শাবান ১৪৪৫   ||   ফেব্রুয়ারি ২০২৪

মুসলিম উম্মাহর জন্য মসজিদে আকসা কেন এত গুরুত্বপূর্ণ?

আবু হাসসান রাইয়ান বিন লুৎফুর রহমান

গত কয়েকদিন আগের কথা, আমার মাকতাবায় এক ভাই এলেন। এলাকায় নতুন এসেছেন। পরিচিত হওয়ার জন্য নাম জিজ্ঞাসা করলাম। তিনি বললেন, আমার নাম সুলাইমান। আমি বললাম, মাশাআল্লাহ অত্যন্ত সুন্দর নাম। আপনি তো অবশ্যই জানেন, হযরত সুলাইমান আ. একজন প্রসিদ্ধ নবী ছিলেন। যাকে আল্লাহ তাআলা নবুওত দান করেছিলেন, আবার বিশাল রাজত্বও দান করেছিলেন। তিনি দ্বীনের বড় বড় খেদমত আঞ্জাম দিয়েছিলেন। মসজিদে আকসা, যার আরেক নাম বাইতুল মাকদিস-এর পুনঃনির্মাণ ও সংস্কারের কাজও তিনি করেছিলেন। এতটুকু বলতেই সুলাইমান ভাই-এর প্রশ্ন, ‘মসজিদে আকসাএটা কোন্ মসজিদ?’ প্রশ্নটি শুনে প্রথমে অবাক হলাম, তারপর ব্যথিত হলাম। বিশেষ করে ফিলিস্তিনের এই সংকটময় মুহূর্তে এমন প্রশ্ন শুনে আরো বেশি মর্মাহত হলাম।

তবে বাস্তবতা এটাই যে, আমাদের বর্তমান প্রজন্মের একটি বড় অংশ মসজিদে আকসার পরিচয়, মর্যাদা ও মাহাত্ম্য সম্পর্কে ন্যূনতম ধারণাও রাখে না। সাধারণ মানুষের সাথে ওঠা-বসার দরুন এই অভিজ্ঞতা আমার বহু আগেই হাসিল হয়েছে। তাই বর্তমান প্রবন্ধে সংক্ষিপ্তাকারে মসজিদে আকসার পরিচয় ও মর্যাদা এবং উল্লেখযোগ্য কিছু দিক ও বৈশিষ্ট্য তুলে ধরতে চেষ্টা করব ইনশাআল্লাহ।

এক. দ্বিতীয় প্রাচীনতম মসজিদ

মসজিদে আকসার একটি বড় পরিচয় ও বৈশিষ্ট্য হল, এটি পৃথিবীর ইতিহাসে দ্বিতীয় প্রাচীন মসজিদ। মসজিদে হারামের পরেই এই মসজিদের বুনিয়াদ স্থাপিত হয়েছে।

عَنْ أَبِي ذَرٍّ، قَالَ قُلْتُ يَا رَسُولَ اللهِ أَيُّ مَسْجِدٍ وُضِعَ فِي الأَرْضِ أَوَّلُ؟ قَالَ: الْمَسْجِدُ الْحَرَامُ. قُلْتُ: ثُمَّ أَيٌّ قَالَ: الْمَسْجِدُ الأَقْصى. قُلْتُ: كَمْ بَيْنَهُمَا؟ قَالَ: أَرْبَعُونَ سَنَةً...

