রবিউল আখির ১৪৩২   ||   মার্চ-২০১১

শেয়ার বাজার : প্রসঙ্গ কথা-২

মুফতি আবুল হাসান মুহাম্মাদ আব্দুল্লাহ

 

প্রশ্ন : আপনি এপ্রিল ২০১০ এর সাক্ষাতকারে শেয়ার বাজারে মানি গেম বা টাকার খেলার কথা বলেছিলেন, কিন্তু কেউ কেউ এটিকে ক্যাপিটাল গেইন মনে করে জবাব দেওয়ার চেষ্টা করেছেন।

উত্তর : এটাই তো আমাদের বড় সমস্যা। অনেক ক্ষেত্রেই আমরা না বুঝে কথা বলে থাকি। কোনো কিছু না বুঝেও বুঝার ভান ধরি। এতে অনবগত ও সরল লোকেরা বিভ্রান্ত হয়। শেয়ার বাজার অনেকটা জুয়ার বাজারের রূপ ধারণ করতে যাচ্ছে সে কথা আমি বলেছিলাম। গত বছরের এ সময়ের দিকে। এক বছর পুরো হওয়ার আগেই অনেক অর্থনীতিবিদ ও বাজার বিশেষজ্ঞ একই কথা বলা শুরু করেছেন। আপনি ১৪/০২/২০১১-এর প্রথম আলো পড়ুন। গোলটেবিল আলোচনায় কি বলা হয়েছে। বড় আকারের লাল শিরোনাম দেখতে পাবেন, শেয়ারবহাজার এখন ক্যাসিনো। ক্যাসিনো মানে জুয়ার আসর। ঐ আলোচনায় কথাটি বলেছেন প্রতিথযশা অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক রেহমান সোবহান। এই অধ্যাপক সাহেবরা তো আর হালাল-হারাম নিয়ে আলোচনা বা চিন্তা করেন না। তারাই এখন শেয়ার বাজারকে জুয়ার আসর বলে আখ্যা দিচ্ছেন। উল্লেখ্য যে, শেয়ার বাজার পুরোপুরিভাবে শরঈ কিমার বা মাইসির-এর অন্তর্ভুক্ত কি না সেটি ভিন্ন প্রসঙ্গ। এবং এখানে লেনদেন নাজায়েয হওয়ার বিষয়টি এটি মাইসির হওয়ার উপর নির্ভরশীলও নয়। আর ক্যাপিটাল গেইন ও মানি গেম-এর পার্থক্য যে বুঝে না তার কথা নিয়ে বলার কি-ই বা থাকতে পারে।  

মূলত মানি গেমের শাব্দিক অর্থ হল টাকার খেলা। আর ক্যাপিটাল গেইন হচ্ছে স্টক এক্সচেঞ্জের শেয়ার ব্যবসা। অর্থাৎ কোম্পানির ডিভিডেন্ট খাওয়ার উদ্দেশ্যে নয়; বরং শেয়ার কেনা-বেচা করে লাভ হাসিলের উদ্দেশ্যে যে ব্যবসা করা হয় তা-ই হচ্ছে ক্যাপিটাল গেইন। একথা সুস্পষ্ট যে, শুধু ক্যাপিটাল গেইন হওয়ার কারণে একটি কারবারকে হারাম বলা হবে না, কিন্তু সেটি যদি মানি গেম-এর রূপ ধারণ করে এবং অন্যান্য শরঈ সমস্যা তাতে যোগ হয় তাহলে তো আর তা হালাল থাকবে না।  

আর বর্তমান শেয়ারবাজারকে যে মানি গেম বলা হচ্ছে তা তো এ প্রশ্নের জবাবের প্রথম অংশ থেকেই জানা গেল। এ বিষয়ে আলকাউসারের গত সংখ্যায় (ফেব্রুয়ারি ২০১১) ও বিস্তারিত লেখা হয়েছে। 

প্রশ্ন : উপমহাদেশে শেয়ার বাজারের মাসআলার আলোচনা এলেই ঘুরে ফিরে হাকীমুল উম্মত হযরত থানভী রাহ.-এর চার শর্তের প্রসঙ্গ আসে। আসলে কি তিনি ঐ চার শর্ত পাওয়া গেলেই শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ জায়েয বলেছেন? 

উত্তর : হযরত থানভী রাহ. এর পুস্তিকা আলকাসাসুস সানী ফী হিসাসিল কোম্পানি, যা ইমদাদুল ফাতাওয়ার অংশ হিসেবে ছেপেছে, তাতে বিষয়টি আলোচিত হয়েছে। ২৮ পৃষ্ঠার ঐ পুস্তিকাটির সব কথার উপর আলোচনা করার অবকাশ এখানে নেই। তবে সংক্ষেপে কয়েকটি বিষয় আরজ করছি।  

১. হাকীমুল উম্মত থানভী রাহ. এ বিষয়ে জবাব দিয়েছিলেন এমন এক সময়ে যখন ভারতে বৃটিশ শাসন ছিল। এজন্য তিনি কাফেরের সাথে মুসলমানের

الربا الربا بين الحربي والمسلممسلم

সুদী লেনদেনের মাসআলাও তাতে লিখেছেন। তিনি একথাও বলেছেন যে, যদি মুসলমানদের কোম্পানিগুলো সুদী লেনদেন করে তবে কাফেরদের কোম্পানিতে অংশীদার হওয়া মুসলমানদের কোম্পানিতে অংশীদার হওয়ার চেয়ে মাসআলার দিক থেকে অধিক সহনীয়। এমনকি এটি এমন এক সময়ের কথা, যখন কোম্পানি কিভাবে গঠিত ও পরিচালিত হয় সে পরিচয় দিতে এবং তা বুঝে নিতে প্রশ্নকারী ও জবাবদাতার অনেক কসরত হয়েছে। অর্থাৎ এটি ভারতে কোম্পানি ব্যবসার শুরুর দিকের ঘটনা। যখন ভারতীয় মুসলমানরা ছিল পরাধীন এবং তাদের হালাত ছিল খুবই শোচনীয়।

