শাবান ১৪৪৫   ||   ফেব্রুয়ারি ২০২৪

আমি কি জান্নাতেও সন্তান-পরিবার নিয়ে থাকতে চাই!

মাওলানা মুহাম্মাদুল্লাহ মাসুম

রোজ সকালে জীবন ও জীবিকার তাগিদে যদিও পরিবারের একেক সদস্যকে ছুটে যেতে হয় একেক দিকে, দিনশেষে আবারো এক ঘরে এক ছাদের নিচে বসবাসের জন্যই আমরা ফিরে আসি। প্রবাসে-নিবাসে যে যেখানেই থাকি, কিছুদিন পর পর হলেও সবাই একত্র হওয়ার জন্য ব্যাকুল হয়ে থাকি এবং আনন্দ ভাগাভাগি করে নেওয়ার চেষ্টা করি। কারণ এই আনন্দ অপার্থিব, অতুলনীয়! এতেই মনের তৃপ্তি ও আত্মার প্রশান্তি!

প্রিয় পাঠক! এই পৃথিবী ছেড়ে আমাদের যখন যেতে হবে আখেরাতের স্থায়ী নিবাসে, সেখানেও যদি আল্লাহ আমাদের পরিবার ও সন্তান-সন্ততিদের একত্র করে দেন, জান্নাতে একসাথে থাকার সুযোগ করে দেন, এর চেয়ে বড় সুখের বিষয় আর কী?

তবে তার জন্য সুন্দর কৌশলও বাতলে দেওয়া হয়েছে কুরআন কারীমে। সেটি হল, নিজে পরিপূর্ণ দ্বীন-ঈমানের ওপর চলা, সন্তান ও পরবর্তী প্রজন্মকেও দ্বীন-ঈমানের ওপর গড়ে তোলা এবং সেভাবে রেখে যাওয়ার চেষ্টা করা। সর্বোপরি আমরা যারা পরবর্তী প্রজন্ম, এই নিআমত পাওয়ার জন্য আমাদেরও দ্বীন-ঈমানের ক্ষেত্রে পূর্বসূরিদের অনুসরণ করতে থাকা। তবে পাওয়া যাবে জান্নাতের এই মহা নিআমত। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন

وَ الَّذِیْنَ اٰمَنُوْا وَ اتَّبَعَتْهُمْ ذُرِّیَّتُهُمْ بِاِیْمَانٍ اَلْحَقْنَا بِهِمْ ذُرِّیَّتَهُمْ وَ مَاۤ اَلَتْنٰهُمْ مِّنْ عَمَلِهِمْ مِّنْ شَیْءٍ.

যারা ঈমান এনেছে এবং সন্তান-সন্ততিগণ ঈমানের ক্ষেত্রে তাদের অনুসরণ করেছে, আমি তাদের সন্তান-সন্ততিকে তাদের সঙ্গে মিলিত করব এবং তাদের কর্ম হতে কিছুমাত্র হ্রাস করব না। সূরা তূর (৫২) : ২১

আয়াতের অর্থ ও মর্ম খুবই স্পষ্ট। নেককারদের সন্তান-সন্ততি যদি ঈমান ও আমলে সালেহের অধিকারী হয়, আল্লাহ তাআলা পিতা-মাতাকে খুশি করার জন্য সন্তানদেরকেও তাদের সাথে যুক্ত করে দেবেন, সন্তানদেরকে সেই স্তরে পৌঁছে দেবেন। যদি আমলের মাধ্যমে তারা পিতা-মাতার মতো জান্নাতের উচ্চ স্তর লাভ করতে নাও পারে, তবুও চক্ষু শীতলের জন্য তাদেরকে পিতা-মাতার পাশে রাখা হবে। এক্ষেত্রে পিতা-মাতা বা পূর্বসূরির স্তর বিন্দুমাত্র কমানো হবে না। বরং তাঁদের মর্যাদা ও স্তর যথাস্থানেই থাকবে। (দ্র. তাফসীরে ইবনে কাসীর ৭/৪৩২; মাজমাউয যাওয়ায়েদ, হাদীস ১১৩৭০; কাশফুল আসতার, হাদীস ২২৬০)

