সফর ১৪৪৫   ||   সেপ্টেম্বর ২০২৩

নতুন পাঠ্যক্রম সংশোধনীতে জাতির প্রত্যাশার প্রতিফলন ঘটছে কি?
খেলাধুলা ও গানবাদ্যই কি নতুন পাঠ্যক্রমের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য!

মাওলানা সায়ীদুল হক

[এবছর নতুন পাঠ্যক্রমের অধীনে প্রথম শ্রেণিতে ৩টি এবং ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণিতে ১২টি করে বই স্কুলের শিক্ষার্থীদের হাতে দেয়া হয়। প্রথম শ্রেণিতে দেয়া হয় বাংলা, অংক ও ইংরেজি বই আর শেষোক্ত দুই শ্রেণিতে উক্ত তিন বিষয়ের সাথে দেয়া হয় বিজ্ঞান, ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান, ডিজিটাল প্রযুক্তি, স্বাস্থ্য সুরক্ষা, জীবন ও জীবিকা, শিল্প ও সংস্কৃতি এবং ধর্ম শিক্ষা বই। এর মধ্যে বিজ্ঞান এবং ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান বিষয়ের রয়েছে দুইটি করে বই- অনুসন্ধানী পাঠ ও অনুশীলন বই। নতুন পাঠ্যক্রমের বই হাতে আসার পর যখন চারদিক থেকে তীব্র সমালোচনা শুরু হয়, সরকার চাপের মুখে ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির একটি করে বইয়ের পাঠদান প্রত্যাহার করে। এনসিটিবি চেয়ারম্যান স্বাক্ষরিত ১০/০২/২০২৩ ঈ. তারিখের এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে শ্রেণিদুটির ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান বিষয়ের শুধু অনুসন্ধানী পাঠের পাঠদান প্রত্যাহারের কথা জানানো হয়। সচেতন মহল মনে করেন, বিষয়টি গরু মেরে জুতো দান’-এর মতো হয়েছে। যেখানে দরকার ছিল দেশ ও  জাতির বৃহত্তর স্বার্থে পাঠ্যবইগুলোর আমূল পরিবর্তন করার, সেখানে মাত্র একটি করে বইয়ের শুধু পাঠদান প্রত্যাহার করা হয়েছে!!

তাছাড়া একই বিষয়ের অনুসন্ধানী পাঠ ও অনুশীলন বই একটি আরেকটির সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। তাই শুধু একটির পাঠদান প্রত্যাহার করা আর অপরটির পাঠদান বহাল রাখা কেমন বাতুলতা- সচেতন জনগণের তা বোধগম্য নয়। পাঠদান প্রত্যাহারকৃত বইগুলো শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে তুলেও নেওয়া হয়নি। অনুশীলন বইগুলোতে জায়গায় জায়গায় অনুসন্ধানী বইয়ের রেফার করা হয়েছে। সপ্তম শ্রেণির ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুশীলন বইয়ের শুধু ২ নং পৃষ্ঠাতেই তিন তিনবার অনুসন্ধানী পাঠ দেখতে বলা হয়েছে। যদিও  এনসিটিবির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, অনুশীলন বইয়ের যে যে স্থানে অনুসন্ধানী পাঠ দেখতে বলা হয়েছে শিক্ষার্থীরা সে সে স্থানে শিক্ষকের সহায়তায়/উপযুক্ত উৎস থেকে তথ্য সংগ্রহ করবে। তবু বইদুটি এখনো তাদের হাতে আছে এবং এ বইদুটো অনুশীলন বইয়ের সাথে ওতপ্রোতভাবে যুক্ত। তাই অনুশীলন বইগুলোর পাঠদান বহাল রাখা আবার সেইসাথে অনুসন্ধানী বইগুলোও ছাত্রদের কাছ থেকে তুলে না নেওয়া  কেমন যেন একটা ধোঁয়াশা তৈরি করেছে।

এরপর গত এপ্রিল মাসের শেষের দিকে  ২৭/০৪/২০২৩ তারিখে শ্রেণিদুটির অন্য বইগুলোর সংশোধনী প্রকাশ করা হয়। সংশোধনী দেখে দেশবাসী হতাশ হয়েছেন, ব্যথিত হয়েছেন। দেশের সচেতন জনগণের অভিযোগ-অনুযোগের প্রতি ভ্রুক্ষেপই করা হয়নি। সমাজ ও দেশের স্বার্থে তারা সরকারের কাছে যে দাবি জানিয়েছেন, তার কোনো তোয়াক্কা করা হয়নি। দায়সারাগোছের কিছু প্রুফ সংশোধনী দিয়েই সবাইকে বুঝ দেয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। ষষ্ঠ শ্রেণির  শিল্প ও সংস্কৃতি বইয়ের চারটি সংশোধনীর চারটিই বানান ভুল সংশোধন। একই শ্রেণির স্বাস্থ্য সুরক্ষা বইয়ে ৩৫টি সংশোধনীর ৩৫টিই প্রুফ সংশোধনী। এ শ্রেণিতে সবচেয়ে বেশি সংশোধনী এসেছে ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুশীলন বইয়ে- মোট ৭২ টি। এর মধ্যে প্রায় ৬০ টির মতো হল প্রুফ সংশোধনী।  এছাড়া কয়েকটি বাক্য বাদ দেয়া হয়েছে আর কয়েকটি বাক্য সম্পাদনা করা হয়েছে। অন্য বইগুলোর অবস্থাও প্রায় একই।

সপ্তম শ্রেণির অবস্থাও এর চেয়ে ভিন্ন নয়। ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুশীলন বইয়ে ৬৩টির মতো সংশোধনী রয়েছে, এর মধ্যে প্রায় ৬০ টিই হল শুধু প্রুফ সংশোধনী। শিল্প ও সংস্কৃতি বইয়ের ১৮টি ও ডিজিটাল প্রযুক্তি বইয়ের ৫টি এবং স্বাস্থ্য সুরক্ষা বইয়ের ২০টি  সংশোধনীর সবগুলোই প্রুফ সংশোধনী। জীবন ও জীবিকা বইয়ের ২৮টির মধ্যে প্রায় সবকটি প্রুফ কারেকশন ধরনের।

উভয় ক্লাসের বইগুলোতে প্রুফ সংশোধনীর বাইরে আর আছে কিছু শব্দ পরিবর্তন, যেমন ট্রান্সজেন্ডারকে থার্ড জেন্ডার’, ‘সুদকে মুনাফাইত্যাদি। ৬ষ্ঠ শ্রেণির ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞানের ১১৪ নং পৃষ্ঠায় বিবর্তনবাদের আলোচনায় শুধু শিরোনাম পরিবর্তন করা হয়েছে- ‘মানুষ কোথা থেকে এলোএর পরিবর্তে করা হয়েছে- ‘প্রাচীন মানুষের ইতিহাস। ষষ্ঠ শ্রেণির ভালুকের গল্পে দাড়ি সংক্রান্ত যে কয়েকটি বাক্য পরিবর্তন করা হয়েছে এনসিটিবির ওয়েবসাইটে ভিডিও ক্লিপে সেগুলোর পক্ষে সাফাই দেয়া আছে। সপ্তম শ্রেণির ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান বইয়ে ১২১ নং পৃষ্ঠায় পূর্বাপর প্রসঙ্গ বাদ না দিয়ে মাঝখান থেকে কিছু কাহিনী বাদ দেয়া হয়েছে।      

মোটকথা, পাঠদান প্রত্যাহার বলুন আর সংশোধনী- সচেতন জনগণের এতে স্বস্তির কিছু নেই। তাদের উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা কমার মতোও কিছু নেই।

যেহেতু নতুন পাঠ্যক্রম আসার পর গণমানুষের দুঃখ ও ক্ষোভ দেখে সরকার এ বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাস দিয়েছিলেন তাই আমরাও আশাবাদী ছিলাম। মনে হয়েছিল, প্রয়োজনীয় সকল সংশোধনী দিয়েই পরবর্তী বই আসবে। কিন্তু যখন গত এপ্রিলের শেষে এনসিটিবি সংশোধনী প্রকাশ করল তখন দেখা গেল, মৌলিক কোনো পরিবর্তন হয়নি। সে কারণে বাধ্য হয়েই বর্তমান শিক্ষাক্রম সম্পর্কে কিছু কথা আরয করছি।]

 

