সফর ১৪৪৫   ||   সেপ্টেম্বর ২০২৩

রঙিন চশমায় দেখা পৃথিবী

ওয়ালিউল্লাহ আব্দুল জলীল

জীবন কেমন অদ্ভুত- যখন কথা ফুরিয়ে যায় তখন মানুষ কথা বলতে চায়। যখন কলম থেমে যায় তখন লেখার তাকাযা আসে। সযত্নে রাখা লাল রঙের কালো কালির কলমটিও হাতে নিয়ে দেখি, নিব খুলে গেছে। এদিকে অযত্নে পড়ে থাকা কলমটাই সঙ্গ দেয় লেখার।

এত এত সংবাদ মাধ্যম, এত সহজলভ্য যোগাযোগ মাধ্যম- কোনো কিছুই চিত্তের প্রশান্তিদায়ক সংবাদ নিয়ে আসে না। না দেশের সংবাদ, না বিদেশের- কোথাও কোনো সুসংবাদ নেই। সংবাদের ওপর ভিত্তি করে তৈরি হওয়া সম্পাদকীয়, উপসম্পাদকীয় আর মতামত সবই নানান চশমায় দেখা। পৃথিবীটাকে বাস্তবতার আয়নায় দেখার চেয়ে সংবাদ মাধ্যমের কর্মীরা রঙিন চশমায় দেখেই তৃপ্তি পায়। একশ্রেণির পাঠকও রঙিন চশমায় জগৎ দেখতে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছেন। সেই রঙিন চশমা ভিন্ন সমাজের, ভিন্ন ধর্মের, ভিন্ন সংস্কৃতির, ভিন্ন দেশের।

যে কারণে আজ কথা ফুরিয়ে যাওয়ার কথা মনে পড়ল, কলমও চলতে না চাওয়ার বিষয়টি এল আর মনের মাঝে খোঁচাতে লাগল- কিছু মানুষের রঙিন চশমার জগৎ দেখার কথা- তা হল, মুসলিম উম্মাহ একদেহ একপ্রাণ হওয়ার সুবাদে যেকোনো প্রান্তে কোনো মুসলমানের বেদনা গোটা মুসলিম উম্মাহর বেদনা; কোনো মুসলমানের সুখ গোটা মুসলিম উম্মাহরই সুখ। উম্মাহর বড় একটা অংশ এ নীতি বিস্মৃত হয়েছে বহু আগেই। খেলাফতের পতন থেকে ধরলে শত বছর। বৃটিশ উপনিবেশ আমল থেকে ধরলে দু-আড়াই শ বছর। এ নীতি-বিস্মৃত জীবনে তারা চোখে পরেছে বিজাতীয় চশমা। তাই তারা যেমন কোনো মুসলিমের আনন্দ-বেদনা অনুভব করে না, তেমনি তাদেরকে খোঁচা দিয়ে দেখিয়ে দিলেও নিপীড়িত মুসলিম দেশ ও জনতাকে দেখে না। এমনকি তারা রঙিন চশমাদাতাদের চেয়ে আগবাড়িয়ে মুসলমানদের জখমে নুনের ছিটা দেয়, মুসলমানদের জয়কে পরাজয়ে পর্যবসিত বলে দেখানোর চেষ্টা করে। ক্ষেত্রবিশেষে জয়কে পরাজয়ে রূপান্তর করতে উঠে-পড়ে লাগে। এমন অনেক ঘটনাই পৃথিবীব্যাপী ঘটে চলেছে।

গত পনেরো আগস্ট ছিল আফগানিস্তানে আমেরিকা মিত্রবাহিনীর পরাজয়ের দ্বিতীয় বর্ষপূর্তি। সার্বিক বিচারে এ ঘটনাটি পৃথিবীর ইতিহাসের পাতায় ঘটা অল্প কিছু ঘটনার একটি। পরাজিত করে সুপার পাওয়ার আমেরিকাকে। দীর্ঘ দুই দশকের জুলুম-নীপিড়ন ও গণহত্যার অবসান ঘটে। এই ঘটনায় অনেক মানবিক অমুসলিমও স্বস্তি প্রকাশ করে। কিন্তু নামধারী কিছু মুসলমান এ বিজয় মেনে নিতে পারেনি। দু বছর আগে আগস্টের দিনগুলোতে অফিসে বসে দীর্ঘ জুলুম নিপীড়ন অবসানের সংবাদ নানান মাধ্যমে পাচ্ছিলাম আর খোদার দরবারে শুকরিয়া আদায় করছিলাম। দেখতে না দেখতেই তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়ল জুলুমের প্রাসাদ। এ যেন কুরআনের বাণীর প্রতিচ্ছবি-

وَ اِنَّ اَوْهَنَ الْبُيُوْتِ لَبَيْتُ الْعَنْكَبُوْتِ.

