সফর ১৪৪৫   ||   সেপ্টেম্বর ২০২৩

দ্বীন পালনে সংকোচ : দুঃখজনক বাস্তবতা

মাওলানা মুহাম্মাদ তাওহীদুল ইসলাম তায়্যিব

আল্লাহ তাআলা মানুষকে যত নিআমত দান করেছেন তন্মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ নিআমত হল দ্বীন। আল্লাহকে চিনতে পারা, আল্লাহ সম্পর্কে জানতে পারা, আল্লাহকে মনেপ্রাণে ভালবাসতে পারা, সর্বোপরি আল্লাহ তাআলার পরিচয় লাভ করা এবং হৃদয়-গভীরে তাঁর প্রতি ঈমান ও বিশ্বাস স্থাপন করা, আল্লাহ তাআলার হুকুম আহকাম ও আদেশ নিষেধগুলো জানা এবং সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে তা পালন করা- এই নিআমত যে কত বড়, সেটা বুঝে আসে- জীবন ও জগৎ নিয়ে মানুষ যত বেশি ভাবে এবং ইহকাল ও পরকালের বাস্তবতা মানুষের কাছে যত বেশি স্পষ্ট হয়।

কারও কাছে বিষয়গুলো স্পষ্ট হয় যথাসময়ে, কারও কাছে সময় পেরিয়ে যাওয়ার পর। আবার কেউ পারিবারিকভাবে, পরিবেশগতভাবে, নির্দিষ্ট কোনো ব্যক্তি বা সাথী-সঙ্গীদের মাধ্যমে অথবা ব্যক্তিগত উদ্যোগ ও মেহনতেই দ্বীনী বুঝ লাভ করে এবং তৃপ্তি ও পরিতৃপ্তির সাথে দ্বীনের ওপর চলতে থাকে। নিঃসন্দেহে এটা অনেক বড় সৌভাগ্যের ব্যাপার। সেটা আল্লাহ তাআলার অনেক বড় ইহসান ও দান।

বলার অপেক্ষা রাখে না যে, ইসলাম আল্লাহ তাআলার মনোনীত একমাত্র দ্বীন। হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পর থেকে কিয়ামত পর্যন্ত আগত সকল যুগের, সকল দেশের, সকল শ্রেণি, পেশা, ভাষা, বর্ণ, গোত্র ও স্বভাব-প্রকৃতির মানুষের জন্য অবশ্যপালনীয় দ্বীন ও ধর্ম হল ইসলাম। একথা পরিষ্কারভাবে বিবৃত হয়েছে কুরআন মাজীদে। আল্লাহ তাআলা বলেন-

إِنَّ الدِّينَ عِنْدَ اللهِ الْإِسْلَامُ.

নিশ্চয় আল্লাহ তাআলার নিকট গ্রহণযোগ্য দ্বীন কেবলই ইসলাম। -সূরা আলে ইমরান (৩) : ১৯

অন্যত্র বলেন-

وَمَنْ يَبْتَغِ غَيْرَ الْإِسْلَامِ دِينًا فَلَنْ يُقْبَلَ مِنْهُ وَهُوَ فِي الْآخِرَةِ مِنَ الْخَاسِرِينَ.

যে ব্যক্তি ইসলাম ছাড়া অন্য কোনো দ্বীন অবলম্বন করতে চাইবে, তার থেকে সেই দ্বীন কবুল করা হবে না। আর সে আখেরাতে মহা ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হবে। -সূরা আলে ইমরান (৩) : ৮৫

একথা যৌক্তিক এবং স্বাভাবিক- যে ধর্ম কিয়ামত পর্যন্ত সকল যুগের এবং সকল শ্রেণির মানুষের জন্য অবধারিত, তা কত নিখুঁত ও নিপুণ হওয়া দরকার। কত সংহত ও ব্যাপক হওয়া কাম্য! নিঃসন্দেহে ইসলাম তেমনই নিখুঁত ও নিপুণ। তেমনই সংহত ও ব্যাপক। কারণ যিনি এই পৃথিবীর স্রষ্টা, সুবিশাল আসমান ও যমীনের স্রষ্টা, সকল মানুষের খালিক ও মালিক- এই দ্বীন তাঁর পক্ষ থেকে। আর একমাত্র তাঁর পক্ষেই সম্ভব সবার উপযোগী দ্বীন নাযিল করা। ফলে এই দ্বীন মেনে মানুষ যতটা সুখ ও প্রশান্তির সাথে জীবন যাপন করছে, অন্য কোনোভাবেই তা পারছে না।