***

গত ২০২২ সালের ৩০ মে শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দুই জাতীয় শিক্ষাক্রমের সমন্বয় কমিটির (এনসিসিসি) যৌথ সভায়  প্রাক-প্রাথমিক থেকে উচ্চমাধ্যমিক স্তরের নতুন শিক্ষাক্রমের আনুষ্ঠানিক অনুমোদন দেয়া হয়। শিক্ষাক্রমের নতুন রূপরেখা ২০২৩ সাল থেকে বিভিন্ন শ্রেণিতে পর্যায়ক্রমে চালু করার সিদ্ধান্ত হয়। সে মতে ২০২৩ সালে প্রথম, দ্বিতীয়, ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণি ২০২৪ সালে তৃতীয়, চতুর্থ, অষ্টম ও নবম শ্রেণি, ২০২৫ সালে পঞ্চম ও দশম শ্রেণিতে এই নতুন রূপরেখা চালু করার কথা হয়। এরপর ২০২৬ ও ২০২৭ সালে দ্বাদশ শ্রেণিতে চালু হবে।

নতুন শিক্ষাক্রমে প্রাক-প্রাথমিক থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত দশ ধরনের শেখার ক্ষেত্র ঠিক করা হয়েছে। এগুলো হল-

১. ভাষা ও যোগাযোগ।

২. গণিত ও যুক্তি।

৩. জীবন ও জীবিকা।

৪. সমাজ ও বিশ্ব নাগরিকত্ব।

৫. পরিবেশ ও জলবায়ু।

৬. বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি।

৭. তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি।

৮. শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য।

৯. সুরক্ষা, মূল্যবোধ ও নৈতিকতা।

১০. শিল্প ও সংস্কৃতি।

২০২৩ সালে তিনটি শ্রেণিতে সম্পূর্ণ নতুন শিক্ষাক্রম চালু করা হয়। প্রথম, ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণিতে। দ্বিতীয় শ্রেণিতে চালুর কথা থাকলেও এবছর তা কার্যকর হয়নি। জানুয়ারি মাসের প্রথম দিনেই নতুন পাঠ্যপুস্তক শিক্ষার্থীদের হাতে আসা শুরু হয়। নতুন শিক্ষাক্রমের পাঠ্যবই শিক্ষার্থীদের হাতে আসার পর দেশের সচেতন মহলে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। বিভিন্ন মহল থেকে নিন্দা, প্রতিবাদ ও সমালোচনার ঝড় ওঠে। যদিও বর্তমান সরকারের আমলে ইতিপূর্বেও সময়ে সময়ে অনেক বিতর্কিত বিষয় পাঠ্যসূচিতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। তারপর তীব্র জনরোষের মুখে কখনো কখনো কিছু বই সংশোধন করা হয়েছে। কিন্তু এবারের বিষয়টি  অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে দেশের সচেতন জনগণকে অনেক বেশি আহত করেছে এবারের পাঠ্যক্রম।

একথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, যে কোনো দেশের শিক্ষাক্রমের পাঠ্যসূচি ওই দেশের জাতীয় চেতনা, ধর্মীয় মূল্যবোধ, দেশপ্রেম ও জাতীয় ঐতিহ্যকে ধারণ করে। যা কোমলমতি শিক্ষার্থীদের পাঠ্যসূচিতে অত্যন্ত গুরুত্ব ও যত্নের সাথে রাখা হয়। যেন তারা দেশের আগামী দিনের সম্পদ হিসেবে গড়ে উঠতে পারে। সেজন্য পাঠ্যপুস্তক প্রণয়নের ভার এমন ব্যক্তিদের কাছেই অর্পণ করা কর্তব্য, যারা দেশের জনগণের  জাতীয় চেতনা-বিশ্বাস, ধর্মীয় মূল্যবোধ এবং জাতীয় ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির নির্ভরযোগ্য ধারক-বাহক ও বিশ্বস্ত মুখপাত্র। বিশেষভাবে যারা দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের বিশ্বাস, মূল্যবোধ ও সংস্কৃতির প্রতি বিশেষ শ্রদ্ধাশীল থাকবে এবং পাঠ্যপুস্তকে তার প্রতিফলন ঘটাবে।

কিন্তু দুর্ভাগ্য যে, সরকারের সংশ্লিষ্ট মহল এক্ষেত্রে যথাযথ দয়িত্বশীলতার পরিচয় দিতে পারেনি। পাঠ্যপুস্তক প্রণয়নের দায়িত্ব এমন কিছু ব্যক্তিবর্গের হাতে দেওয়া হয়েছে, যাদের সাথে এদেশের মাটি ও মানুষের রুচি-প্রকৃতি, আবেগ-অনুভূতি, চিন্তা-চেতনা ও প্রাণ-প্রেরণার কোনো সম্পর্ক  নেই। ফলে আমাদের পাঠ্যপুস্তকে এমন সব বিষয় অন্তর্ভুক্ত হয়েছে, যা কোনোভাবেই আবহমান কাল থেকে চলে আসা এ দেশের গণমানুষের বিশ্বাস, আবেগ, সভ্যতা ও সংস্কৃতির সাথে মানানসই নয়। ফলে তা আমাদের কোমলমতি সন্তানদের জন্য উপযোগী নয়।

এক্ষেত্রে সচেতন মহল থেকে যে বস্তুনিষ্ঠ সমালোচনা করা হয় তাতে অনেক বিষয় উঠে আসে। সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীল ব্যক্তিবর্গ, পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন বোর্ড, বইগুলোর রচয়িতা ও সম্পাদকমণ্ডলী সম্পর্কে সচেতন জনগণের আশংকাই বাস্তব রূপ নেয়। তারা দেখতে পায়, অত্যন্ত চতুরতার সাথেই দেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম, কচিকাচা শিশুদের ধ্বংসের মুখে ঠেলে দেয়া হচ্ছে। মানুষ জানে না- এটি কারও সুনির্দিষ্ট এজেন্ডা কি না। তবে নতুন পাঠ্যবইয়ের পাতায় পাতায় এমন গন্ধই পাওয়া যায়। দেশের জনগণের চিন্তা-চেতনা, তাদের সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধ এবং কোমলমতি শিক্ষার্থীদের নির্মল মন মানস ধ্বংসের এ ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে দলমত নির্বিশেষে সবাই সোচ্চার হয়।

এ বছর নতুন পাঠ্যক্রমের কেবলমাত্র তিন ক্লাসের বই সামনে এসেছে। আগামী বছরগুলোতে পর্যায়ক্রমে অন্যান্য ক্লাসের বইগুলো সামনে আসার কথা। এ বছরের বইগুলো থেকেই স্পষ্ট ধারণা পাওয়া যায় (আল্লাহ না করুন) আগামী বছরগুলোতে কী ধরনের চমক (!) থাকছে।

যাইহোক, এ ধরনের পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন ও অনুমোদনের পেছনে কী ধরনের কার্যকারণ সক্রিয় রয়েছে, আমাদের জাতীয় জীবনে এ পাঠ্যক্রমের কত বড় বিরূপ প্রভাব পড়বে, এ পাঠ্যক্রম কারা কেন আমাদের উপর চাপিয়ে দিচ্ছে- এসব বিষয়ে বিশদ বিবরণ প্রচার করা না হলেও ভেতরে ভেতরে যে গভীর কোনো ষড়যন্ত্র কাজ করছে- তা তো আর অস্পষ্ট নয়। নতুন পাঠ্যক্রমে এ দেশের জনগণ, জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে এমন বিপর্যয়ের মুখে পড়তে যাচ্ছে, যা কাটিয়ে ওঠা বহু যুগেও হয়তো সম্ভব হবে না। এগুলো অত্যন্ত মর্মন্তুদ বিষয়। তবে এ সম্পর্কে এই সংক্ষিপ্ত নিবন্ধে বিশদ আলোচনা করার সুযোগ নেই। অনেকেই জাতির সামনে এগুলোর কিয়দাংশ তুলে ধরেছেন। আমরা শুধু এতটুকু বলতে চাই যে, এই পাঠ্যক্রম এ ভূখণ্ডের ইসলাম ও মুসলমানদের জন্য কত বড় বিপর্যয়করসে দিকে সবার নযর দেয়া দরকার।

