রবিউল আউয়াল ১৪৪৫   ||   অক্টোবর ২০২৩

দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধগতি
এ দুঃসময়ে দরকার ব্যাপক সরকারি পদক্ষেপ

দ্রব্যমূল্য ক্রমেই আমজনতার নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে। মধ্যবিত্তের একরকম সমস্যা, নিম্নবিত্তের আরেক রকম সমস্যা। বাচ্চাদের মাদরাসা-স্কুল ফি, বাসা ভাড়া, বিদ্যুৎ বিল, গ্যাস সিলিন্ডার ও নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য কিনতে গিয়ে নাভিশ্বাস উঠছে সকলের।

অন্যদিকে বিজ্ঞমহলের মতে দেশের সার্বিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি স্মরণকালের ভয়াবহ খারাপ অবস্থায় রয়েছে। যতই দিন যাচ্ছে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভও কমছে। সৎ ব্যবসায়ীরা আছেন চরম চাপ ও কষ্টে। একশ্রেণির বাড়তি সুবিধাভোগী গুটিকতেক ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট (খোদ বাণিজ্যমন্ত্রীর ভাষায়) নিয়ন্ত্রণ করছে নিত্যপণ্যের পুরো বাজার। ভাবে বোঝা যায় তাদের কাছে সরকারও জিম্মি। অর্থাৎ তারা ক্ষমতাবানদের চেয়েও বড় ক্ষমতাবান। সকল ধরা-ছোঁয়ার বাইরে। এমতাবস্থায় আমজনতার কাহিল অবস্থা দেখার মনে হয় কেউ নেই। ক্ষমতাসীনেরা বিভিন্নভাবে প্রায় দেড় দশক ধরে ক্ষমতার স্বাদ ভোগ করছে। তবুও তাদের পেট ভরছে না। তারা দেশ-বিদেশে দৌড়ঝাঁপ দিচ্ছেন অনন্তকাল ক্ষমতায় টিকে থাকতে। অন্যদিকে বিরোধী দলগুলোর দৌড়ঝাঁপÑ ভবিষ্যতে তারা কীভাবে ক্ষমতায় আসবে তা নিয়ে। তাহলে জনগণকে দেখবে কে?

এ দুঃসময়ে দরকার ব্যাপক সরকারি পদক্ষেপ। সকল বড় বড় উন্নয়ন প্রকল্প স্থগিত রেখে নজর দেওয়া দরকার গণমানুষের ডাল-ভাত ও নিত্যপণ্য জোগান দেওয়ার দিকে। যে পর্যন্ত নিত্যপণ্যের বাজার গণমানুষের ক্রয় ক্ষমতার মধ্যে না আসবে, তত দিন টিসিবিকে সক্রিয় করে দেশব্যাপী বড় বড় স্টোর খুলে ন্যায্যমূল্যে অথবা ভর্তুকিমূল্যে নিত্যপণ্য বিক্রি করতে হবে সাধারণ মানুষের কাছে। শুধু ট্রাকের বিক্রি যথেষ্ট নয়।

মনে রাখতে হবে, যে যত কৌশলই খাটাক, একদিন ক্ষমতা থেকে, এমনকি দুনিয়া থেকেও বিদায় নিতে হবে। তাই ক্ষমতা চলে যাওয়া বা দুনিয়া থেকে চির বিদায় নেওয়ার পরের চিন্তা আগে করাই সকলের জন্য কল্যাণকর ও বুদ্ধিমানের কাজ বলে বিবেচিত হবে।

আল্লাহ তাআলা আমাদের প্রিয় মাতৃভূমিকে হেফাযত করুন। মানুষের জান-মাল-ইজ্জত রক্ষা করুন এবং অসহায় মানুষের সহায় হোন।

 

পুলিশ ছাত্রলীগ একে অপরকে নির্যাতন

একটি সভ্য দেশের জন্য চরম লজ্জা ও কলঙ্কের

পোশাকি পুলিশ কর্তৃক নিরীহ লোকের ওপর অত্যাচার-নির্যাতন এবং সরকারি দলের ছাত্র সংগঠন, যুব সংগঠন বিশেষত ছাত্রলীগ যুবলীগ কর্তৃক হরেক শ্রেণির লোকদের ওপর আধিপত্য বিস্তার, প্রভাব খাটানো ও মারপিটের অভিযোগ তো এদেশে নতুন নয়। কিন্তু চলতি মাসে একটি ঘটনা দেশব্যাপী বরং বিশ্ব মিডিয়াতেও আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। মিডিয়ার ভাষায়Ñ