নিশ্চয়ই ঘরের মধ্যে সর্বাপেক্ষা দুর্বল মাকড়সার ঘরই হয়ে থাকে। -সূরা আনকাবূত (২৯) : ৪১

দিনগুলো ছিল বড়ই আনন্দের। বিজয়ের সংবাদ রক্তের প্রতিটি কণায় চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছে। প্রতিটি মুহূর্তে মনদিল ভরে আসছিল। অবুঝ দিনের দুআ কবুল হতে দেখে আনন্দে বাকরুদ্ধ হয়েছিলাম।

আমার কৈশোরের শুরুতে হামলা শুরু হয়েছিল আফগানিস্তানে। বিনিদ্র রজনীগুলো কেটেছিল মাদরাসায় ছটফট করে। রাজপথ কাঁপানো কত মিছিলে যোগ দিয়েছি দিনের পর দিন। শুক্রবারগুলো শ্লোগানে শ্লোগানে প্রকম্পিত হত ঢাকার রাজপথ। ফরিদাবাদ মাদরাসা মসজিদে ইমাম সাহেব কুনূতে নাযেলা পড়তেন। তখনকার দুআগুলো একপর্যায়ে আহাজারিতে রূপ নিত। সেই কান্নার সুফল আজ দেখা যাচ্ছে। আফগান জাতি লিখে চলেছে রক্ত দিয়ে পৃথিবী কাঁপানো এক ইতিহাস।

আফগানদের এমন এক বিজয়ের সময় এদেশের অধিকাংশ পত্র-পত্রিকার চেহারা দেখলে মনে হত, এ যেন মার্কিন মুল্লুক আর মুশরিক-প্রধান দেশের পত্রিকা। মনে হচ্ছিল, আফগানের এ বিজয়ে তাদের কলিজা ছেচে যাচ্ছে। বিদেশী সংবাদের জন্য তো এদেশের পত্রিকাগুলো পশ্চিমা মিডিয়ার দিকেই তাকিয়ে থাকে। কিন্তু এবার যেন তারা পশ্চিমা মিডিয়ার সামনে সেজদাবনত হয়েছে। উপসম্পাদকীয়, মতামত সব ভরে যায় ইসলাম, আফগান ও মানবতাবিরোধীদের লেখায়। সঙ্গে সেসব একপেশে ইসলামবিরোধী সংবাদ আশ্রয় করে এদেশীয় রঙিন চশমাধারীদের ইসলাম ও মুসলিমবিরোধী লেখা তো ছিলই। এসব লেখার কিছু ছিল সরাসরি দখলদারের পদলেহী, কিছু ছিল ইনিয়ে বিনিয়ে।

এই যে দুই বছর আগের প্রবণতা এখনো রয়ে গেছে। পুরো আফগানিস্তান দেশপ্রেমিক আফগানদের নিয়ন্ত্রণে আসা সত্ত্বেও তারা মানতে পারছে না। শান্তি ও নিরাপত্তাপূর্ণ আফগান সমাজকে পাশ কাটিয়ে অভাব, দারিদ্র্য ও ক্ষুধাকে সামনে আনার চেষ্টা করছে। অথচ তারা আফগান-বিরোধী, ইসলাম-বিরোধীদের রঙিন চশমা ছেড়ে সাদা চোখে আফগান পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করলে খুব সহজেই বাস্তব পরিস্থিতি উপলদ্ধি করতে পারত। কিন্তু তাদের সে সদিচ্ছা থাকতে হবে তো!

তারা কোনো কোনো খেলার আয়োজনে ডজন ডজন ভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে লাইভ হওয়া সত্ত্বেও ক্ষেত্রবিশেষে একাধিক নিজস্ব প্রতিনিধি পাঠায়। সেখানে তারা শতাব্দীর এ শ্রেষ্ঠ ঘটনা অন্যের চোখে দেখেই শান্তি পায়। এ যেন কুরআন কারীমের সে বাণীর প্রতিফলন-

فَاِنَّهَا لَا تَعْمَي الْاَبْصَارُ وَ لٰكِنْ تَعْمَي الْقُلُوْبُ الَّتِيْ فِي الصُّدُوْرِ.

প্রকৃতপক্ষে চোখ অন্ধ হয় না; বরং অন্ধ হয় সেই হৃদয়, যা বক্ষদেশে বিরাজ করে। -সূরা হজ্ব (২২) : ৪৬ 

 

 

advertisement