আবু যর রা. বলেন, আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসুল! পৃথিবীতে সর্বপ্রথম কোন্ মসজিদ স্থাপিত হয়েছে? তিনি বললেন, মসজিদে হারাম। আমি বললাম, অতঃপর কোন্ মসজিদ? তিনি বললেন, মসজিদে আকসা। বললাম, এই দুইয়ের নির্মাণের মাঝে কত সময়ের ব্যবধান? তিনি বললেন, চল্লিশ বছর। সহীহ বুখারী, হাদীস ৩৩৬৬; সহীহ মুসলিম, হাদীস ৫২০

দুই. বরকতময় মসজিদ, বরকতপূর্ণ ভূমি

মসজিদে আকসার একটি বিশেষ ফযীলত হল, আল্লাহ একে বরকতময় করেছেন। এই মসজিদকে কেন্দ্র করে আশপাশের জনপদকেও বরকতপূর্ণ করে দিয়েছেন। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন

سُبۡحٰنَ الَّذِیۡۤ اَسۡرٰی بِعَبۡدِہٖ لَیۡلًا مِّنَ الۡمَسۡجِدِ الۡحَرَامِ اِلَی الۡمَسۡجِدِ الۡاَقۡصَا الَّذِیۡ بٰرَکۡنَا حَوۡلَہٗ لِنُرِیَہٗ مِنۡ اٰیٰتِنَا ؕ اِنَّہٗ ہُوَ السَّمِیۡعُ الۡبَصِیۡرُ.

পবিত্র সেই সত্তা, যিনি নিজ বান্দাকে রাতারাতি মসজিদে হারাম থেকে মসজিদে আকসায় নিয়ে যান, যার চারপাশকে আমি বরকতময় করেছি, তাকে আমার কিছু নিদর্শন দেখানোর জন্য। নিশ্চয়ই তিনি সব কিছুর শ্রোতা, সব কিছুর জ্ঞাতা। সূরা বনী ইসরাঈল (১৭) : ১

আল্লাহ আরো ইরশাদ করেন

وَجَعَلۡنَا بَیۡنَہُمۡ وَبَیۡنَ الۡقُرَی الَّتِیۡ بٰرَکۡنَا فِیۡہَا قُرًی ظَاہِرَۃً...

আমি ওদের এবং যে জনপদগুলোতে বরকত রেখেছিতার মাঝে এমন সব জনপদ স্থাপন করেছিলামযা নজরে আসত...। সূরা সাবা (৩৪) : ১৮

ইবনে আব্বাস রা. বলেন, এখানে বরকতময় জনপদ দ্বারা উদ্দেশ্য হল বাইতুল মাকদিসের জনপদ। তাফসীরে ইবনে কাসীরখ. ৬পৃ. ৪৬৮

তিন. তৃতীয় মর্যাদাপূর্ণ মসজিদ

ইসলামের দৃষ্টিতে সবচে মর্যাদাপূর্ণ মসজিদ হল মসজিদে হারাম, যা পবিত্র মক্কা নগরীতে অবস্থিত। দ্বিতীয় মর্যাদাপূর্ণ মসজিদ হল মসজিদে নববীযা মদীনা মুনাওয়ারায় অবস্থিত। এই দুই মসজিদের পরেই তৃতীয় পবিত্রতম ও শ্রেষ্ঠতম মসজিদ হল মসজিদে আকসাযা ফিলিস্তিনের জেরুজালেম নগরীতে অবস্থিত। এ কারণেই রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন

لاَ تُشَدُّ الرِّحَالُ إِلَّا إِلَى ثَلاَثَةِ مَسَاجِدَ: المَسْجِدِ الحَرَامِ، وَمَسْجِدِ الرَّسُولِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، وَمَسْجِدِ الأَقْصَى

সফর করলে তিনটি মসজিদের উদ্দেশ্যে সফর করা উচিত। মসজিদে হারামমসজিদে নববীএবং মসজিদে আকসা। সহীহ বুখারী, হাদীস ১১৮৯; সহীহ মুসলিমহাদীস ১৩৯৭

এই হাদীস প্রমাণ করে মসজিদে হারামমসজিদে নববীর পরেই মর্যাদার দিক থেকে মসজিদে আকসার অবস্থান।

চার. মুসলিমদের একসময়ের কেবলা

মসজিদে আকসার একটি অনন্য বৈশিষ্ট্য হল এটি মুসলিম উম্মাহর একসময়ের কেবলা।

ইবনে আব্বাস রা. বলেন

كَانَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يُصَلِّي وَهُوَ بِمَكَّةَ نَحْوَ بَيْتِ الْمَقْدِسِ، وَالْكَعْبَةُ بَيْنَ يَدَيْهِ، وَبَعْدَ مَا هَاجَرَ إِلَى الْمَدِينَةِ سِتَّةَ عَشَرَ شَهْرًا، ثُمَّ صُرِفَ إِلَى الْكَعْبَةِ.

