ভিউ : প্রচারের দুষ্ট স্রোত
প্রচার-সম্প্রচারের সঙ্গে অন্তর্জাল প্রযুক্তি যোগ হওয়ার পর সব প্রচার উপাদানের ওজন ঠিক করে দিচ্ছে ‘ভিউ’-সংখ্যা। কে কতবার দেখল, কতজন মানুষের দৃষ্টি কেড়ে নিল- এর ওপর ভিত্তি করেই একটি পাঠ কিংবা দর্শন-উপাদানের গ্রহণযোগ্যতা সাব্যস্ত হচ্ছে। এভাবে প্রবণতা কিংবা ঝোঁক বদলে যাচ্ছে প্রচারকর্মীদের এবং একইসঙ্গে পাঠক-দর্শকদেরও। বদল ঘটছে ডিজিটাল প্রচার-দুনিয়ার এই নির্ণায়কের চক্করে ভালোমন্দ, পছন্দ-অপছন্দের ছায়া-সংজ্ঞাও।
গণমাধ্যম, সংবাদমাধ্যম ও সামাজিক মাধ্যমের এই রেটিং-পারদ অদ্ভুত এবং দায়িত্বহীন কিছু প্রবণতার জন্ম দিয়েছে প্রচার-প্রচারণার দুনিয়ায়। তৈরি করেছে নতুন একটি উন্মাদনা। যে কোনো মূল্যে ‘ভিউ’ বাড়াতে হবে। দর্শক-পাঠকের ভিউ-‘ঢুঁ’ দেওয়ার সংখ্যা ও মাত্রা বেড়ে গেলে প্রচারযন্ত্র ও কৌশলের বিস্তার বাড়বে, গ্রহণযোগ্যতা বাড়বে। এতে আরও পাঠক-দর্শক বাড়ার দৌড় শুরু হবে। নতুন দর্শক-পাঠক ওই উপাদানে লাখো-কোটি দর্শকের ঢুঁ দেওয়া দেখে নিজেও উঁকি দেবে।
ভিউ-সংখ্যার আধিক্য থেকে ভিউ বৃদ্ধির নতুন চক্কর তৈরি হয়! আর এ দৌড় ও চক্করেই গৌণ হয়ে যাবে এবং যাচ্ছে প্রচারিত বিষয়ের মান ও নৈতিকতায় উত্তরণের প্রশ্নটি। কিছু ব্যতিক্রম বাদ দিলে সমাজে ও দুনিয়ার অনৈতিক, চপল, হালকা ও সস্তা জিনিসের প্রচার ও গ্রহণের ঝোঁক বেড়ে যাচ্ছে। গ্রহণ করার চোখ ও মস্তিষ্কের, বোধ ও হৃদয়ের এ এক নতুন বিকারচক্র সামনে এসেছে। সুস্থতা ও নৈতিকতার দাবি হল, অনৈতিক, মানহীন ও জীবন-পরিশীলনের অনুপযোগী ভিউ-উল্লম্ফনের এই জটিলতা থেকে বের হয়ে আসা। প্রক্রিয়া ও নিয়মের কোনো কাঠামো প্রস্তুত না হলে নিজ উদ্যোগে এই অন্ধকার পাঁক থেকে বের হয়ে আসা, মুক্ত থাকা।
ডিজিটাল প্রচার-ব্যবস্থাপনার বিভিন্ন কন্টেন্ট (টেক্সট, অডিও, ভিডিও) মান, শুদ্ধতা ও জীবনের প্রয়োজনীয়তার আঙ্গিক থেকে গ্রহণ করা। প্রচারের দুষ্ট স্রোত যেন আমাকে গ্রাস করে নিতে না পারে, দখল করে নিতে না পারে আমার সময়, নেকি, রুচি ও ভালোমন্দ বিবেচনার সুস্থ জমিন। একটি মনস্তাত্ত্বিক ফাঁদ এভাবেও তৈরি হয় যে, ভিউ বেশি মানেই জনপ্রিয়তা, জনপ্রিয়তা মানেই ভালো। আর জনপ্রিয় ভালো উপাদান তো আমারও জানা থাকা দরকার। প্রচার ও গ্রহণের এই চাপিয়ে দেওয়া বাজারটিই মূলত দ্বীনী মূল্যবোধ বিনাশে বড় রকম ভূমিকা রাখে। ডিজিটাল ডিভাইসের রমরমা দুনিয়ায় বাছাইপ্রবণ ও সংযমশীল না হলে দুষ্ট স্রোত থেকে রক্ষা পাওয়া কঠিন।
ভিউ মানে দেখা, অন্তর্জাল-ভিত্তিক কন্টেন্ট কোনটা কতবার দেখা কিংবা পড়া হল- সেই সংখ্যা বোঝাতেই ‘ভিউ’ নামক এই নতুন পরিভাষা। এই পরিভাষা ও প্রক্রিয়াটি সম্প্রতি প্রলোভনের একটি টোপের পর্যায়ে চলে গেছে। প্রযুক্তি, প্রবৃত্তি ও প্রবণতার সম্মিলিত হাত ধরাধরিতে গড়ে উঠেছে নতুন অপরুচি-সংস্কৃতি। ভালো, প্রয়োজনীয় ও রুচিস্নিগ্ধ উপাদানের পরিবর্তে প্রথম সুযোগেই বেশি সংখ্যক দর্শক-পাঠক শিকারের আগ্রহ ও কৌশল থেকেই মুগ্ধকর কিংবা প্রলুব্ধকর পরিবেশনা যুক্ত করা হয়। এরপর অল্প সময়েই রুচিহীন ভুল বিষয়ের পেছনে অনেকসংখ্যক ভুল আগ্রহের সংযুক্তি ঘটে। তারপর শুরু হয় অনুকরণ-প্রবণ কৌতূহলের পথচলা। এভাবেই বর্জ্যের মতো উপাদানটিও কোটি চোখের টার্গেটে পরিণত হয় এবং হতেই থাকে।
