যিলকদ ১৪৪৫   ||   মে ২০২৪

মধুখালীতে এই বিষ কীভাবে জন্ম নিল

মাওলানা শরীফ মুহাম্মাদ

ফরিদপুর মধুখালী উপজেলার ডুমাইন ইউনিয়নের পঞ্চপল্লী এলাকায় গত ১৮ এপ্রিল বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় দুজন মুসলিম নির্মাণ শ্রমিককে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে। হত্যা করেছে স্থানীয় হিন্দু যুবক-জনতা ও জনপ্রতিনিধিরা। ঘটনার পরদিন কয়েকটি অনলাইন নিউজ পোর্টালে প্রকাশিত খবরে জানা গেছে, ঘটনার দিন সন্ধ্যা ৭টার কিছু পর ওই এলাকার কৃষ্ণনগর গ্রামের একটি মন্দিরের ভেতরে মূর্তির গায়ে কে বা কারা আগুন ধরিয়ে দেয়। এটা প্রথমে দেখতে পায়, ওই মন্দিরের পূজারী মহিলা তপতী রানী মণ্ডল এবং তার চিৎকারেই অন্যরা জানতে পারে। এরপর কৃষ্ণনগরসহ গোটা পঞ্চপল্লীর হাজারো লোকজন, যাদের প্রায় সবাই হিন্দু, সেখানে জমায়েত হয়ে যায়।

মন্দিরের পাশে একটি স্কুলে সরকারি কাজের অংশ হিসেবে নির্ধারিত ঠিকাদারের অধীনে কর্মরত মুসলিম শ্রমিকদের হাত-পা বেঁধে স্কুলের ভেতরে আটকে রেখে মারধর শুরু করা হয়, শুধুই সন্দেহবশত। ওইসময় মারধরের ঘটনায় নেতৃত্ব দেয় ওয়ার্ড সদস্য (মেম্বার) অজিৎ কুমার সরকার, ওয়ার্ড সদস্য (মেম্বার) লিংকন বিশ্বাস, প্রভাষ কুমার ও বিনয় সাহা-সহ স্থানীয় হিন্দু লোকজন। ঘটনার শুরুর দিকেই ফোনে ডেকে আনা হয় ডুমাইন ইউনিয়নের চেয়ারম্যান উপজেলা আওয়ামী লীগ নেতা আসাদুজ্জামান তপনকে। মারমুখী হিন্দুদের মধ্যেই চেয়ারম্যান নিজে নির্মাণ-শ্রমিক দুই মুসলিম সহোদর আশরাফুল ইসলাম ও আরশাদুল ইসলামকে পেটানো শুরু করে।

চেয়ারম্যানের সঙ্গে মেম্বার অজিৎকুমারও প্রহার করতে থাকে। প্রহারকারীদের হাতে ছিল নির্মাণ কাজে ব্যবহারের জন্য আনা রড, বাঁশ ও লাঠি। এরপর পরিস্থিতি আরো উত্তেজনা-মুখর হয়ে ওঠে। স্কুল কক্ষের ভেতরে-বাইরে অবস্থানরত হিন্দু জনতা কক্ষের ভেতর ঢুকে মুসলিম শ্রমিকদের মারতে থাকে। হিন্দু জনতার আক্রোশ ও ক্ষুব্ধতার সামনে নিজেকে অনিরাপদ মনে করে চেয়ারম্যান তখন বেরিয়ে যায় এবং পরে ম্যাজিস্ট্রেট ও পুলিশ নিয়ে আসে। ততক্ষণে দুজন মুসলিম সহোদর শ্রমিক নিহত হয় এবং দুজন মারাত্মক আহত হয়।

দুই.