قال الهيثمي في مجمع الزوائد: رَوَاهُ أَحْمَدُ وَالطَّبَرَانِيُّ فِي الْكَبِيرِ وَالْبَزَّارُ، وَرِجَالُهُ رِجَالُ الصَّحِيحِ.

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মক্কায় কাবাকে সামনে রেখে বাইতুল মাকদিসের দিকে ফিরে নামায আদায় করতেন। মদীনায় হিজরতের পরও ষোলো মাস বাইতুল মাকদিসের দিকে ফিরেই নামায আদায় করেছেন। অতঃপর কেবলা কাবার দিকে ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছে। মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ২৯৯১; আলমুজামুল কাবীর, তবারানী, হাদীস ১১০৬৬; মাজমাউয যাওয়ায়েদ, হাদীস ১৯৬৭

হযরত বারা ইবনে আযেব রা. বলেন, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন প্রথম মদীনায় এলেন, তাঁর মামাদের বাড়িতে মেহমান হলেন। আর তিনি বাইতুল মাকদিসের দিকে ফিরে ১৬ থেকে ১৭ মাস পর্যন্ত নামায আদায় করেছেন। তবে তিনি চাইতেন বাইতুল্লাহ যেন তাঁর কেবলা হয়...। সহীহ বুখারীহাদীস ৪০, সহীহ মুসলিমহাদীস ৫২৫

পাঁচ. ইসরা ও মেরাজের স্মৃতি বিজড়িত মসজিদ

মসজিদে আকসার গুরুত্ব বোঝার জন্য এটাই যথেষ্ট যে, মেরাজ রজনীতে আমাদের নবীজী ঊর্ধ্বজগতের সফর শুরু করার পূর্বে জিবরীল আমীনের সাথে প্রথমে এই মসজিদে এসেছেন এবং নামায আদায় করেছেন। তিনি ইমামতি করেছেন আর সমস্ত নবীগণ তাঁর ইকতিদা করেছেন। আবু হুরায়রা রা. বলেনরাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম (বাইতুল মাকদিসের বিবরণ দিতে গিয়ে)  বলেন

وقَدْ رَأَيْتُنِي فِي جَمَاعَةٍ مِنَ الأَنْبِيَاءِ فَإِذَا مُوسَى قَائِمٌ يُصَلِّي، فَإِذَا رَجُلٌ ضَرْبٌ جَعْدٌ كَأَنَّه مِنْ رِجَالِ شَنُوءَةَ، وَإِذَا عِيسَى ابْنُ مَرْيَمَ -عَلَيْهِ السَّلاَمُ- قَائِمٌ يُصَلِّي، أَقْرَبُ النَّاسِ بِه شَبَهًا عُرْوَةُ بْنُ مَسْعُودٍ الثَّقَفِيُّ، وَإِذَا إِبْرَاهِيمُ -عَلَيْهِ السَّلاَمُ- قَائِمٌ يُصَلِّي، أَشْبَهُ النَّاسِ بِه صَاحِبُكُمْ -يَعْنِي نَفْسَه- فَحَانَتِ الصَّلاَةُ فَأَمَمْتُهُمْ...