২. হযরত থানভী রাহ. কে বর্তমান সময়ের মতো কোনো স্টক এক্সচেঞ্জ বা সেকেন্ডারি মার্কেটের বিষয়ে জিজ্ঞেস করা হয়নি। বরং একটি প্রাইভেট কোম্পানির শেয়ার যে পদ্ধতিতে হস্তান্তর হয় (যেমন পরিচালকগণ গ্রহণ করলে হস্তান্তর গৃহীত হবে অন্যথায় নয়) সে পর্যায়ের হস্তান্তরের কথা সেখানে উল্লেখিত হয়েছে (দেখুন ইমদাদুল ফাতাওয়া ৩/৫০০)

সুতরাং হযরত থানভী রাহ.-এর বক্তব্যকে বর্তমান সময়ে স্টক এক্সচেঞ্জ বা শেয়ার বাজারের মাসআলার দলীল বানানো খুবই অন্যায় কাজ হবে। কারণ তিনি তো বিষয়টির উল্লেখই করেননি এবং তাঁকে সে বিষয়ে জিজ্ঞাসাও করা হয়নি।

৩. সবচেয়ে জরুরি যে কথাটি উল্লেখ করা দরকার তা হচ্ছে, সুদী লেনদেন করে অথচ মূল কারবার হালাল-এমন কোম্পানির অংশ খরিদের (প্রচলিত শেয়ার বাজারের শেয়ার নয়) ব্যাপারেও শর্তসাপেক্ষে যে জবাবটি দিয়েছেন তার শেষে সুস্পষ্ট একটি ঘোষণাও দিয়েছেন তিনি। তা হচ্ছে-

يقول يقول أشرف علي : إن هذا التوسع كله في أمثال هذه المعاملات لمن ابتلي بها أو اضطر إليها، وأما غيره فالتوقي الورع.

অর্থাৎ আশরাফ আলী থানভী (হযরত থানভী রাহ.) বলছেন, উপরের ছাড়গুলো শুধু ঐ ব্যক্তির জন্য, যে এই বিপদে পতিত হয়ে গেছে অথবা সে তা করতে চরমভাবে বাধ্য         (اضطرار)। এমন ব্যক্তি ছাড়া অন্যদের জন্য তা থেকে দূরে থাকাই হচ্ছে তাকওয়া। (মধ্য শাওয়াল ১৩৫৫ হিজরীতে লিখিত)।

উপরোক্ত বক্তব্য পরিষ্কারভাবে ঘোষণা করছে যে, হযরত থানভী রাহ. আজ থেকে ৭৬ বছর আগে সুদী লেনদেনকারী কোম্পানির অংশ খরিদের ব্যাপারে যা বলেছেন তা কিছুতেই অবাধ ছাড় ছিল না; বরং তিনি দুই ধরনের ব্যক্তির জন্য ঐ হীলা পেশ করেছেন : একজন হচ্ছে ঐ ব্যক্তি, যে ইতিমধ্যেই তাতে জড়িত হয়ে গেছে। আর অপরজন হচ্ছে, যে ইজতিরার তথা কারবারটি করার জন্য চরমভাবে বাধ্য হয়েছে। (উল্লেখ্য যে, ইজতিরার শরীয়তে এমন অবস্থাকে বলা হয়, যখন শূকর বা মৃত জন্তু ভক্ষণ করা জায়েয হয়ে যায়।)

বর্তমান সময়ের সুদী মূলধন ভিত্তিক কোম্পানিগুলোর কথা তিনি বলেননি এবং তাঁকে জিজ্ঞাসিত প্রশ্নেও এখনকার মতো কোম্পানি (যারা হালাল জিনিস উৎপাদন করলেও তাদের মূলধনের একটি বড় অংশই ব্যাংক লোন থাকে।) এর কথা ছিল না।

আর তাঁর ঐ আরবী ইবারতটি আবার পড়ে দেখুন। তিনি তো মুবতালা বিহী বা ইতিমধ্যেই শেয়ার কিনে ফেলেছে এমন ব্যক্তির জন্য হুকুম বর্ণনা করেছেন। কিন্তু তাঁর কথাকে দলীল বানানো হচ্ছে জেনে শুনে সুদী মূলধনভিত্তিক কোম্পানির শেয়ার লেনদেন জায়েয হওয়ার দলীল হিসেবে।

অথচ সেই বক্তব্যটিও উল্লেখ করা হচ্ছে অসম্পূর্ণভাবে, তিনি দলীলের শেষে আশরাফ আলী বলছে বলে আরবীতে যা বলেছেন তা পেশ করা হচ্ছে না। আপনি কারো কথার উদ্ধৃতি দিলে তো সংশ্লিষ্ট পুরো কথাই আনবেন। অংশ বিশেষ (গুরুত্বপূর্ণ অংশ) ছেড়ে দিলে তো তাঁর প্রতি অবিচার করা হবে।

মোটকথা হল, ক) হযরত থানভী রাহ. ঐ ফতোয়া দিয়েছেন ৭৬ বছর পূর্বে, তখনকার কোম্পানিগুলোর অবস্থা এখনকার মতো ছিল না। খ) তিনি প্রচলিত শেয়ার বাজার বা সেকেন্ডারি মার্কেট সম্পর্কে কিছুই বলেননি। গ) যারা তখনো জিজ্ঞাসিত কোম্পানির শেয়ার কিনেনি বা কেনার জন্য চরমভাবে বাধ্য হয়নি তাদেরকে তিনি এর থেকে বেঁচে থাকার নসীহত করেছেন।

