রবিউল আখির ১৪৪৫   ||   নভেম্বর ২০২৩

আমেরিকা-ইসরাইলের জুলুমের প্রতিবাদে পদত্যাগ
‘আমি পদত্যাগ করলাম, কারণ এই পররাষ্ট্র দপ্তর আমার চেনা সেই পররাষ্ট্র দপ্তর নয়’

জশ পল

[জশ পল মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের ব্যুরো অব পলিটিক্যাল-মিলিটারি অ্যাফেয়ার্সের সাবেক পরিচালক। সম্প্রতি তিনি ইসরাইলে অস্ত্র পাঠানোর বিষয়ে বাইডেন প্রশাসনের অন্ধ নীতির প্রতিবাদে চাকরি ছাড়েন। গত ২৩ অক্টোবর তিনি ওয়াশিংটন পোস্টের এক নিবন্ধে চাকরি ছাড়ার কারণ ব্যাখ্যা করেছেন।

নিবন্ধটি আমেরিকা-ইসরাইলের জুলুম ও বর্বতার একটি সাক্ষী ও দলীল। সেইসাথে এতে ফুটে উঠেছে- আমেরিকা তথা বাইডেন প্রসাশন কোনো নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করে কেমন নির্লজ্জতার সাথে ফিলিস্তিনী জনসাধারণকে হত্যায় সহযোগিতা করছে।

আলকাউসারের পাঠকদের জন্য নিবন্ধটির বাংলা অনুবাদ পেশ করা হল।

ইংরেজি থেকে অনুবাদ করেছেন : মাওলানা এনাম হাসান জুনায়েদ]

 

মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের ব্যুরো অব পলিটিক্যাল-মিলিটারি অ্যাফেয়ার্সে আমি এক দশকের বেশি সময় ধরে কাজ করেছি। বিভাগটির দায়িত্ব বহির্বিশ্বে যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্র স্থানান্তর ও নিরাপত্তা সহায়তার বিষয়টি দেখাশোনা করা। এ বিভাগে দায়িত্ব পালনকালে বিভিন্ন দেশে অস্ত্র পাঠানো নিয়ে অনেক জটিল ও নৈতিকভাবে চ্যালেঞ্জিং নানা বিতর্কের মধ্যে আমি যুক্ত ছিলাম। কিন্তু এই প্রথম চলতি মাসে আমি দেখলাম, জটিল ও নৈতিকভাবে চ্যালেঞ্জিং অস্ত্র হস্তান্তর প্রক্রিয়া চলছে, অথচ কোনো আলোচনা বা বিতর্ক নেই। এ কারণে গত সপ্তাহে আমি পদত্যাগ করেছি।

অসলো চুক্তি স্বাক্ষরের পর থেকে ইসরাইলে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক সহযোগিতার মূল ভিত্তি ছিল শান্তির জন্য নিরাপত্তা। অর্থাৎ ইসরাইল যাতে নিরাপদ অনুভব করতে পারে, সেজন্য প্রতি বছর শত শত কোটি ডলারের মার্কিন অস্ত্র সহায়তা দেশটিকে দেওয়া হবে। পাশাপাশি  ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য কিছু ছাড় দেওয়ার মানসিকতা তৈরি করবে। (পররাষ্ট্র দপ্তরের মার্কিন নিরাপত্তা সমন্বয়কের এটি একটি মৌলিক কাজ। রামাল্লায় এক বছর অবস্থানকালে আমি এ কাজ করেছিলাম।)

কিন্তু ইসরাইলের অতীত কর্মকাণ্ড বলছে, যুক্তরাষ্ট্রের সরবরাহ করা অস্ত্র ইসরাইলকে শান্তির পথে আনতে ব্যর্থ; বরং তারা পশ্চিম তীরে ফিলিস্তিনী ভূখণ্ড দখল করে বসতি স্থাপন করেই যাচ্ছে। যা ক্রমশ ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সম্ভাবনাকে ক্ষীণ করে দিচ্ছে। সেই সাথে তারা ঘনবসতিপূর্ণ গাজা উপত্যকায় নির্বিচার বোমাবর্ষণ করে সাধারণ মানুষকে হত্যা করছে, শারীরিক বা মানসিকভাবে পঙ্গু করে দিচ্ছে।