বেদনাদায়ক এ হত্যাকাণ্ডের ঘটনার পরদিন দু-চারটি নিউজ পোর্টালে নিউজ প্রকাশ হয়। কিন্তু নিউজের শিরোনামে জোর দেওয়া হয়, মন্দিরে আগুনের প্রসঙ্গটি নিয়ে। আগুন লাগানোর সন্দেহে দুই সহোদর নির্মাণ শ্রমিককে হত্যা করার কথা বলা হয় এবং এ-ও বলা হয়, উত্তেজিত ক্ষুব্ধ জনতার গণপিটুনিতে এই দুই সহোদর মুসলিমের হত্যার ঘটনাটি ঘটেছে।

কোনো কোনো গণমাধ্যমের নিউজের ভাষায় এমন একটি আবহ তৈরির চেষ্টা লক্ষ করা যায় যে, মন্দিরে কেউ আগুন লাগালে উত্তেজিত হিন্দু জনতার হাতে হত্যার মতো ঘটনা ঘটে যেতেই পারে। এটা তেমন অস্বাভাবিক কিংবা দূষণীয় কিছু নয়

দ্বিতীয়ত, তারা যেভাবে ঘটনা তুলে ধরেছে তাতে মনে হয়েছে, সন্দেহবশত শ্রমিকদের পিটিয়ে যে হত্যা করা হয়েছে- সেটি   ছিল বাঁধভাঙা জনতার গণপিটুনি। যেন এঘটনার কোনো আসামী নেই। এ হত্যার কোনো হত্যাকারী নেই। এর কোনো বিচার নেই!

অথচ বাস্তবতা এমন ছিল না। প্রথম কথা, মন্দিরে সেদিন কে আগুন দিয়েছিল, এটা এমন এক রহস্যময় ঘটনা করে রাখা হয়েছে যে, ঘটনার ১২ দিন পর এপ্রিলের শেষ দিন পর্যন্ত সেটা উদ্ধার করা হয়নি; বরং ঘটনার দুদিনের মাথায় আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর বরাতে সংবাদপত্রে প্রকাশ হয়েছে, মন্দিরের এ আগুনের সঙ্গে মুসলিম নির্মাণ-শ্রমিকদের কোনো সংশ্লিষ্টতা পাওয়া যায়নি। তাছাড়া, কোনো মন্দিরে কিংবা মূর্তির গায়ে কেউ আগুন দিলেও তাকে পেটানো কিংবা পিটিয়ে মেরে ফেলার অধিকার কে কাকে দিয়েছে! এজন্য কি দেশে কোনো আইন নেই। ভুল আবহ তৈরির মধ্য দিয়ে মুসলিমকে সন্দেহ করে প্রহার ও হত্যার এই উগ্র হিন্দুত্ববাদী সন্ত্রাসের ঘটনাকে হালকা করে দেখার কোনো সুযোগ কি আছে?

দ্বিতীয় কথা হল, ঘটনার ৪ দিন পর ২১ এপ্রিল সামাজিক মাধ্যমে প্রকাশিত দুটি ভিডিও ক্লিপে স্পষ্ট দেখা যায়, হত্যাপর্ব শুরু হওয়ার আগ মুহূর্তে স্কুলঘরে বেঁধে রাখা হয়েছে মুসলিম নির্মাণ শ্রমিকদেরকে। তাদের চোখে-মুখে আতঙ্ক এবং অসহায়ত্ব। তাদের সামনে চেয়ারম্যান, হিন্দু মেম্বার ও নেতারা জিজ্ঞাসাবাদ করছে, কথাবার্তা বলছে। এরপর শুরু হয়েছে রড দিয়ে প্রহার। অত্যন্ত ঠাণ্ডা মাথায় নেতৃত্ব ও পরিকল্পনার মধ্য দিয়ে হত্যাপর্ব শুরু হয়েছে। উপস্থিত হিন্দু জনতা ঝাঁপিয়ে পড়েছে এর পরে। এটা পথে-ঘাটে সংঘটিত আকস্মিক কোনো গণপিটুনির ঘটনা ছিল না।

ঘটনার ৯ দিন পর ২৬ এপ্রিল ফরিদপুরের জেলা প্রশাসক তার সম্মেলন কক্ষে সাংবাদিকদের ব্রিফিং দিতে গিয়ে এই দুটি ভিডিও ক্লিপ প্রকাশের প্রসঙ্গ উল্লেখ করে বলেছেন, ২১ এপ্রিল এ দুটি ক্লিপ প্রকাশের আগে আমাদের জানা ছিল না, ঘটনার সূচনা কীভাবে হয়েছে এবং কারা এর সঙ্গে জড়িত ছিল। আসামী চেয়ারম্যান আসাদুজ্জামান ও মেম্বার অজিৎকুমার পালিয়ে গেছে দাবি করে তিনি তাদের  সন্ধান দেওয়ার জন্য দেশের মানুষ ও সংবাদকর্মীদের সহযোগিতা চান। এ থেকেও বোঝা যায়, এই হত্যাকাণ্ড আকস্মিক কোনো গণপিটুনির ঘটনা ছিল না।

তিন.