শিক্ষা যেহেতু মানুষের জীবনের গতিপথ নির্ধারণ করে, তাই সবকিছু যদি  এভাবে চলতে থাকে এবং একের পর এক শিক্ষানীতি ও শিক্ষাক্রমকে এদেশের জনগণের বিশ্বাস ও সভ্যতার বিপরীতেই পরিচালনা করার এ ধারা অব্যাহত থাকে, তবে এর প্রভাব থেকে আমাদের সমাজ ও জীবন, সভ্যতা-সংস্কৃতি, মন-মানস ও বিবেক-বুদ্ধি- কিছুই নিরাপদ থাকবে না। এর অশুভ প্রতিক্রিয়ায় সুস্থ সুন্দর সামাজিক, নৈতিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধের অধিকারী এ জাতি হৃদয় ও আত্মা, নীতি ও চরিত্র এবং চিন্তা ও বিশ্বাসের ক্ষেত্রে মহাদুর্যোগে পড়ে যাবে। বলা বাহুল্য, বস্তু-সম্পদের ক্ষতির চেয়ে আত্মিক সম্পদের ক্ষতি অনেক বেশি ও বিপর্যয়কর। এই বিপর্যয়ের সত্যি কোনো তুলনা নেই। নতুন পাঠ্যক্রম আমাদের জনগণকে কতটা আত্মিক বিপর্যয়ের মধ্যে ফেলে দেবে- সচেতন নাগরিকগণ ছাড়া হয়তোবা খুব অল্পসংখ্যক মানুষই তার ভয়াবহতা উপলব্ধি করতে পেরেছেন। যদিও মোটাদাগের বিষয়গুলো অনেকের নযরেই এসে গেছে, তাই এ বিষয়টিও বিস্তারিত আলোচনা ও ব্যাপক সচেতনতার দাবি রাখে।

আমাদের এ ভূখণ্ডের প্রায় শতভাগ জনগণ কোনো না কোনো ধর্মাবলম্বী। ২০২২ সালের আদমশুমারী অনুযায়ী ৯১.০৪ ভাগ মুসলমান। ৭.৯৫ ভাগ হিন্দু ধর্মাবলম্বী। এছাড়াও আছে বৌদ্ধ ও খ্রিস্টান ধর্মের অনুসারী। নতুন পাঠ্যক্রম জাতি ধর্ম নির্বিশেষে সবার জন্যই বিপর্যয় ডেকে আনবে। তবে স্বতন্ত্র বোধ, বিশ্বাস, সংস্কৃতি, নীতি ও নৈতিকতা প্রভৃতি দিক থেকে ইসলামী জীবনব্যবস্থাই যেহেতু জাহেলিয়াতের আসল প্রতিদ্বন্দ্বী, তাই খুব স্বাভাবিক কারণেই বিতর্কিত পাঠ্যক্রমে ইসলাম ও মুসলিম উম্মাহকে বেশি টার্গেট করা হয়েছে এবং তাদের উপর দিয়েই বয়ে যাচ্ছে ক্ষতি ও বিপর্যয়ের মূল তাণ্ডব।

বিতর্কিত নতুন পাঠ্যক্রমের প্রাণ ও প্রেরণা

নতুন পাঠ্যক্রমে লেখক ও রচয়িতার ভিন্নতা, বিষয়বস্তু ও আলোচ্যবিষয়ের ভিন্নতা সত্ত্বেও সবগুলো বইয়ে একধরনের একাত্মতা লক্ষ্য করা যায়। এই বইগুলো পড়লে একজন নিরপেক্ষ পাঠকের কাছে মনে হবে, চারটি বিষয়ে বইগুলোতে ফোকাস করার চেষ্টা করা হচ্ছে। যেন এই চার বিষয়ই হল এ বইগুলোর প্রাণ ও প্রেরণা। সে চারটি বিষয় হল :

১. পাশ্চাত্যের বস্তুবাদ ও ধর্মবিমুখতা।

২. ইউরোপীয় লিবারেলিজম।

৩. পৌত্তলিক সংস্কৃতি।

৪. ইসলাম-বিদ্বেষ।

আর সম্ভবত উপরোক্ত উদ্দেশ্যাবলি বাস্তবায়নের জন্যই এ পাঠ্যক্রমের পেছনের কুশলীবরা এমন বেশ কিছু লেখা এবং বিষয়াদিও যোগ করেছেন, যা এদেশের স্কুলগামী কোমলমতি ছাত্র-ছাত্রীদের যৌবন ও চরিত্রের জন্য সর্বনাশী হয়ে ওঠার আশঙ্কা প্রবল। এবং যা এতদঅঞ্চলের হাজার বছর থেকে চলে আসা সভ্যতা-সংস্কৃতির সম্পূর্ণ বিপরীত।

নতুন পাঠ্যক্রম আসার পর সচেতন মহল থেকে জোর প্রতিবাদ ওঠায় সম্প্রতি সংশ্লিষ্ট বোর্ড থেকে নামকাওয়াস্তে কিছু সংশোধনী দেয়া হয়েছে। কিন্তু বাস্তবতা হল, পাঠ্যপুস্তকগুলো যে দুরারোগ্য দোষে দুষ্ট তা চিকিৎসায় সারবার নয় এবং যারা এগুলো রচনা ও সম্পাদনা করেছেন তাদের হাতে এর চেয়ে ভালো কিছু সম্ভবও নয়। কারণ তারা তো একটি বিশেষ চিন্তা ও চেতনা থেকেই ইচ্ছাকৃতভাবেই এমনটি করেছেন। তাই একমাত্র পথ হল সবগুলো বই প্রত্যাহার করা এবং নতুন পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন করা। তা হতে হবে এমন হাতে- দেশ ও জাতির প্রতি যাদের দায়বদ্ধতা আছে, কল্যাণকামিতা আছে, এদেশের মাটি ও মানুষের চিন্তা-চেতনা, বিশ্বাস ও মূল্যবোধের সাথে যাদের একাত্মতা আছে। যাদের প্রতি জাতিরও আস্থা ও নির্ভরতা আছে।

যাইহোক, এ সংখ্যায় আমরা উপরোক্ত চার বিষয়ের কেবল বস্তুবাদ নিয়ে কিঞ্চিৎ আলোকপাত করছি :

পাশ্চাত্যের বস্তুবাদ ও ধর্মবিমুখতা

বিতর্কিত পাঠ্যক্রমের স্বভাব ও বৈশিষ্ট্য এবং প্রাণ ও প্রেরণায় শীর্ষে আছে পাশ্চাত্যের বস্তুবাদ ও ধর্মবিমুখতা। পাশ্চাত্যের বস্তুবাদ ও ধর্মবিমুখতার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে উপাদানকে আমাদের পাঠ্যপুস্তকে সক্রিয়রূপে স্থান দেয়া হয়েছে তা হল, পার্থিব জীবন ও ভোগ বিলাসে অতিআসক্তি। এর অনিবার্য অনুষঙ্গগুলোর মধ্যে রয়েছে, ভাস্কর্য-প্রীতি, নাচ-গান. খেলতামাশা, সিনেমা-চলচ্চিত্রসহ নানা অনাচার ও অশ্লীলতা। তার সাথে নারী-পুরুষের অবাধ মেলামেশা, লজ্জাহীনতা ও ভোগের উন্মত্ততা। একথা তো দিবালোকের ন্যায় স্পষ্ট যে, উক্ত  ভোগবাদী অবাধ জীবনাচার আবহমান কাল থেকে চলে আসা এদেশের গণমানুষের মার্জিত ও শালীন-সুন্দর জীবনধারার সাথে কোনোভাবেই যায় না। এমন জীবন তাদের কাছে চরম নিন্দিত ও ঘৃণিত। তারা তাদের সন্তানদেরকে স্কুলে পাঠান মানুষের মতো মানুষ হওয়ার জন্য। কুপ্রবৃত্তিকে সংশোধন করে নির্মল পবিত্র চরিত্রের অধিকারী হওয়ার জন্য। সুশিক্ষায় আলোকিত হয়ে আলোকিত সমাজ গড়ার জন্য। কিন্তু সচেতন মহল জানেন, আমাদের  পাঠ্যপুস্তকে শিক্ষানুরাগী জনগণের এ আশা-প্রত্যাশা ধূলিসাত করে দেয়া হয়েছে। তাতে তাদের অনেকের জন্যই আদর্শ মানুষ হওয়ার স্বপ্ন দেখা কঠিন হয়ে পড়বে। সচেতন দেশবাসী অত্যন্ত উদ্বেগের সঙ্গে প্রত্যক্ষ করছেন, জ্ঞানী-গুনী ও আদর্শ মানুষ হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে বিদ্যালয়ে আসা ছাত্র-ছাত্রীদেরকে কীভাবে অত্যন্ত কুশলতার সঙ্গে লক্ষ্যভ্রষ্ট করা হচ্ছে। এ বিষয়ে লম্বা আলোচনা করে পাঠ্যপ্স্তুকের কারসাজি বুঝিয়ে বলার কিছু নেই। ক্লাস সিক্স-সেভেনের এক-দুটি বই নাড়াচাড়া করলেই যে কেউ বিষয়টি সচক্ষে দেখতে পাবেন।  তবু কিছু উদাহরণ লক্ষ্য করুন-