৭ অক্টোবর হামাস যখন ইসরাইলে হামলা চালায় তখন আমি ঘটনার ভয়াবহতা এবং পরে কী ঘটতে যাচ্ছে, সেটা ভেবে অস্থির হয়ে পড়লাম। ইসরাইলের নিজের আত্মরক্ষার অধিকার রয়েছে; কিন্তু গত ১৫ বছরের আধা ডজনের অধিক সংঘাতের রেকর্ড বলছে, ইসরাইলের এই আত্মরক্ষার প্রক্রিয়ায় এবারও হাজার হাজার ফিলিস্তিনী বেসামরিক নাগরিক নিহত হবে।

এব্যাপারে আমি যথেষ্ট নিশ্চিত ছিলাম। ইতিমধ্যে নানা ধরনের অস্ত্রসহ গোলাবারুদের জন্য ইসরাইলের অনুরোধ আসা শুরু হয়ে গেল। তারা এমন এমন অস্ত্রের জন্য অনুরোধ জানাতে লাগল, যা এ সংঘাতে ব্যবহারযোগ্য নয়। ইসরাইলের এসব অনুরোধের ব্যাপারে আমি খোলামনে আলোচনার আহ্বান জানাই। কিন্তু আমার আহ্বানে কোনো সাড়া পেলাম না। উল্টো পরিষ্কার নির্দেশনা এল- আমাদের যত দ্রুত সম্ভব ইসরাইলের অনুরোধ রক্ষায় কাজ করতে হবে।

সম্প্রতি যে কংগ্রেস মানবাধিকার লঙ্ঘনের রেকর্ড বিবেচনায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সরকারের কাছে অস্ত্র বিক্রি আটকে দিয়েছিল, সেই কংগ্রেসই যত দ্রুত সম্ভব ইসরাইলের দাবি পূরণ করতে এখন আমাদের ওপর চাপ দিচ্ছে।

যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্র কোনো বেসামরিক নাগরিককে হত্যায় ব্যবহার হবে না’- এ নীতি আমার চাকরিকালে গত চার মার্কিন প্রেসিডেন্টের আমলে কোনো বিতর্কিত বিষয় ছিল না। ২০০৪ থেকে ২০০৬ সাল আমি ইরাকে নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠার কাজে সহায়তা করেছিলাম। 

চলতি বছরের শুরুর দিকে বেসামরিক নাগরিকদের সুরক্ষায় বাইডেন প্রশাসন এই নীতিকে শক্তিশালী করতে কিছু উদ্যোগ গ্রহণ করে। বাইডেন প্রশাসন নতুন একটি অস্ত্র স্থানান্তর নীতি প্রণয়ন করে, যাতে বলা হয়, মানবাধিকার লঙ্ঘনের কাজে ব্যবহারের আশঙ্কাথাকলে অস্ত্র স্থানান্তর করা যাবে না। গত আগস্টে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তর বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অবস্থিত মার্কিন দূতাবাসে সিভিলিয়ান হার্ম ইনসিডেন্ট রেসপন্স গাইডেন্স’ (সিএইচআইআরজি) সম্পর্কে প্রজ্ঞাপন জারি করে। মার্কিন অস্ত্রের আঘাতে সাধারণ নাগরিকের মৃত্যুর এক ঘটনাকে কেন্দ্র করে এই নীতিমালা তৈরি করা হয়। এতে মার্কিন অস্ত্রের ব্যবহারে যাতে কোনো বেসামরিক নাগরিকের ক্ষতি না হয়, সেটা নিশ্চিত করতে বলা হয়। কিন্তু এখানে তো পরিষ্কারভাবেই ঝুঁকি রয়ে গেল যে, ইসরাইলকে সরবরাহ করা মার্কিন অস্ত্র, বিশেষ করে আকাশ থেকে ভূমিতে ক্ষেপণযোগ্য গোলাবারুদ বেসামরিক নাগরিকের ক্ষতি করবে এবং মানবাধিকার লঙ্ঘিত হবে। কিন্তু পররাষ্ট্র দপ্তর এ ঝুঁকি নিয়ে কোনো ধরনের বিতর্কে প্রস্তুত নয়। এমনকি সিএইচআইআরজি প্রকাশের প্রক্রিয়াও আটকে দেওয়া হয়।