ঘটনার ৫ দিন পর ২২ এপ্রিল মানবজমিন পত্রিকা একটি বিস্তারিত প্রতিবেদন প্রকাশ করে। সেই প্রতিবেদনে অন্য অনেক বিষয় তুলে ধরার পাশাপাশি একথাটিও তুলে ধরা হয় যে, মর্মান্তিক এ ঘটনার পেছনে স্কুলের ঠিকাদারি কাজে হিন্দু মেম্বার অজিৎকুমারের চাঁদাবাজির একটা পূর্বসূত্র ও জেদ সক্রিয় ছিল। ওই প্রতিবেদনে দুজন গ্রাম পুলিশের ভাষ্য  এভাবে উদ্ধৃত করা হয়েছে :

১ নং ওয়ার্ড গ্রাম পুলিশ সদস্য অমৃত কুমার বসু বলেন, বিনয় সাহা মূল হোতা। সে এখানে কেন আসল? তার চরিত্রই ভালো না। সে ধর্মীয় উসকানিমূলক কাজকর্ম করে। সে ঘটনার সময় নেতৃত্ব দিয়েছে।

২ নং ওয়ার্ড গ্রাম পুলিশ সদস্য সুজিত অধিকারী বলেন, ঘটনার সময় অসিম বিশ্বাসের হাতে গোড়ালি ছিল। সে খুব উত্তেজিত ছিল। গোবিন্দ নামের ছেলেটি মধুখালী থানার ওসির সঙ্গে অনেক বাকবিতণ্ডা করেছে। গোবিন্দ এলাকার তরুণদের মধ্যে নেতৃত্ব দেয়।

সংবাদপত্রের ভাষ্য অনুযায়ী, মধুখালী উপজেলায় একসঙ্গে পাঁচটি গ্রাম এমন, যে সেখানে সব বাসিন্দাই হিন্দু/সনাতন ধর্মাবলম্বী, কোনো মুসলিম বাসিন্দা নেই। গ্রামগুলো হচ্ছে, কৃষ্ণনগর, জিনিসনগর, জাননগর, সীধলাজুড়ি ও তারাপুর; এই পাঁচগ্রামকেই একসঙ্গে বলা হয় পঞ্চপল্লী। হামলার দিন ১৮ এপ্রিল সন্ধ্যায় এই পাঁচ গ্রামের অন্তত ২ হাজার লোক কৃষ্ণনগরে জামায়েত হয়ে হামলায় অংশ নেয়।

ঘটনার এই সংখ্যা ও বর্ণনাটি পরিস্থিতির ভয়াবহতা বোঝার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। মন্দিরের ভেতরে মূর্তির গায়ে আগুন লাগানোর সন্দেহে ভিন্ন ইউনিয়ন থেকে আসা মুসলিম নির্মাণ শ্রমিকদের পিটিয়ে হত্যা করার এই পর্বটিতে এত এত উৎসাহী হিন্দু অংশ নিল, কিন্তু ওই পাঁচপল্লীর হিন্দুদের কোনো  নেতা বা কণ্ঠ এ বীভৎস হত্যাকাণ্ডে বাঁধা দিয়েছে বলে কোনো গণমাধ্যম কোনো খবর দিতে পারল না। দেখা গেল, স্থানীয় হিন্দুদের মধ্য থেকে কিছু লোক উদ্যোগী হয়ে ওইদিন হত্যাকাণ্ডে নেতৃত্ব দিয়েছে, কিছু লোক হত্যাকারীদের পাশে পাশে থেকে বর্বরতায় সহযোগিতা করেছে এবং কিছু লোক উৎসাহী দর্শকের ভূমিকা পালন করেছে। এদের মধ্যে কেউ এই হত্যাকাণ্ডে বাঁধা দিয়েছে বলে কোনো নিউজ পাওয়া যায়নি। পুলিশ কিংবা ফরিদপুরের ডিসির বক্তব্যেও এমন কোনো তথ্য সামনে আসেনি। এবং ঘটনার দিন কৃষ্ণনগরে উপস্থিত হয়েও পুলিশ তাদের বিরুদ্ধে কোনো একশনে যায়নি। ওইদিন শুধু দুজনকে গ্রেফতার করা হয়েছিল।