ষষ্ঠ শ্রেণির ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুশীলন বইয়ের পৃ. ২ -এ একজন শিক্ষার্থীর আত্মপরিচয়ের কার্ডের নমুনা দেয়া হয়েছে। তাতে আছে- “... আমার ক্রিকেট খেলতে খুব ভালো লাগে। বড় হয়ে আমি ক্রিকেট খেলোয়াড় হতে চাই।

একই বইয়ের  (ষষ্ঠ শ্রেণির ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুশীলন) পৃষ্ঠা ৪-এ রুমার পরিচয়ের ছকে লেখা হয়েছে- “... ব্রাজিল ফুটবল দলের ভক্ত। ফুটবল খেলার ইচ্ছা আছে। সিনেমার করুণ দৃশ্য দেখে কাঁদে। গান গায় ভালো।

একই বইয়ের (ষষ্ঠ শ্রেণির ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুশীলন) পৃ. ২৩-এ আরেকজন শিক্ষার্থীর ব্যক্তিগত পরিচয় দেয়া হয়েছে এভাবে- “সাদিয়া খুব ভালো ক্রিকেট খেলে, ... তার স্বপ্ন সে একদিন বড় ক্রিকেটার হবে।

সপ্তম শ্রেণির স্বাস্থ্য সুরক্ষা বইয়ের পৃ. ১০৬ এ আছে, “রহিম ও করিম একে অপরের ভালো বন্ধু। বিদ্যালয়ের সাংস্কৃতিক দলের সাথে যুক্ত থাকায় রহিম নাচে ও গানে পারদর্শী হয়ে ওঠে। বিদ্যালয়ের সকলের কাছে সে পরিচিত মুখ। রহিম এসব নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। অন্যদিকে করিম এ ধরনের কোনো সাংস্কৃতিক কার্যক্রমে  নিজেকে যুক্ত না করায় সে এসবের থেকে পিছিয়ে পড়ে।...

সপ্তম শ্রেণির ডিজিটাল প্রযুক্তি বইয়ের পৃ. ৩২ -এ আছে, “মিজান একটি বিখ্যাত বাংলা সিনেমা দেখার জন্য একটি ওয়েবসাইটে নিবন্ধন করল। সেখানে নির্দিষ্ট ফি পরিশোধ করে তাদের গ্রাহক হলো।... মিজান এখন খুশিমনে পছন্দের সিনেমা দেখছে।

উক্ত বইয়ের পৃ. ৪৩ -এ বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পদ ব্যবহারের নীতিমালায় উদাহরণে আছে, “ধরি একটি ওয়েবসাইটে নির্দিষ্ট আইডি ও পাসওয়ার্ড দিয়ে লগইন করে বিভিন্ন সিনেমা দেখা যায়।

ক্লাস সিক্সের ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুশীলন বইয়ের ১৫ নং পৃষ্ঠায় প্রত্যেক শিক্ষার্থীর জন্য একটি ব্যক্তিগত পরিচয়ের ছক দেয়া হয়েছে। বইয়ের উদাহরণে শিক্ষিকা খুশি আপার ক্লাসে প্রত্যেক শিক্ষার্থী সে ছক পূরণ করেছে। ছকে প্রিয় বই, প্রিয় শখের পাশাপাশি আছে পছন্দের গান ও প্রিয় চলচ্চিত্রও।

ষষ্ঠ শ্রেণির জীবন ও জীবিকা বইয়ের পৃ. ৭৭ -এ আছে, “উষা চাকমার ভীষণ ফুটবল প্রীতি। টিমে  সে খবু ভালো  খেলে। সে খাবার না খেয়ে একদিন কাটাতে পারে, কিন্তু ফুটবল না খেলে একদিনও থাকতে পারে না। সে সপ্তাহে একদিন দেড় কিলোমিটার পায়ে হেঁটে দূরে শহরের খেলার মাঠে ফুটবল ক্লাবে খেলতে যায়।...

পাঠ্যপুস্তকগুলোতে এ ধরনের উদাহরণ ভুরি ভুরি। এখানে মাত্র কয়েকটি নমুনা দেখানো হল।

প্রিয় পাঠক ও সচেতন অভিভাবকবৃন্দ, নমুনা স্বরূপ পেশ করা উপরের কয়েকটি উদাহরণ থেকে একথা কি সুস্পষ্ট বোঝা যায় না যে, এ ধরনের বিষয়গুলো আমাদের কোমলমতি শিশুদের মূল পড়াশোনা ও নিজেদেরকে ভবিষ্যতের যোগ্য নাগরিক এবং সমাজ ও রাষ্ট্রের পরিচালনা ও ব্যবস্থাপনার দায়িত্বশীল হওয়া থেকে দূরে সরিয়ে দিতে পারে। ষষ্ঠশ্রেণির একটি কোমলমতি শিশুই যদি নিজ থেকে সিনেমা দেখার সব কলা-কৌশল রপ্ত করে তাতে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে, ঐ বয়সেই যদি সে খেলাধুলার প্রতি অতি মনোযোগী হয়ে ওঠে, তাহলে কি তার পড়াশোনায় মন বসবে? সে কি ভবিষ্যতে কোনো বিষয়ে পারদর্শী হয়ে উঠতে পারবে?

প্রশ্ন হচ্ছে, আমাদের শিশুরা কাকে আদর্শ বানাবে? একজন খেলোয়াড়, সিনেমার কোনো লোক বা এসব জগতের অন্য কাউকে, নাকি তার আদর্শ হবে কোনো নিবেদিতপ্রাণ শিক্ষাবিদ, কোনো নিস্বার্থ সমাজ সেবক, কোনো মানব উপকারী রাজনীতিবিদ এবং সর্বোপরি তার স্রষ্টা এবং তাঁর প্রেরিত রাসূলগণ। এটাই মূল ভাবনার জায়গা, যা গভীর উদ্বেগের বিষয় হয়ে উঠেছে- দেশের সচেতন নাগরিকদের জন্য।

আমাদের দেশের শিক্ষার্থীরা আসলেই কি খেলাধুলা ও নাচ-গান-সিনেমায় এত আসক্ত? বিপথগামী মিডিয়ায় খেলাধুলা ও চিত্রজগতের ব্যাপক ফলাও-ফাঁপাও-এর পরও গ্রামের কথা না হয় বাদই দিলাম, শহরের শিক্ষার্থীদের মধ্যেই কয়জন পাওয়া যাবে, যারা এগুলোকে এত ভালবেসে জীবনের লক্ষ্য-উদ্দেশ্যই বানিয়ে নিয়েছে! নাকি আমাদের পাঠ্যপুস্তকেই শিক্ষার্থীদেরকে সেদিকে প্রলুদ্ধ করা হচ্ছে। জ্ঞানী-গুণী মানুষ হওয়ার জন্য বিদ্যালয়ে আসা কোমলমতি শিক্ষার্থীদেরকে তাদের অবচেতনে ভিন্ন পথে ঠেলে দেয়া হচ্ছে। আরও কয়েকটি উদাহরণ দেখুন, ক্লাস সিক্স-সেভেনের কম বয়েসী শিক্ষার্থীদেরকে কীভাবে প্রলুদ্ধ করা হচ্ছে-

ষষ্ঠ শ্রেণির ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুশীলন বইয়ের পৃষ্ঠা ১৫০ -এ সামাজিক কাঠামোর উদাহরণ দিতে গিয়েও খেলার প্রসঙ্গ টেনে এনেছে- “শাপলা বার বছরের একটি মেয়ে। সে মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্রী। সে নিজেকে একজন স্বতন্ত্র বা আলাদা ব্যক্তি হিসেবে বুঝতে শিখেছে। শাপলা স্কুলের ফুটবল দলে যোগ দিয়েছে। কারণ সে খেলাটা উপভোগ করে। এভাবে খেলতে খেলতে তার কিছু বন্ধু তৈরি হয়।...