সুতরাং বর্তমান সময়ের বিচিত্র ব্যবসাকেন্দ্র শেয়ার বাজারের লেনদেন জায়েয হওয়ার জন্য হযরত থানভী রাহ.-এর কথাকে দলীল হিসেবে পেশ করা কিছুতেই গ্রহণযোগ্য  হতে পারে না। বরং হালাল-হারাম বেছে চলতে চায়-এমন মুসলমানদেরকে হাকীমুল উম্মতের বরাতে সুদী লেনদেনকারী প্রতিষ্ঠানের অংশীদার হওয়ার মাসআলা দেওয়া কতটুকু যুক্তিযুক্ত তা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গের ভেবে দেখা উচিত। আমার অনুরোধ, আপনারা ইমদাদুল ফাতাওয়ার ঐ অংশটুকু (৩/৪৮৬-৫১২) আবার মন দিয়ে ভালোভাবে বুঝে পড়ুন এবং হযরত থানভী রাহ. যে হীলা-তাবীলগুলো বলেছেন (বিশেষত ফেইস ভ্যালু থেকে অতিরিক্ত মূল্যে বিক্রি হলে) সেগুলোর উপর কেউ আমল করে কিনা বা আমল করার জন্য বলা হয় কি না তাও দেখুন। এবং ঐ ফাতাওয়ার পৃষ্ঠাগুলো ও দলীলগুলো বারবার পড়ুন। এরপর বর্তমান সময়ের সাথে তা মিলে কি না তা পরখ করুন। সুদ-প্রতারণাসহ আরো বহুবিধ হারাম মিশ্রিত একটি বিচিত্র বাজারে আপনি যদি অংশগ্রহণ করেনই তবে সেটি আপনার ব্যাপার, কিন্তু এর পক্ষে একজন আল্লাহর ওলীকে টেনে আনার আগে আরো একবার ভেবে দেখুন।

প্রশ্ন : কোম্পানির মূল কারবার হালাল, কিন্তু সে সুদী লেনদেনের সাথে জড়িত-এমন প্রতিষ্ঠানের শেয়ার খরিদের বিপক্ষে আগেও আপনি মত দিয়েছেন। এ ধরনের মতামত কি অন্য আরো কোনো আলিম দিয়েছেন?

উত্তর : ভালো হত যদি আপনি জিজ্ঞেস করতেন যে, এ মতের বিপক্ষে কতজন আলেমের রায় আছে। কারণ বিশ্বের বড় বড় ফকীহগণের সিংহভাগের মত এটিই। তারা সুদের সাথে জড়িত কোম্পানির শেয়ার ক্রয় হারাম মনে করেন। বিষয়টি সহজে বুঝার জন্য নিচের দিকে লক্ষ করুন।

ক) পুরো বিশ্বের বহু বড় বড় ফকীহদেরকে নিয়ে গঠিত ওআইসি ফিকহ একাডেমী কয়েকটি সেমিনারে পর্যালোচনার পর এটি হারাম হওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। সিদ্ধান্ত নং ৬৫/১/৭ তারিখ : ১-১৪ মে ১৯৯২ ঈ. (দ্র. উক্ত ফিকহ একাডেমীর মাজাল্লাহ, সংখ্যা : ৭, পৃষ্ঠা : ৭১১-৭১২)

খ) রাবেতা আলমে ইসলামীর অধীনে পরিচালিত ফিকহ একাডেমী তার চতুর্দশ সেমিনারে (২১/১/১৯৯৫ ঈ. তারিখে অনুষ্ঠিত) সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে যে, ১. কোনো মুসলমানের জন্য জেনে শুনে এমন কোম্পানির শেয়ার কেনা জায়েয নয়, যার কারবারের কোনো অংশে সুদ অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। ২. যদি কেউ না জেনে এমন কোম্পানির শেয়ার খরিদ করে ফেলে তাহলে অবগত হওয়ার পর তার জন্য ঐ কোম্পানি থেকে বেরিয়ে আসা ওয়াজিব।

রাবেতার ফিকহ একাডেমীর উক্ত ফতোয়ায় যারা স্বাক্ষর করেছেন তাদের কয়েকজনের নাম দেখুন :

১। শায়খ আবদুল আজিজ বিন বায

২। ড. আহমদ মোহাম্মাদ আলী

৩। ড. মোস্তফা যারকা

৪। ড. ছালেহ বিন ফাওযান

৫। ড. হাবীব খওজা

৬। ড. বকর আবু যায়েদ

৭। শায়খ মুহাম্মাদ ইবনে আবদুল্লাহ সুবাইয়িল

৮। শায়খ মুহাম্মাদ ইবনে জুবাইর

৯। আবদুল্লাহ আবদুর রহমান বাসসাম

১০। আবদুর রহমান হামযাহ মারযূকী

১১। ড. মুহাম্মাদ রশীদ রাগেব কাবানী

১২। মুহাম্মাদ সালেম আদুদ

১৩। মাবরূক মাসউদ আওয়াদী

১৪। ড. আহমদ ফাহমী আবু সানাহ

১৫। মুহাম্মাদ আশশাযিলী।

গ) সৌদী আরবের সর্বোচ্চ ইফতা বোর্ড সুদী লেনদেনে জড়িত কোম্পানির শেয়ার ক্রয় হারাম ঘোষণা করেছে।

ঘ) বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় কয়েকটি ব্যাংকের শরিয়া কাউন্সিল/ফতোয়া বোর্ড এ ধরনের শেয়ার কেনা হারাম ঘোষণা করেছে। যদিও বিষয়টি তাদের স্ব স্ব প্রতিষ্ঠানের স্বার্থবিরোধী তবুও দলীলের অকাট্যতার কারণে তারা এমন সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়েছে। ঐ ব্যাংকগুলোর মধ্যে রয়েছে :