প্রশ্ন হচ্ছে, কয়েকজন মুসলিম নির্মাণ শ্রমিককে নিছক সন্দেহবশত প্রহার ও হত্যার আয়োজনে অংশ নিতে রাজধানী থেকে দূরবর্তী একটি উপজেলার পল্লীগ্রামের বাসিন্দা হাজারো হিন্দুর মন কীভাবে এত উথলা ও আগ্রহী হয়ে উঠল? তাদের মনে এত হিংসা ও উগ্রতার চাষ কীভাবে কতদিনে কোন্ কোন্ পন্থায় সম্পন্ন হল? এটা কি হঠাৎ বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনা, নাকি প্রতিবেশী বড় দেশের উগ্র হিন্দুত্ববাদী নৃশংসতা এবং এদেশীয় বিভিন্ন হিন্দুবাদী উসকানি এর পেছনে বড় ভূমিকা রেখেছে?

ইসলামে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের প্রতি সাম্প্রদায়িক হামলা-আঘাত নিষিদ্ধ। এদেশে বিভিন্ন ধর্মের লোকদের মধ্যে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের গুরুত্ব নিয়ে ইসলামী ব্যক্তিত্ব ও দাঈগণ সবচেয়ে বেশি কথা বলে থাকেন। আমরাও সেই প্রেরণা লালন করি। কিন্তু মুসলিম দেশে মুসলিম-বিদ্বেষী সাম্প্রদায়িকতা ও ক্রমবর্ধমান উগ্রতা সম্পর্কে সচেতনতা ও হিন্দু উগ্রতা প্রতিরোধের চিন্তাটাও সুন্দর সহাবস্থানের প্রয়োজনে দরকারি মনে করি।

চার.

পর্যবেক্ষকরা মনে করেন, মধুখালী উপজেলায় যে বিষাক্ত ঘটনা ঘটল, এটি হঠাৎ ঘটে যাওয়া কোনো দুর্ঘটনা নয়; বরং সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বিভিন্ন উৎস ও প্রসঙ্গ থেকে হিন্দুয়ানী উগ্রতা এবং হিন্দুদের ইসলাম ও মুসলিম-বিদ্বেষের যেসব আলামত সামনে আসছিল, তারই একটি ছোট্ট বিস্ফোরণ। এসবের বড় একটি উৎস প্রতিবেশী দেশের হিন্দু উগ্রবাদী রাজনীতি, উগ্রবাদী প্রচারণা এবং বিভিন্ন মুসলিম-বিদ্বেষী ঘটনা। বড় রাষ্ট্র, বড় প্রচার মাধ্যম ও সংক্রামক বিনোদন-সংস্কৃতির কারণে ওই উগ্রবাদের একটি উপমহাদেশীয় ক্ষেত্র দাঁড় করানো হয়েছে। ভারতীয় হিন্দুত্ববাদের হিংস্রতার কারণে উপমহাদেশীয় কয়েকটি দেশের সনাতন ধর্মাবলম্বীদের মধ্যেও সুপিরিয়র মনোভাবের বিস্তার ঘটেছে। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে ইসকন, হিন্দু মহাসভা, বিশ্ব হিন্দু পরিষদ, আরএসএস-এর নানামুখী প্রচারণা ও ইন্ধন। উগ্র হিন্দুত্ব-তোষণের দেশীয় রাজনীতিও এ উগ্রতার শেকড় দৃঢ় করায় ভূমিকা রেখেছে। যে কারণে এদেশে ইসলাম ও মুসলিম-বিদ্বেষী বিভিন্ন ইস্যু ও ঘটনা সম্প্রতি সামনে এসেছে। এ বিষয়ে দায়িত্বশীল সব মহলের সচেতনতা প্রয়োজন, প্রয়োজন কার্যকর চিকিৎসা ও প্রতিরোধ।