এই দ্বীন-ইসলামে মানব জীবনের সকল বিষয়ের সুস্পষ্ট বিবরণ আছে। সঠিক নির্দেশনা আছে। আছে সকল সমস্যার সুষ্ঠু সমাধান। বিখ্যাত সাহাবী হযরত সালমান ফারসী রা.-এর ঘটনাটি এ বিষয়ের উল্লেখযোগ্য একটি উদাহরণ।

একদিন সালমান ফারসী রা.-কে একদল মুশরিক ব্যঙ্গ করে বলেছিল-

لقد عَلَّمَكم نبيُّكم كلَّ شيءٍ حتَّى الخِراءَةَ؟!

তোমাদের নবী তো তোমাদেরকে সবকিছু শিক্ষা দিয়েছে। এমনকি পেশাব- পায়খানা কীভাবে করতে হয় সেগুলোও!!

সাহাবীর উত্তর-

أَجَلْ، لقد نهانا -صلَّى الله عليه وسلم- أن نَستَقبِلَ القِبلَةَ بغائِطٍ أو بَولٍ، وأن لا نَستَنجِيَ باليمين، وأن لا يَستَنجِيَ أحَدُنا بأقَلَّ من ثلاثةِ أحجارِ، أو نَستَنجِيَ برَجيعٍ أو عَظمٍ.

হাঁ, তিনি আমাদেরকে কিবলামুখী হয়ে পেশাব-পায়খানা করতে নিষেধ করেছেন। ডান হাতে ইস্তিঞ্জা (পানি ব্যবহার ও পরিচ্ছন্নতা অর্জন) করতে নিষেধ করেছেন। আরও নিষেধ করেছেন তিন ঢিলার কম ব্যবহার করতে এবং গোবর ও হাড্ডিকে ঢিলা হিসেবে ব্যবহার করতে। -সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ৭; সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস ৩১৬

এখানে হযরত সালমান ফারসী রা.-কে যে বিষয়ে বিদ্রƒপ করা হচ্ছিল, ঠিক সে বিষয়টিকেই তিনি শ্রেষ্ঠত্বের প্রতীক হিসেবে পেশ করলেন। স্পষ্টভাবে বুঝিয়ে দিলেন যে, ছোট থেকে ছোট এবং তুচ্ছ থেকে তুচ্ছ কোনো বিষয়ও যদি মানুষের জীবনসংশ্লিষ্ট হয়- তার সমাধান সরাসরি দ্বীন ও শরীয়তে পাওয়া তো বিরাট সৌভাগ্যের ব্যাপার। কোনো দ্বীন ও শরীয়তের জন্যও এটা গর্ব ও শ্রেষ্ঠত্বের বিষয়।

এই ঘটনায় সকল যুগের মুমিনদের জন্য রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ অনেক শিক্ষা।

কোনো মুমিন-মুসলমান যেন দ্বীনের কোনো বিষয়কে হালকা মনে না করে। দ্বীনের প্রতিটি বিষয়ে যেন কুরআন ও সুন্নাহ অভিমুখী হয়। দ্বীন মানার ক্ষুদ্রতম প্রসঙ্গেও যেন কারও কোনো বিদ্রূপ, তাচ্ছিল্য কিংবা অবজ্ঞার প্রতি ভ্রুক্ষেপ না করে। বরং জীবনের সকল ক্ষেত্রে যেন দ্বীনের শিক্ষাকে গ্রহণ করে এবং সেই শিক্ষা পালনের মধ্যেই যেন সফলতা ও শ্রেষ্ঠত্ব অনুভব করে।