১। ইসলামী উন্নয়ন ব্যাংক (আইডিবি)

২। বাইতুত তামইল কুয়েত

৩। দুবাই ইসলামী ব্যাংক

৪। সুদান ইসলামী ব্যাংক।

ওআইসি ফিকহ একাডেমী আলোচিত কারবারটি হারাম ঘোষণা করার পূর্বে তাদের নিয়ম অনুযায়ী এর উপর দীর্ঘ পর্যালোচনার ব্যবস্থা করেছে। সংস্থাটির সদস্য আলিমগণ তাতে স্ব স্ব গবেষণাসমৃদ্ধ লিখিত মাকালা পেশ করেছেন। তাঁদের মধ্যে এই উপমহাদেশ ও আরব বিশ্বের ঐ ব্যক্তিবর্গের মাকালাও ছিল, যাঁরা এ ধরনের শেয়ার ক্রয় করাকে শর্ত সাপেক্ষে জায়েয বলে থাকেন। সকলের বক্তব্য উপস্থাপনের পর নিয়ম অনুযায়ী সেগুলোর উপর মুনাকাশা (ডিসকাস) বা আলোচনা-পর্যালোচনা অনুষ্ঠিত হয়েছে এবং প্রত্যেকে নিজ নিজ মতামতের উপর অন্যের পক্ষ থেকে উত্থাপিত আপত্তির জবাব দেওয়ার প্রয়াস পেয়েছেন। কিন্তু লক্ষণীয় বিষয় হল, এ সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার পূর্বে উক্ত সেমিনারে উপস্থিত জায়েয মতের পক্ষের আলেমগণ অন্যদের প্রশ্নাবলির যথাযথ উত্তর দিতে পারেননি এবং অন্যদের দলীলের সামনে তাঁদের যুক্তি দুর্বল প্রমাণিত হয়েছিল এবং এভাবেই শেষ পর্যন্ত সুদী লেনদেনে জড়িত কোম্পানির শেয়ার কেনা হারাম হওয়ার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।

এ ধরনের শেয়ার কেনা নাজায়েয হওয়ার কথা আরো যে সকল বড় ব্যক্তিত্ব বলেছেন তাঁদের মধ্যে রয়েছেন উপমহাদেশের বিখ্যাত ফতোয়া সংকলন ফাতাওয়া রহীমিয়ার প্রণেতা মুফতী আবদুর রহীম লাজপুরী এবং প্রখ্যাত ফকীহ, মুহাদ্দিস ও দায়ী মাওলানা ইউসুফ লুধিয়ানভী প্রমুখ। আরব বিশ্বের আলেমদের মধ্যে রয়েছেন, ড. আলী আহমদ ছালূছ, শায়খ আলী শায়বানী, ড. ছালেহ মারযূকী, ড. ফাহাদ বিন আবদুর রহমান, ড. আহমাদ মুহিউদ্দীন হাসান, ড. মুহাম্মাদ উসমান শাববীর প্রমুখ।

প্রশ্ন : কিন্তু আমরা জানি যে, কোম্পানিগুলোর আইনই হচ্ছে এমন যে, এখানে পরিচালকরা শেয়ার হোল্ডারদের বক্তব্য বা মতামতের উপর আমল করতে বাধ্য থাকে না। সেক্ষেত্রে সুদী লেনদেন বিষয়ক তাদের সিদ্ধান্তের জন্য শেয়ার হোল্ডারদেরকে দায়ী করা বা ঐ কোম্পানির শেয়ার কেনা নাজায়েয হওয়ার কথা বলা ঠিক হবে কি?

উত্তর : এটিই হচ্ছে সেই বহুল প্রচলিত যুক্তি, যা সুদের সাথে জড়িত কোম্পানির শেয়ার জায়েয হওয়ার সপক্ষের আলেমগণ পেশ করে থাকেন। এর জবাব আমি আগেও দিয়েছি। এবার শুনুন, বিশ্ব ফোরামে (ওআইসি ফিকহ একাডেমীর সেমিনার) এর কী জবাব দেওয়া হয়েছে।

এক্ষেত্রে যে জবাবটি খুবই দৃঢ়ভাবে দেওয়া হয়েছে তা হচ্ছে, কোম্পানি পরিচালকরা আপনার কথা শুনতে বাধ্য নন-একথা জানার পরও সুদ মিশ্রিত কোম্পানির শেয়ার খরিদে আপনাকে কে বাধ্য করেছে। আপনি জেনে শুনে সুদ মিশ্রিত প্রতিষ্ঠানের অংশীদার হচ্ছেন আবার এজিএমে এর প্রতিবাদ করার নিয়ত করছেন। যদিও আপনি ভালোভাবেই জানেন যে, এ প্রতিবাদের কোনো ফল হবে না, তাহলে বিষয়টি হাস্যকর হয়ে গেল না?

আর সুদের অংশ সদকা করে দেওয়ার বিষয়টি একেবারেই দুর্বল কথা বলে চিহ্নিত হয়েছে ঐ সেমিনারে। আলেমগণ বলেছেন, ফুকাহায়ে কেরাম হারাম মাল সওয়াবের নিয়ত ছাড়া সদকা করার কথা বলেছেন ঐ ব্যক্তির জন্য, যে তওবা করে হারাম থেকে বের হতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হয়েছে। কিন্তু একথা কোন ফকীহ বলেছেন যে, আপনি জেনেশুনে হারামের অংশিদার হবেন। আবার তা সদকা করবেন এবং এভাবে প্রতিবছর হারাম নিবেন আর সদকা করবেন। এটি তো ফকীহগণের কথাকে অপাত্রে রাখা হচ্ছে।