আর আমি নিজেকে আম্বিয়া আলাইহিস সালামের জামাতের মধ্যে দেখতে পেলাম। দেখি, হযরত মূসা আ. নামাযরত আছেন। তিনি ছিলেন ছিপছিপে ও দীর্ঘ দেহের অধিকারী। তাঁর চুল কোঁকড়ানো, যা ছিল কান পর্যন্ত ঝুলন্ত। দেখে মনে হবে, যেন শানওয়াগোত্রেরই একজন লোক। হযরত ঈসা আ.-কেও নামাযে দণ্ডায়মান দেখা গেল। তাঁর আকার আকৃতি সাহাবী উরওয়া ইবনে মাসউদ সাকাফী রা.-এর সাথে অধিক সাদৃশ্যপূর্ণ। হযরত ইবরাহীম আ.-কেও নামাযরত অবস্থায় দৃষ্টিগোচর হল। নবীজী বলেন, তাঁর দেহাবয়বের সাথে আমার দেহাবয়বের মিল বেশি। ইতিমধ্যে নামাযের সময় হয়ে গেল আর আমি তাঁদের সকলের ইমামতি করলাম। সহীহ মুসলিম, হাদীস ১৭২

একটি দীর্ঘ হাদীসের বর্ণনায় হযরত আনাস ইবনে মালেক রা. বলেন, রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন

ثُمَّ دَخَلْتُ بَيْتَ الْمَقْدِسِ فَجُمِعَ لِيَ الأَنْبِيَاءُ عَلَيْهِمُ السَّلاَمُ فَقَدَّمَنِي جِبْرِيلُ حَتى أَمَمْتُهُمْ.

অতঃপর আমি বাইতুল মাকদিসে প্রবেশ করলাম। সমস্ত নবীদেরকে একত্রিত করা হল। জিবরীল আমাকে সামনে এগিয়ে দিলেন আর আমি তাঁদের ইমামতি করলাম। সুনানে নাসায়ীহাদীস ৪৪৯

ছয়. হাশরের ময়দান

বাইতুল মাকদিসের গুরুত্ব এখান থেকেও বোঝা যায় যেকিয়ামতের দিন এটাই হবে হাশরের ময়দান। হযরত মাইমুনা রা. বলেন

يَا رَسُولَ اللهِ، أَفْتِنَا فِي بَيْتِ الْمَقْدِسِ قَالَ: هُوَ أَرْضُ الْمَحْشَرِ وَأَرْضُ الْمَنْشَرِ ائْتُوهُ فَصَلُّوا فِيهِ...

হে আল্লাহর রাসূল! আমাদেরকে বাইতুল মাকদিস সম্পর্কে বলুন। তিনি বললেন, কিয়ামতের দিন এটা হবে হাশরের ময়দান। এখান থেকে মানুষ নিজ নিজ গন্তব্যের দিকে যাবে। তোমরা এখানে আসো এবং নামায আদায় করো...। মুসনাদে আবু ইয়ালা, হাদীস ৭০৮৮

নুরুদ্দীন হাইছামী রাহ. বলেন

رجاله ثقات.

এই হাদীসের বর্ণনাকারীগণ নির্ভরযোগ্য। মাজমাউয যাওয়ায়েদ ৩/৬৭৫

সাত. যিয়ারতকারীর জন্য বিশেষ দুআ

মসজিদে আকসার একটি বড় ফযীলত হল, হযরত সুলাইমান আ. এই মসজিদ যিয়ারতকারীর জন্য একটি বিশেষ দুআ করেছিলেন। আর স্বয়ং আমাদের নবী এই দুআ কবুল হওয়ার বিষয়ে আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন। আব্দুল্লাহ ইবনে আমর রা. বলেন, রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন

لَمَّا فَرَغَ سُلَيْمَانُ بْنُ دَاودَ مِنْ بِنَاءِ بَيْتِ الْمَقْدِسِ سَأَلَ اللهَ ثَلاَثًا: حُكْمًا يُصَادِفُ حُكْمَه، وَمُلْكًا لاَ يَنْبَغِي لأَحَدٍ مِنْ بَعْدِه، وَأَلاَّ يَأْتِيَ هَذَا الْمَسْجِدَ أَحَدٌ، لاَ يُرِيدُ إِلاَّ الصَّلاَةَ فِيهِ، إِلاَّ خَرَجَ مِنْ ذُنُوبِه كَيَوْم وَلَدَتْهُ أُمُّه.

