অথচ এ মতবাদ মেনে নেয়া হলে একজন ট্রান্সপুরুষের (বাস্তবে নারী) একাধিক ট্রান্সনারীকে (বাস্তবে পুরুষ) বিয়ে করার সুযোগ তৈরি হবে।

এমনিভাবে শরীয়া আইনে মীরাসের ক্ষেত্রে দুজন মেয়েকে একজন ছেলের সমান গণ্য করা হয়। দুজন মেয়ে একজন ছেলের সমান উত্তরাধিকারের অংশ পায়। কিন্তু এ মতবাদ অনুযায়ী ট্রান্সপুরুষ (বাস্তবে নারী) পুরুষের সমান গণ্য হবে। ট্রান্সজেন্ডার ব্যক্তির অধিকার সুরক্ষার খসড়া আইনেও এটি রয়েছে যে, ট্রান্সজেন্ডার ম্যান-এর জন্য উত্তরাধিকারের অংশ পুরুষের অংশের অনুরূপ হইবে; ট্রান্সজেন্ডার উইম্যান-এর জন্য উত্তরাধিকারের অংশ নারীর অংশের অনুরূপ হইবে অথচ এটি সরাসরি কুরআনের নির্দেশের লঙ্ঘন; বরং বিরুদ্ধাচরণ। কুরআনের যে কোনো বিধানের বিরুদ্ধাচরণেরই শাস্তি জাহান্নাম। মীরাসের ক্ষেত্রে বিশেষভাবে ঘোষিত হয়েছে-

وَ مَنْ يَّعْصِ اللهَ وَ رَسُوْلَهٗ وَ يَتَعَدَّ حُدُوْدَهٗ يُدْخِلْهُ نَارًا خَالِدًا فِيْهَا وَ لَهٗ عَذَابٌ مُّهِيْنٌ.

পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের অবাধ্যতা করবে এবং তাঁর (স্থিরীকৃত) সীমা লঙ্ঘন করবে, তিনি তাকে দাখিল করবেন জাহান্নামে, যাতে সে সর্বদা থাকবে এবং তার জন্য আছে লাঞ্ছনাকর শাস্তি। সূরা নিসা (৪) : ১৪

এভাবে ইসলামের অনেক বিষয়ে বিধানগতভাবে নারী-পুরুষের মাঝে পার্থক্য রয়েছে। এ মতবাদ মেনে নেওয়া হলে ঐসব বিধানে নারীর জন্য পুরুষের বিধান আর পুরুষের জন্য নারীর বিধান চালিয়ে দেওয়া হবে, যা শরীয়ত বিকৃতির ভয়ংকর রূপ।

মোটকথা, ট্রান্সজেন্ডারবাদ এতই ভয়ংকর একটি বিষয় যে, সামাজিক ও আইনগতভাবে যদি একে স্বীকৃতি দেওয়া হয়, তাহলে পুরো সমাজব্যবস্থাই ভেঙে পড়বে। চরম বিশৃঙ্খলা ও নৈতিক অবক্ষয় দেখা দেবে এবং বড় বড় সব অপরাধ অবাধে ছড়িয়ে পড়বে। দেশ, জাতি ও সমাজ ভয়াবহ বিপর্যয়ের সম্মুখীন হবে। সর্বোপরি আল্লাহ তাআলার সৃষ্টি এবং তাঁর দেওয়া বিধি-বিধানে হস্তক্ষেপ করা হবে, যা স্পষ্ট কুফরী।

ট্রান্সজেন্ডার ও হিজড়া সম্পূর্ণ ভিন্ন

ট্রান্সজেন্ডারের সাথে হিজড়ার কোনো সম্পর্ক নেই; বরং দুটি সম্পূর্ণ ভিন্ন বিষয়। হিজড়ারা একধরনের শারীরিক প্রতিবন্ধী। তাদের যৌন অঙ্গগুলোতে জন্মগতভাবে কিছু ত্রুটি থাকে। এতে তাদের কোনো হাত নেই। হিজড়া হওয়া কোনো অপরাধ নয়। অপরদিকে ট্রান্সজেন্ডার হল সম্পূর্ণ মনের বিষয়। পুরোটাই মনের শয়তানী। সুস্থ পুরুষ হয়েও নিজেকে নারী দাবি করে, সুস্থ নারী হয়েও নিজেকে পুরুষ দাবি করে। এটা শরীয়তের দৃষ্টিতে অনেক বড় অপরাধ। যারা এরূপ করবে, তাদের উপর আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের লানত। কাজেই ট্রান্সজেন্ডার ও হিজড়া সম্পূর্ণ আলাদা, একটিকে অপরটির সাথে গুলিয়ে ফেলা স্পষ্ট বিভ্রান্তি ছাড়া কিছু নয়।

তাছাড়া হিজড়া নারী ও পুরুষের বাইরে ভিন্ন কোনো শ্রেণি নয়। তার দেহের আলামতগুলোকে ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যাবে, শরীয়তের দৃষ্টিতে হয়ত সে নারী গণ্য হবে বা পুরুষ। কোন্ ধরনের হিজড়ার ক্ষেত্রে পুরুষের বিধান আরোপিত হবে আর কোন্ প্রকারের হিজড়ার ক্ষেত্রে নারীর বিধান আরোপিত হবে- তা ইসলামী ফিক্হ-ফতোয়ার কিতাবে বিস্তারিত উল্লেখ আছে। যে প্রকারের হিজড়া শরীয়তের দৃষ্টিতে পুরুষের অন্তর্ভুক্ত, তার জন্য নিজেকে নারী গণ্য করার সুযোগ নেই এবং যে প্রকারের হিজড়া শরীয়তের দৃষ্টিতে নারী শ্রেণিভুক্ত, তার জন্য নিজেকে পুরুষ গণ্য করার সুযোগ নেই।

হিজড়াদের জন্য ইসলামে যাবতীয় বিধিবিধান রয়েছে। তাই হিজড়ার অধিকার সুরক্ষা আইন অবশ্যই থাকা উচিত। তবে সেটা হতে হবে তাদের জন্য প্রদত্ত ইসলামের বিধান অনুযায়ী। কিন্তু ট্রান্সজেন্ডার অধিকার নামে কিছুতেই কোনো আইন প্রণয়ন করা, পাস করা ও বাস্তবায়ন করা বৈধ নয়।

আল্লাহ, রাসূল ও আখেরাতে বিশ্বাসী সকল মুমিনের দায়িত্ব, সমাজ বিধ্বংসী এ কুফরি মতবাদের ভয়াবহতা ভালোভাবে বুঝে নিজেরা এ থেকে দূরে থাকা এবং দ্বীনী ও দাওয়াতী পন্থায় সমাজের অন্যদের সামনেও বিষয়টি পরিষ্কার করা এবং এর বিরুদ্ধে ব্যাপক জনমত গড়ে তোলা। আল্লাহ তাআলা আমাদের সকলকে তাওফীক দান করুন- আমীন। 

 

 

advertisement