এ আয়াতে আমাদের জন্য রয়েছে বহুমুখী শিক্ষা।

প্রথমত, নিজে পরিপূর্ণ দ্বীন-ঈমানের ওপর চলা, সন্তান-সন্ততি ও পরবর্তী প্রজন্মকেও তার ওপর গড়ে তোলা এবং সেভাবে রেখে যাওয়ার চেষ্টা করা। দ্বিতীয়ত, আমরা যারা পরবর্তী প্রজন্ম, এই নিআমত পাওয়ার জন্য দ্বীন-ঈমানের ক্ষেত্রে পূর্বসূরিদের পুরোমাত্রায় অনুসরণ করতে থাকা। ঈমান-আমলের মাধ্যমে পিতা-মাতা ও পূর্বসূরিদের অনুসরণ করে যাওয়া, যেন তাদের সঙ্গে জান্নাতে থাকা যায়।

আরেকটি বিষয় হল, মা-বাবার নেক আমলের কল্যাণ যেমন সন্তানেরা লাভ করে, তেমনি সন্তানদের আমলের কল্যাণও মা-বাবা লাভ করবেন।

আল্লামা ইবনে কাসীর রাহ. এই প্রসঙ্গে বলেন, আর পূর্ববর্তীদের জন্যও রয়েছে আল্লাহ তাআলার দান ও করুণা। সেটি হবে পরবর্তী প্রজন্মের দুআর মাধ্যমে।

এক হাদীসে এসেছে

إِنَّ اللهَ لَيَرْفَعُ الدَّرَجَةَ لِلْعَبْدِ الصَّالِحِ فِي الْجَنَّةِ فَيَقُولُ: يَا رَبِّ، أَنَّى لِي هَذِهِ؟ فَيَقُولُ: بِاسْتِغْفَارِ وَلَدِكَ لَكَ.

قال العراقي في المغني عن حمل الأسفار : رَوَاهُ أَحْمد بِإِسْنَاد حسن.

وقال البوصري: هذا إسناد صحيح، رجاله ثقات.

আল্লাহ তাআলা জান্নাতে অবশ্যই সালেহ ও নেককার বান্দাদের মর্যাদা বৃদ্ধি করবেন। বান্দা বলবে, আল্লাহ, আমার জন্য এসব কোত্থেকে এল? আল্লাহ তাআলা বলবেন, তোমার জন্য তোমার সন্তানদের দুআর মাধ্যমে। মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা, হাদীস ৩০৩৫৯; মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ১০৬১০; সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস ৩৬৬০

বলার অপেক্ষা রাখে না, পরকালে পূর্বসূরিদের মর্যাদায় কাছাকাছি বা পাশাপাশি থাকার জন্য ঈমান যেমন আনতে হবে, নেক আমল ও শরীয়ত পরিপালনের মাধ্যমে তাঁদের অনুসরণও করতে হবে। নতুবা কেবল বাপ-দাদার নেককার ও আমলদার হওয়ার কারণে পরবর্তী বংশধরেরা পার পাবে না। রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করে ইরশাদ করেন

وَمَنْ بَطَّأَ بِه عَمَلُه، لَمْ يُسْرِعْ بِه نَسَبُه.

আর যার আমল তাকে পিছিয়ে দিল, বংশমর্যাদা তাকে অগ্রসর করতে পারবে না। সহীহ মুসলিম, হাদীস ২৬৯৯

ইমাম নববী রাহ. বলেন, কাজেই বংশমর্যাদা ও বাপ-দাদার ঐতিহ্যের ওপর ভরসা করে বসে না থেকে নিজে আমলের প্রতি বেশি মনোযোগী হওয়া কাম্য। শরহু মুসলিম, নববী ১৭/২৩

তাই আসুন, নিজে ঈমান-আমলের রঙে রঙিন হই এবং পরিবার ও পরবর্তী প্রজন্মকেও সে রঙে রঙিন করি। 

 

 

advertisement