ছাত্রলীগের দুই কেন্দ্রীয় নেতাকে ধরে নিয়ে নির্মমভাবে মারধর করা হয়েছে রাজধানীর শাহবাগ থানায়। আরেকজন কেন্দ্রীয় নেতা তাঁদের খোঁজ নিতে গেলে তাঁকেও মারধর করা হয়।

ভুক্তভোগী ছাত্রলীগ নেতাদের অভিযোগ, শাহবাগ থানার ওসির (তদন্ত) কক্ষে গত শনিবার রাতে এই মারধরে নেতৃত্ব দিয়েছেন পুলিশের রমনা বিভাগের অতিরিক্ত উপকমিশনার (এডিসি) হারুন অর রশিদ। একপর্যায়ে ছাত্রলীগের অন্য নেতা-কর্মীরা গিয়ে থানা থেকে আক্রান্ত নেতাদের উদ্ধার করেন।

শাহবাগ থানায় ছাত্রলীগ নেতা আনোয়ার ও শরিফকে এডিসি হারুনের নেতৃত্বে বেদম মারধর করা হয় বলে জানান নেতা-কর্মীরা। এর মধ্যে আনোয়ারের আঘাত গুরুতর। তাঁর বেশ কয়েকটি দাঁত ভেঙে গেছে। তিনি ঢাকার একটি বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। অন্যদিকে শরিফ প্রাথমিক চিকিৎসা নিয়ে হলে ফিরে গেছেন। ভুক্তভোগী নেতাদের অভিযোগ, রাষ্ট্রপতির সহকারী একান্ত সচিব (এপিএস) আজিজুল হকের সঙ্গে ব্যক্তিগত বিষয় নিয়ে ঘটনার জেরে এডিসি হারুন এ ঘটনা ঘটিয়েছেন। ছাত্রলীগ নেতাদের ডেকে নিয়ে গিয়েছিলেন আজিজুল হক।

এভাবে ব্যক্তিগত আক্রোশে কাউকে থানায় নিয়ে যাওয়া এবং ওসির (তদন্ত) কক্ষে বেদম মারধর করার এই ঘটনায় পুলিশি ক্ষমতার অপব্যবহার নিয়ে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, ক্ষমতাসীন দলের ভ্রাতৃপ্রতিম ছাত্রসংগঠনের কেন্দ্রীয় নেতাদের সঙ্গে যদি এমন আচরণ করা হয়, তাহলে সাধারণ মানুষ ও বিরোধী রাজনৈতিক দলের কর্মীদের সঙ্গে পুলিশ কী আচরণ করতে পারে, তা সহজেই অনুমেয়।Ñপ্রথম আলো ১১ সেপ্টেম্বর ২০২৩

সাদা চোখে দেখলে মানুষ মনে করবে, এ তো সাধারণ ঘটনা। এ ধরনের ঘটনা তো ঘটতেই থাকে। কিন্তু এ ধরনের ঘটনা একটি সভ্য সমাজ ও রাষ্ট্রকে কতটা কলঙ্কিত করে, যখন আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর দায়িত্বশীল ও ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠনের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব অনেকটা প্রকাশ্যেÑ সম্ভবত নারী জনিত বিষয়েÑ মারামারিতে জড়িয়ে পড়ে। একে অন্যের দাঁত ভেঙে ফেলে। আবার সে ভাঙা দাঁতের ছবি প্রকাশ করে। মিডিয়া সেই ঘটনা নিয়ে মাতামাতি করে। কতই না ভালো হত, সাধারণ মানুষ যদি এসব বিষয় না জানত। তারা নিজেরা নিজেরা মারামারি করে চুপচাপ থাকত। কিন্তু এ কলঙ্কজনক অধ্যায়ও জাতিকে দেখতে হয়েছে।