উক্ত সেমিনারের এক আলোচক বলেছেন যে, আপনি প্রতিবাদ করেই সুদের সকল দোষের ভাগী পরিচালক পরিষদ বা নির্বাহী বিভাগকে করতে পারেন না। কারণ তারা তো চাকুরে, তারা আপনাদের অর্থাৎ শেয়ার হোল্ডারদের দেওয়া বেতনেই সেখানে চাকুরি করে। বলা হয়েছে যে, আপনি সুদী ব্যাংকে টাকা জমা রেখে অতিরিক্ত নেওয়া হারাম বলেছেন, সুদভিত্তিক লোন নিয়ে ব্যবসা করা হারাম বলেছেন, কিন্তু সুদী লোন গ্রহণকারী বা সুদ কামাই করে-এমন কোম্পানির শেয়ার কেনা জায়েয বলছেন তাহলে তো আপনি প্রকারান্তরে সুদে প্রবেশের রাস্তাই দেখালেন।

এ ধরনের কোম্পানির শেয়ার কেনা জায়েযের মতামত প্রদানকারী এক ডক্টর সাহেব বলেছিলেন যে, এ কোম্পানিগুলোর গুরুত্ব অপরিসীম এবং তারা দেশের অর্থনীতির বড় একটা অংশের নিয়ন্ত্রক, সুতরাং মুসলমানদেরকে এর থেকে ফিরিয়ে রাখা মানে তাদেরকে আর্থিকভাবে দুর্বল করা। এর জবাবে বলা হয়েছে যে, কোনো হারামে মুসলমানদের কল্যাণ থাকতে পারে না। শরীয়ত যা হালাল করেছে তাতেই মুসলমানদের কল্যাণ নিহীত। যদি প্রয়োজনীয়তা ও গুরুত্বের কথা আসে তবে তো সুদী ব্যাংকের লোন নেওয়া এবং তাদের সাথে কারবারের প্রয়োজনীয়তা আরো অনেক বেশি। আপনি তো সে অনুমতি দিচ্ছেন না। অথচ কোম্পানিতে এসে ওকালত বা প্রতিনিধিত্বের হীলা করে আপনি সুদের সাথে জড়িত হওয়ার সুযোগ দিচ্ছেন।

প্রশ্ন : একজন বললেন যে, যদি সুদী লেনদেনে অংশ গ্রহণকারী কোম্পানির শেয়ার ক্রয় নাজায়েয হয় তবে তো ঐ সব কোম্পানির উৎপাদিত পণ্য খরিদ করাও জায়েয হবে না। তাদের উৎপাদিত কাপড়, ঔষধ ইত্যাদি খরিদ করা যাবে না।

উত্তর :  দেখুন, কিছু কথা এতই দুর্বল ও অযৌক্তিক হয়ে থাকে যেগুলোর উত্তর দেওয়ার প্রয়োজন থাকে না। একটি কোম্পানির শেয়ার কেনার অর্থ হল আপনি তার পুরো সম্পদে আনুপাতিক হারে অংশিদার হলেন। তার বর্তমান সকল এসেট তথা স্থায়ী-অস্থায়ী সম্পদ, সকল লায়াবিলিটি তথা যাবতীয় দায়-দেনার অধিকার ও  দায়দায়িত্ব (শেয়ার অনুপাতে) আপনারও। আইপিও থেকে শেয়ার খরিদ করেন বা সেকেন্ডারি মার্কেট তথা স্টক এক্সচেঞ্জ থেকে উভয় ক্ষেত্রেই কোম্পানির যাবতীয় ব্যাংক ডিপোজিট এবং তার সুদে আনুপাতিক হারে আপনার অংশ রয়েছে। অন্য দিকে তার দায়-দেনা ও ব্যাংক লোনে আপনার দায়ও রয়েছে সমানভাবে। কোম্পানি তার বার্ষিক ব্যালেন্সশিটের আলোকে যে ডিভিডেন্ট বা লভ্যাংশ ঘোষণা করে তাতে ঐ সুদ দেওয়া-নেওয়ার ব্যাপারটিও মূল্যায়িত হয়ে থাকে। এছাড়া কোম্পানি আয়-ব্যয় হিসাব করার সময় তার মূলধনের যত টাকা ব্যাংক লোন রয়েছে সেগুলো থেকে অর্জিত মুনাফাও তো এর অন্তর্ভুক্ত করে থাকে। তাহলে জেনে শুনে এমন কোম্পানির শেয়ার কেনা বা তাতে যুক্ত থাকা প্রকারান্তরে এমনই হল যে, আপনি ব্যক্তিগত কোনো ব্যবসার জন্য সুদভিত্তিতে লোন নিলেন, যা হারাম হওয়ার ব্যাপারে কারো কোনো দ্বিমত নেই। পক্ষান্তরে কোনো কোম্পানির কাপড় বা ঔষধ খরিদ করার দ্বারা আপনি তার কোনো মালিকানা বা ডিভিডেন্ট পাচ্ছেন না, তার কোনো দায়-দেনা বা ক্ষতির ভারও আপনার কাঁধে আসছে না। সুতরাং একটি কোম্পানির শেয়ার কিনে তার অংশিদার হওয়া আর সেই কোম্পানির পণ্য খরিদের মাঝে যে জমিন-আসমানের পার্থক্য সে কথা বোঝার জন্য অনেক বেশি ফিকহ জানার প্রয়োজন আছে বলে মনে হয় না। তবে সুদে জড়িত কোম্পানির পণ্য কখন কেনা যাবে এবং তার জন্য শরীয়তের কী নীতিমালা রয়েছে সেটি একটি ভিন্ন প্রসঙ্গ। আজকের আলোচ্য বিষয় সেটি নয়।

প্রশ্ন : সুদমিশ্রিত কোম্পানির  শেয়ার খরিদ জায়েয হওয়ার পক্ষে মত দিয়েছে এমন কিছু সংস্থা বলেছে যে, ৩০% শতাংশ পর্যন্ত সুদী মূলধন ভিত্তিক কোম্পানিতে অংশ গ্রহণ করা যাবে। আবার কেউ কেউ ৪০% পর্যন্ত অনুমতি দিয়েছে। এসব কথার ভিত্তি কি?