অন্তত আমার অভিজ্ঞতায়, ইসরাইলকে অস্ত্র সরবরাহের এই সিদ্ধান্ত আমাদের দেশের আইন প্রণয়নে মানবিক পরিণতি উপেক্ষা করার এক নজিরবিহীন দৃষ্টান্ত।

মানবাধিকারসংশ্লিষ্ট বিষয় এবং আমাদের অংশীদারদের অনুরোধ- আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে দুটি বিষয়কে সমন্বয় করা- মানসম্মত অস্ত্র স্থানান্তর প্রক্রিয়ার অংশ। এ ধরনের পরিস্থিতিতে অনেক ভালো ভালো লোক মার্কিন আইন, নীতি ও মানবিক বিচারবোধ সামনে রেখে আলোচনা ও বিতর্কের মাধ্যমে রাষ্ট্রকে সহযোগিতা করেন। বলা বাহুল্য, এ ধরনের প্রক্রিয়া মার্কিন জনগণের জন্য গর্বের।

অস্ত্রবাণিজ্যের স্লোগান এটা নয় যে,  ‘সর্বাগ্রে, কোনো ক্ষতি করো না।বরং  যতটা সম্ভব কম ক্ষতির ব্যাপারে সর্বোচ্চ চেষ্টা থাকতে হবে। ইউক্রেনে ক্লাস্টার বা গুচ্ছ বোমা পাঠানোর বিষয়ে পররাষ্ট্র দপ্তরে ব্যাপক বিতর্ক হয়েছিল। ওই বিতর্ক প্রমাণ করে, সংকটকালেও আলোচনার মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নেওয়া সম্ভব।

ইসরাইলের প্রসঙ্গ এলেই বিতর্ক ও আলোচনায় আমাদের যে অনীহা- এটা কিন্তু একথার প্রমাণ বহন করে না যে, ইসরাইলের নিরাপত্তায় আমরা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। বরং এটা একথার প্রমাণ বহন করে যে, আমরা এমন এক পলিসির প্রতি প্রতিজ্ঞাবদ্ধ, যা কোনো সমাধানের দিকে নিয়ে যায় না। এটা একথার প্রমাণ বহন করে যে, আমরা আমাদের মূল্যবোধকে পরিত্যাগ করতে আগ্রহী। এবং এটা একথার প্রমাণ বহন করে যে, রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের জন্য আমরা গাজার লাখ লাখ মানুষের দুর্দশাকে উপেক্ষা করছি।

এই পররাষ্ট্র দপ্তর আমার চেনা সেই পররাষ্ট্র দপ্তর নয়। তাই আমি বাধ্য হয়ে চাকরি ছেড়ে দিয়েছি।

 

পুনশ্চ : বলে রাখা ভালো, পদত্যাগকারী এই মার্কিন কর্মকর্তা যাই বলুন না কেন যুগ যুগ থেকে মুসলিম দেশগুলো এবং বিশ্বের বিভিন্ন দেশের নিরীহ ও মজলুম মুসলমানদের ক্ষেত্রে আমেরিকার নীতি বরাবরই একপেশে ছিল। তাদের মানবাধিকার, অস্ত্রনীতি, যুদ্ধনীতি- সবই মুসলমানদের স্বার্থের সামনে আসলে অকার্যকর হয়ে যায়। আবার মুসলিমদের বিরুদ্ধে ব্যবহারের জন্য দ্রুত সচল হয়ে ওঠে। তবুও বাইডেন প্রশাসনের ইসরাইল তোষণের অতি একপেশে তৎপরতা হয়তো তার পররাষ্ট্র দপ্তরের ঐ পদত্যাগী কর্মকর্তার কাছেও বেশি বেখাপ্পা লেগেছে। তিনি সহ্য করতে না পেরে চাকরী ছেড়ে দিয়েছেন। -সম্পাদক

 

 

advertisement