ষষ্ঠ শ্রেণির শিল্প ও সংস্কৃতি বইয়ের পৃ. ১৯ -এ আছে, “...আমরা কেউ আঁকতে পছন্দ করি, কেউ গাইতে, কেউ নাচতে বা অভিনয় করতে, কেউবা আবার লিখতে পছন্দ করি। কেউ যদি পছন্দের এসব কাজে বাধা দেয় তখন আমাদের খুব খারাপ লাগে।...।

ষষ্ঠ শ্রেণির ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুশীলন বইয়ের পৃষ্ঠা ১০৪ -এ মেয়েদের ফুটবলশিরোনামের আলোচনায়, “...  ক্লাসে এসে খুশি আপা জানতে চাইলেন, তোমরা কি ফুটবল খেলা পছন্দ করো? ... সবাই সমস্বরে বলে উঠল, হ্যাঁ, ফুটবল আমাদের খুব ভালো লাগে। খুশি আপা বললেন, আজ আমরা সবাই ক্লাসে ফুটবল খেলা নিয়ে কথা বলব। সবাই খুশিতে হাততালি দিল। এরপর আপা সবাইকে বাংলাদেশ অনূর্ধ্ব নারী ফুটবল দলের সঙ্গে ভারত দলের ম্যাচ রিপোর্ট পড়তে দিলেন। রিপোর্ট পড়ে সবাই খুব উত্তেজিত হয়ে খুশি আপাকে জানাল, তারা খেলাটা ভিডিওতে দেখতে চায়। ...এরপর তারা সবাই একত্রে তুমুল উত্তেজনার সঙ্গে সাফ অনূর্ধ্ব-১৯ মহিলা চ্যাম্পিয়নশিপ ২০২১ -এর ফাইনালে বাংলাদেশ বনাম ভারতের ম্যাচটি উপভোগ করল।

শিক্ষিকা শ্রেণিকক্ষে শিক্ষার্থীদের নিয়ে খেলা দেখেছে শুধু এতটুকুই নয়, বরং একই বইয়ের  পৃ. ২৪ -এ আছে ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞানের শিক্ষিকা খুশি আপা একদিন তার ক্লাসের সময়ে ফুটবল খেলার আয়োজন করেছে। ক্লাসের ছেলে-মেয়ে সবার সে খেলায় অংশগ্রহণ বাধ্যতামূলক ছিল। দুই দলের দুই অধিনায়ক ছিল নীলা আর গণেশ। রেফারি ছিল খাদিজা।

বাস্তবেই কি আমাদের কোনো শিক্ষক ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞানের ক্লাসটাইমে ফুটবল খেলার বা খেলা দেখার ব্যবস্থা করেন বা করার নিয়ম আছে, নাকি  নতুন করে চাপিয়ে দেয়া পাঠ্যপুস্তকের মাধ্যমে তাদেরকে  সেটি শেখানো হচ্ছে। আসলে বিভিন্ন কৌশলে শিক্ষক ও  শিক্ষার্থীদের মাঝে  খেলা আসক্তি ও গান বাদ্যকে স্বাভাবিক করে তোলা হচ্ছে। ঘুরিয়ে ফিরিয়ে নানা আঙ্গিকে শিক্ষার্থীদের সামনে বিষয়গুলো তুলে ধরা হচ্ছে। সঙ্গে অবচেতনে মেয়ে শিশুদেরকে সামাজিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধের প্রতি অনাস্থাশীল হয়ে ওঠার উৎসাহ দেওয়া হচ্ছে। উপরে উল্লিখিত উদ্ধৃতিটি আবার পড়ুন এবং শেষের আন্ডারলাইন করা অংশ  লক্ষ্য করুন-

ষষ্ঠ শ্রেণির শিল্প ও সংস্কৃতি বইয়ের পৃ. ১৯ -এ আছে, “...আমরা কেউ আঁকতে পছন্দ করি, কেউ গাইতে, কেউ নাচতে বা অভিনয় করতে, কেউবা আবার লিখতে পছন্দ করি। কেউ যদি পছন্দের এসব কাজে বাধা দেয় তখন আমাদের খুব খারাপ লাগে।...।

সপ্তম শ্রেণির বাংলা বইয়ের পৃ. ৬৬ -এ একটি বিজ্ঞাপনের নমুনা দেয়া হয়েছে- “গান শিখাই : রবীন্দ্র সংগীত, নজরুল সংগীত, আধুনিক গান ও লোকগীতি

ষষ্ঠ শ্রেণির জীবন ও জীবিকা বইয়ের পৃ. ৮৫ -এ বিভিন্ন ধরনের কাজ শিরোনামে সৃজনশীল কাজের তালিকায় লেখা হয়েছে- “... গান করা, গান শোনা, নাচ করা, ছবি তোলা, ভিডিও বানানো, ... বাঁশি, হারমোনিয়াম, তবলা, গিটার ইত্যাদি বাজানো।

মনে হচ্ছে, যেহেতু আবহমানকাল থেকে চলে আসা আমাদের সামাজিক মূল্যবোধ, শালীন ও মার্জিত সংস্কৃতি এবং পারিবারিক শিক্ষা ও দীক্ষার কারণে শিক্ষার্থীরা -বিশেষত মুসলিম শিক্ষার্থীরা- স্বাভাবিকভাবেই নাচ-গান-সিনেমা ও অশ্লীলতা থেকে দূরে থাকবে, মেয়ে শিক্ষার্থীরা ক্রিকেট, ফুটবল ও দৌড় প্রতিযোগিতায় যুক্ত হতে চাইবে না- তাই পাঠ্যপুস্তকে বিভিন্ন আঙ্গিকে অত্যন্ত চতুরতার সঙ্গে বিষয়গুলোকে ফোকাস করা হয়েছে। শিক্ষার্থীদের মনমগজে গেঁথে দেয়ার অপচেষ্টা করা হয়েছে এবং বারবারই মেয়েদেরকে ফুটবলের মতো খেলায় পেশাদার হয়ে ওঠায় উদ্বুদ্ধ করছে। কে না জানে, ফুটবল  খেলার পোশাক-আশাক ও ধরন আমাদের সভ্যতা-সংস্কৃতির সাথে কোনোভাবেই মানানসই নয়। 

পূর্বের উদাহরণগুলোতে ক্রিকেট, ফুটবল ও দৌড় প্রতিযোগিতায় মেয়েদের নাম ব্যবহার করা হয়েছে। আর নাচ গান সিনেমায় রহিম, করিম ও মিজানের মতো সম্ভ্রান্ত মুসলিম নাম ব্যবহার করা হয়েছে। আমাদের রুমা-সাদিয়া-খাদিজা-শাপলারা কি সত্যিই ক্রিকেট-ফুটবল ও দৌড় প্রতিযোগিতাকে তাদের মূল পেশা বানাতে মন থেকে আগ্রহী, নাকি তাদেরকে এগুলোর প্রতি উদ্বুদ্ধ করা হচ্ছে! রহিম মিজানরা কি সত্যিই নাচ গান সিনেমা পছন্দ করে, নাকি তাদেরকে এগুলো পছন্দ করার সবক দেয়া হচ্ছে!?

সচেতন পাঠক ভালোভাবেই বুঝতে পারবেন যে, বর্তমান পাঠ্যপুস্তকে শিক্ষার্থীদেরকে এগুলো পছন্দ করার সবক দেয়া হচ্ছে। কখনো তাদেরকে ফুসলানো হয়, কখনো উৎসাহ দেয়া হয়, কখনো তাদের সামনে অন্যদের উদাহরণ ফলাও করা হয়। আরও কিছু নমুনা দেখুন-

সাধারণত আমরা পরিচয় বলতে বুঝি, নাম, ঠিকানা ইত্যাদি। কিন্তু পাঠ্যবইয়ে পরিচয়ের নতুন একটি ধারণা দেয়া হয়েছে। সে অনুযায়ী পরিচয়ের ছকে থাকে- প্রিয় রং, প্রিয় শখ, প্রিয় খেলা, প্রিয় বই, প্রিয় চলচ্চিত্র, পছন্দের গান, যে দক্ষতা সম্পর্কে নিজে গর্বিত ইত্যাদি। এ পরিচয় সম্পর্কে শিক্ষার্থীদেরকে শেখানো হচ্ছে, “আমার ব্যক্তিগত পরিচয়ে যে বিষয়ই থাকুক না কেন, আমি আমার আত্মপরিচয় নিয়ে গর্ব অনুভব করি।”  (ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান, ৬ষ্ঠ, ২৩)