সুলাইমান ইবনে দাউদ আ. যখন বাইতুল মাকদিস নির্মাণ থেকে ফারেগ হলেন, আল্লাহর কাছে তিনটি দুআ করলেন

১.  তাঁর প্রতিটি ফায়সালা যেন আল্লাহর ফায়সালা মোতাবেক হয়।

২. তাকে যেন এত বড় রাজত্ব দেওয়া হয়, যা তাঁর পরে আর কাউকে দেওয়া হবে না।

৩. একমাত্র নামাযের উদ্দেশ্যে যে ব্যক্তি এই মসজিদে আগমন করবে, আল্লাহ্ যেন তাকে সেদিনের মতো নিষ্পাপ করে দেন, যেদিন তার মা তাকে জন্মদান করেছেন।

নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, প্রথম ও দ্বিতীয় দুআ তো আল্লাহ কবুল করেছেন। আর আমি আশাবাদী আল্লাহ তাঁর তৃতীয় দুআও কবুল করেছেন। সুনানে নাসায়ীহাদীস ৬৯২; সুনানে ইবনে মাজাহহাদীস ১৪০৮

আট. মসজিদে আকসায় নামাযের সওয়াব

মসজিদে হারাম, মসজিদে নববীর পাশাপাশি মসজিদে আকসায় নামায পড়ার সওয়াবও অন্যান্য মসজিদের তুলনায় অনেক গুণ বেশি।

হযরত আবুদ দারদা রা. বলেনরাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন

الصَّلَاةُ فِي الْمَسْجِدِ الْحَرَامِ بِمِائَةِ أَلْفِ صَلَاةٍ وَالصَّلَاةُ فِي مَسْجِدِي بِأَلْفِ صَلَاةٍ وَالصَّلَاةُ فِي بَيْتِ الْمَقْدِسِ بِخَمْسِمِائَةِ صَلَاةٍ.

মসজিদে হারামের নামায এক লক্ষ নামাযের সমতুল্য। আমার মসজিদে (মসজিদে নববীতে) নামায এক হাজার নামাযের সমতুল্য। আর বাইতুল মাকদিসের নামায পাঁচ শ নামাযের সমতুল্য। মুসনাদে বাযযার (কাশফুল আসতার), হাদীস ৪২২; শুআবুল ঈমান, বায়হাকী, হাদীস ৩৮৪৫

নূরুদ্দীন হাইছামী রাহ. বলেন

رواه الطبراني في الكبير ورجاله ثقات، وفي بعضه كلام وهو حديث حسن.

মাজমাউয যাওয়ায়েদ ৩/৬৭৫

নয়. মসজিদে আকসার খেদমতে অংশগ্রহণ

যদি বাইতুল মাকদিস যিয়ারত করা বা মসজিদে আকসায় নামায আদায় করা সম্ভব না হয়, তাহলে যে কোনোভাবে এই মসজিদের খেদমতে অংশগ্রহণের প্রতি উদ্বুদ্ধ করেছেন নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। মাইমুনা রা. বলেন

قُلْنَا: يَا رَسُولَ اللَّهِ فَمَنْ لَمْ يَسْتَطِعْ أَنْ يَتَحَمَّلَ إِلَيْهِ؟ قَالَ: مَنْ لَمْ يَسْتَطِعْ أَنْ يَأْتِيَهُ فَلْيُهْدِ إِلَيْهِ زَيْتًا يُسْرَجُ فِيهِ، فَإِنَّ مَنْ أَهْدَى إِلَيْهِ زَيْتًا كَانَ كَمَنْ قَدْ أَتَاهُ.