উত্তর : এসব কথার ভিত্তি হল একটি ফিকহী নীতি-লিল আকছারি হুকমুল কুল্ল অর্থাৎ অধিকাংশের ভিত্তিতে পুরোটার হুকুম হবে। এক্ষেত্রে কেউ কেউ ৪০% এর বেশিকে অধিকাংশ হিসাব করেছেন। আবার কেউ ওয়াছ ছুলুছু কাছীর (এক তৃতীয়াংশ বেশি) একথার উপর ভিত্তি করে ৩০% পর্যন্ত অনুমতি দিয়েছেন। কিন্তু সুদের মতো একটি ঘৃণিত ও কঠোর হারাম বিষয়ের ক্ষেত্রে এ ধরনের আকলী (যুক্তিনির্ভর) দলীলকে নিতান্তই দুর্বল বলে আখ্যা দিয়েছেন হাল যামানার বহু আলিম। তাদের মধ্যে রয়েছেন : শায়খ ছালেহ, শায়খ আলী শায়বানী, ড. আলী আহমদ ছালুছ, শায়খ আবু আবদুল ইলাহ ছালেহ উসাইমী।

যেখানে কুরআনুল কারীমে

وذروا ما بقى من وذروا ما بقى من الربا ان كنتم مؤمنين

অর্থাৎ সকল সুদ (০% পর্যন্ত) ছেড়ে দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে অন্যথায় আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের সাথে যুদ্ধের ঘোষণা শুনে নিতে বলা হয়েছে (সূরা বাকারা : ২৭৮-২৭৯) সেখানে যুক্তিনির্ভর দলিল দিয়ে ৪০% বা ৩০% সুদের সাথে অংশিদার হওয়ার সুযোগ দেওয়া গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। সাহাবায়ে কেরাম শুধু সুদের সন্দেহ আছে এ ভিত্তিতে কোনো কারবারে অংশিদার হতেও বাধা দিয়েছেন। মুসান্নাফ ইবনে আবী শাইবায় (১০/৪৯০, হাদীস : ২০৩৪৭) হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আববাস রা.-এর বক্তব্য বর্ণিত হয়েছে। তাঁকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল যে, আমার পিতা একজন পশু আমদানীকারক। তিনি ইহুদী-নাসারাদের সাথে অংশিদারী কারবারও করে থাকেন। একথা শুনে হযরত ইবনে আববাস রা. বলেন, কোনো ইহুদী-নাসারা বা মাজূসীর সাথে ব্যবসায় অংশিদার হয়ো না। প্রশ্নকারী জিজ্ঞাসা করলেন, কেন? ইবনে আববাস রা. জবাব দিলেন, যেহেতু তারা সুদি কারবার করে থাকে আর সুদ হচ্ছে হারাম।

উপরোক্ত বর্ণনাটি প্রশ্নে উল্লেখিত বিষয়ের সুস্পষ্ট দলিল।

এখানে আরেকটি বিষয় লক্ষণীয়, তা হচ্ছে -লিল আকছারি হুকমুল কুল্ল (অর্থাৎ অধিকাংশের ভিত্তিতে পুরোটার হুকুম হবে।) নীতি যেখানে প্রযোজ্য হয় সেখানে এর অর্থ দাঁড়ায় এমন যে, সিংহভাগের যে হুকুম কম অংশেরও একই হুকুম হবে। সে অনুযায়ী তো ৩০% বা ৪০% সুদী মূলধন সমৃদ্ধ কোম্পানির সুদের অংশসহ পুরোটা হালাল হয়ে যাওয়া দরকার। এমনিভাবে কোম্পানির ডিভিডেন্টে সুদী আয় যুক্ত থাকলে তার পরিমাণ যদি অর্ধেকের কম হয় তাও সিংহভাগের সাথে মিলে হালাল হয়ে যাওয়ার কথা। অথচ এমন দাবি তো সুদমিশ্রিত কোম্পানির শেয়ার কেনা জায়েযের মতামত দাতা আলেমগণও বলতে পারেননি; বরং তারা উল্টো বলতে বাধ্য হয়েছেন যে, ডিভিডেন্টের সুদী অংশ সদকা করতে হবে এবং কোম্পানির সুদ দিলে তার প্রতিবাদ করতে হবে। তা হলে ঐ নীতির উপর তো তারাই আমল করছেন না। মূলত ঐ কায়েদা (নীতি) এক্ষেত্রে পুরোপুরি লাগাতে গেলে ব্যাপারটি হবে ১ লিটার শরবতের সাথে ১০০ গ্রাম মদ মিশ্রিত হওয়ার পর সিংহভাগ পাক হওয়ার ভিত্তিতে পুরোটাকেই পবিত্র বলে ফেলা। যা কেউই বলেন না। সুতরাং সিংহভাগ ও লঘুভাগের নীতি সুদের মতো সুস্পষ্ট ও কঠিন হারামের ক্ষেত্রে কিছুতেই প্রযোজ্য হতে পারে না।

প্রশ্ন : আরেকটি কথা শোনা যায় যে, একটি কোম্পানি তার সকল শেয়ার তো বাজারে ছাড়ে না, অংশ বিশেষ ছেড়ে থাকে। সে হিসেবে এ শেয়ারের সাথে আর সুদের সম্পর্ক থাকে না; বরং উদ্যোক্তাদের কাছে যে শেয়ার রয়েছে তার সাথেই সুদী লোনের সম্পর্ক থাকবে।