আমি আমার পরিচয় সম্পর্কে যা ভাবি তাই আমার পরিচয় গড়ে তোলার জন্য গুরুত্বপূর্ণ; অন্যরা কী ভাবলো তা নয়।” (ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান, ৬ষ্ঠ, ২২)

আসলেই কি ষষ্ঠ শ্রেণির একটি ছাত্র বা ছাত্রী তার ব্যক্তিগত পরিচয় কী হওয়া উচিত, তার ভবিষ্যত পেশা কী হওয়া উচিত- সেটি উপলদ্ধি করার মতো যোগ্য হয়ে যায়, নাকি সেক্ষেত্রে তার শিক্ষক ও অভিভাবকের পরামর্শ ও সহযোগিতার প্রয়োজন পড়ে। তাহলে আমাদের পাঠ্যপুস্তকে কেন এই শিশুদেরকে একথা বলতে শেখানো হচ্ছে- “আমি আমার পরিচয় সম্পর্কে যা ভাবি, তাই আমার পরিচয় গড়ে তোলার জন্য গুরুত্বপূর্ণ; অন্যরা কী ভাবলো তা নয়।

এ বয়স থেকেই কি তাহলে শিশুদেরকে অবাধ্য হওয়ার সবক দেয়া হচ্ছেপশ্চিমের দেশগুলোতে তো ২১ বছর বয়স হওয়ার পর পর সন্তানাদি পিতামাতা থেকে স্বাধীন ও মুক্ত হয়ে যায়। এদেশের পাঠ্যক্রমের পেছনের কুশলীবরা কি ১২/১৩ বছরের একটি শিশুকেই অবাধ ও অবাধ্য হওয়ার প্রতি উৎসাহিত করছে। 

শিক্ষার্থীদের সামনে ক্রিকেটার, ফুটবলার, নাট্যকার, চিত্রকর, চিত্রশিল্পী ও নৃত্যশিল্পীদের জয়গান গাওয়া হয়েছে। তাদেরকে  দেশের মহান সারথীরূপে পেশ করা হয়েছে। বিশেষ করে মেয়ে খেলোয়াড়দের নিয়ে  বেশি মাতামাতি করা হয়েছে। ষষ্ঠ শ্রেণির বিজ্ঞান অনুসন্ধানী পাঠের ৮ম অধ্যায়ের প্রথম পৃষ্ঠায় পুরা পৃষ্ঠা জুড়ে সানজিদা নামের এক মেয়ে ক্রিকেটারের ব্যাটিং-এর ছবি দেয়া হয়েছে। বিজ্ঞানের বল ও শক্তির আলোচনায়  যেন খেলা ছাড়া আর কোনো উদাহরণ পাওয়া যায় না, নাকি মেয়েদের ফুটবল খেলার প্রসঙ্গ ইচ্ছা করেই বারবার আনা হয়েছে।

ষষ্ঠ শ্রেণির ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুশীলন বইয়ের পৃষ্ঠা ১০০ -এ সামাজিক পরিচয়ের আলোচনায় প্রথম পৃষ্ঠায় বাংলাদেশ জাতীয় দলের ক্রিকেটারদের ছবি দেয়া হয়েছে। পৃষ্ঠা ১০৪ -এর আলোচনার শিরোনাম হল মেয়েদের ফুটবল। পরের পৃষ্ঠায় অনূর্ধ্ব ১৯ জাতীয় নারী ফুটবল দলের মেয়েদের শর্ট প্যান্ট পরা দুটি ছবি দেয়া হয়েছে। তার পরের পৃষ্ঠায় অ-১৯ মহিলা জাতীয় ফুটবল দলের ২৩ জনের ছবিসহ নামঠিকানা দেয়া হয়েছে। এমনিতে তাদেরকে শুধু পাঠ্যপুস্তকের পাতায় ঠাঁই দেয়ার মানেই হল তাদেরকে শিক্ষার্থীদের সামনে মডেল হিসেবে তুলে ধরা। শিক্ষার্থীদেরকে তাদের মতো হতে প্রলুদ্ধ করা।  খেলোয়াড়দের শুধু ছবি দেয়ার দ্বারাই এ কাজ হয়ে যায়, তবুও এতটুকুতেই আমাদের পাঠ্যপুস্তক প্রণেতাদের মন ভরেনি। আরও অনেক অগ্রসর হয়ে খুব ঢাক-ঢোল পিটিয়ে  মেয়ে খেলোয়াড়দের গুণকীর্তন করা হয়েছে। সপ্তম শ্রেণির ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান বইয়ের ১২৩-১২৪ নং পৃষ্ঠার আলোচনার শিরোনাম দেয়া হয়েছে, ‘কলসিন্দুর থেকে হিমালয়েশিরোনামের পরেই আধা পৃষ্ঠা জুড়ে নারী ফুটবল দলের একটি ছবি। ১২৩ ও ১২৪ নং পৃষ্ঠার আলোচনার কিছু অংশ উদ্ধৃত করছি-

সাফ নারী ফুটবল চ্যাম্পিয়নশীপের ২০২২ সালের আসরে স্বাগতিক নেপালকে ৩-০ গোলে হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন হয়েছে বাংলাদেশের মেয়েরা।... এই দলের আটজন খেলোয়াড় এসেছে ময়মনসিংহের কলসিন্দুর নামের এক অখ্যাত গ্রাম থেকে।  ফুটবলকন্যাদের বদৌলতে  কলসিন্দুর এখন সারা দেশের এক পরিচিত নাম। গ্রামীণ বালিকা থেকে সুপারস্টার হয়ে ওঠা এই মেয়েরা নিজেদের অবস্থানের সঙ্গে সঙ্গে বিশ্বপরিমণ্ডলে দেশের অবস্থানকেও নিয়ে গেছে এক অনন্য উচ্চতায়।

কলসিন্দুরের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের যে ছোট্ট মেয়েগুলোর কাছে মেয়েরা ফুটবল খেলে’- এই কথাই ছিল বিস্ময়ের, আজ ফুটবলের পঙ্খিরাজে চড়ে তারা নিজেরাই সবার কাছে বিস্ময়। অখ্যাত গ্রাম কলসিন্দুর থেকে হিমালয়কন্যা নেপালে গিয়ে সাফ জয়, যেমন ছিল পথটা-  ... ২০১১ সালে কলসিন্দুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক মফিজউদ্দিন তার স্কুলের মেয়েদের দিয়ে ফুটবল দল গঠন করেন। তিনি নিজেই ছিলেন প্রশিক্ষক। স্কুলের প্রধান শিক্ষক মিনতি রানী শীল দেখভালের দায়িত্ব নেন।... মফিজউদ্দিন জানান, শুরুটা অনেক চ্যালেঞ্জিং ছিল। গ্রামের অভিভাবকরা রক্ষণশীল। মেয়েদের ফুটবল খেলতে দেওয়ার কথা ভাবতেও পারত না। অভিভাবকদের বুঝিয়ে শুনিয়ে রাজি করাতে অনেক পরিশ্রম করতে হয়েছে তাকে।  এরপর মেয়েদের নিয়ে যখন মাঠে নেমেছেন, অনেকেই ঠাট্টা মশকরা করেছে।

... স্কুলের প্রধান শিক্ষক মিনতি রানী শীল জানান, শুরুতে প্রধান সমস্যা ছিল পোশাক নিয়ে সংকোচ। মেয়েরা প্রথমে সালোয়ার-কামিজ পরে খেলত। লোকলজ্জার ভয় দূর করে খেলার পোশাকে মেয়েদের মাঠে নামাতে অনেক সময় লেগেছে।