আমরা বললাম, হে আল্লাহর রাসূল!  যে ব্যক্তি সরাসরি বাইতুল মাকদিস যিয়ারত করতে সক্ষম না হবে, সে কী করবে?

তিনি বললেন, যে ব্যক্তি এখানে আসার সামর্থ্য রাখবে না, সে যেন এখানের বাতি জ্বালানোর জন্য তেল হাদিয়া পাঠায়। নিশ্চয়ই যে ব্যক্তি তেল হাদিয়া পাঠাবে সে ঐ ব্যক্তির ন্যায় সওয়াবের অধিকারী হবে, যে সরাসরি বাইতুল মাকদিস যিয়ারত করেছে। মুসনাদে আবু ইয়ালা, হাদীস ৭০৮৮; মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ২৭৬২৬

নুরুদ্দীন হাইসামী রাহ. বলেন

رجاله ثقات.

মাজমাউয যাওয়ায়েদ ৩/৬৭৫

১৭ হিজরীতে যখন বাইতুল মাকদিস মুসলমানদের হাতে এল তখন উমর রা. এই মসজিদে নামায পড়েছেন এবং নিজ হাতে ঝাড়ু দিয়েছেন। (দ্র. মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ২৬১)

ইবনে কাসীর রাহ. এই হাদীসের সনদকে হাসানবলেছেন। মুসনাদে ওমর ১/১৬০

দশ. মসজিদে আকসা থেকে ইহরাম বেঁধে উমরা করা

এক পবিত্র ভূখণ্ড থেকে আরেক পবিত্র ভূখণ্ডে সফর করা কতইনা আনন্দ ও সৌভাগ্যের বিষয়। একারণেই হাদীস শরীফে মসজিদে আকসা থেকে ইহরাম বেঁধে উমরাহ করার প্রতি উদ্বুদ্ধ করা হয়েছে। হযরত উম্মে সালামাহ রা. বলেন, রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন

مَنْ أَهَلَّ بِعُمْرَةٍ مِنْ بَيْتِ الْمَقْدِسِ غُفِرَ لَهُ .

যে ব্যক্তি বাইতুল মাকদিস থেকে ইহরাম বেঁধে উমরাহ্ করবে, তার গোনাহগুলো মাফ করে দেওয়া হবে। সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস ৩০০১

ইমাম মুনযীরী রাহ. বলেন

رواه ابن ماجه بإسناد صحيح.

(আততারগীব ওয়াত তারহীব ২/১৮৮)

এগারো. বাইতুল মাকদিসের সান্নিধ্যে বসবাস

পবিত্র ভূখণ্ডের সান্নিধ্যে কিছু সময় যাপন করতে পারাই তো সৌভাগ্যের বিষয়। উপরন্তু বসবাসের জন্য যদি এক টুকরো মাটি পাওয়া যায়, তাহলে এটা তো আরো অনেক বড় প্রাপ্তি। একারণেই হাদীস শরীফে বাইতুল মাকদিসের কাছাকাছি বসবাসের প্রতি উদ্বুদ্ধ করা হয়েছে। আবু যার রা. বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন

وَلَيُوشِكَنَّ أَنْ يَكُونَ لِلرَّجُلِ مِثْلُ شَطَنِ فَرَسِهِ مِنَ الْأَرْضِ حَيْثُ يَرَى مِنْهُ بَيْتَ الْمَقْدِسِ خَيْرٌ لَهُ مِنَ الدُّنْيَا جَمِيعًا...