উত্তর : কোম্পানি আইন এবং শেয়ার বিষয়ে যথাযথ জ্ঞানের অভাব থেকেই কেউ এমনটি বলে থাকতে পারেন। বাস্তব কথা সেটিই, যা আমি এর পূর্বের প্রশ্নের জবাবে বললাম যে, কোম্পানির সকল শেয়ারেই এর যাবতীয় সম্পদ ও দায়-দেনার আনুপাতিক হিস্যা থাকে। ধরুন, একটি প্রতিষ্ঠানের এক কোটি টাকার পেইড আপ ক্যাপিটাল বা পরিশোধিত মূলধন রয়েছে তার মধ্য থেকে আইপিও এর মাধ্যমে পাবলিককে দেওয়া হয়েছে ৪০ লক্ষ টাকার শেয়ার। আপনি সেখান থেকে ১০০ টাকা অভিহিত মূল্যের ৫০ টি শেয়ারের একটি লট কিনলেন ৫,০০০/- টাকা দিয়ে। এদিকে ঐ কোম্পানির ব্যাংক লোন রয়েছে ৫০ লক্ষ টাকা। এক্ষেত্রে তার ব্যাংক লোনগুলোর মধ্য থেকে ২৫০০/- টাকার দায়ভার আপনার উপরও বর্তাবে। এবং ঐ পরিমাণ টাকার সুদ আপনার অংশের আয় থেকে পরিশোধিত হবে।

প্রশ্ন : আপনি বহু বছর থেকে ব্যবসা-বাণিজ্য ও ইসলামী অর্থনীতির বিষয়গুলো পড়াচ্ছেন। দীর্ঘ দিন এসব বিষয়ে গবেষণায় জড়িত। এছাড়া আমাদের জানা মতে আপনি ১০ বছর যাবত ১টি কোম্পানি সফলভাবে পরিচালনা করেছেন। এসব অভিজ্ঞতার আলোকে আলকাউসারের পাঠকদের অনেকেই আশা করে থাকেন যে, আপনি শেয়ার বাজার সম্পর্কে সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনা প্রদান করবেন।

উত্তর : আপনি যেহেতু প্রসঙ্গ টেনে এনেছেন তাই প্রথমে ঐ কোম্পানিটির কথা বলি, যেটির ব্যবস্থাপনা পরিচালকের দায়িত্ব আমাকে পালন করতে হয়েছিল। ১৯৯৮ ঈ. সনে আরো কিছু আলেম-ওলামার সমন্বয়ে এটি গঠিত হয়। জয়েন্ট স্টক থেকে রেজিস্ট্রেশনের সময়ই আমরা এটি শরীয়া মোতাবেক চলার বাধ্যবাধকতার বিষয়টি এর মেমোরেন্ডাম তথা সংঘবিধিতে জুড়ে দিয়েছিলাম। এবং পরিস্থিতি প্রতিকূল থাকা সত্ত্বেও ঐ প্রতিষ্ঠান ১০ বছর পূর্ণ করেছে সাফল্যের সাথে এবং প্রত্যেক বছরের জন্যই শেয়ার হোল্ডারগণ লভ্যাংশ পেয়েছেন। এবং আল্লাহর রহমতে কোনো প্রকারের হারাম বা মাকরূহ ব্যবসায় জড়িত হওয়া ছাড়াই ঐ কোম্পানি অনেক উপরে উঠেছিল। এমনকি কোনো কমিশন বাণিজ্যও সেখানে ছিল না। যদিও ঐ প্রতিষ্ঠানের কার্যাদি পরিচালনায় আমাকে অনেক বেগ পেতে হয়েছে তথাপি এক দশক ধরে সফলভাবে এটি প্রতিষ্ঠিত থাকায় একথা ভালোভাবে প্রমাণিত হয়েছে যে, পুঁজিবাদের চরম উত্থানের এ যুগেও হালাল ব্যবসা করা সম্ভব। প্রয়োজন শুধু সদিচ্ছা, ঐকান্তিকতা, ধৈর্য্য ও শরীয়ার উপর অবিচল থাকা। আমাদের ঐ কোম্পানি ছোট খাটোভাবে শুরু হলেও শেষের দিকে সেটি এমন পর্যায়ে পৌঁছেছিল যে, আইপিও ইস্যু করে সেকেন্ডারি মার্কেটেও যাওয়া যেত। কিন্তু আমরা সঙ্গত কারণেই সেই ঝুঁকি নেইনি; বরং অনিবার্য কারণেই শরীয়া পরিপালনের বিষয়টি আমাদের কাছে ছিল মুখ্য। অবশেষে এক দশক পূর্ণ হওয়ার পর মূল পেশার কাজে সময় বেশি দেওয়ার প্রয়োজনে আমি সম্মানিত শেয়ার হোল্ডারদেরকে অনুরোধ করে তাদের মূলধন ও চূড়ান্ত লভ্যাংশ বুঝিয়ে দিয়েছি। কথাগুলো একটু লম্বা করে বললাম এ কথা বোঝানোর জন্য যে, আমাদের প্রতিষ্ঠানটি স্টক এক্সচেঞ্জে লিস্টেড বা তালিকাভুক্ত ছিল না এবং সেটি কোনো বিতর্কিত ব্যবসায় জড়ায়নি। এবং আগেই বলেছি যে, বর্তমান যুগে যারা হালাল ব্যবসা করতে আগ্রহী তাদের জন্য সেটি আদর্শ নমুনা ছিল। কারণ ঐ প্রতিষ্ঠানে সদস্য আনার জন্য কোনো প্রকারের কমিশনের ব্যবস্থা ছিল না। অথচ আমাদেরকে আগ্রহী নতুন শেয়ার হোল্ডারকে বুঝিয়ে শুনিয়ে যোগদান থেকে বিরত রাখতে হত। আপনাকে আহামরি কোনো লাভ দেওয়ার প্রয়োজন নেই; বরং যদি আপনি আদর্শে অটুট থাকেন এবং সঠিক কর্মপন্থা অবলম্বন করেন তবে মানুষ আপনার কাছে আসবেই। যাক সে কথা। এবার মূল বিষয়ে আসুন। অর্থাৎ বর্তমান সময়ে শেয়ারবাজারে যোগ দেওয়ার ব্যাপারে সুস্পষ্ট নির্দেশনা। হ্যাঁ, আমি পরিষ্কারভাবে এবং দৃঢ়তার সাথেই বলছি যে, বর্তমানে শেয়ারবাজারগুলো যে অবস্থায় পৌঁছেছে সেখানে বিনিয়োগ করা জায়েয হবে না। আমি তাহকীকের প্রয়োজনেই বহু বছর থেকে শেয়ারবাজারকে প্রত্যক্ষ করছি এবং সিডিবিএল পদ্ধতি আসার অনেক আগ থেকেই তা দেখে আসছি। কোম্পানিগুলোর শেয়ার ক্রয়-বিক্রয়ের নতুন ও পুরাতন প্রক্রিয়া, আইপিও ইস্যু, এজিএম ইত্যাদি কার্যক্রম দেখার বাস্তব অভিজ্ঞতা আমার হয়েছে। এসব অভিজ্ঞতা এবং উপরে বর্ণিত শরঈ দলিলাদির ভিত্তিতেই আমি একথা বললাম।