উদাহরণস্বরূপ কয়েকটি প্রসঙ্গের কথা এখানে উল্লেখ করা যায়-

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বিভিন্ন স্কুল-কলেজে হিন্দু শিক্ষক কর্তৃক ইসলাম, প্রিয় নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এবং কুরআনের বক্তব্যের বিরুদ্ধে উসকানিমূলক কথা বলার ঘটনা ঘটেছে এবং এখনো প্রায় ঘটছে। ফেইসবুকসহ বিভিন্ন অনলাইন মাধ্যমে হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা অহরহ ইসলাম-বিদ্বেষী মন্তব্য-বক্তব্য দিচ্ছে। মুসলিম নারী শিক্ষার্থীদেরকে পরিমলের মতো হিন্দু শিক্ষক, হিন্দু শিক্ষার্থী ও যুব মহলের পক্ষ থেকে যৌন নিগ্রহের শিকার বানানো ও ফাঁদে ফেলার ঘটনা প্রায়ই নিউজে আসছে। কক্সবাজারের সাবেক ওসি প্রদীপ সাহার মতো দুর্ধর্ষ আচরণ সম্প্রতি প্রশাসনের বিভিন্ন জায়গায় থাকা সনাতনীদের আচরণে পরিণত হয়েছে।

তেজগাঁওয়ের টিপকাণ্ডে লতা সমাদ্দার যে মিথ্যা নাটক তৈরি করেছিল, প্রশাসন ও মিডিয়া তাকে সঙ্গ দিয়ে অনেক দূর পর্যন্ত নিয়ে গিয়েছিল। প্রভাবশালী রাজনৈতিক দলের ছাত্র, যুব ও মূল দলে বড় বড় অবস্থান নিয়ে বহু হিন্দু সংখ্যালঘু ব্যক্তি রাজনৈতিক ও সাম্প্রদায়িক প্রভাবের খুঁটি মজবুত করছে। আর্থিক ও ব্যবসায়িক সেক্টরে হাজার হাজার কোটি টাকা পাচার করে দেওয়া পিকে হালদারের মতো সংখ্যালঘুর এখন অভাব নেই। সংস্কৃতি ও মিডিয়ায় সনাতনী ব্যক্তি ও ইস্যুর প্রভাব মুসলিম সমাজকে প্রায়ই চ্যালেঞ্জ করছে। জন পরিসরে পূজামণ্ডপের সংখ্যা অনেক বেড়েছে, সঙ্গে বেড়েছে দিনব্যাপী মাইকের আওয়াজ ও বাদ্যবাজনা। বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোতে সাড়ম্বরে স্বরস্বতি পূজা হচ্ছে। সম্প্রতি দেওয়ালি ও হোলি উৎসবের নামে মুসলিম নারী-পুরুষের গায়ে রঙ ছিটানো ও রাস্তাজুড়ে রঙের মহড়া দেওয়ার উৎসব শুরু হয়েছে। হিন্দু পেশাজীবী, শিক্ষাজীবী ও ব্যবসায়ীদের বড় একটি অংশের মধ্যে ভারতীয় হিন্দুত্ব বন্দনার সংস্কৃতি প্রকাশ্য হয়ে উঠেছে। কেউ কেউ তো প্রকাশ্যে অখণ্ড ভারতের কথাও বলছে। প্রিয়া সাহার মতো সংখ্যালঘুর সংখ্যা বাড়ছে। দেশে প্রাধান্য বিস্তার করে, অতিরিক্ত সুবিধা ভোগ করে বিদেশের বড় শক্তির কাছে এরা হিন্দু নির্যাতনেরনালিশ করে।