শারীরিক ফিটনেস ও মানসিক স্বাস্থ্যের সুস্থতার জন্য খেলাধুলা দরকার তা ঠিক। এবং শিক্ষার্থীদের জন্য সে ব্যবস্থা তো আগে থেকেই চালু আছে। কিন্তু একজন শিক্ষার্থীর জীবনের মূল টার্গেটটা কী হবে? সে কী জন্য লেখাপড়া করবে? খুব স্বাভাবিক কথা যে, সে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করে কোনো একটি বিষয় নিয়ে পড়াশোনা করবে, দক্ষতা অর্জন করবে। দেশ, জাতি ও মানবতার সেবা করবে। গবেষণা করবে, উদ্ভাবন-আবিষ্কার করবে। কেউ আবার রাষ্ট্রীয় কোনো দায়িত্ব পালন করবে। বিভিন্ন পদে নিয়োজিত হবে। এগুলোই তো সকল শিক্ষার্থীর মূল চিন্তা চেতনা হওয়া উচিত এবং তাদের অভিভাবকরাও এটাই চায়। পাশ্চাত্যের পুঁজিবাদী চিন্তাচেতনার কারণে আজকাল ক্রীড়া ও তথাকথিত বিনোদনগুলোকে খুব হাইলাইট করা হচ্ছে। পুঁজিপতিরা তাদের ব্যবসার সুবিধার জন্যই এগুলো করছে।  আর সে ফাঁদেই আটকে ফেলা হচ্ছে আমাদের শিক্ষার্থীদেরকে। পাঠ্যপুস্তকে এ বিষয়গুলোকেই খুব ফলাও করা হচ্ছে। তাহলে একজন শিক্ষার্থী কি ভালো পড়াশুনা করে দেশের, জাতির ও মানবতার সেবক হয়ে উঠবে, নাকি সে তথাকথিত সংস্কৃতিমনা হয়ে নাচ-গান এবং ক্রীড়া- এগুলোর মধ্যে দৌড়ঝাঁপ করবে। কোন্টা করবে? তাহলে শিক্ষার্থীকে কোথা থেকে কোথায় ঠেলে দেয়া হচ্ছেএখানে এটা কথা না যে, শিক্ষার্থীদের মূল্যবোধ নষ্ট করে ফেলা হচ্ছে। শুধু এটা কথা না; বরং অর্থ ও প্রচারের মোহ তাদের মানসে ঢুকিয়ে দিয়ে শুরু থেকেই স্বার্থপর করে তোলা হচ্ছে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের শিক্ষিত শ্রেণিকে।

পাঠ্যবইগুলোর পাতায় পাতায় কিছুক্ষণ পরপর হয় খেলার কথা, না হয় নাচ-গান সিনেমার কথা। সাথে থাকে সংশ্লিষ্ট হরেক রকম ছবি। খেলার ছবি, খেলোয়াড়ের ছবি, নাচ-নৃত্যের ছবি, গায়ক-অভিনেতার ছবি ইত্যাদি। শিল্প ও সংস্কৃতি নামের দুটি বই যেন উৎসর্গই করা হয়েছে শিক্ষার্থীদেরকে নাচ-গান অভিনয় জগতে নেয়ার জন্য। ক্লাস সিক্সের শিল্প ও সংস্কৃতি বইয়ের প্রচ্ছদ পৃষ্ঠাতেই একটি মেয়ের নাচের ছবি আর একটি ছেলের হারমোনিয়াম বাজানোর ছবি। সপ্তম শ্রেণির একই বইয়ের প্রচ্ছদে একজন তবলা বাজাচ্ছে আরেকজন হারমোনিয়াম বাজাচ্ছে। বইদুটিতে নাচের রস মুদ্রা চলন আর সংগীতের তাল মাত্রা লয় ছন্দ- সবই শেখানো হয়েছে।

কোনো জাতির উন্নতি-অগ্রগতি ও সমৃদ্ধির জন্য সুশিক্ষার বিকল্প নেই। জ্ঞান, বিজ্ঞান, গবেষণা ও দেশ জাতির জন্য কঠোর শ্রম সাধনার মাধ্যমে জগতে প্রতিষ্ঠিত হতে হয়। খেল-তামাশা আর নাটক সিনেমার মাধ্যমে কোন্ দেশ কবে প্রতিষ্ঠিত হতে পেরেছে? আধুনিক দেশগুলোর জাগতিক উন্নতির পেছনেও রয়েছে তাদের কঠোর জ্ঞান-সাধনা আর কঠোর অধ্যবসায়।

আচ্ছা আমাদের বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মতো দেশগুলোতে খেলা নিয়ে যত মাতামাতি, জাপান ও আমেরিকার মতো রাষ্ট্রে কি তেমনটি আছে? তাহলে জাতিকে ইচ্ছাকৃত সে মুখী করা হচ্ছে কেন? আমাদের পাঠ্যপুস্তক কেন আমাদেরকে উন্নতি-অগ্রগতির পথ রেখে খেলাধুলা আর চলচ্চিত্রের পথ দেখাচ্ছে? বস্তুত এ কারণেই অভিজ্ঞ মহল এটাকে সুদূরপ্রসারী ষড়যন্ত্র বলে মনে করছেন।

পাঠ্যপুস্তকগুলোতে একদিকে খেলাধুলা ও নাচ গানের প্রতি ছাত্র-ছাত্রীদের প্রবল ঝোঁক তৈরি করার অপচেষ্টা করা হয়েছে, পাশাপাশি স্বভাবজাত সংকোচ ও লজ্জাশীলতা ঝেড়ে ফেলে ছাত্র-ছাত্রীদের ও নারী-পুরুষের অবাধ মেলামেশার পরিবেশ সৃষ্টির জোর চেষ্টা করা হয়েছে।

বয়োসন্ধিকালীন শারীরিক ও মানসিক পরিবর্তন এবং স্বাস্থ্য-পরিচর্যা ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা বিষয়ে শিক্ষার্থীদের জ্ঞান থাকা জরুরি- এতে তো কারও দ্বিমত নেই। পাঠ্যপুস্তকে এ বিষয়ে জরুরি আলোচনা থাকাতে দোষের কিছু নেই। তবে বিষয়গুলো যেহেতু অতি সংবেদনশীল তাই অত্যন্ত বিচক্ষণতার সাথে শালীন ও মার্জিতভাবে তা উপস্থাপন করা উচিত। যেন তা লজ্জাহীনতার দিকে না চলে যায়। কিন্তু বর্তমান পাঠ্যপুস্তকে বিষয়গুলো যেভাবে পেশ করা হয়েছে, তা পড়ে যে কোনো পাঠকের কাছেই মনে হবে, শিক্ষার্থীদেরকে স্বাস্থ্য-সচেতন করার চেয়ে ভিন্ন কিছুই যেন এগুলোর মূল প্রতিপাদ্য। সহশিক্ষার ক্লাসে বয়োসন্ধিকালীন পরিবর্তন নিয়ে আলোচনা অত্যন্ত খোলাখুলিভাবে করা হয়েছে। ষষ্ঠ শ্রেণির বিজ্ঞান অনুসন্ধানী পাঠের বয়োসন্ধি শিরোনামের চার পৃষ্ঠাব্যাপী (১১৯-১২২ পৃ.) আলোচনা বেশ স্পর্শকাতর। এদেশের সভ্য সমাজের কাছে তা কোনোক্রমেই মানানসই মনে হবে না। ষষ্ঠ শ্রেণির স্বাস্থ্যসুরক্ষা বইয়ের বয়ঃসন্ধির আলোচনায় শিক্ষার্থীদের জন্য ছক এঁকে কিছু প্রশ্ন দেয়া হয়েছে। উত্তর লিখে খালি ছক পূরণ করতে বলা হয়েছে। প্রশ্নগুলোর মধ্যে আছে- বয়ঃসন্ধিকালীন পরিবর্তন সম্পর্কে আমি কী জানি? আমার শরীরে কী ধরনের পরিবর্তন লক্ষ করছি? একই প্রশ্ন বিজ্ঞান বইতেও রয়েছে। এ ধরনের প্রশ্নের কী উদ্দেশ্য- পাঠকবর্গই হয়তো ভালো বুঝতে পারবেন।

যুগ যুগ থেকেই এ ধরনের বিষয়গুলো  ছেলে-মেয়েরা তাদের দাদা-দাদী, নানা-নানী, ভাবি এবং ক্ষেত্রবিশেষে মা-সহ এ ধরনের দূরের-কাছের আত্মীয়, যাদের সাথে খোলামেলা কথা বলা যায়, তাদের সাথে আলোচনা করে সমাধান পেয়ে আসছে। এখন পশ্চিমের অনুকরণে কচি-কাঁচা ছাত্র-ছাত্রীদের পাঠ্যপুস্তকেই এসব বিষয় খোলামেলাভাবে  পেশ করা হচ্ছে। যা পড়া হয়ে থাকে উঠতি বয়সী ছাত্র-ছাত্রীদের যৌথ ক্লাসে, নিজের শিক্ষক-শিক্ষিকার সামনে। এসব দেখে অনেকেই আঁতকে উঠছেন। এমনেই তো সামান্য প্রচার হওয়া সংবাদগুলোতে ছাত্র-শিক্ষিকা, শিক্ষক-ছাত্রী- এ ধরনের অবৈধ সম্পর্কের কম কথা শোনা যায় না; এর পরও এ পরিস্থিতি কোথায় নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা চলছে। কদিন পর আবার ঐসকল দেশের মতো এ ধরনের বিষয়ের ভিডিও এবং বিবাহ-বহির্ভূত সম্পর্কে জড়ানোর তথাকথিত নিরাপদ পদ্ধতিও সিলেবাসে অন্তর্ভুক্ত করার পাঁয়তারা করা হয় কি না- কে বলবে।