 

যারা শেয়ারবাজারের পরিভাষা বোঝেন, তাদেরকে উদ্দেশ্য করে বলছি যে, শেয়ারবাজারকে কোম্পানির আর্থিক অবস্থার দিক থেকে বিচ্ছিন্ন করে অবাস্তব মূল্য বৃদ্ধির ব্যবস্থা কিন্তু কর্তৃপক্ষ, নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা তথা সরকারই করে দিয়েছে। পাগলা ঘোড়া লাগামহীন ছুটিয়ে দেওয়ার পর সে দৌড়াতে দৌড়াতে একপর্যায়ে নিজেই ঝিমিয়ে পড়েছে। আইপিও ইস্যুর সময় শেয়ারের প্রাথমিক মূল্যের সাথে অস্বাভাবিক প্রিমিয়াম যোগ করা (যেমন ১০/-টাকার শেয়ারের সাথে ৬০০% প্রিমিয়াম যোগ করে ৭০/- টাকা বিক্রি) বুক বিল্ডিং পদ্ধতির মাধ্যমে প্রথমেই ফেইস ভ্যালু থেকে বহু বহু গুণ বেশি মূল্য নির্ধারণ করে স্টক এক্সচেঞ্জে সরাসরি তালিকাভুক্ত হওয়া, শেয়ারবাজারে কালো টাকার বিনিয়োগের সুযোগ দেওয়া, নিতান্তই কু-উদ্দেশ্যে বহু প্রতিষ্ঠানের শেয়ারের ফেইস ভ্যালু ১০/- টাকায় নামিয়ে আনা, লাগামহীনভাবে ব্রোকারেজ হাউজ ও মার্চেন্ট ব্যাংকের লাইসেন্স দেওয়া এসবই কৃত্রিমভাবে শেয়ারবাজারকে ফুলে ফেঁপে উঠাতে সাহায্য করেছে। এবং এসবের আড়ালে এক শ্রেণীর পুঁজিবাদী তাদের আসল কাজটি করে গেছে ও যাচ্ছে। আপনি সে মিছিলে যোগ দিয়ে মাঝে মাঝে বড় কিছু স্পর্শ করতে হয়তো পারবেন, কিন্তু এরপরই আপনাকে যোগ দিতে হবে হতাশ বিক্ষোভকারী ও গাড়ি ভাঙচুরকারীদের দলে।

শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারী নিয়ে একটি তদন্ত কমিটি হয়েছে বটে, কিন্তু তাতে কি? এদেশে কটি তদন্ত কমিটির রিপোর্ট জনসম্মুখে এসেছে? আচ্ছা ১৯৯৬ ঈ. সনের মহা কেলেঙ্কারির কোনো হোতার বিচার কি আজো হয়েছে? আজকের   আমার দেশের (২৮/০২/২০১১) প্রথম পাতা দেখুন, বাজার থেকে ইতিমধ্যেই উধাও হয়ে গেছে ১ লাখ ১৭ হাজার কোটি টাকা। যারা ৬ মাস আগে বাজারে প্রবেশ করেছেন, তারা ভালো মৌলভিত্তির কোম্পানির শেয়ার কিনেও ৫০-৬০% মূলধন খুইয়েছেন। অথচ এ সময়ে কোম্পানিগুলোর অবস্থা খারাপ হয়নি; বরং এ বছর তাদের অনেকেই রেকর্ড পরিমাণ ৬০, ৭০ ও ৯০ এমনকি ১০০% বা তারো বেশি লভ্যাংশ ঘোষণা করেছে।

সুতরাং আপনি কেন ঝুঁকি নিবেন। কোন শেয়ারের দাম বাড়ছে বা কমছে এ নিয়ে রাত-দিন কেন টেনশনে থাকবেন। কেন নিজের দুনিয়া-আখিরাত দুটিই বরবাদ করবেন।

পত্রিকার সংক্ষিপ্ত পরিসরে অনেক লম্বা করে লেখা সম্ভব নয়। যদি কোনো প্রিয় পাঠক উপরোক্ত উত্তরগুলোর ব্যাপারে কোনো ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের প্রয়োজন মনে করেন তাহলে তিনি মারকাযুদ দাওয়াহ আলইসলামিয়ায় এসে তা জানতে পারবেন ইনশাআল্লাহ।

আরও পড়ুনঃ

http://alkawsar.com/article/352

 

 

advertisement