কয়েক বছর ধরে এদেশের ক্যান্টিন ও ছাত্রাবাসগুলোতে গরুর গোশত রান্না ও খাওয়া নিয়ে নতুন ইস্যু দাঁড় করানো হচ্ছে। মঙ্গল শোভাযাত্রায় হিন্দুয়ানি মিশ্রণের কথা সবার জানা। সংখ্যায় খুবই সংখ্যালঘু (১৫% থেকেও কম) হয়েও বিগত কয়েক বছর ধরে দেশের বিভিন্ন ক্ষেত্রে একরকম সুপিরিয়র ও অধিক প্রাধান্যপ্রাপ্ত নাগরিকের দাপট নিয়ে তারা চলছে। মনোভাব, আলাপ, শরীরী ভাষা, আচরণ ও সুবিধায় তাদের প্রাধান্য এখন চোখে পড়ার মতোই।

এসব সঞ্চিত উগ্রতারই একটি উৎকট প্রকাশ ঘটেছে মধুখালীর পঞ্চপল্লীতে। প্রাধান্য, দাপট আর হিন্দু উগ্রতার অবাধ যাত্রার প্রয়োজনে মুসলিম হত্যা সম্ভবত তাদের কাছে এখন আর চিন্তার বিষয় নয়। এজন্যই কৃষ্ণনগরে মুসলিম নির্মাণ-শ্রমিকদের হত্যায় অংশ নেওয়া দুই হাজার হিন্দু জনতার মধ্যে দুটি প্রতিবাদী কণ্ঠও পাওয়া যায়নি! বিস্ময়কর লাগলেও সত্য হল, ঘটনার ১৩ দিন পরও হিন্দু কম্যুনিটির দায়িত্বশীল কেউ নির্মম সে ঘটনার প্রতিবাদ করে, বিচার চেয়ে বিবৃতি পর্যন্ত দেয়নি। এই উগ্রতা নিয়ে কোনো ভাবনা কিংবা বোধের উদয়মূলক কোনো আচরণ একদমই প্রকাশ পায়নি।

পাঁচ.

পুরো ঘটনাটি হিন্দু উগ্রবাদীদের দ্বারা ঘটলেও ওখানে গুরুত্বপূর্ণ একটি খল-চরিত্র ডুমাইন ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আসাদুজ্জামান। সে এখন পলাতক। মেম্বার অজিৎ কুমারের ফোন পেয়ে সে গিয়েছিল কৃষ্ণনগরে এবং মারধর শুরু করেছিল। পরে সে-ই আবার নিয়ন্ত্রণহীন পরিস্থিতি দেখে পুলিশ নিয়ে হাজির হয়।  মুসলিম বংশোদ্ভুত এমন চরিত্র বিরল নয় এদেশে। ইসলাম ও মুসলিমদের বিপরীত শক্তির কোনো ইস্যুতে এই চরিত্রের নামধারী মুসলিমদের কাজ বিপরীত শক্তির সঙ্গে সহযোগিতা করা। কখনো উগ্র হিন্দুর পক্ষে, কখনো নাস্তিক্যবাদী কিংবা অন্য কোনো মহলের পক্ষে। এই শ্রেণির লোকেরা রাজনীতি, প্রশাসন কিংবা ব্যবসার যে কোনো নিয়ন্ত্রক পর্যায়ে অবস্থান করে আত্মপ্রবঞ্চনায় লিপ্ত হয়। এরা হীনম্মন্যতাগ্রস্ত মুসলিম। জাতীয় পরিসরে চোখে পড়বে এমন লোকের সংখ্যা অনেক।

সেক্যুলার/প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবী ও আওয়াজজীবীদের এমন অনেক ব্যক্তি ও মহল মধুখালীর ঘটনা নিয়ে কথা বলেনি। এরা কিন্তু এদেশের মুসলিমদের গালি দেওয়ার কোনো সুযোগ নষ্ট করে না।