বেশি ভিউ পাওয়া সব উপাদানই যে মন্দ, ব্যাপারটি এমন নয়। অনেক স্বাস্থ্যকর, নৈতিকতাদীপ্ত, উন্নত রুচির বিষয় উপাত্তও কখনো কখনো দীর্ঘ সময় নিয়ে প্রচুর ভিউ-যুক্ত কন্টেন্টে পরিণত হয়। কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ভিউ-শিকার প্রবণতার তাড়নাই থাকে নেতিবাচক চটুল বিষয় দিয়ে বহুসংখ্যক চোখের দৃষ্টি টেনে নেওয়া। ভিউ-প্রবণতার প্রধান মন্দ দিক এটিই। কারণ এতে ধীরে ধীরে অনলাইন জগতে, সামাজিক মাধ্যমে নেতিবাচক উপাদানের বিস্তার বেড়ে যায় এবং মানুষের সুস্থ রুচি ও আগ্রহের জায়গা বদলে যায়। বদলে যায় প্রচার ও গ্রহণের মাপকাঠি ও মানদণ্ড। লোপ পেয়ে যায় অথবা ক্ষীণ হয়ে যায় ভালোমন্দ বিবেচনার স্বাস্থ্যসম্মত আগ্রহ। প্রবণতার নতুন নেতিবাচক সংস্কৃতির সয়লাব এভাবেই বাড়ছে।
প্রচারের এই অন্ধকার জটিলতা থেকে বাঁচতে নিজের ভেতরের ভালো-সন্ধানী চোখ ও বোধকে শাণিত করতে হবে। সময়, শ্লীলতা ও সুস্থ রুচির পরিচর্যার স্বার্থে অন্তর্জাল দুনিয়ার নাফরমানি ও দুষ্টতা থেকে সরিয়ে রাখতে হবে নিজের গ্রহণের চোখ ও মাথাকে। ভালোকে গ্রহণ করতে হবে। মন্দকে এড়িয়ে যেতে হবে এবং আমার ঘর-অঙ্গন ও চারপাশের পরিবেশকেও ভালোমন্দ বেছে চলতে অনুপ্রাণিত করার পথে চলতে হবে। অধিক প্রচার-অধিক সংখ্যা নয়, ভালোর সঙ্গে থাকতে হবে। মন্দ আর ভালো কখনো এক হতে পারে না। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন-
قُلْ لَّا يَسْتَوِي الْخَبِيْثُ وَ الطَّيِّبُ وَ لَوْ اَعْجَبَكَ كَثْرَةُ الْخَبِيْثِ فَاتَّقُوا اللهَ يٰۤاُولِي الْاَلْبَابِ لَعَلَّكُمْ تُفْلِحُوْنَ.
বল, মন্দ ও ভালো এক নয়; যদিও মন্দের আধিক্য তোমাকে চমৎকৃত করে। সুতরাং হে বোধশক্তিসম্পন্নেরা! আল্লাহকে ভয় কর-যাতে তোমরা সফলকাম হতে পার। -সূরা মায়িদাহ (০৫) : ১০০
আনুষ্ঠানিক-অনানুষ্ঠানিক সবরকম প্রচারযন্ত্রের নেতিবাচক ‘ভিউ’ বা দেখা-সংখ্যার আধিক্যের প্রভাব-প্রাবল্য বিদ্যমান। এক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত ও আনুষ্ঠানিক গণমাধ্যম এবং সব গণমাধ্যমের ডিজিটাল শাখায় সতর্কতা-সংযমের দাবিটিও অনেক বেশি গুরুত্বের দাবি রাখে। শুধু বেশি চোখের বেশি মাথার ‘খোরাক’ দেওয়ার জন্য দূষিত ও স্খলিত উপদান তারা ছড়িয়ে দিতে পারেন না। দ্বীন-ঈমান, সুচিন্তা ও শালীনতা, সুস্থতার সবকটি মানদণ্ড সামনে রেখেই তাদের প্রচার-পদক্ষেপ সাজানো উচিত। ‘ভিউ’ প্রতিযোগিতায় তারা নেমে গেলে এবং নেমে সেই দূষিত নর্দমায় পড়ে থাকলে একটি প্রজন্মের বোধ ও জীবনযাত্রায় অসুস্থতার মহামারি শুরু হয়ে যায়। এই সত্যটা তাদের বোঝা দরকার।