মানব জীবনের নিতান্ত ছোট ও ক্ষুদ্র এবং ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ, দেশ ও বৈশ্বিক পর্যায়ের সবচে বড়, সবচে গুরুত্বপূর্ণ এবং সবচে জটিল বিষয়েও ইসলামের সুষ্পষ্ট, সর্বোৎকৃষ্ট এবং সুউপযোগী শিক্ষা, সমাধান ও বিবরণ রয়েছে। আর এই দ্বীন যেহেতু কিয়ামত পর্যন্ত আগত সকল মানুষের জন্য এবং তা মানব জাতির স্রষ্টার পক্ষ থেকে নির্ধারিত, সুতরাং তাতেই প্রকৃত কল্যাণ, দুনিয়া ও আখেরাতের প্রকৃত সফলতা নিহিত। একথা বিশ্বাসে যেমন বদ্ধমূল হতে হবে, আমল-আচরণেও তার সুস্পষ্ট প্রকাশ হতে হবে। আর এই প্রকাশ হতে হবে সৌভাগ্য ও গর্বের অনুভূতির সাথে।

কিন্তু অত্যন্ত দুঃখের বিষয় হল- অনেক সময় দেখা যায়, তথাকথিত সভ্য সমাজে দ্বীনদারী রক্ষা করে চলা ব্যক্তি ও পরিবার কেমন যেন কোণঠাসা বোধ করেন। নিজেদের চেতনা বিশ্বাস ও কর্মরীতিকে লুকিয়ে পালন করতে চেষ্টা করেন। অথবা কিছুটা সংকোচ নিয়ে পালন করেন। যেন সবার সামনে নিজেদের এই আচার-পদ্ধতি প্রকাশ না পেলেই ভালো। যেন এটা নিজেদের অসম্মান ও নিম্নশ্রেণিতার প্রমাণ। ফলে দ্বীন মানার কোনো প্রসঙ্গ বা ক্ষেত্র প্রকাশ পেয়ে গেলে কেমন যেন অপ্রয়োজনীয় ব্যাখ্যার আশ্রয়ে নিজেদের সীমাবদ্ধতা প্রকাশ করেন। অপারগতা ও দুর্বলতা জাহির করেন। একজন মুমিনের জন্য যা মোটেও শোভনীয় নয়।

উদাহরণস্বরূপ, ঘরোয়া বা সামাজিক কোনো অনুষ্ঠানে দেখা গেল- অনেকে বাম হাতে চা কফি খাচ্ছে। সেখানে দ্বীনদার কেউ ডান হাতে খেতে আগ্রহী হওয়া সত্ত্বেও ইতস্তত বোধ করছে। ডান হাতে খাওয়াটাকে আভিজাত্য পরিপন্থী মনে করছে।

অথবা সেখানে ইসলামী শরীয়তের গুরুত্বপূর্ণ ফরয বিধান পর্দালঙ্ঘন করে নারীদের কেউ কেউ চেহারা খুলে রেখেছে। কিংবা অনৈসলামিক পোশাক পরে আছে। তখন পর্দানশীন কোনো নারী বা তার অভিভাবক সেখানে পর্দা রক্ষা করতে সংকোচ করছেন। কিংবা দ্বীন পালনের কারণে বোরকা পরা বা চেহারা ঢেকে রাখার জন্য নানা অজুহাত পেশ করছেন। নিজেদের অপারগতা প্রকাশ করছেন।

তেমনিভাবে এমন কোনো আত্মীয়ের বাসায় বেড়াতে গিয়েছেন, যারা নিয়মিত নামায পড়ে না। সেখানে নামাযের ওয়াক্ত হয়ে যাওয়ার পরও নামাযের প্রসঙ্গ তুলতে সংকোচবোধ করছেন। নামায পড়তে চাইলে তারা কী ভাববে অথবা নামায পড়তে চাওয়া এখানে ঠিক হবে কি না- এসব ভাবতে ভাবতে নামায কাযা হয়ে যাচ্ছে।

দ্বীন পালনে এমন সংকোচ ও হীনম্মন্যতা অবশ্যই পরিত্যাগ করা উচিত। হৃদয়ে লালন করা উচিত দ্বীন পালনের তীব্র আগ্রহ এবং প্রকৃত সৌভাগ্যের অনুভূতি। বাস্তবেই দ্বীন পালন করা একজন মুমিনের জন্য যেমন জরুরি বিষয় তেমনি আনন্দ, সৌভাগ্য ও গর্বেরও বিষয়।