২২ এপ্রিলের খবর অনুযায়ী স্থানীয় ৩১ জন হিন্দু ধর্মাবলম্বীর বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। পরে সেই তালিকায় আরো দুয়েকজন যোগ হয়েছে। কিন্তু গ্রেফতারের খবর মোটেও সন্তোষজনক নয়। ২৩ এপ্রিলে মধুখালীতে সর্বস্তরের মুসলিম জনসাধারণ মানববন্ধন করেছিলেন। তাদেরকে সরিয়ে দিতে পুলিশ একপর্যায়ে গুলি ছুঁড়েছে। এতে বেশ কয়েকজন মারাত্মক আহত হয়েছেন। মুসলিমদের প্রতিবাদী মানববন্ধনে দাঁড়াতে না দিলেও, হত্যাকাণ্ডে অপরাধী মামলাভুক্ত আসামীদের গ্রেফতার করতে না পারলেও, আক্রমণকারী হিন্দুদের নিরাপত্তায় ফরিদপুর-মধুখালীতে পুলিশের পাশাপাশি বিজিবি মোতায়েন করা হয়েছে। দৃশ্য ও সংখ্যাগুলোতে সামঞ্জস্য-অসামঞ্জস্যের অনেক কিছুই হয়তো চোখ এড়াবে না।

ছয়.

তবুও আমরা মনে করি না, হিন্দু উগ্রতার প্রতিরোধে মুসলিম উগ্রতার চর্চাও প্রয়োজন। আমরা মনে করি না, হিন্দু সাম্প্রদায়িকতার জবাবে মুসলিম শক্তিমত্তার আঘাত প্রয়োজন। শান্তিকামী ও শান্তিময় সহাবস্থানের আকাঙ্ক্ষী দায়িত্বশীল দ্বীনের দাঈদের আহ্বানের সঙ্গে কণ্ঠ মিলিয়ে বলতে চাই, দায়িত্বশীলরা দায়িত্ব পালন করুন, হিন্দু উগ্রতার আলামতগুলো পরখ করুন, সমস্যা চিহ্নিত করুন এবং ব্যবস্থা গ্রহণ করুন। নির্মম এ হত্যাকাণ্ডের যথাযথ বিচার করুন এবং হত্যাকারীদের মৃত্যুদণ্ড দিন।

একইসঙ্গে মুসলিম সমাজ ও চিন্তার জগতে বিচরণশীল সবাইকে অনুরোধ করব, সচেতন থাকুন। মুসলমানদের দ্বীন-ধর্ম, সংস্কৃতি ও সম্প্রদায়গত সুস্থতা এবং দেশের মর্যাদার জন্য সজাগ সচেতনতার কোনো বিকল্প নেই। হিন্দু কিংবা সংখ্যালঘু কোনো আক্রোশের পরিবর্তে পাল্টা আক্রোশ নয়; বরং যথাযথ আত্মরক্ষা, প্রতিরোধ ও সচেতনতার পাশাপাশি দ্বীনের দাওয়াত দেশের প্রতিটি প্রান্তে পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা করা দরকার। শহর-গ্রাম, পাহাড়-সীমান্ত সব জায়গায় দ্বীনের দাওয়াত ও আখলাক ছড়িয়ে দিতে হবে।

এই প্রথম জানতে পারলাম, বাংলাদেশের সমতল এলাকায় কোনো একটি উপজেলায় এমন পাঁচটি গ্রাম একসঙ্গে রয়েছে, যেখানে কোনো মুসলিম বাসিন্দা নেই। হিন্দুত্ব কেন্দ্রিক উগ্র মনস্তত্ব কেন্দ্রীভূত হয়ে বিষ্ফোরণ ঘটার এটাও কি কারণ হতে পারে না? সেখানে কিংবা এরকম একচ্ছত্র সংখ্যালঘু অঞ্চল যে নিরাপত্তার জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে- ১৮ এপ্রিলে হিন্দুদের আঘাতে  মধুখালীতে নিরীহ নির্দোষ দুই মুসলিম হত্যার ঘটনা তার একটি প্রমাণ। এসব জায়গায় দাওয়াত পৌঁছানোর চেষ্টা করা, একচ্ছত্র দুর্ভেদ্যতা ভেঙে ঈমানের শামিয়ানা নির্মাণ করার প্রয়াস সচেতন মুসলিমদের অন্যতম দাওয়াতী দায়িত্ব। 

 

 

advertisement