অচিরেই এমন সময় আসবে, যখন  কোনো ব্যক্তি যদি ঘোড়ার রশি পরিমাণ জায়গাও পেয়ে যায়, যেখান থেকে বাইতুল মাকদিস দেখা যায়, তাহলে এটা তার জন্য সমগ্র দুনিয়া থেকে বেশি উত্তম হবে। মুসতাদরাকে হাকেম ৪/৫০, হাদীস ৮৫৫৩; আলমুজামুল আওসাত, তবারানী, হাদীস ৬৯৭৯, ৮২২৬

নূরুদ্দীন হাইসামী রাহ. মাজমাউয যাওয়ায়েদে (৩/৬৭৬) বলেন

رجاله رجال الصحيح

ইমাম হাকেম রাহ.-ও সহীহ বলেছেন।

বারো. বাইতুল মাকদিসে মৃত্যুর তামান্না

পবিত্র ভূখণ্ডে জীবন অতিবাহিত করার পাশাপাশি মৃত্যুবরণ করাও একজন মুমিনের পরম কাক্সিক্ষত বিষয়। বাইতুল মাকদিস যেহেতু পবিত্রতম স্থান, তাই তো হযরত মূসা আ. এই মাটিতে মৃত্যুর আরজি পেশ করেছিলেন।  রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হযরত মূসা আ.-এর মৃত্যুর ঘটনার বিবরণ দিতে গিয়ে বলেন

فَسَأَلَ اللهَ أَنْ يُدْنِيَهٗ مِنَ الأَرْضِ المُقَدَّسَةِ رَمْيَةً بِحَجَرٍ، قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: فَلَوْ كُنْتُ ثَمَّ لَأَرَيْتُكُمْ قَبْرَهٗ، إِلَى جَانِبِ الطَّرِيقِ، عِنْدَ الكَثِيبِ الأَحْمَرِ.

তিনি আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করলেন, যেন তাঁকে পবিত্র ভূখণ্ডের এত কাছে নিয়ে যাওয়া হয়, যেখান থেকে একটি পাথর নিক্ষেপ করলে পবিত্র ভূখণ্ডে পতিত হবে। যদি আমি সেখানে থাকতাম, তবে লাল টিলার কাছে রাস্তার পাশে আমি তোমাদেরকে তাঁর কবর দেখিয়ে দিতাম। সহীহ বুখারী, হাদীস ১৩৩৯; সহীহ মুসলিম, হাদীস ২৩৭২

এই হাদীসে পবিত্র ভূখণ্ড দ্বারা বাইতুল মাকদিস উদ্দেশ্য করা হয়েছে।

তেরো. আহলে হকের অবস্থানস্থল

বাইতুল মাকদিস এবং আশপাশের অঞ্চলে সর্বদা এমন একটা জামাতের উপস্থিতি থাকবে, যারা সত্যের ওপর প্রতিষ্ঠিত থাকবে। আবু উমামা বাহিলী রা. বলেন, রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন

لَا تَزَالُ طَائِفَةٌ مِنْ أُمَّتِي عَلَى الدِّينِ ظَاهِرِينَ لَعَدُوِّهِمْ قَاهِرِينَ لَا يَضُرُّهُمْ مَنْ خَالَفَهُمْ إِلَّا مَا أَصَابَهُمْ مِنْ لَأْوَاءَ حَتَّى يَأْتِيَهُمْ أَمْرُ اللهِ وَهُمْ كَذَلِكَ. قَالُوا: يَا رَسُولَ اللهِ وَأَيْنَ هُمْ؟ قَالَ: بِبَيْتِ الْمَقْدِسِ وَأَكْنَافِ بَيْتِ الْمَقْدِسِ.

আমার উম্মতের একটি দল সর্বদা সত্যের ওপর অবিচল থাকবে। তাদের দুশমনদের ওপর বিজয়ী থাকবে। তাদের সঙ্গ ত্যাগ করে কেউ তাদের কোনো ক্ষতি করতে পারবে না। অবশেষে আল্লাহর নির্দেশ আসবে আর তারা এভাবেই থেকে যাবে।

সাহাবায়ে কেরাম জিজ্ঞেসা করলেন, এই দলটির অবস্থান কোথায় হবে

তিনি বললেনবাইতুল মাকদিস ও তার আশেপাশে। মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ২২৩২০আলমুজামুল কাবীর, তবারানী, হাদীস ৭৬৪৩

নুরুদ্দীন হাইসামী রাহ. বলেন

رواه عبد الله بن أحمد في المسند وجادة عن خط أبيه، والطبراني، ورجاله ثقات.