মুমিনের উচিত এই আনন্দ, সৌভাগ্য ও গর্বকে উপলব্ধি করা। নিজেদের মজবুত অবস্থান থেকে স্বাধীনভাবে বিষয়গুলো আঞ্জাম দেওয়া। এবং সুযোগে সময়ে পশ্চিমা সভ্যতার আত্মীয়- পরিজনদেরকেও বিষয়গুলো জানানো ও বোঝানো। অন্তত নিজের ভেতর যে সৌভাগ্যের অনুভূতি আছে সেটা প্রকাশ করা। হীনম্মন্যতা ও নিজেকে তুচ্ছ জ্ঞান করা কিংবা দ্বীন মানাকে দুর্বলতা ও সীমাবদ্ধতা মনে করা- কোনোভাবেই মুমিনের শান হতে পারে না। মুমিনের ঈমান তো তার শক্তির উৎস। তার সৌভাগ্যের সুউচ্চ মিনার।

সাহাবী হযরত উমর ফারূক রা.-এর সেই উক্তি বারবার স্মরণ করার মতো, যা তিনি হযরত আবু উবাইদা ইবনুল জাররাহ রা.-কে লক্ষ করে বলেছিলেন।

হযরত উমর রা. তখন মুসলিম জাহানের খলীফা। খ্রিস্টানদের সাথে একটি চুক্তি প্রসঙ্গে তিনি শামে যাচ্ছিলেন। পথিমধ্যে একটি জলাভূমি বা অগভীর খাল ছিল। তার ওপারে মুসলিম খ্রিস্টান সবাই তাঁকে সম্ভাষণ জানাতে এসেছে। হযরত উমর খালের সামনে গিয়ে উট থেকে নেমে পড়লেন। পা থেকে চামড়ার মোজা খুলে কাঁধে ঝুলিয়ে নিলেন। এরপর নিজেই উটের লাগাম ধরে পানিতে নেমে গেলেন।

এই দৃশ্য দেখে হযরত আবু উবাইদা ইবনুল জাররাহ রা. বললেন, আমীরুল মুমিনীন! পুরো শহরবাসী আপনার দিকে তাকিয়ে আছে। আপনি নিজ হাতে উটের লাগাম ধরে চলছেন! পায়ের মোজা (সাধারণ মানুষের মতো) কাঁধে ঝুলিয়ে নিয়েছেন!.... আমার কাছে বিষয়টি ভালো লাগছে না।

হযরত উমর রা. তাকে বললেন, থাম আবু উবাইদা! আজ তুমি ছাড়া যদি অন্য কেউ একথা বলত...

এরপর বললেন সেই ঐতিহাসিক বাণী-

إِنَّا كُنَّا أَذَلَّ قَوْمٍ فَأَعَزَّنَا اللهُ بِالْإسْلَامِ فَمَهْمَا نَطْلُبُ الْعِزَّةَ بِغَيْرِ مَا أَعَزَّنَا اللهُ بِهِ أَذَلَّنَا اللهُ.

(শোন!) আমরা ছিলাম অত্যন্ত হীন জাতি। আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে ইসলামের মাধ্যমে সম্মানিত করেছেন। অতএব যার মাধ্যমে আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে সম্মান দান করেছেন তা ছাড়া যখনই অন্য কিছুতে সম্মান তালাশ করব, আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে লাঞ্ছিত করে ছাড়বেন। -মুসতাদরাকে হাকেম, হাদীস ২০৭

কী দৃপ্ত উচ্চারণ! কী আত্মবিশ্বাসী বাণী! নিজ হাতে উটের রশি ধরে চলা আর শুকনো চামড়ার মোজা প্রয়োজনে কাঁধে ঝুলিয়ে নেওয়া- এতে সরলতা আছে, সামাজিকতা আছে, আছে বিনয় ও আত্মবিলোপের গভীর প্রকাশ। তাতে দ্বীন-বিরাধী কিছু তো নেই। অন্যায় নেই। অহংবোধ নেই। অসম্মান নেই। নেই অনভিজাত সংকোচের কোনো কিছু।

চেতনার এই সরল শিক্ষা উম্মতে মুহাম্মাদীর প্রতিটি সদস্য যদি গ্রহণ করতে পারে- এই একটি শিক্ষাই বদলে দিতে পারে জীবনের অসংখ্য এলোমেলো দিক। অসংলগ্ন অসঙ্গত বহু ভাবনা। দৃষ্টি ফিরিয়ে দিতে পারে নিজের দিকে। তুলে ধরতে পারে আপন পরিচয়ের অন্তত একটি ঝলক। 

 

 

advertisement