প্রশ্ন হচ্ছে, কেন এমন ঘটনা ঘটছে? পুলিশের কাজ কি সাধারণ মানুষকে থানায় নিয়ে মারপিট করা? পুলিশ-আইনে কি এটা লেখা আছে? কারো বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ থাকলে তাকে গ্রেফতার করে ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে নিয়ে যেতে পারে। এরপর আসামীর যা বিচার হবার হবে। কিন্তু এ দেশে তো অনেক সময় পুলিশ নিজেই বিচার করে ফেলে। পুলিশ যখন বিচারের দায়িত্ব নিয়ে নেয় এবং পুলিশকে বিরোধীদেরকে ইচ্ছেমতো পেটানোর সুযোগ দেওয়া হয়, পুলিশ রাস্তাঘাটে জনগণকে প্রকাশ্যে মারে, তাহলে পুলিশের হাত তো কচলাতে থাকবেই এবং মারপিটে অভ্যস্ত হবেই। এখন সেটাই ঘটছে।

রাশিয়ার কথাই ধরুন। ভাড়াটে বাহিনী দিয়ে বিভিন্ন দেশে আক্রমণ করেছে। তাদের নৃশংসতা প্রবাদে পরিণত হয়েছে। সে ভাড়াটে বাহিনীই রাশিয়ার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছে। যারা রাষ্ট্রের টাকায়, জনগণের টাকায় ভিন্নমত দমনে বিভিন্ন বাহিনী লালন-পালন করে, নিশ্চিতভাবেই কখনো না কখনো সে বাহিনী তাদের বিরুদ্ধেও যাবে।

একসময় ছাত্রসংগঠনগুলো সামনে এসেছিল ছাত্রদের মাঝে সভ্যতা ও সংস্কৃতির বিকাশ ঘটাতে, পড়াশোনার পরিবেশ উন্নত করতে, কোনো অন্যায় অবিচার হলে শান্তিপূর্ণ প্রতিকার করতে। এগুলো ছিল তাদের কাজ। কিন্তু আজকের ছাত্র সংগঠনগুলো কোথায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে? ছাত্র সংগঠনগুলোকে মানুষ কীভাবে চেনে? এটা কি ছাত্রসংগঠনগুলোর দোষ। ছাত্ররা কি নিজেরাই এ পর্যায়ে নেমে এসেছে? আমরা দেখি, দলীয় বড় বড় সমাবেশগুলোতে প্রধান প্রধান নেতারা ঘোষণা করেন, অমুককে দমানোর জন্য, তমুককে শেষ করার জন্য ছাত্রলীগই যথেষ্ট।

এগুলোকে তাঁরা ভালো কাজ মনে করছেন। কিন্তু এ ধরনের কর্মকাণ্ড আমাদেরকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে। এসব মানসিকতার ছেলেরাই যখন প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরে যাচ্ছে, তখন পুরোনো অভ্যাস ছাড়তে পারছে না। কিল-ঘুসির পুরোনো অভ্যাস  অব্যাহত রাখছে। নাহলে রাষ্ট্রের প্রধান অভিভাবক রাষ্ট্রপতির একজন এপিএস কী করে দলবল নিয়ে পুলিশের সাথে ঝগড়ার জন্য তেড়ে যেতে পারে। তার যদি স্ত্রীর বিষয়ে কারো বিরুদ্ধে অভিযোগ থাকে, তাহলে তো আইনগত ব্যবস্থা নিতে পারেন। রাষ্ট্রপতির এপিএসের জন্য তো এটা কোনো ব্যাপারই না। তিনি তৎক্ষণাৎই তো রাষ্ট্রপতি বা রাষ্ট্রপতির অফিসের মাধ্যমে ব্যবস্থা নিতে পারতেন। কোনো আইনি ব্যবস্থা না নিয়ে মারামারি করতে যান কেন? কারণ, সেই পুরোনো অভ্যাস ছাড়তে পারেননি। সুতরাং শুধু ক্ষমতাবানেরাই না, সমাজের সকল স্তরের লোকদেরই সতর্ক থাকা দরকার।

মনে রাখা দরকার, অনিয়মতান্ত্রিকভাবে যখন কোনো ভুল কাজ করব, অন্যকে দমানোর চিন্তা করবÑ সেটা অনেক সময় আমার পথের কাঁটাও হতে পারে। সে কূপে আমি নিজেও একদিন নিপতিত হতে পারি। এ ব্যাপারে সতর্ক না হলে জাতিরই শুধু ক্ষতি হবে না; যারা এসব করবে তারাও যে এর মধ্যে পড়বেÑ ঘটে যাওয়া এ ঘটনা এর সামান্য একটি উদাহরণ মাত্র।

 

 

advertisement