দুই ক্লাসের পাঠ্যপুস্তকে শত শত ছবি আছে। এর মধ্যে বেশ কিছু আছে নাচ-নৃত্যের ছবি। অনেকগুলো আছে শ্রেণির শিক্ষার্থীদের যৌথ কাজের ছবি। প্রায় ছবিতেই ছেলের সাথে মেয়েকে দিয়ে জোড়া মেলানো হয়েছে। পাঠ্যবইয়ের পাতা উল্টালে যে কেউ তা সচক্ষে দেখতে পারবেন। সিক্সের স্বাস্থ্য সুরক্ষা বইয়ের তৃতীয় অধ্যায় হল- চলো বন্ধু হই। শিরোনামের সাথে একটি ছেলে ও তার মেয়ে বন্ধুর সাইকেল চালানোর ছবি। মেয়ে বন্ধুর সাথে বেড়ানোর আরও ছবি আছে বইগুলোতে।

ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির স্বাস্থ্য সুরক্ষা বইদুটিতে এভাবে জোড়ায় জোড়ায় বন্ধু বানানোর সবক দেয়া হয়েছে এবং বন্ধু সৃষ্টি ও বন্ধুত্ব ধরে রাখার বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ উতরানোর দিকনির্দেশনা দেয়া হয়েছে।

সপ্তম শ্রেণির স্বাস্থ্য সুরক্ষা বইয়ের চতুর্থ অধ্যায়ের শিরোনাম কৈশোরের আনন্দযাত্রা। কৈশোরে আনন্দের অভিজ্ঞতাকে বাড়িয়ে তোলা আর চ্যালেঞ্জগুলোকে মোকাবেলা করার বিভিন্ন কৌশল শেখানো হয়েছে এখানে। এ অধ্যায়ে কৈশোর অভিজ্ঞতা বিষয়ে দুটি পাতানো গল্প উপস্থাপন করা হয়। ২য় গল্পটি হল-

অন্তরা ও ফাহিম উভয়েই সপ্তম শ্রেণির শিক্ষার্থী। তাদের বাড়ি একই গ্রামে, কিন্তু তারা দুজন ভিন্ন স্কুলে পড়ে। নিজ নিজ শ্রেণিতে তারা দুজনেই প্রথম। ওরা অত্যন্ত মেধাবী, বিনয়ী ও নম্র। ওদের সবাই খুব ভালোবাসে ও স্নেহ করে। প্রতিদিন স্কুলে যাতায়াতের পথে তাদের দেখা হয়, মাঝে মাঝে কথা হয়। এভাবেই তাদের বন্ধুত্বের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। একদিন অন্তরার এক আত্মীয় তাদের কথা বলার সময় দেখে ফেলেন। তিনি অন্তরার বাবাকে বিষয়টি জানান। ফলে বাবা-মা অন্তরার উপর রেগে ওঠেন। তারা বকাঝকা, মারধর এমনকি অন্তরার স্কুল যাওয়া বন্ধ করে দেন। তারা বললেন, এবার বিয়ে দিয়ে দেবেন। অথচ অন্তরা এই আত্মীয়ের দ্বারাই মাঝে মাঝে আপত্তিকর আচরণের শিকার হয়; কিন্তু ভয়ে তার মা-বাবাকে কিছু বলতে পারেনি।

ওদিকে ফাহিমের বাবাকেও বিষয়টি জানানো হল। ওর মা-বাবাও কোনো কথা না শুনে একতরফা ওকে বকাঝকা ও মারধর করলেন। ওর নিজেকে অসহায় লাগল। ওর এক ফুফাতো ভাইয়ের কথা মনে হল, যে এমনই একটি ঘটনায় আবেগপ্রবণ হয়ে অসৎ বন্ধুদের সাথে মেলামেশা শুরু করে; নানা ধরনের ক্ষতিকর কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ে। একপর্যায়ে ধূমপানে আসক্ত হয়ে পড়ে।

পাঠক লক্ষ্য করেছেন, ফাহিম ও অন্তরাকে নিয়ে পাতানো গল্পে কত কৌশলে তাদের সম্পর্ককে বৈধতা  দেয়ার চেষ্টা করা হয়েছে; বরং তা উৎসাহিত করা হয়েছে। গল্পটিতে আর কী কী আছে একটু দেখে নেয়া যাক-

ক. ছেলে মেয়ের অবাধ বন্ধুত্বে যারা আপত্তি করবে, তাদের আপত্তিকে অপরাধ সাব্যস্ত করা হয়েছে। হোক না সে সন্তানের বাবা অথবা মা।

খ. ছেলে-মেয়ের অবাধ বন্ধুত্বের সুযোগ না দেয়াকে পড়ালেখার অগ্রগতির পথে বাধা সাব্যস্ত করা হয়েছে।

গ. এমন বন্ধুত্বকে ভালো মেধাবী বিনয়ী শিক্ষার্থীদের বৈশিষ্ট্য বলা হয়েছে।

ঘ. গল্পের শেষে দেখানো হয়েছে- এ ধরনের সম্পর্ক বাধাগ্রস্ত হলে নানা অন্যায় কাজে জড়িয়ে যাওয়ার আশঙ্কা আছে।

এখানে বিষয় শুধু এটা না যে, পাঠ্যপুস্তকগুলোর এ ধরনের আলোচনায় শিক্ষার্থীদের চরিত্র ও নৈতিকতা হুমকির মুখে পড়ছে; বরং তাদের জীবন নষ্ট করে দেয়া হচ্ছে। তাদের ক্যারিয়ার ধ্বংস করে দেয়া হচ্ছে। ছাত্রাবস্থায়ই যদি তাদের মাঝে প্রেমের সম্পর্ক উসকে দেয়া হয়, তাহলে তাদের পড়াশুনার কী হবে? তাদের ভবিষ্যৎ কী হবে?

একদিকে ছাত্র-ছাত্রীদেরকে জোড়ায় জোড়ায় বন্ধুত্বে ফুসলানো হচ্ছে। অপরদিকে তাদেরকে খোলাখুলি প্রজননস্বাস্থ্যের খুটিনাটিও সহশিক্ষার শ্রেণিকক্ষে শেখানো হচ্ছে। ক্লাস সেভেনের স্বাস্থ্য সুরক্ষা বইয়ের ৫৬ নং পৃষ্ঠায় যৌন হয়রানি ও নিপীড়নের বিভিন্ন রূপও তাদেরকে জানানো হয়েছে- এর পরিণতি কী হতে পারে- সচেতন ব্যক্তিমাত্রই তা আঁচ করতে পারেন। এসবের মাধ্যমে পাশ্চাত্যের তথাকথিত লিভ টুগেদার-এর পথই খোলা হচ্ছে বলে মনে করছেন অনেকে।

বিতর্কিত পাঠ্যপুস্তকে শিক্ষার্থীদেরকে তথাকথিত বিনোদনমূলক যে জীবনধারার সবক দেয়া হয়েছে, তার কিছু নমুনা সচেতন পাঠক ও  অভিভাবকবৃন্দের সামনে পেশ করা হল। এটা তো জানা কথা যেএ জীবনধারা আমাদের হাজার বছরের সভ্যতা-সংস্কৃতি এবং এদেশের জনগণের বিশ্বাস ও রুচি-প্রকৃতির সাথে কোনোভাবেই মানানসই নয়। আমাদের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক মূল্যবোধের বিচারে তা অত্যন্ত ঘৃণিত ও নিকৃষ্ট আর ধর্মীয় বিচারেও তা চরম গর্হিত ও পরিত্যাজ্য। এ জাতির দুর্ভাগ্য যে, দেশের ধর্মানুরাগী বিশাল জনগোষ্ঠীর মাঝে বস্তুবাদী জীবনধারা চালু করে তাদেরকে এমন ভয়াবহ বিপর্যয়ের মুখে ঠেলে দেয়া হচ্ছে, যে বিপর্যয়ে পাশ্চাত্যের সমাজব্যবস্থা পর্যদুস্ত হয়ে আছে। 

 

 

advertisement