অর্থাৎ, এর বর্ণনাকারীগণ সবাই নির্ভরযোগ্য। মাজমাউয যাওয়ায়েদ ৭/৫৬৪

চৌদ্দ. হক-বাতিলের চূড়ান্ত ভাগ্য নির্ধারণী লড়াই

পৃথিবীতে মানব জাতির যাত্রালগ্ন থেকেই শুরু হয়েছে হক ও বাতিলের লড়াই, সত্য ও মিথ্যার সংঘাত। এটা অতীতে ছিল, বর্তমানে আছে এবং ভবিষ্যতেও থাকবে। তবে হক-বাতিলের চূড়ান্ত ভাগ্য নির্ধারণী লড়াই হবে বাইতুল মাকদিস অঞ্চলে। আবু হুরায়রা রা. বলেন, রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন

لَا تَقُومُ السَّاعَةُ حَتَّى يُقَاتِلَ الْمُسْلِمُونَ الْيَهُودَ، فَيَقْتُلُهُمُ الْمُسْلِمُونَ حَتَّى يَخْتَبِئَ الْيَهُودِيُّ مِنْ وَرَاءِ الْحَجَرِ وَالشَّجَرِ، فَيَقُولُ الْحَجَرُ أَوِ الشَّجَرُ: يَا مُسْلِمُ يَا عَبْدَ اللهِ هَذَا يَهُودِيٌّ خَلْفِي، فَتَعَالَ فَاقْتُلْهُ، إِلَّا الْغَرْقَدَ، فَإِنَّهُ مِنْ شَجَرِ الْيَهُودِ.

কিয়ামত কায়েম হবে না, যতক্ষণ না মুসলিমগণ ইহুদীদের সাথে লড়াই করবে আর মুসলিমগণ তাদের হত্যা করবে। এমনকি ইহুদীরা যে পাথর বা গাছের পেছনেই আত্মগোপন করবে, সে পাথর বা গাছও বলে উঠবে, হে মুসলিম! হে আল্লাহর বান্দা! এই যে আমার পেছনে ইহুদী আছে। এসো তাকে হত্যা করো। তবে গারকাদ গাছ কিছু বলবে না; কারণ এটা ইহুদীদের গাছ। সহীহ মুসলিম, হাদীস ২৯২২; সহীহ বুখারী, হাদীস ২৯২৬

ইমাম নববী রাহ.  এই হাদীসের ব্যাখ্যায় বলেন, ‘গারকাদএকধরনের কাঁটাদ্বার গাছ, যা বাইতুল মাকদিসে প্রচুর পরিমাণে হয়। আর সেখানেই দাজ্জাল ও ইহুদী বধের ঘটনা ঘটবে। (দ্র. শরহে মুসলিম, নববী ১৮/৪৫)

উপরের আলোচনা দ্বারা স্পষ্ট হয়ে গেল, আলআকসা বা বাইতুল মাকদিস ইসলামের দৃষ্টিতে কতটা তাৎপর্যপূর্ণ আর মুসলিম উম্মাহ্র জন্য কতই না গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, গোটা মুসলিম উম্মাহ আলআকসার বিষয়ে দায়িত্বহীনতার শিকার হয়ে পড়েছে।

আল্লাহ আমাদের মাফ করুন  এবং আলআকসার মুক্তির জন্য আবারো জেগে ওঠার তাওফীক দান করুন। আমীন, ইয়া রাব্বাল আলামীন। 

 

 

advertisement